(১)
একজন অভিজিৎ রায়কে শারীরিকভাবে হত্যা করা যায়। অভিজিৎ বা অন্য কোন লেখকই সাধারণত সাথে বন্দুক বা বন্ধুকবাহী গার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। ব্যতিক্রম আছে, কোন কোন লেখকের সাথে বন্দুকধারী দেহরক্ষী মোতায়েন করতে হয়। সালমান রুশদির কথা ধরেন, অথবা তসলিমা নাসরিন। তস্করদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ওদেরকে জন্যে রক্ষীর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে বৈকি। কিন্তু লেখকেরা তো এইরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা, বন্দুক, পাহারাদার এইসব পছন্দ করেন না। ওরা মানুষের সাথে মিশতে চান, মানুষের সাথে কথা বলতে চান, মানুষকে ওদের কথা শুনাতে চান।
একজন লেখককে হত্যা করা খুবই সহজ। হুমায়ুন আহমেদ হেঁটে হেঁটেই বইমেলা থেকে ফিরতেন। আগামীর স্টলে বসতেন কিছু সময়, ঘুরতেন, আড্ডা দিতেন। সন্ধ্যার পরপর হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরতেন। তাঁকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা খুবই সহজ। ওরা করেছেও তাই। হুমায়ুন আজাদকে হামলা করেছে। গুরুতর আহত হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। তসলিমা নাসরিনকে ধাওয়া করেছে এই বইমেলাতেই। পরে তাঁর বিরুদ্ধে বইছিল করেছে। তাঁকে হত্যার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করেছে। নিজের মাতৃভূমিতে থাকতে পারেননি তিনি। আর অভিজিতকে তো হত্যাই করেছে।
অভিজিৎ হুমায়ুন আজাদ তসলিমা নাসরিন এরা তো হচ্ছেন বিশ্বজুড়ে সেইসব অসংখ্য মনিষীদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র যাদেরকে ওদের সময় ওদের সমাজ কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছে। গ্যালিলিও বা ব্রুনোর সাথে আমাদের এইসব লেখকদের সম্পর্ক কি বা এদের সকলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কি? ওদের একেকজনের চিন্তার ও লেখার বিষয়বস্তু আলাদা, স্বতন্ত্র ওদের চিন্তা ও চিন্তার ক্ষেত্র। হয়তো ওরা একে অপরের চিন্তার সাথে একমতও হবেন না কোন কোন ক্ষেত্রে। কিন্তু একটা জায়গায় এরা সকলেই একমত এবং ঐক্যমত্য পোষণ করবেন- মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা অন্যায়।
(২)
এইটাই হচ্ছে সংগ্রামের মুল প্রতিপাদ্য। মুল সুর, মুল বিষয়বস্তু। মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না। মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা অন্যায়। মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হচ্ছে সভ্যতার বিকাশের পথে প্রতিবন্ধিকতা সৃষ্টি করা। মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা মানে হচ্ছে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা। একটি দেশকে বা সমাজকে যদি আপনি অন্ধকারের রাখতে চান তাইলে আপনি মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করবেন। কেননা ভিন্নমত এবং কেবল ভিন্নমতই মানুষের চিন্তাকে অগ্রসর করে নিয়ে যায়, মানুষের জ্ঞানের বিকাশ করে, মানুষের দৃষ্টি উম্মচিত করে দেয়। এবং কেবল ভিন্নমত করার ক্ষমতাই মানুষকে অন্য প্রাণীর চেয়ে উন্নত করে।
এইজন্যে আমরা বলি যারা ভিন্নমতকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে ওরা কাপুরুষ। বেওকুফ হলে আপনি বলবেন যে, আরে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ক্ষত বখত করে হত্যা করে ফেললো, আর আপনি ঘাতককে বলেন কাপুরুষ! হ্যাঁ, ওরা কাপুরুষ, ওরা মূর্খ এবং ওরা ক্রিমিকিতের চেয়েও নোংরা। কেন? কিভাবে? কারণ ওদের সাহস নেই প্রশ্ন শুনার বা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। ওদের সাহস নেই ওদের হেফজ করা বাণীসমূহকে বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা দিয়ে রক্ষা করার। সত্যের রূপ দেখার শক্তি ওদের নেই, প্রচলিত প্রথা বিশ্বাসকে প্রশ্ন করার সাহস ওদের নেই। সত্যকে মোকাবেলা করার বা সত্যকে আবাহন করার প্রতিবরতে ওরা বেছে নেয় হত্যা।
হত্যা করা তো সহজ। মানবদেহ নশ্বর। আপনি আঘাত করলে শরীরের পতন হয়। মানুষকে আঘাত করা সহজ। এটা কোন বীরের কাজ নয়। সাহস যদি থাকে শক্তি যদি থাকে তাইলে প্রশ্ন করবেন। সবচেয়ে মান্য যে বাণী, সবচেয়ে পূজ্য যে প্রথা, সবচে পবিত্র যে প্রতিষ্ঠান সেগুলিকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সবচেয়ে সাহসের কাজ। কাপুরুষ বেওকুফরা কি করে? ওরা ঘুণে ধরা শতাব্দী প্রাচীন কেতাব খুলে পাতা উল্টে আপনাকে বলবে, কই, না তো, সূর্য তো স্থির, সূর্য কখনো ঘুরে না। কিন্তু চোখ খুলে গ্যালিলিওর যন্ত্রে একবার তাকিয়ে দেখবে না কি দেখতে পায়। যদি বলেন, ওরে তোদের কেতাবে তো ভুল আছে, আপনার কল্লা ফেলে দিবে।
(৩)
মুশকিল হয়েছে কি জানেন? আমাদের চারপাশে অন্ধকার বড়ই প্রবল। আমরা এখন যেন ধীরে ধীরে সেই জমানায় প্রবেশ করছি যেখানে উই পোকার চোখ আছে কিনা সেই প্রশ্নের একশটা উত্তর দেওয়ার লোক তো আছে বটে, এরা সবাই নানারকম কেতাব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আপনাকে বুঝাতে চাইবে। কিন্তু উইপোকাটাকে ধরে একটা যন্ত্র দিয়ে দেখে যে আপনাকে জানাবে যে না উইপোকার চোখ আছে বা নেই সেই কাজটা করার লোক নেই। আর দেশে যখন গণতন্ত্র না থাকে, একরকমের স্বইরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম থাকে তখন এইরকম অন্ধকারের দৌরাত্ব বেড়ে যায়।
সেদিন তসলিমা নাসরিন একটা ফেসবুক পোস্ট লিখেছেন, ছোট কয়েক লাইনের কথা। তিনি লিখেছেন, “এগিয়ে থাকা পাশ্চাত্যে এবং পিছিয়ে থাকা প্রাচ্যে বই লিখেছেনঃ Imtiaz Mahmood
প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা বড় পার্থক্য লক্ষ্য করেছি। পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী সমাজ যে বই নিয়ে ডিবেট হবে বলে মনে করে, যে বইয়ে প্রথার বাইরে নতুন কথা বলা হয়েছে, প্রচলিত নিয়ম কানুন ভেঙ্গে ফেলার প্রেরণা দেওয়া হয়েছে, সে বইটি প্রকাশ করতে, পড়তে আগ্রহ প্রকাশ করে। পিছিয়ে থাকা প্রাচ্য যে বই নিয়ে ডিবেট হবে বলে মনে করে, সে বইটি প্রকাশ করতে, পড়তে মোটেও আগ্রহ প্রকাশ করে না।” সত্যি কথা বলেছেন। বইমেলার আগে আমাদের পুলিশও নির্দেশ দেয়, উস্কানিমূলক কোন বই রাখা যাবে না।
ও ভাই, যে বই উস্কানি দেয় না সেটা কোন বই হলো! যে বই উস্কানি দেয় না সে তো চানাচুরের চেয়েও অধম- চানাচুর তো অন্তত আপনার জিহ্বার নানাপ্রকার মৃদু তীব্র কটু মিথ্যে স্বাদ দেয়। যে বই বিতর্ক তোলে না, যে বই প্রশ্ন করে না, যে বই প্রচলিত বিশ্বাসকে আঘাত করে না সেই বই দিয়ে আমি কি করবো? সেই বইতে আমার কি কাজ যে বই আমাকে বলবে যে মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞান সব অর্জন সমাপ্ত হয়ে গেছে হাজার চহর আগে? যে বই আমাকে ভাবতে নিষেধ করবে, প্রশ্ন করতে নিষেধ করবে, যে বই আমাকে ভয় দেখাবে, আমাকে লোভ দেখাবে পাশবিক পরিতৃপ্তির সেই তো আমি চাই না। সেই বইয়ের তো কোন প্রয়োজন নাই।
(৪)
স্বাধীন চিন্তার জন্যে হত্যা করা এই বর্বর কাজ তো শুরু হয়েছে বহু আগে। আমাদের অভিজিৎ তো সেইসব চেতনার শহিদদের একজন মাত্র। অভিজিৎ একটা তো নয়- বিশ্বজুড়ে চিন্তার জন্যে যারা প্রাণ দিয়েছে ওদের নাম আপনি যেকটা জানেন সেগুলি স্মরণ করুন- আমাদের অভিজিৎ ওদেরই একজন। ওদেরকে এইসব অন্ধকারের প্রাণীরা হত্যা করেছে বটে, কিন্তু ওদেরকে কি কেউ হত্যা করতে পেরেছে?
Leave A Comment