আজ আপনাদের কাছে মর্মান্তিক একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। ব্যাপারটা আমাকে খুবই আঘাত করেছে। তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে ভাগ করি। ঘটনাটা হলো, বিগত এক সপ্তাহ পর্যন্ত আমি ফেসবুক ও টুইটারে প্রায় ১০০-১৫০ জন নারী বন্ধু ও আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করেছি, যাদের মধ্যে ছিল দার্শনিক,কবি, বিজ্ঞানমনস্ক ও নারীবাদী। আমার প্রশ্ন ছিল, পৃথিবীর ৫ জন নারী দার্শনিকের নাম বলুন। সরল একটি প্রশ্ন। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। একজন আমাকে উত্তর দিয়েছিল, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল,হবস ও হিউম। আমি প্রশ্ন করলাম, উনারা নারী? তাজ্জব! আমি অবাক হলাম তার উত্তর শুনে। এই একুশ শতাব্দীর বিলিয়ন তথ্যের ভীড়েও পুরুষতান্ত্রিক দার্শনিক মনোভাব তার মগজে এত গভীর ভাবে প্রবিষ্ট হয়েছে, একজন ফেমিনিস্ট হওয়ার পরও সে কল্পনা করতে পারেনি, পাঁচজন নারী কখনো দার্শনিক হতে পারে। অনেক তথাকথিত ফেমিনিস্ট, আমার এ প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রত হয়েছে, তাদের উত্তর ছিল, এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।

          সান্ত্বনার ব্যাপার হলো তাদের মধ্যে কয়েকজন অনেক্ষণ গুগল অনুসন্ধান করে, আমাকে বেশ গর্বের সাথে দুজন নারী দার্শনিকের নাম বলতে পেরেছিল। তার মধ্যে ছিলেন সিমোন দ্য বোভোয়া এবং হাইপেশিয়া! বিশ্বাস করুন। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! এটা আমি কী দেখলাম? তার চেয়েও আমি বেশি অবাক হয়েছিলাম, যখন আমি দেখলাম “ফিলোসফি: হানড্রেড এসেনশিয়াল থিংকার্স’ বইটিতে মাত্র দুজন নারীর নাম মেনশন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ছিলেন, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট এবং সিমোন দ্য বোভোয়া।

          সবচেয়ে আতঙ্কজনক ব্যাপার হলো, “দ্য গ্রেট ফিলোসফার: ফ্রম সক্রেটিস টু ট্যুরিং” বইয়ে কোনো নারীরই জায়গা হয়নি। বাংলাদেশী বেশিরভাগ ওয়েবসাইটে নারী দার্শনিকদের সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো ইনফরমেশন নেই। আমার বয়স যখন পনের, আমি তখন থেকেই প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, ডেকার্ট, হবস, লক, হিউম, রুসো, কান্ট, মিল, নিচাহ, সার্ত্র এবং রলজ এদের প্রত্যেকের নাম মুখস্ত বলতে পারতাম, কিন্তু আমাদের একাডেমিক বইগুলোতে নারী দার্শনিক সম্পর্কে কিছুই বলা নেই! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করতাম, এটা কেন? তার মানে নারীর পক্ষে দার্শনিক হওয়া সম্ভব না? সে বয়সেই আমি আমার কলেজ পড়ুয়া একটি বোনের সহযোগিতায় নারী দার্শনিকদের একটি তালিকা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে এমনকি আজও, হাইপেশিয়া ও আর অল্পকিছু দার্শনিক ছাড়া বেশিরভাগ বাংলাদেশী ওয়েবসাইট আর কোনো দার্শনিক সম্পর্কে জানে না! আমার মনের মাঝে যেন অসীম কালের এক নীরবতা নেমে এসেছিল! এটা কোন ধরনের আনজাস্টিস!!

          আমি কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি ডাইওটিমাকে চেনেন? প্লেটোর সিম্পোজিয়ামের ফিকশনাল চরিত্র বলে যাকে উপেক্ষা করা হয়? সক্রেটিস যাকে শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক বলে সম্বোধন করেছিলেন? সক্রেটিস নিজেকে যে নারীর ছাত্র হিসেবে অ্যাডমিট করেছিলেন? আপনি জানেন, তার ভালোবাসার দর্শন কত সমৃদ্ধ ছিল? আপনি কী জানেন, কেন হিস্টরি অব উইমেন ফিলোসফারস’ (১৯৮৭) বইয়ে গবেষকরা ডাইওটিমাকে একজন ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিলেন? কারণ প্লেটোর সিম্পোজিয়ামের বেশিরভাগ চরিত্রই বাস্তব ছিল বলে গবেষকরা মনে করেন কিন্তু ডাইওটিমাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দুই হাজার বছর পর্যন্ত ফিকশন হিসেবে প্রচার করে এসেছে! তাকে তারা সিরিয়াসলি বিবেচনা করেনি! এ এক নির্মম সত্য যে, ডাইওটিমা দর্শনের ইতিহাসে একজন উপেক্ষিত চরিত্র কারণ তিনি ছিলেন একজন নারী! আপনি শুনলে হয়তো অবাক হবেন, আমরা আজ “সক্রেটিক” পদ্ধতি বলতে সক্রেটিসের যে তর্ক-বিতর্কমূলক আলোচনা পদ্ধটির কথা জানি, সেটা ডাইওটিমার সাথে সক্রেটিসের গভীর আলোচনার ফলাফল । গবেষক ও স্কলার জোয়ি আলিয়োজি বলেছিলেন, ডাইওটিমা সক্রেটিসকে তার সবচেয়ে মহান অবদানগুলোর একটি শিখিয়েছিল আর তা হলো: তার মেথেডোলজি। তার একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, প্রতিটি মানুষই প্র্যাগনেন্ট।

          ডায়োটিমার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে স্কলাররা বিতর্ক করলেও, ঐতিহাসিকভাবে সুস্পষ্ট দলিল সম্পন্ন, অসংখ্য নারী দার্শনিক ছিলেন এই গ্রহে কিন্তু মানব সমাজ তাদের দার্শনিক বলে পরিচয় দেয়নি, তাদের পরিচয় করিয়েছে বিপ্লবী অথবা সংগ্রামী নামক ঠুনকো এক একটা বিশেষণ দিয়ে। দার্শনিক হবে কেবল দাড়ি আর আলখেল্লা বিশিষ্ট অটল পুরুষ। আমরা যখন দার্শনিকের কথা বলি, তখন আমাদের চোখে কেবল একদল পুরুষের ভাস্কর্য ভেসে ওঠে। সেখানে কোনো নারীর ভাস্কর্য ভেসে ওঠে না। বিষয়টা এমন যে, পুরুষ যদি হোমো স্যাপিয়েন্স হয় , তবে নারী নির্বোধ নিয়ান্ডারথাল। তাদের দুজন ভিন্ন দুটি গ্রহে বিবর্তিত হয়েছে, পুরুষ আর নারীর মস্তিষ্কের ক্যাপাসিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন! নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কতটা বিদ্বেষ পোষণ করে, নারীর প্রতিভা আর জ্ঞানের প্রতি তারা কতটা হিংসাত্মক ও অনমনীয় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক হাইপেশিয়া।

           পঞ্চম-শতাব্দীর বাইজানটাইন ইতিহাসবিদ সক্রেটিস স্কলাসটিকাস তার ‘ইক্লেসিয়াসটিকাল হিস্টরি’ বইয়ে লিখেছিলেন, “দার্শনিক থিওনের কন্যা হাইপেশিয়া সাহিত্য এবং বিজ্ঞানে এমন কিছু অর্জন করেছিলেন যে, তিনি তার সমসাময়িক সব দার্শনিকদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন”। ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রগুলো বর্ণনা করেছে যে, হাইপেশিয়া “যদিও একজন নারী, কিন্তু তিনি দার্শনিকের আলখাল্লা পরেই শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতেন”। আমরা জানি যে, তিনি প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, এবং অন্য দার্শনিকদের কাজ সম্বন্ধে উন্মুক্তভাবেই শিক্ষা দিতেন যে কাউকেই, যারা তার কথা শুনতে আগ্রহী হতেন। সিরিল শহরের নতুন পোপ তার প্রতিভা ও আভিজাত্য দেখে এত বেশি আতঙ্কিত ও হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিলেন যে, সে পারাবালানি নামক একদল গুন্ডা সন্ন্যাসী নিয়োগ করেছিল, হাইপেশিয়াকে শেষ করে দেয়ার জন্য। তারা হাইপেশিয়ার শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে তাকে নগ্ন করেছিল এবং তার শরীরটিকে বেশ কয়েক টুকরোয় খণ্ডিত করে হত্যা করেছিল, আর এই বীভৎস নিষ্ঠুরতায় তারা ব্যবহার করেছিল এমন কিছু অস্ত্র, যা একটি গ্রিক অনুবাদের ইঙ্গিত অনুযায়ী ঝিনুকের খোলস কিংবা ছাদে ব্যবহৃত টাইল হতে পারে। এরপর তারা তার শরীরের খণ্ডাংশগুলো শহরের মধ্য দিয়ে টেনে হেচড়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তারা তার শরীরের অবশিষ্টাংশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।

          একজন ফেমিনিস্ট নয় শুধু, একজন নারী হিসেবে আপনার জানা উচিত সে সকল উপেক্ষিত নারী দার্শনিকদের, যারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভয়ে প্রকাশ হতে পারেনি, তারা তাদের প্রতিভাকে মেলে ধরতে পারেনি, তাদের দার্শনিকতাকে এ পৃথিবী থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। প্লেটোর একাডেমিতে শিক্ষার্থী হিসাবে বেশ কয়েকজন নারীও ছিলেন, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ফ্লিয়াসের অ্যাক্সিওথিয়া এবং মানটিনিয়ার লাসথিনিয়া।

          আপনাকে জানতে হবে ৪৫-১২০ খ্রিস্টাব্দের চীনের ফেমিনিস্ট দার্শনিক বান ঝাও-এর কথা যিনি বলেছিলেন, ‘একজন নারীর সবচেয়ে সেরা যৌতুক হচ্ছে তার কুমারীত্ব’ । আপনাকে জানতে ১৩২০-১৩৯২ খ্রিষ্ঠাব্দের কাশ্মিরের নারী দার্শনিক লালার কথা। লালা এমন এক সময় প্রকাশিত হয়েছিলেন, যখন ছিল ইতিহাসের একটি ক্রান্তিকাল, যখন একটি প্রধাণত হিন্দু এবং বৌদ্ধ দার্শনিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রসঙ্গগুলো ইসলামী প্রভাব আর রাজনৈতিক শক্তির মুখোমুখি পিছু হটতে শুরু করেছিল। এখানেই বিশ্বজনীন একটি চরিত্র হিসাবে লালা আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাকে ঐতিহাসিকভাবেই হিন্দু আর মসুলমান, উভয় ঐতিহ্যই নিজেদের বলে দাবি করেছিল। লালার দার্শনিক কবিতাগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তার কবিতা ৬০০ বছর পর্যন্ত মানুষ অলিখিতভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে রেখেছিল।

          এরকম অসংখ্য নারী দার্শনিক ছিলেন, যার মধ্যে অজস্র নারী দার্শনিকের নাম উঠে এসেছে কাজী মাহবুব হাসান অনূদিত বই “ The Philosopher Queens” নামক যুগান্তকারী এই গ্রন্থে। এ গ্রন্থে আপনি ডাইওটিমা অথবা সোফি থেকে আল হিব্বি পর্যন্ত অসংখ্য নারী দার্শনিকের সাথে পরিচিতি হবেন। আমি হাইপারস্পেস প্রকাশনীর পক্ষ থেকে এ বইটি সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই। লেখক ও অনুবাদক কাজী মাহবুব হাসান, মূল অনুবাদের পাশাপাশি এ বইটিতে স্বতন্ত্রভাবে আরও অনেক ঐতিহাসিক নারী দার্শনিকের জীবনি ও দর্শন তুলে ধরেছেন। এ বইটি ফিল্ম মেকার ও রাইটারদের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়।

বইটি সংগ্রহ করুন “Hyperspace: The Dimension Hoppers” ফেসবুক পেজ থেকে।