লিখেছেনঃ মো. মহিউদ্দীন শুভ

সর্দিকাশি নেই, ঘ্রাণ পাচ্ছি, শ্বাসকষ্ট হচ্ছেনা, ভয়ে ভয়ে আঙ্গুল টা অক্সিমিটারে রাখলে অক্সিজেন রেট ৯৭-৯৮ শতাংশ দেখতে পাচ্ছি। ব্যাস, চলমান মহামারীরতে এইটুকুতেই একবুক স্বস্তির নিঃশ্বাস। বিদ্যমান করোনার পরিস্থিতিকে আরো কয়েকগুণ ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে সম্প্রতি ভারতে আইডেন্টিফাই হওয়া তিনগুণ শক্তিশালী বেঙ্গল ভেরিয়েন্টে।

ভারতের বর্তমান মর্মান্তিক অবস্থা দেখে আজ গোটা বিশ্ব হতবাক।

অঘোষিত এই নীরব যুদ্ধে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে পারাটাই যেন চূড়ান্ত বিজয়।

বাংলাদেশী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ  একজন ব্যক্তি বলেছিলেন, আমরা করোনার থেকেও শক্তিশালী। কিন্তু কই? মাত্র একটা বছরের পরিক্রমায় করোনা দ্বিগুণ- তিনগুণ শক্তিশালী রূপ ধারণ করলো কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় দ্বিগুণ তিনগুণ সক্ষমতা বাড়লো কোথায়?

গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। কিন্তু তা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হলো কোথায়?  নেওয়া হয়নি। ফলে এপ্রিলে দেশে করোনায় রেকর্ড সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মারা গেছেন। দেশের এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়েও করোনার শুরুর দিক থেকেই রোগী চিহ্নিত করা নিয়ে টালবাহানা, চিকিৎসা খাতে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা, নমুনা পরীক্ষায় প্রতারণা, পিপিই এবং ত্রান চুরিসহ নানান দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে বারবার।

প্রতি বছর হাজার হাজার টন অক্সিজেন আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দেশে কেন উৎপাদন হবে না?  একবার ভাবুন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত গোটা বছরের চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন উৎপাদন করে নিজের দেশেই। সেই ভারতের মানুষই কি’না এইমুহূর্তে এইটুকু অক্সিজেন না পেয়ে ছটফট করে চির স্থবিরতাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে প্রতিনিয়ত।  প্রাণগুলো এ পৃথিবীর বুকে একটিবার প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য আর বুকটা ফোলাবে না কোনদিন। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য সহ্য করা যায় না।

করোনার শুরুর দিক থেকেই অক্সিজেনের অপর্যাপ্ততার কথা শুনে আসছি আমরা। ভারতও বাংলাদেশকে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতে দেওয়াটাও স্বাভাবিক। তাহলে ভাবুন, ভারতের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমারা কতখানি প্রস্তুত? করোনার সাথে এই যুদ্ধ এক বছরের অধিক সময় ধরে চলছে। রাষ্ট্রের দূরদর্শী এবং সময়োপযোগী ভাবনা থাকলে এই একটা বছরের ব্যবধানে পুরোদস্তুর একটা জায়ান্ট অক্সিজেন প্রোডাকশন প্লান্ট স্থাপন করে ফেলা যেত। উলটো দেখেছি, ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালকে মাত্র মাসিক ৭ লক্ষ টাকার maintenance cost এড়াতে পুরো হাসপাতালটি ভ্যানিস করে ফেলা হয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে আবার দরকার হতে পারে কি না, তা কারও বিবেচনায় আসেনি কারো। খুবই অদ্ভুত বিষয়! এইমুহূর্তে সব থেকে উদ্বেগজনক  বিষয় হলো ভারতের শক্তিশালী বেঙ্গল ভেরিয়েন্ট ১৮ টি দেশে ছড়িয়ে পরেছে। ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ। সীমান্ত যোগাযোগসহ সমস্তরকম পরিবহণ ব্যবস্থা স্থগিত করতেও বাংলাদেশ কিঞ্চিত বিলম্ব করলো। এখন সমস্ত রকম যোগাযোগ বন্ধ আছে কিন্তু এই অদৃশ্য নীরব ঘাতকের সীমান্ত পাড়ি দিতে কোন পাসপোর্ট বা অনুমিতপত্র লাগে না। কখন বা কেমন করে ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করতে হানা দিতে পারে এই বাংলায় তা ভাববারও সময় পাওয়া যাবে না হয়তো। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ভয়াবহ আশংকা মাথায় রেখে আমরা কতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছি ভারতের মত এমন দুর্যোগ মোকাবেলা করবার? এইমুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষকে ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আনাটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশেষ টিকা আমদানিতে কূটনৈতিক দূরদর্শিতার চরম অভাব বাংলাদেশের জনগণের সামনে ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে ভারতের প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউশনের বাংলাদেশে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। টিকা আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সরাসরি সেরাম ইন্সটিটিউশনের সাথে চুক্তি না করে কেন বেক্সিমকো ফার্মার মাধ্যমে করল? বাংলাদেশ সরকার নতুন করে রাশিয়া ও চীনা কোম্পানির ভ্যাকসিনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। এটি এক ধরনের পানি ঘোলা করে ঘাস খাওয়ার মতো অবস্থা। ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার চুক্তির মাধ্যমে টিকা ক্রয় করলে টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তা নিশ্চয়ই তুলনামূলক বেশি থাকত। একটা দেশের সরকারি তৎপরতা এবং একটি কোম্পানির কর্পোরেট তৎপরতা আকশ পাতাল পার্থক্য। আজকে টিকা অনিশ্চয়তার মুখে বেক্সিমকো ফার্মার এমডি পাপন সাহেব  বলছেন “অগ্রিম টাকা নিয়ে কেনো টিকা নিবে না”। সরকার সরাসরি ভারতের সাথে চুক্তি করলে আজকে বাংলাদেশ আশা করত, বাংলাদেশের সরকার প্রধান হয়ত বলবেন অগ্রিম টাকা নিয়ে কেনো টিকা দিবে না। পাপন সাহেবের কথায়ই ফিরে যাই, “ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু কি’না তা বিবেচনা করার সময় এসেছে”। চোখের সামনে হাজারো মৃত্যু দেখে দেখে করোনার সাথে লড়াই করে একটা বছরের অধিক সময় পার হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে এবং করোনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে কতখানি সচেতন করা গেছে? বাংলাদেশে গ্রামের অসংখ্য মানুষ এখনো মনে করেন করোনা বড়লোকেদের অসুখ। এগুলো তাদের হবে না। অথচ আশেপাশেই হয়তো করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।

সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে দায় এড়ানোটা সহজ। সমাজে প্রচুর অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, অসচেতন মানুষ রয়েছেন। একটা দেশের জনসমষ্টিকে শিক্ষিত সচেতন করতে না পারাটাও রাষ্ট্রের দায়। কিন্তু তারাও সমাজের সমান গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সমাজের শ্রমজীবী মানুষজন, গ্রামের চাষিরা অর্থনীতির চাকাটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই সহজ সরল মানুষগুলোকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র ভাল থাকতে পারে না। বাংলাদেশের এই সংকটাবস্থায় অবশ্যই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব এবং মেধার সর্বোচ্চ ব্যাবহারের পরিচয় দিতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আর কোন আক্ষেপ চাই না।