প্রথম পর্ব: মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু আক্রমণ
পর্ব দুই: সুলতান মাহমুদ গজনী’র ভারত আক্রমণ
পর্ব তিন:মুহম্মদ ঘুরীর দিল্লী দখল
পর্ব চার: কুতুব উদ্দিন আইবেকের শাসনামলের শুরু; হত্যা, দাসত্ব এবং মন্দির ধ্বংসের মাত্রা
পর্ব পাঁচ: ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি: বাংলার প্রথম মুসলিম শাসক
আলাউদ্দিন খিলজির ছোটবেলা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে ১৬শতকের ইতিহাসবিদ হাজ-উদ-দবির অনুমান করেন আলাউদ্দিন খিলজির জন্ম হয়েছিল ১২৬৬ সালে দিল্লিতে। দিল্লিতে খিলজি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান জালালুদ্দিনের বড়ভাই শিহাবুদ্দিন মাসুদের পুত্র আলি গুরসাপ পরবর্তীতে আলাউদ্দিন খিলজি নাম ধারণ করেন। বড়ভাই শিহাবুদ্দিনের মৃত্যুর পর জালালুদ্দিন ভ্রাতুষ্পুত্র আলাউদ্দিন খিলজিকে লালনপালন করে আপন কন্যা মালিক-ই-জাহানের সাথে বিয়ে দেন। কিন্তু মালিক-ই-জাহান সুলতানের মেয়ে হওয়ার অহংকারে আলাউদ্দিনকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করত। শাশুড়ির সাথেও আলাউদ্দিনের ভাল সম্পর্ক ছিল না। পারস্যের ইতিহাসবিদ মুহম্মদ কাশিম শাহ ফিরিশতা Tarikh-i Firishta গ্রন্থে লিখেছেন, জালালুদ্দিনের স্ত্রী এবং কন্যা আলাউদ্দিনের সম্ভাব্য বিদ্রোহের ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। মা-মেয়ে দুজন মিলে সুলতানের কাছে নালিশ দিলেও সুলতান আলাউদ্দিন বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ১২৯১ সালে খিলজি সাম্রাজ্যের কারা অঞ্চলের গভর্নর মালিক চাজ্জু বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সুলতান জালালুদ্দিন আলাউদ্দিনকে বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত করে। তাকে পিতৃ-স্নেহে লালনপালনের পুরস্কার সুলতান পাবে অচিরেই। আলাউদ্দিন বিদ্রোহ দমনে সফল হলে সুলতান তাকে কারা অঞ্চলের নতুন গভর্নর ঘোষণা দেয়। এদিকে পরাজিত মালিক চাজ্জু সুলতানকে দুর্বল শাসক উল্লেখ করে আলাউদ্দিনকে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করতে থাকে। সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। অর্থ এবং সৈনিক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মালিক চাজ্জুর পরামর্শে পাশের হিন্দু রাজ্য ভিলসা আক্রমণ করার অনুমতি চায় সুলতানের কাছে। ১২৯৩ সালে মালভা রাজ্যের পারামার অঞ্চলের ধনী নগর ভিলসা আক্রমণ করে। দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভিলসা নগর সহজ আক্রমণের মুখেই ধ্বসে পড়ে। ভিলসা নগরে এসে আলাউদ্দিন খিলজি যাদব রাজ্যের সম্পদের কথা জানতে পারে এবং রাজধানী দেবাগিরির যাওয়ার রাস্তা সন্ধান করে আসে। সুলতান জালালুদ্দিনের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য ভিলসা থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ তার সামনে হাজির করে আলাউদ্দিন খিলজি। খুশি হয়ে সুলতান জালালুদ্দিন আলাউদ্দিনকে যুদ্ধ-মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয় এবং আওয়াধের (বর্তমানে উত্তর প্রদেশে) গভর্নর নিযুক্ত করে।
আলাউদ্দিন খিলজি ভারতীয় উপমহাদেশে আসার আগ পর্যন্ত কোন বিদেশী আক্রমণকারী দক্ষিণ ভারত থেকে আলাউদ্দিন খিলজির মত এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ, মূল্যবান ধাতু, মণিমুক্তা লুট করতে পারে নি। এমনকি সুলতান মাহমুদও এত সম্পদ লুট করতে পারেনি। শত শত বছর ধরে এইসব ধনরত্নরাশি জমেছিল রাজপ্রাসাদে, কোষাগারে, আর মন্দিরে। সমসাময়িক পর্যটক মারকো পোলো এবং ইতিহাসবিদ শিহাবুদ্দিন আবুল আব্বাস আহমেদ ধারণা করেন বিভিন্ন কারণে ভারতে শুধু স্বর্ণের আগমন ঘটছে শতাব্দী ধরে কিন্তু কোনদিন রফতানি হয়নি। দক্ষিণ ভারতের রাজারা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি কখনো বিনষ্ট করেনি নি বরং নিজেরা আরো বৃদ্ধি করেছেন। এতদিনের সঞ্চিত ধনসম্পত্তি দখল করাই ছিল আলাউদ্দিন খিলজির একের পর এক রাজ্য জয়ের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিটি শহর থেকেই পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে বন্দী নারী ও শিশু কিশোর। এখান থেকেই সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি মালিক কাফুরকে সংগ্রহ করে, সে তখন হিন্দু ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় মালিক কাফুর বালক বয়সে এত সুন্দর ছিল যে আলাউদ্দিন খিলজি তার প্রতি যৌনাবেগ বোধ করে। খিলজি তাকে খোঁজা করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে একান্ত সহচর বানিয়ে নেয় এবং এই মালিক কাফুরই কয়েক বছরের মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজির রাজ্য বিস্তারের অন্যতম সফল জেনারেলে পরিণত হয়।
দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি শেষে আলাউদ্দিন খিলজি ১২৯৬ সালে যাদব রাজ্যের রাজধানী দেবাগিরি আক্রমণ করে। ভারতের বিশাল ভূখণ্ড তখন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং রাজাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ছিল ক্লাসিক্যাল পর্যায়ের। প্রায় সব রাজাই ভোগ বিলাস, পানভোজন আর নারী সঙ্গে ব্যস্ত। এদিকে পাশের রাজ্যে অবরোধ, আরেক রাজ্য আক্রান্ত দেখেও নিজেদের রাজ্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করতে হবে এসব বিষয়ে তাদের কোন প্রস্তুতি ছিল না। হরিণের মাংস যেমন হরিণের শত্রু তেমনি দীর্ঘদিনের সঞ্চিত রত্নভাণ্ডার হিন্দু রাজাদের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ালো। একের এক রাজ্য দখল নিয়ে মন্দির ধ্বংস, প্রাসাদ এবং রাজকোষাগার লুট করতে লাগল আলাউদ্দিন খিলজি। ১২৯৬ সালে আলাউদ্দিন খিলজির সেনাবাহিনী যখন দেবাগিরির যাদব রাজ্যের রাজধানীর (বর্তমানে মহারাষ্ট্র) উপকণ্ঠে পৌঁছায় তখন দেবাগিরির রাজা রাম দেব দুর্গ থেকে কয়েক মাইল দূরে ছিলেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার রাজ্যে কোন গোয়েন্দা ব্যবস্থা ছিল না। কানহান নামের এক সৈনিকের নেতৃত্বে অল্পকিছু সেনা তুর্কি সেনাবাহিনীর সামনে খড়কুটোর মত প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সুপ্রশিক্ষিত উন্নত রণকৌশলের সামনে তারা অচিরেই নিহত হন এবং দেবাগিরি অতিসহজে আলাউদ্দিন খিলজির দখল চলে আসে। যদিও এই খণ্ডযুদ্ধের খবর দেবাগিরির রাজপ্রাসাদের কেউ তখনো জানত না। রাজা রামদেবের ছেলেও তখন দূরে সেনা অভিযানে ব্যস্ত। ফলে রাজ্য ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
তখন ভারতের রাজ্যগুলো নিজেদের নিয়ে এতটাই আত্মমগ্ন ছিল যে রাজ্যের প্রজারা পর্যন্ত রাজ্যের বাইরের খবর রাখত না। রাজ্যগুলোর আত্মনিমগ্নতা সম্পর্কে ব্রিটিশভারতের কলোনিতে সিভিল সার্ভিসে নিয়োজিত হেনরি মায়ার্স ইলিয়ট তার বিখ্যাত ‘The History of India as Told by Its Own Historians (Vol III) ইতিহাস বইতে লিখেছেন, “দেবাগিরি রাজ্যের নাগরিকরা ইতিপূর্বে মুসলমানদের সম্পর্কে কিছু শোনেই নি। মারাঠার নাগরিক কখনো তাদের দেশের সেনা দ্বারা নিপীড়িত হয় নি, এখানে কোনদিন কোন মুসলমান বাদশাহ বা যুবরাজের আগমন ঘটেনি”।
দেবাগিরির রাজধানী অবরোধের শিকার হলে খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান নিশ্চিত করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। পাহাড়ের উপর নির্মিত দুর্গে বড়জোর তিন বছরের খাবার মজুদ রাখার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিশাল গুদামঘর থাকলেও যখন খিলজি আক্রমণ করে তখন দেখা যায় গুদামে রাখা হাজার হাজার বস্তায় শুধু লবণ। কোথাও কোন খাবার নাই। কয়েকটা খণ্ডযুদ্ধের পরে রাজা রামদেবের আর প্রতিরোধ রইল না। তিনি তার রাজকোষাগার খিলজির কাছে উজাড় করে দিতে বাধ্য হন। আলাউদ্দিন খিলজি রাজা রামদেবের কোষাগার, প্রাসাদ এবং মন্দির থেকে ২৪০০ কেজি স্বর্ণ, ৪০০০ কেজি রূপা, ২৮ কেজি মুক্তা, ৮ কেজি পান্না, নীলকান্ত, হিরা, মনি এবং অন্যান্য মূল্যবান রত্ন, ৪০০০ পিস সিল্ক এবং মূল্যবান বস্ত্র লুট করে।
ভারত আক্রমণকারী মুসলিম শাসকগণ সাধারণত হিন্দু-নারীদের প্রতি ভীষণ লোভাতুর থাকত বিশেষত রাজপরিবারের উপর। আলাউদ্দিন রাজা রামদেবের কন্যা জ্যেষ্ঠাপল্লিকে নিজের জন্য দাবি করল। পরিবার এবং রাজ্য তখন অবরুদ্ধ, দুর্গে কোন খাবার নাই, পর্যাপ্ত সৈন্য নাই, অস্ত্র নাই এমতাবস্থায় যাদব রামদেবের সামনে আত্মসমর্পণ ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা খোলা ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের মাধ্যমে একটা প্যারাডাইমের পরিবর্তন ঘটে যায় ভারতের সমাজে। মধ্য এশিয়া এবং আরব উপদ্বীপ থেকে আগত শাসকবর্গ অবিশ্বাস্য বর্বরতার সাথে বয়ে আনল নারীর প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষী মূল্যবোধ। হিন্দু রাজাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধের সময় কখনো শত্রুপক্ষের নারীদের ক্ষতি করত না। কিন্তু মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুসলিম সেনাবাহিনীর এসব নিয়মনীতির কোন বালাই নাই। শত্রুপক্ষের নারী, সম্পদ, গবাদিপশু সবই যুদ্ধের গনিমতের মাল। এইসব বিদেশী আক্রমণকারীরা রাজ্য আক্রমণ সূচনার করে ধর্ষণের মাধ্যম আর জয় উদযাপন করে সম্পদ এবং নারী ভাগাভাগির যৌন লালসায়।
দেবাগিরি থেকে লুণ্ঠিত ধনসম্পদ নিয়ে আলাউদ্দিন সুলতানের কাছে না গিয়ে সরাসরি কারা পৌঁছায় এবং সেখান থেকে সুলতানের উদ্দেশ্যে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখে এবং ধনরত্ন পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানায়। সুলতানের কিছু অনুগত সৈন্য, গোয়েন্দা ষড়যন্ত্রের আভাস টের পেয়ে যায় এবং সুলতানকে জানানোর চেষ্টা করে কিন্তু খবর পৌঁছানোর আগেই আলাউদ্দিন তাদেরকে হত্যা করে। আলাউদ্দিনের আমন্ত্রণ পেয়ে জালালুদ্দিন গঙ্গানদী পার হয়ে কারা যাচ্ছিলেন, এদিকে আলাউদ্দিন সুলতানকে স্বাগত জানানোর জন্য এগিয়ে আসে। মাঝপথে তাদের সাক্ষাৎ হয় এবং সেখানেই কুর্নিশ জানানোর ছলে আলাউদ্দিন খিলজি সুলতানকে হত্যা করে।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন যে, দেবাগিরি দখল করে লোভী আলাউদ্দিন খিলজি সন্তুষ্ট থাকবে না। দেবাগিরি দখলের সময় তার সাথে ছিল মাত্র ৮০০০ পদাতিক সৈন্য। আলাউদ্দিন খিলজি আপন চাচা এবং শ্বশুরকে হত্যা করে নিজেকে সুলতান ঘোষণা দিয়ে রাজধানী দিল্লির দিকে রওনা হলো। দিল্লি যেতে যেতে সৈন্য সংগ্রহের জন্য আলাউদ্দিন অভিনব উপায় বের করলো। রাজ্যে ঘোষণা দিয়ে পাঁচ মন স্বর্ণ বিতরণ করা হয় দিল্লির পৌঁছাতে পৌঁছাতে আলাউদ্দিনের সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়ে যায় ৫০,০০০ অশ্বারোহী এবং ৬০,০০০ শক্তিশালী পদাতিক যোদ্ধা।
১৩০৩ সালে আলাউদ্দিন খিলজি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে একদল সেনা পাঠায় কাকাতিয়ার (বর্তমানে তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ) রাজধানী বারাঙ্গালার উদ্দেশ্যে। প্রথম আক্রমণে খিলজি বাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ১৩০৯ সালের অক্টোবর থেকে খিলজি বাহিনীর দীর্ঘদিনের অবরোধের ফলে রাজধানী অকেজো হয়ে পড়ে। কাকাতিয়ার রাজা রুদ্র-প্রতাপ দেবের দুর্গ ছিল দুর্ভেদ্য। দুর্গের চারিদিকে পরিখা খনন করা ছিল, সেখানে জলের প্রতিবন্ধকতা। বারাঙ্গাল দখল করা সত্যিই খুব কঠিন কারণ, দুর্গের চারপাশে কয়েক স্তরে পাথরের দেয়াল। এদিকে দিল্লীর করদ রাষ্ট্র দেবাগিরির রাজা রামদেব ঘোড়া, সৈন্য, অস্ত্র, খাবার দিয়ে আলাউদ্দিন খিলজিকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়।
Richard M. Eaton তার India in the Persianate Age: 1000-1765 – University of California Press; Penguin: 2019 বইতে লিখেছেন, “তেলেগু বীর যোদ্ধারা তাদের যথাসম্ভব অস্ত্র দিয়ে বিক্রমের সাথে খিলজি বাহিনীর আধুনিক সমরাস্ত্র ও যুদ্ধ কৌশলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তুর্কি সেনাদল ইরান থেকে বিশাল বিশাল পাথর ছোঁড়ার যন্ত্র, আগুনের গোল্লা ছোঁড়ার যন্ত্র, দেয়াল ভাঙার মেশিন নিয়ে এসেছিল।”
রাজা রুদ্রপ্রতাপের একদল সেনা রাতের আঁধারে হামলা করে কিন্তু সেটা ছিল অপরিকল্পিত এবং হটকারি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। চতুর মালিক কাফুর অতি সহজেই তাদেরকে ধরাশায়ী করে, তারা প্রত্যেকেই যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়। তিনমাস অবরোধের পরেও দুর্গের দেয়াল ভেদ করতে না পেরে মালিক কাফুর তার সৈন্যদের দুর্গের দেয়ালের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার নির্দেশ দেয়। অনবরত তীর, বর্শার, পাথর বৃষ্টির মধ্যে দেয়ালের নিচে গর্ত খুঁড়তে গিয়ে অনেক সৈন্য মারা গেলেও শেষ পর্যন্ত ভিতরে ঢুকতে সক্ষম হয়। এমতাবস্থায় উপায়ান্তর না দেখে রাজা রুদ্র-প্রতাপ দেব মালিক কাফুরকে সন্ধি প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু মুসলিম সমরনীতিতে বলা আছে, সন্ধি প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তাদেরকে সমূলে হত্যা করতে হবে কারণ, বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধে সন্ধি করার নিয়ম নেই। যাইহোক আলাউদ্দিন খিলজি নির্দয় মালিক কাফুরকে নির্দেশ দিলো, যেহেতু খিলজির সেনাবাহিনী দাক্ষিণাত্যের পথ চেনে না, দিল্লি থেকে অনেকদূরে এবং ত্বরিত সাহায্যের কোন সম্ভাবনা নাই সুতরাং রাজা এবং প্রজাদেরকে ছেড়ে দাও।
কিশোরী লাল শরণের মতে, আলাউদ্দিন খিলজি জানত, ঘন জঙ্গল এবং পাথুরে পথে সাহায্য ছাড়া পার হওয়া দুস্তর পারাবার হয়ে যাবে। সুতরাং চতুর আলাউদ্দিন খিলজি রাজপরিবারকে না হত্যা করে তাদের কোষাগার লুট করে এবং বাৎসরিক কর আরোপ করে পুনরায় ক্ষমতায় বসায়। তবে ভবিষ্যতে অন্য রাজ্য আক্রমণের সময় এই রাজ্য সৈন্য, ঘোড়া, খাদ্য, অস্ত্র দিয়ে আলাউদ্দিন খিলজিকে সাহায্য করবে এমন শর্ত দেয়। অবশেষে রুদ্র-প্রতাপ দেব ১০০ হাতি, ১২,০০০ ঘোড়া, কোষাগার উজাড় করে দেয় মালিক কাফুরের কাছে।
আলাউদ্দিন খিলজির সভাকবি আমির খসরু Khaza’in ul-Futuh (The Treasures of Victory) বইতে লুণ্ঠিত ধনসম্পত্তি, রত্নের কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন। ১৩১০ সালের মহরমের দিন আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লীতে আরব, পারস্য, আফগান আমির-ওমরাদের সামনে রত্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বিশাল এলাকাব্যাপী কালো কাপড় দিয়ে সামিয়ানা টানিয়ে খসরুর জবানীতে মনে হয় যেন আলাউদ্দিন কা’বা ঘর দিল্লীতে নিয়ে আসছে এবং সেদিন যেন দিল্লির মুসলিম সমাজে ঈদের আনন্দ বইছিল। আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে দিয়ে সজ্জিত হাতি, ঘোড়ার বহর যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে, এরপর উন্মোচিত হলো সেই কাঙ্ক্ষিত রত্নভাণ্ডার। হিরা, চুনি, পান্না, মুক্তা, প্রবাল, স্বর্ণের উপর সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে অভূতপূর্ব দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সৃষ্টি হলো। প্রদর্শিত রত্নের মধ্যে কোহিনূর হিরাও ছিল যা এখন ইংল্যান্ডের মহারাণীর মুকুটে শোভা পাচ্ছে।
হয়সালা অভিযান:
দেবাগিরি, কাকাতিয়া দখল করার পর আলাউদ্দিনের পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য নির্ধারিত হলো হয়সালার দ্বারাসমুদ্র এবং মাদুরাইয়ের পাণ্ডিয়া রাজ্য। আক্রমণের কারণ তো আগে থেকেই। মালিক কাফুর গোয়েন্দা মারফত জানতে পারে এই দুই রাজ্যেও সঞ্চিত আছে বিশাল পরিমাণ ধনরত্ন, স্বর্ণ, যুদ্ধের ঘোড়া, হাতি। কিন্তু সভাকবি আমির খসরু বলছেন, “আলাউদ্দিনের হয়সালা আক্রমণের উদ্দেশ্য নিছক ধনসম্পত্তি লুট করা নয় বরং ইসলাম প্রচার অন্যতম কারণ”। ১৩১০ সালের ২৫ নভেম্বর মালিক কাফুরের নেতৃত্বে বিশাল সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করে হয়সালা জয়ের লক্ষ্যে। মাঝখানে আলাউদ্দিন সাম্রাজ্যের করদ রাষ্ট্র দেবাগিরি রাজ্যে মালিক কাফুর যাত্রাবিরতি করে। দেবাগিরির রাজা রামদেব ২৩টা হাতি, বর্শা, তরোয়াল, তীর এবং পরশুরাম দেবা নামের একজন বীর সেনাকে মালিক কাফুরের সাথে দেয় মুসলিম বাহিনীর সহায়তা করতে। পরশুরাম পথ দেখিয়ে নিয়ে হয়সালা রাজ্যে নিয়ে যায়। (কী বিচিত্র ইতিহাস তাই না? যে আলাউদ্দিন খিলজি রাজা রামদেবের কন্যাকে হারেমে নিয়ে গেল, সেই রাজাই আলাউদ্দিন খিলজিকে অন্য হিন্দু রাষ্ট্র আক্রমণের রসদ, খাবার ও গোপন তথ্য বলে দেয়)। তৎকালীন হিন্দু রাজাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সামরিক জ্ঞানের অভাব, মাত্রাহীন ভোগবিলাস, সুরাসক্তি, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, গোয়েন্দা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, মুসলিম সেনাবাহিনীর তুলনায় অনাধুনিক অস্ত্র ও যুদ্ধের কৌশল একের পর এক হিন্দু রাজ্য পতনের অন্যতম কারণ। হিন্দু রাজাদের বোঝা উচিত ছিল মুসলিম সেনাবাহিনী প্রচণ্ড আক্রোশে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে আসছে, সামনে যে রাজ্য পাচ্ছে ধ্বংস ও লুট করছে, গণহত্যা চালাচ্ছে তার প্রতিকার করা উচিৎ। রাজাদের উচিৎ ছিল আলাউদ্দিন খিলজির নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনীর অগ্রগতি থামাতে পরস্পরের দ্বন্দ্ব ভুলে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা, সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া, সেনাবাহিনীতে নতুন সেনা নিয়োগ দেয়া, অস্ত্রের আধুনিকায়ন করা অথচ হয়সালার রাজা বল্লাল দেব তখন তখন প্রতিবেশী পাণ্ডিয়া রাজ্যের সাথে শত্রুতা বাড়াতে ব্যস্ত। পাণ্ডিয়া রাজ্য আক্রমণের মধ্যেই বল্লাল দেব জানতে পারে মালিক কাফুরের নেতৃত্বে আলাউদ্দিন খিলজির সেনা হয়সালা আক্রমণ করেছে। বল্লাল দেব ১০,০০০ ঘোড় সওয়ার সেনা নিয়ে দ্রুত রাজধানী দ্বারাসমুদ্র ফিরে আসে। দুর্গে ফিরে বল্লাল দেব মন্ত্রীদের সাথে আলোচনা করে যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন মালিক কাফুরের বিশাল সেনাবাহিনী আর তাদের পিছনে দেবাগিরি এবং বারাঙ্গালের সেনাবাহিনী দেখল তখন বুঝে গেল এ-যুদ্ধে জয়ের কোন আশা নাই। বাধ্য হয়েই রাজা বল্লাল দেব মালিক কাফুরের সাথে সমঝোতা প্রস্তাব দেয়। সন্ধি চুক্তির শর্তানুযায়ী হয়সালা তার রাজকোষ এবং প্রাসাদের সমুদয় অর্থ, রত্ন আলাউদ্দিন খিলজিকে দিয়ে দিবে এবং প্রতিবছর বিশাল অংকের অর্থ এবং যুদ্ধের সময় সেনা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। সারা রাত্রি ধরে চলল অর্থ, স্বর্ণ, রত্ন লুটের প্রতিযোগিতা, সকালবেলা ৫৩টা হাতির উপর সাজানো হয় হয়সালা রাজ্যের লুণ্ঠিত ধনসম্পত্তি। সভাকবি আমির খসরুর লেখনীতেই পাওয়া যায়, বল্লাল দেবের পতনের সাথে সাথে মুসলিম সেনাবাহিনী হয়সালার দ্বারাসমুদ্রকে লুট করে, মন্দির ভেঙে ফেলে এবং স্বর্ণ ও রত্ন নির্মিত বিগ্রহ-মূর্তি দখল করে। তারা সদ্য ভেঙে ফেলা মন্দিরের উপরই মসজিদ নির্মাণ করে ফেলে।
পাণ্ডিয়া রাজাকে ধাওয়া করে হন্যে মালিক কাফুর:
কিশোরী লাল শরণ বলছেন, বল্লাল দেবের পরিণতি এখানেই শেষ নয়, মালিক কাফুর রাজা বল্লাল দেবেকে আদেশ দেয় পাণ্ডিয়া রাজ্যের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে। মালিক কাফুর এক অভিযানেই পাণ্ডিয়া রাজ্যও আক্রমণ করে। পাণ্ডিয়া রাজ্যের পরিণতিও হয়সালার মত। দুটি সমৃদ্ধ রাজ্য কয়েকদিনের ব্যবধানেই ধ্বংস হয়ে যায়। পাণ্ডিয়া রাজ্যে তখন দুই রাজকুমার বীর এবং সুন্দরের মাঝে ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াই চলছিল। দুইভাইয়ের দ্বন্দ্বের সুযোগে খিলজির সেনাবাহিনী পাণ্ডিয়া রাজ্যে প্রবেশ করে ১৩১১ সালের মার্চে এবং পাণ্ডিয়ার রাজধানী মাদুরাইয়ের সব মন্দির ভেঙে স্বর্ণ, নগদ অর্থ, মন্দিরের বিগ্রহ লুট করে। আলাউদ্দিন খিলজি বাহিনীর হাতে অন্যান্য রাজাদের ভাগ্য পরিণাম দেখে পাণ্ডিয়ার রাজা বীর পাণ্ডিয়া ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি যুদ্ধ না করে অনুগত সৈনিক, পারিষদ ও পরিবার নিয়ে বিভিন্ন জায়গা, ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে লাগলেন। অপরিচিত জায়গায় প্রতিকূল পরিবেশে তুর্কি এবং আফগান সেনারা রাজা বীর পাণ্ডিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে পড়ল। বীর পাণ্ডিয়াকে খুঁজতে চষে বেড়াতে লাগল ২০হাজার মুসলিম সেনাদল। পাণ্ডিয়াকে না পেয়ে তারা নির্বিচারে হিন্দুদের হত্যা করতে লাগল। পাণ্ডিয়াকে খুঁজতে কান্নানুর শহরে এসে পাণ্ডিয়াকে না পেয়ে শহরের সব বেসামরিক লোকদেরকে হত্যা করে এবং মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গোয়েন্দারা মালিক কাফুরকে খবর দেয় বীর পাণ্ডিয়া মাদুরাই শহরে আছে। মালিক কাফুরের সেনাদল আসার আগেই পাণ্ডিয়া মূল্যবান রত্ন স্বর্ণ নিরাপদে অন্যত্র নিয়ে চলে যায়। রাগে ক্ষোভে হতাশায় মালিক কাফুর মাদুরাই শহরের শিব মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বীর পাণ্ডিয়া মালিক কাফুরের সাথে যুদ্ধ না করেও মালিক কাফুরের সেনাবাহিনীকে পর্যদস্তু করে ফেলেছিল। লুটের মাল নিয়ে দীর্ঘদিন পাহাড়ে পাথুরে রাস্তায় জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে তারা ক্লান্ত এবং দিল্লি ফিরতে চায়। ফেরার পথে তারা একটা মন্দিরের স্বর্ণ নির্মিত ছাদ এবং ভিত্তির পায় সন্ধান পায়। স্বর্ণ ও রত্ন লুট করে তারা মন্দিরটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সোইন্যদের অবস্থা বুঝতে পেরে মালিক কাফুর দিল্লি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দিল্লি ফেরার আগে কাফুর গণিমতের সব মালকে আলাদা করে হিসেব করে রাখে। গুনে দেখা গেল কাফুরের কাছে জমা হয়েছে ৫১২টা হাতি, ৫০০০ আরবিয় ঘোড়া এবং ২০০০ কেজি স্বর্ণ এবং অন্যান্য রত্ন পাথরও পরিমাণে বেশুমার। মুসলিম ইতিহাসবিদগণের মতে, লুটের মাল এত বেশি জমা হয়েছিল যে খিলজির সাম্রাজ্যের পরবর্তী দুই প্রজন্ম শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলেও অর্থ ফুরোবে না।
গুজরাট: আলাউদ্দিন খিলজির আক্রমণে ভাগেলার রাজা রাই কর্ণের করুণ পরিণতি
১২৯৯ সালের গুজরাট অভিযানে আলাউদ্দিন খিলজি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সমসাময়িক পার্সিয়ান ইতিহাসবিদ, জৈন চন্দ্রপ্রভা স্বীকার করেন যে গুজরাট শহরকে ধ্বংস করা হয় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। খিলজির সেনাবাহিনী গুজরাটের বাণিজ্যিক এলাকার অনিলাবাদা, নাহারওয়ালা, আসাভাল, বানমান্থালি, সুরাট, কোম্বে, সোমনাথ ইত্যাদি শতাধিক শহর লুট করতে থাকে, হিন্দু ও জৈন মন্দিরগুলো ভাঙতে থাকে। পার্সিয়ান ইতিহাসবিদ আব্দুল্লাহ ইবনে ফাদাল্লাহ শরফ ওয়াসাফ Tarikh-i-Wassaf বইতে লিখেছেন আলাউদ্দিন খিলজির প্রতিটি অভিযান শুরু হয় “পবিত্র যুদ্ধের উদ্দেশ্যে এবং সেটা ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির জন্য নয়। ফজরের নামাজ পড়েই খিলজি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ত শান্ত জনপদে, পাহাড়ে, সমতলে সেখানে মানুষ বা প্রশিক্ষিত সৈনিক হয়ত কেবল ঘুম থেকে উঠেছে, যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। খিলজি বাহিনীর আক্রমণে ভোর হতেই কোম্বে শহরের পতন হয়। ঘুম থেকে কেবল জেগে ওঠা হতচকিত মানুষগুলো জানে না কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য, তারা জানে না কোথায় যাবে, বুঝতে পারে না কী করতে হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় মা হয়ত ভুলে গেছে কোলের শিশু আর সৈন্যরা শিশুকে নারীর বুক থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে করেছে ধর্ষণ।”
গুজরাট দখল নিয়ে আলাউদ্দিন খিলজির সেনাবাহিনী স্থানীয় মানুষ হত্যা শুরু করে পাইকারি হারে। মুসলমানদের চোখে ভারত বিধর্মীদের দ্বারা অপবিত্র স্থান, সুতরাং ইসলাম প্রচারের স্বার্থে যতবেশি বিধর্মী হত্যা করা হবে ততবেশি পবিত্রতার দিকে এগিয়ে যাবে। মানুষের রক্তে আক্ষরিক অর্থেই সেদিন স্রোত বয়ে গিয়েছিল গুজরাটে। এত পরিমাণ স্বর্ণ, রুপা লুট করেছিল যে তারা নিজেরাও কল্পনা করতে পারেনি। বিভিন্ন রকম উজ্জ্বল মূল্যবান পাথর, মুক্তা, হিরা, পান্না লুট করেছিল অগণিত। মূল্যবান খোদাই করা সিল্কের রঙিন বস্ত্রও লুটের মালের তালিকায় ছিল। (‘The History of India as Told by its Own Historians, Vol III, by Henry Miers Elliot.)
‘The Legacy of Jihad: Islamic Holy War and the Fate of Non-Muslims’ (edited by Andrew Boston) বইতে উল্লেখ পাওয়া যায় আলাউদ্দিন খিলজির নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী সোমনাথ শহর দখল করে ২০০০০ সুন্দরী নারী ও শিশুকিশোর বন্দী করে সম্পূর্ণ শহরটিকে ধ্বংস করে দেয়, ধ্বংস করে স্থানীয় অধিবাসীদের বাড়িঘর, আগুন লাগিয়ে দেয় তাদের ফসলের গোলায়, কেটে খেয়ে ফেলে তাদের গোয়ালের গরু।
পার্সিয়ান ইতিহাসবিদ আব্দুল্লাহ ইবনে ফাদাল্লাহ শরফ ওয়াসাফ সোমনাথ শহর ধ্বংসের বর্ণনা দিয়েছেন, মুসলিম সেনারা প্রতিটি বাড়ি, মন্দির, প্রাসাদ থেকে ধনসম্পদ ছিনিয়ে নেয় এবং মূর্তি, বিগ্রহ ধ্বংস করে। বেঁচে যাওয়া বিধর্মীরা গভীর বেদনা নিয়ে চোখের সামনে দেখতে লাগল তাদের দেবতাদের দুর্দশা। প্রতিটি দেবতার মূর্তি রক্ষার জন্য মুসলিম সেনারা হিন্দুদের কাছে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা দাবি করে, কিন্তু তাদের সবকিছুই তো ইতিমধ্যে দখল হয়ে গেছে, নিজেদের বলে অবশিষ্ট কিছুই নেই। রাগে ক্ষোভে অপমানে তারা ফুঁসতে থাকলেও বাস্তবে কিছু করতে পারে না। মুসলিম সেনারা একে একে অঙ্গচ্ছেদ করে মূর্তি ভাঙতে থাকে। কিছু ভাঙা মূর্তি দিল্লী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় জামে মসজিদের সামনের রাস্তায় রাখা হয় পদদলিত করার উদ্দেশ্যে যাতে মানুষ বুঝতে পারে মুসলমানদের কতবড় বিজয় অর্জিত হয়েছে। নিশ্চয় সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর এবং যিনি এই দুনিয়ার মালিক। আমিন”।
আলাউদ্দিনের সভাকবি আমির খসরু একটু সহনশীলভাবে লিখেছেন, “তখন থেকে সোমনাথ মন্দির পবিত্র মক্কার দিকে সেজদায় রত হলো, যেন মন্দিরটির চূড়া মাথা নিচু করে সমুদ্রে বিলীন। বলতে পারেন ভবনটি নামাজ পড়ে গোসল সেরে নিলো। মন্দিরের মূর্তিগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল সৈন্যরা আব্রাহামিক নিয়মানুসারে। কিন্তু একটা বড় মূর্তিকে তারা না ভেঙে বরং রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যায় হিন্দুদের দেখানোর উদ্দেশ্যে যে তোমাদের ঈশ্বর কত অসহায়। নিজেকেই রক্ষা করতে পারে না।”
ভাগেলার রাজা রাই কর্ণ পালিয়ে একটু দুর্গে আশ্রয় নিলে আলাউদ্দিনের সেনাবাহিনী রাজপ্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরমধ্যেই সেনাবাহিনী রাই কর্ণের স্ত্রী রাণী কমলা দেবীকে ধরে ফেলে এবং তাকে সেদিনই আলাউদ্দিন খিলজির হারেমে পাঠিয়ে দেয় এবং ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে। কিন্তু রেখে যেতে হয় দুগ্ধপোষ্য শিশু কন্যা দেবলা দেবীকে। খিলজি বাহিনী দিল্লীতে ফিরে গেলেই রাই কর্ণ রাজধানীতে ফিরে আসে।
আট বছর হারেমে থাকার পর কমলা দেবী কন্যার প্রতি মায়া অনুভব করে এবং দেবলা দেবীকে গুজরাট থেকে নিজের কাছে এনে দেয়ার জন্য আলাউদ্দিন খিলজিকে অনুরোধ করে। আলাউদ্দিন খিলজিও সাথে সাথে দ্বিতীয়বার গুজরাট আক্রমণের আদেশ দেয়। খিলজির সেনাবাহিনী আসছে জেনে রাই কর্ণ তার কন্যাকে ৩০০জন সৈন্যসহ বারাঙ্গালে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু একদল তুর্কি সৈন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল এবং তারা পথিমধ্যেই দেবলা দেবীর বহরকে আক্রমণ করে বন্দী অবস্থায় দিল্লি নিয়ে যায়। সেখানেই আলাউদ্দিন খিলজির বড়ছেলে খিজির খানের সাথে দেবলা দেবীর বিয়ে হয়। তখন রাজকন্যার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। বিয়ের মাত্র ৮ বছরের মাথায় নিজের ছোটভাই কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ খিজির খানকে হত্যা করে এবং দেবলা দেবীকে তার হারেমে নিয়ে যায়। ১৩২০ সালে কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহকে হত্যা করে খুশরাও খান দিল্লীর সিংহাসনে বসে দেবলা দেবীকে বিয়ে করে।
আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলের প্রশংসা করে অনেক বামপন্থী। তাদের মুখের উপর দেবলা দেবী এক দুঃশাসনের নিদর্শন। ভ্রাতৃঘাতী কলহে একের পর এক ভাই মারা যাচ্ছে আর খুনি বিয়ে করে যাচ্ছে, হারেমে নিয়ে যাচ্ছে এক রাজকন্যাকে। তাহলে গোটা রাজ্যের কী পরিস্থিতি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। যেসব বামপন্থী এবং নারীবাদী মুসলিম আক্রমণের মুখে হিন্দু-নারীদের ‘জহর’ থেকে দেবলা দেবীর মত হারেমে যেতে বাধ্য হওয়া শ্রেয় মনে করে তারা কোন জ্বালানিতে কোন যন্ত্র দিয়ে চিন্তা করে ভেবে দেখা দরকার।
এদিকে রাই কর্ণের জীবন শেষ হয় অতি করুণভাবে। জৈন পণ্ডিত কাকা সুরি Nabhi-Nandana-Jinoddhara-Prabandha লিখেছেন, “রাজা এক রাজ্য থেকে অন্যরাজ্যে গিয়ে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ কালে তার মৃত্যু হয় অতি দীনহীন বেশে।”
রাজস্থান: রক্তাক্ত যুদ্ধের ময়দান
ইতিহাসবিদ কিশোরী লাল শরণ মনে করেন, “অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের নাম শোনার পর থেকেই আলাউদ্দিন খিলজিরও বিশ্বজয়ের ভূত মাথায় চাপে। আলাউদ্দিন খিলজি নিজেকে ‘অ্যালেক্সান্ডার সানি বা দ্বিতীয় অ্যালেক্সান্ডার’ সম্বোধন শুনতে পছন্দ করত এমনকি নিজের নামে সে মুদ্রা, মুসজিদে খুতবা চালু করেছিল। যাইহোক, তার একজন পরামর্শদাতা তাকে বোঝালেন যে বিশ্বজয়ের আগে ভারতের বাকি অংশ দখল করতে। ভারতেও সম্পদের কমতি নেই।”
ভারতের রাজস্থান ছিল সবচেয়ে পুরনো রাজত্ব এবং বংশপরম্পরায় বীরত্বপূর্ণ সাহসী যোদ্ধা। আলাউদ্দিন খিলজি মনে করলো রাজস্থান দখল করতে পারলে তার বিজয়ের মুকুটে আরেকটা পালক যুক্ত হবে। রানথাম্বরে প্রথম আক্রমণ করেই আলাউদ্দিন খিলজি বুঝতে পারল রাজস্থান জয় অনেক কঠিন হবে। দীর্ঘদিনের অবরোধের মধ্যেও রাজস্থানের রাজা হামির দেব খিলজি বাহিনীর সাথে সেয়ানে সেয়ানে যুদ্ধ করে গেছে। রাজপুত সেনাদের হাতে নিহত হয় আলাউদ্দিনের অন্যতম প্রধান সেনাপতি নুসরাত খান। রাজা হামির দেবের প্রতিরোধের তীব্রতায় খিলজির সেনাদল অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়। পরাজয়ের খবর শুনে আলাউদ্দিন খিলজি নিজেই রানথাম্বরে উপস্থিত হয়। খিলজির নেতৃত্বে সেনাবাহিনী মরণপণ যুদ্ধ করে গেল রাজপুত সেনাদের সাথে। কিন্তু তখনো দুর্গের দেয়াল ভাঙা সম্ভব হয়নি। কিন্তু দুজন রাজপুত বিশ্বাসঘাতকতা করে খিলজির সেনাবাহিনী পথ দেখিয়ে দেয়। নিশ্চিত পরাজয় জেনে দুর্গের নারীরা ‘জহর’ করছিল আর রাজপুত সেনারা রাজা হামির দেবের সাথে কোমর বেঁধে প্রাণ বিসর্জনের জন্য শেষ যুদ্ধ করছিল। অগণিত তুর্কি সেনার সামনে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। কিশোরী লাল শরণ উল্লেখ করেছেন, আলাউদ্দিন খিলজি সেদিন রাজপরিবারের একজন সদস্যকেও জীবিত খুঁজে পায়নি।
১৩০৩ সালে ২৮ জানুয়ারি আলাউদ্দিন খিলজি চিতোরের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করে। সভাকবি আমি খসরু চিতোর অভিযানে সাথে ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “চিতোর দুর্গের শক্তিশালী দেয়াল আর প্রতিরোধের মুখে আলাউদ্দিন খিলজির অবরোধ ফলপ্রসূ ছিল না। দীর্ঘ আট মাসের অবরোধে চিতোরের সেনারা বীর বিক্রমে লড়ে গেছে কিন্তু আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাচ্ছিল খাবার। এখানেও প্রায় ৭০০০ নারী একসাথে আগুনে প্রবেশ করে এবং পুরুষরা যুদ্ধ করতে করতে মারা যায়।” আগুনে পুড়তে পুড়তে মেয়েরা যখন গগনবিদারী আর্ত চিৎকার দিচ্ছিল তখন পুরুষরা জাপানের ‘কামিকাজে কায়দায়’ একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসলিম বাহিনীর উপর। এখানেও চিতোরের রাজা রতন সিংকে প্রতারণা করে হত্যা করে মালিক কাফুর। তবে কবি আমির খসরুর লেখায় রাণী পদ্মাবতীর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
ধ্বংসস্তূপ আর পোড়া কয়লা দুর্গের মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজি প্রবেশ করে ১৩০৩ সালের ২৬ আগস্ট। রাজপুত সেনাদের বীরোচিত প্রতিরোধে নিহত মুসলিম সেনাদের লাশ দেখে আলাউদ্দিন খিলজি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চিতোরের সাধারণ মানুষদেরকেও হত্যার আদেশ দেয়। আমির খসরু লিখেছেন, “একদিনে ৩০,০০০ হিন্দুকে কচু কাটা করা হয়।” Annals and Antiquities of Rajasthan the Central and Western Rajput States বইতে James Todd এবং William Crooke লিখেছেন, “অমানবিক গণহত্যার পরে যে কয়েকদিন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি চিতোরে ছিল সবসময় একজন যুদ্ধোন্মাদের মত খুন, ধর্ষণ, এবং মন্দির, মঠ, মূর্তি ধ্বংস আর লুট করতে লাগল।”
হিন্দুদের জন্য নীতিমালা:
আলাউদ্দিন খিলজি একবার বায়নার কাজি মুগিসুদ্দিন দরবারে ডাকল এবং তাকে জিজ্ঞেস করল “আইনে হিন্দুদের কী বিধান দেয়া আছে?”
কাজি উত্তর দিলো, “১৮ থেকে ৫০ বছরের হিন্দুরা সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট (tribute payer) জিম্মি অর্থের বিনিময়ে নিরাপত্তা পাবে। কোন সাবালক পুরুষ অস্ত্র বহন করতে পারবে না। রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তা যা চাইবে কোন প্রশ্ন ছাড়াই তারা দিতে বাধ্য। কর্মকর্তা যদি একমুঠো মাটি তাদের মুখের দিকে ছুড়ে দেয় তবুও তারা মুখ হা করে সেই মাটি গিলতে বাধ্য অম্লানবদনে। এভাবেই হিন্দুরা মুসলিম রাজ্যের রাজস্ব কর্মকর্তাকে সম্মান দেখাবে। ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব, আল্লাহ বিধর্মীদের পছন্দ করেন না, তারা সব সময় থাকবে অধীনস্থ। হিন্দুদেরকে দমন করতে হবে এটা ধর্মীয় দায়িত্ব, কারণ আমাদের প্রিয় নবী নির্দেশ দিয়েছেন বিধর্মীদের কতল করতে, তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিতে এবং তাদেরকে বন্দী করতে যতক্ষণ না তারা ইসলামের ছায়াতলে আসছে। আমি আবু হানিফা (স্কুল অফ ইসলামিক থট) থেকে শিক্ষা লাভ করেছি এবং সেখানে হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর আরোপের নির্দেশ দেয়া আছে। অন্য স্কুল অফ ইসলামিক থট ‘মৃত্যু অথবা ইসলাম’ দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে বলে।”
আলাউদ্দিন খিলজি উত্তর দিলো, “ওহহ প্রাজ্ঞজন, আপনি শিক্ষিত মানুষ, কিন্তু আমার আছে অভিজ্ঞতা। আমার অক্ষরজ্ঞান নেই কিন্তু আমি অনেক কিছু দেখে শিখেছি। তাহলে এবার শোনেন, হিন্দুরা হত দরিদ্র না হওয়া পর্যন্ত কখনো আত্মসমর্পণ করবে না, তারা বাধ্যগতও হবে না। তাই আমার প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে অত অল্প পরিমাণ খাবার, শস্য, দুধ, গবাদি হিন্দুদের জন্য রেখে আসো যা খেয়ে তারা কোনমতে জীবনযাপন করতে পারে, তারা যেন কখনো ধনসম্পত্তি মজুদ করতে না পারে।”
কিশোরী লাল শরণ হিন্দুদের প্রতি আলাউদ্দিন খিলজির দুইটা নীতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন। The Legacy of Muslim Rule in India বইতে তিনি লিখেছেন, “আলাউদ্দিন খিলজি শাসন কায়েম করে কৃষি উপর ৫০ শতাংশ খাজনা আরোপ করে, এছাড়া বসতভিটা এবং গোচারণ ভূমির উপরেও কর ধার্য করে। সুলতান ইলতুতমিশ এবং গিয়াসউদ্দিন বলবানের শাসনামলে খাজনার হার ছিল উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশ। ৫০ শতাংশ খাজনা বাড়ানোর সাথে সাথে কৃষক আরও গরীব হতে শুরু করল। সমসাময়িক ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বারানি উল্লেখ করেছেন, সব গবাদিপশু যেমন ছাগল গরুর উপরেও কর ধার্য ছিল। পারস্যের ইতিহাসবিদ মুহম্মদ কাশিম শাহ ফিরিশতা Tarikh-i Firishta গ্রন্থে লিখেছেন, দুইজোড়া হালের বলদ, কয়েকটা গাভী ও ছাগল করের আওতা মুক্ত। তবে কারি, চারাই, জিজিয়া, তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার উপরেও কর আরোপ করা ছিল।”
মিশরের ইসলাম ধর্মের পণ্ডিত মাওলানা শামসুদ্দিন তুর্ক’র বয়ান থেকে জিয়াউদ্দিন বারানি Fatawah-i-Jahandari বইতে বলেন, “সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি হিন্দুদেরকে পরাজিত করে দারিদ্রের জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছে শুনে বড় তৃপ্তি পেলাম। তাদের অবস্থা এখন এতটাই সঙ্গিন যে মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে তারা এখন ভিক্ষার থালা নিয়ে ঘোরে। হিন্দুদের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ না আগে কেউ কখনো দেখেছে না পরে কেউ দেখবে।”
আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে সব শ্রেণির পেশার হিন্দুরা চরম দরিদ্র হয়ে পড়ে। যে সামন্ত রাজা সম্মান এবং বিলাসের জীবন যাপন করত তারা খিলজির শাসনামলে কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করত। গরীব কৃষকের দুর্দশার কোন সীমা ছিল না কারণ সুলতানের পাইক পেয়াদা করের নামে সবকিছু উজাড় করে নিয়ে যেত। কিশোরী লাল শরণের তথ্যমতে, হিন্দুদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে সঞ্চয় বলতে তাদের আর কিছু রইল না, উঁচু-বর্ণের হিন্দুরাও মুসলমান বাড়িতে সামান্য দিনমজুরের কাজ খুঁজে বেড়াতো।
একই সাথে যখন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আলাউদ্দিন খিলজি সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ, রাজনীতিতে ভীষণ চতুরতার পরিচয় দিলো। কিশোরী লাল তার ‘History of the Khaljis’ লিখেছেন, “আলাউদ্দিন খিলজি প্রথম মুসলিম শাসক যে আনুগত্য এবং প্রতিবছর নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়ে পরাজিত রাজাদেরকে স্বপদে বহাল রেখেছিল। এক্ষেত্রে আলাউদ্দিন খিলজি সম্রাট আকবরের পূর্বসূরি। আকবর যেমন ভারতের প্রাচীন রাজপরিবার পুরোপুরি ধ্বংস না করে বরং নিজের ক্ষমতা ও রাজ্যের সাথে একীভূত করতো।”
কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুর পরে খিলজি-তুঘলক বাহিনী যৌথভাবে দক্ষিণে অভিযান শুরু করে বারাঙ্গলের কাকাতিয়া রাজবংশকে মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে ফেলে ইসলামি শাসনের সূচনা করে।
আলাউদ্দিন খিলজির শাসন:
ভারতের মুসলিম শাসন ছিল সর্বদা যুদ্ধ, অনাচার, প্রসাদ ষড়যন্ত্র আর নৈরাজ্যের ইতিহাস। মুসলিম আক্রমণের আগেই এই অঞ্চলে যুদ্ধ হানাহানি, শত্রুতা ছিল রাজায় রাজায় কিন্তু তারা কখনো যুদ্ধজয় করে নারী দখল, মন্দির ধ্বংস বা সম্পদ বিনষ্ট করেনি। সাধারণ বেসামরিক জীবন নির্বিঘ্নে চলতে যেমন হাজার বছর ধরে চলে আসতেছিল। রাজা বদলে গেলেও কর, খাজনা, ঈশ্বর, উৎসবের কোন পরিবর্তন ছিল না। দাসত্ব ছিল না।
কিন্তু ৭১২ সালে মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু আক্রমণ ও বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথমবার দাসপ্রথার সূচনা হয়। তখন থেকেই ভারতের মুসলিম শাসকগণ হাজার হাজার যুদ্ধবন্দীকে দাস বানিয়ে ধর্মান্তরিত করে গৃহস্থালি, রাজপ্রসাদে, আস্তাবলে, সৈন্যদলে নিয়োগ দেয়। হাজার হাজার হিন্দু যুদ্ধবন্দীকে ইরাক, সিরিয়া, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তানের দাস বাজারে বেঁচে দেয়। ফর্সা ত্বকের সুন্দর বালক ছেলেদের উপর আলাউদ্দিন খিলজির যৌন আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। মালিক কাফুরের সাথে তার সমকাম তখন বহুল আলোচিত ছিল। ১২৯৯ সালের গুজরাট বিজয়ের পর গণিমতের মাল থেকে আলাউদ্দিন খিলজি কাফুরকে ১০০০ দিনার দিয়ে কিনে নেয় যৌনদাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। এমনকি ক্ষেত্র-বিশেষে মেয়েদের থেকে সুন্দর ছেলেদের দাম বেশি উঠত নিলামে। আলাউদ্দিন খিলজি ১১ বছর বয়সী (তখন হিন্দু ছিল) মালিক কাফুরের প্রেমে পড়ে যায়। কিশোরী লালের মতে, আলাউদ্দিন খিলজির নিজের দখলে ছিল ১ লাখ ২০ হাজার দাস যারা রাজপ্রাসাদে ও বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মাণে কাজ করত। আমির খসরুর জবানিতে রাণী পদ্মাবতীর কথা উল্লেখ না থাকলেও মালিক কাফুরের সাথে আলাউদ্দিন খিলজির গভীর প্রণয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। গনিমতের সুন্দর চেহারার বালকরা অনেক সময় যৌন-দাসে পরিণত হতো। অবাক ব্যাপার হলো ১৩১৬ সালের ৪ জানুয়ারি রাতে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজিকে হত্যা করে মালিক কাফুর। আলাউদ্দিনের ছেলে কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ নিজেও সমকামী ছিল এবং সেও তার যৌন-সঙ্গী খুশরাও খানের হাতে নিহত হয় এবং এভাবেই ১৩২০ সালে খিলজি রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে।
আলাউদ্দিন খিলজি আওরঙ্গজেবের তুলনায় কম মন্দির ধ্বংস করছে এরকম একটা সান্ত্বনার প্রলেপ দেয় আধুনিক বামপন্থী একটা শ্রেণি। কিন্তু তারা তথ্য গোপন করে যে আলাউদ্দিন খিলজি কী পরিমাণ যুদ্ধে কী পরিমাণ মানুষ হত্যা করেছে, ধনসম্পত্তি লুট করেছে। যুদ্ধের খরচ যোগাতে স্থানীয় মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল সীমাহীন করের বোঝা। কিছু মুসলিম ইতিহাসবিদ এবং ইতিহাস অন্ধ বামপন্থী আলাউদ্দিন খিলজিকে মঙ্গোল আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করার জন্য যোগ্য শাসক হিসেবে পরিচয় করিয়ে পূর্বের অপরাধ লঘু করে ভারতের ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তার সময়ে অপরাধ অনেক কমে গিয়েছিল, এটা সত্য। তাই, তাকে প্রোগ্রেসিভ ‘সোশ্যালিস্ট’ মডারেট মুসিলম শাসক হিসেবে পরিচিত করতে আর্টিকেলও পাবলিশ হয় জাতীয় দৈনিকে।
এরকম বিতর্ক খুব উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং বামপন্থীরা হলো ইসলামের প্রয়োজনের বুদ্ধিমান নির্বোধ। এটা সত্যি ছিচড়ে অপরাধ কমেছিল আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে। কিন্তু তার বিচার ব্যবস্থা ও শাস্তি দেখলে নারকীয় এবং লঘু পাপে গুরুদণ্ড মনে হবে, মনে হবে আগে বিচার ব্যবস্থার বিচার হওয়া উচিত। যেমন কোন দোকানদার ওজনে কমে দিয়ে ধরা পড়লে শরীর থেকে সমান ওজনের মাংস কেটে দাঁড়িপাল্লায় দিতে হবে। কেউ মদ্যপান করলে মুগুর দিয়ে হাত থেঁতলে দিতে হবে। চুরি করলে হাত কেটে ফেলতে হবে, কর ফাঁকি দিলে বিষাক্ত সাপ, ইঁদুর, বিচ্ছুতে ভরা কুয়াতে ফেলে দিতে হবে। ইতিহাসবিদগণ বলেন, আলাউদ্দিন খিলজির রাজ্যজুড়ে এত গোয়েন্দা ছিল যে মানুষ সামাজিক যোগাযোগের কথাও নির্ভয়ে বলতে পারত না। কারণ সবসময় বিদ্রোহের ভয়।
মনে করা হয় সমাজতন্ত্রের শাসক যোসেফ স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নেও কোন অপরাধ ছিল না থাকবে কী করে, ইতিহাসের অন্যতম অপরাধী নিজেই তখন শাসন ক্ষমতায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসন করেছিলেন শক্তহাতে ডিসটোপিয়ান কায়দায়। স্ট্যালিনকে নাস্তিক বলা হলেও সে আদতে ভাগ্য শিকারি। জার্মান বাহিনী যখন মস্কোর দ্বার প্রান্তে তখন স্ট্যালিন রাশান অর্থোডক্স চার্চে প্রার্থনা করে সহায়তা চান। তেমনি আলাউদ্দিন খিলজি নিয়মিত হারেমে কাটিয়ে নামাজ না পড়লেও মুসলিম যোদ্ধাদের খুশি করতে প্রতিটি হিন্দু রাজ্য আক্রমণ করে মন্দির ধ্বংস এবং লুট করার নির্দেশ দিয়েছে।
ভয়ংকর পলপট, মাও বা স্ট্যালিনের মত সমাজতন্ত্রী নেতার আদলে আলাউদ্দিনেরও কিছু গুণাবলী ছিল বৈকি। সদ্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত ২৫ হাজার মঙ্গোল সৈন্যকে বিদ্রোহের দায়ে একদিনে হত্যা করে খিলজি বাহিনী আর তাদের নারীদের তুলে দেয় বাজারে নিলামে। পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চাদেরকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়।
উপসংহার:
আলাউদ্দিন খিলজি নিঃসন্দেহে একজন কুশলী, ধূর্ত এবং সাহসী যোদ্ধা। যুদ্ধের ময়দানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার অসাধারণ গুণ ছিল তার। যুগের তুলনায় তার যুদ্ধাস্ত্র ছিল আধুনিক এবং হিন্দু রাজারা ছিল ততটাই অনগ্রসর এবং অপ্রস্তুত। আলাউদ্দিন খিলজি মঙ্গোল আক্রমণ থেকে রক্কার জন্য তার নিজের রাজ্য সীমানার চারিদিকে শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করেছিল। বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ এবং মুসলিম ইতিহাসবিদ এখন খিলজির অপরাধকে ঢেকে বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচীকে (বাজারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অপরাধ দমন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা) সামনে এনে তার রিব্র্যান্ডিং করতে মরিয়া। ৭১২ সাল থেকে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সুলতানি শাসনামলে ভারতের ইতিহাসে হিন্দুদের উপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার, গণহত্যা, মন্দির ভাঙচুর এবং লুটের ঘটনা ঘটে। তবে মাহমুদ গজনি, মুহম্মদ ঘুরি, কুতুবুদ্দিন আইবেক, আওরঙ্গজেব, বাবর, আলাউদ্দিন খিলজি ইত্যাদি মুসলিম শাসকদের মধ্যে কে বেশি হত্যা করেছে তার পুরো ফিরিস্তি জানতে গবেষণা এবং ইতিহাসের নিরপেক্ষ পাঠ জরুরি।
Reference:
“Tarikh-i Firishta” by Muhammad Qasim Shah
“A Social History of the Deccan” quoted from ‘The History of India as Told by Its Own Historians” by Henry Miers Elliot
“Fatawah-i-Jahandari” by Ziauddin Barani ( He was court historian of Muhammad bin Tughlaq)
“India Before Europe” (page 40) by co-authored Catherine B. Asher (she is specialist in Islamic and Indian art from 1200 to the present) and Cynthia Talbot (medieval Indian history expert)
“The Legacy of Muslim Rule in India” by Kishori Lal Sharon
“History of the Khaljis” by Kishori Lal Sharon
“Khaza’in ul-Futuh” by Amir Khusrau Dihlavi (in ‘The Campaigns of Alauddin Khilji’ chapter) Amir Khusrau Dihlavi was Sufi musician, Islami Scholar and court poet of Alauddin Khilji.
“Tarikh-i-Wassaf” by Abdallah ibn Faḍlallah Sharaf al-Din Shirazi
“The Legacy of Jihad: Islamic Holy War and the Fate of Non-Muslims” by Andrew Boston
“Nabhi-Nandana-Jinoddhara-Prabandha” by Jain scholar Kakka Suri
“Annals and Antiquities of Rajasthan the Central and Western Rajput States” by Colonel James Todd and edited by Willam Crooke.
“The Story of Islamic Imperialism in India” by Sita Ram Goel
“India in the Persianate Age: 1000-1765” by Richard Maxell Eaton
বিশদে না জানলেও বলব যে আলাউদ্দিনই শুধু না , তুর্কি আফগান শাসন ভারতের এক কালো ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই না। আর আলাউদ্দিন এক রকম বর্বর ই ছিল , আর যতদূর শুনেছি শেষ বয়সে আলাউদ্দিন তার কুকর্মের শাস্তি পেয়েছিলেন, মালিক কাফুরের হাতের পুতুল হয়ে গিয়ে, মালিক কাফুরের আগ্রহ ছিল সম্পদ এক করা রাজত্ব নয় আর তাতেই ফেসেছিলেন শেষ পর্যন্ত আলাউদ্দিন খিলজি।
তুর্কি আফগান শাসন নিয়ে সম্রাট আকবর নিজেই বলেছিলেন ” এই দেশের আগের শাসক গন আকণ্ঠ মধু পান করে স্থানিয় মানুষের মুখে বিষ তুলে দিয়েছিল”। যাই হোক লেখাটার জন্য ধন্যবাদ ।
১
বীভত্স যুদ্ধ, লুণ্ঠন আর গনহত্যা ইতিহাস!
তবে এর সাথে অহেতুক বামপন্থার গুষ্টি উদ্ধার অপ্রসঙ্গ ও হাস্যকর লেগেছে।
২
বখতিয়ার খিলজি এখনো এদেশে অল্প বিদ্যার মোল্লাদের কাছে জেহাদের খোয়াব, লেখায় এর উল্লেখ কিছুটা প্রাসঙ্গিক হতে পারতো।
৩
এই খোপে জামাতি তালেবান কবির কবিতাটিও থাক :
~
বখতিয়ারের ঘোড়া / আল মাহমুদ
মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।
জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।
যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,
যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,
মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি;
বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে।
আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।
না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।
বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো
বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি
হাতে নাংগা তলোয়ার।
মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে
নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।
কোথায় সে বালক?
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
ভাইয়া, বখতিয়ার খিলজি নিয়ে আলাদা আরেকটা পর্ব আছে।
এসব মন খারাপ করা লেখা কি না লিখলেই নয়!!
তাতে ইতিহাস কি মুছে যাবে? ইতিহাস তুলে ধরা একজন সচেতন মানুষের দায়িত্ব।
ভারত যদি আগ থেকেই হিন্দুদের হাতে থাকত তাহলে আজো স্বামীর চিতায় স্ত্রী জীবন্ত ঝাপ দিতে বাধ্য থাকত
ঠিক বলেছেন