শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে উদ্ভাবন করেন ‘মুনীর অপটিমা‘ নামে বাংলা ভাষার টাইপরাইটার। ছাপাখানার বাইরে সেই প্রথম প্রযুক্তির সূত্রে বাংলা পেল নতুন গতি। স্বাধীনতার পর ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারেও যুক্ত হয় বাংলা। পরে আটের দশকে ‘বিজয়‘ সফটওয়্যার ব্যবহার করে সম্ভব হয় কম্পিউটারেই বাংলা লেখা। আর ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ মুক্ত সফটওয়্যার ‘অভ্র‘ উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এক নবযাত্রা।
আন্তর্জাতিক বর্ণ সংকেতায়ন বা ইউনিকোডে বাংলা বর্ণলিপি যুক্ত হওয়ায় ‘অভ্র‘ ফন্টে সম্ভব হয় ইন্টারনেটে বাংলায় লেখালেখিসহ বাংলায় ওয়েবসাইট নির্মাণ। একই সঙ্গে অফলাইনে বাংলার প্রসার বাড়ে এই সফটওয়্যারে। কম্পিউটারে বাংলা লেখার সুযোগ সৃষ্টি মুদ্রনশিল্পেও এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন।
‘অভ্র‘ উদ্ভাবন করেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান। মেহেদী, রিফাতুন্নবি, তানভিন ইসলাম সিয়াম, রাইয়ান কামাল, শাবাব মুস্তফা, নিপুণ হক- এই কয়েক বন্ধু সেই থেকে ‘অভ্র’র উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে কাজ করছেন। ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’- এই স্লোগানে ‘অভ্র’র সম্মুখযাত্রা শুরু। এর সমস্ত সংস্করণ ওয়েবসাইট [omicronlab.com] থেকে বিনা মূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারকারীর সুযোগ রয়েছে অভ্র, প্রভাত বা ফনেটিক কি-বোর্ড বাছাই করার। এমনকি যিনি কম্পিউটারে বাংলা লিখতে অভ্যস্ত নন, তিনিও অন্তত কিছু বাক্য অভ্রতে লিখতে পারবেন ডিজিটাল কি-বোর্ড থেকে মাউস দিয়ে।
কয়েক বছর আগে অভ্রতে ফনেটিক ভার্সন যুক্ত হওয়ায় বাংলা টাইপিং হয়েছে আরো সহজ। রোমান হরফে বাংলা কথাটি টাইপ করলে ফনেটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটি পরিণত হবে বাংলায়। অভ্র ফনেটিক অনলাইন ও অফলাইনে সমান সক্রিয়। এ ছাড়া অভ্রর কোডাররা উদ্ভাবন করেছেন বহনযোগ্য সফটওয়্যার ভার্সন। মুক্ত জ্ঞানকোষ বাংলা উইকিপিডিয়া, সংবাদপত্র, নিউজ পোর্টালসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সার্চ ইঞ্জিনে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে এই ফনেটিক অপশন।
ইউনিকোডে বাংলা যুক্ত হওয়ায় ইন্টারনেটে দ্রুত প্রসার হচ্ছে বাংলার। অভ্র’ ও উইন্ডোজ সেভেন এই কাজকে করেছে আরো সহজ। আর কম্পিউটারের উইন্ডোজ সেভেন ভার্সন থেকে শুরু করে পরের সবগুলো ভার্সনে বাংলা দেখার জন্য আলাদাভাবে প্রয়োজন নেই বাংলা কনফিগারেশনের। এ ছাড়া ব্রাউজিং সফটওয়্যার ফায়ারফক্সেও এখন যুক্ত হয়েছে অভ্র’। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার থেকে তো বটেই, এমনকি মোবাইল ফোনেও সম্ভব হয়েছে বাংলায় লেখাপড়ার কাজ।
অভ্র সফটওয়্যারে ইউনিকোড ব্যবহার করে সহজেই ই-মেইল, ডিজিটাল সংবাদপত্র, নিউজ পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, বাংলা ব্লগসহ সব সাইটেই বাংলায় চলছে লেখাপড়ার কাজ। ওপার বাংলাসহ সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে মহান একুশের গৌরবগাথা। এ কারণে অভ্রকে অনেকেই বলছেন ইন্টারনেটে বাংলা ব্যবহারের মাইলফলক। উবুন্টু লিনাক্স, উইন্ডোজের সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলা ব্যবহারের।
বেশ কয়েক বছর হলো শুরু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়েবসাইট গুগল ও ফেসবুকের বাংলা সংস্করণ। সার্চ ইঞ্জিনের পাশাপাশি গুগলের সব কটি ওয়েবসাইট পরিষেবায় বিশ্বের ৬৫টি ভাষার মধ্যে স্থান পেয়েছে বাংলা ভাষা। ফনেটিকে গুগলেও এখন বাংলায় লেখা সম্ভব হচ্ছে। গুগল ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে করা যাচ্ছে বিদেশি ভাষার বঙ্গানুবাদ। তবে এখনো তা অনেকটাই যান্ত্রিক।
‘অভ্র‘র পরে বাংলাদেশে ‘বিজয় বায়ান্ন‘, ‘বিজয় একুশে‘ এবং ‘বিজয় একাত্তর‘ নিয়ে এসেছে বাংলা ইউনিকোড ফন্ট। এসব ফন্টের কি-বোর্ড পুরোপুরি ‘বিজয়‘ টাইপিং সফটওয়্যারনির্ভর। ফলে যাঁরা কম্পিউটারে লেখালেখিতে বিজয় কি-বোর্ডে অভ্যস্ত তাঁরা এটি সহজেই ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া ‘আকাশ নর্মাল‘ ‘অপর্ণা লোহিত‘ ‘বাংলা‘ ‘গোধূলি‘ ‘মহুয়া‘, ‘মুক্তি‘, ‘সোলায়মানলিপি‘সহ ডজনখানেক ইউনিকোড ফন্ট উদ্ভাবিত হয়েছে বাংলায়।
তবে বাংলা ইউনিকোড ফন্ট অভ্র বা বিজয় (সুতন্বী ওএমজে) বা অন্যান্য কোনোটিই মূদণের জন্য দৃষ্টিবান্ধব নয়। কারণ ছাপার পরে এগুলো মোটা হরফে দেখায়, একেকটি অক্ষর প্রচুর কালি ধরে।
এই বাধা দূর করতে লেখক-প্রকাশকরা কনভার্টার ব্যবহার করে ইউনিকোডে লেখা বাংলা পাণ্ডুলিপি মূদ্রণযোগ্য ফন্ট বিজয়- সুতন্বী এমজে‘তে রূপান্তর করে কাজ চালাতেন। বিজয়- সুতন্বী এমজে ইউনিকোড ফন্ট নয়, হালকা-পাতলা গড়নের একেকটি অক্ষর মূদ্রণের জন্য বেশ উপযোগি। তবে কনভার্ট করতে পুরো লেখার বেশকিছু অংশ প্রায়ই ভেঙেচুরে যায়। তখন ধৈর্য ধরে সেসব আবার পুনর্লিখন করতে হয়। বই ছাপার ক্ষেত্রে বিষয়টি পরিশ্রম ও সময়-সাপেক্ষ।
সম্প্রতি এই বাধা দূর হয়েছে ‘কালপুরুষ‘ নামে ইউনিকোড ফন্ট উদ্ভাবনে। এটি ইউনিকোড হলেও হালকা-পাতলা ও দৃষ্টি নন্দন বলে এই ফন্টেই এখন প্রকাশকরা বই ছাপছেন। যে কোনো ফন্টে লেখাপত্র সহজেই কালপুরুষে রূপান্তর করা যায়, লেখাও ভেঙেচুরে যায় না।
অভ্রর অন্যতম উদ্ভাবক ডা. মেহেদী হাসান খান এই লেখককে জানিয়েছেন, তাদের কোডাররা এখন অভ্রর নতুন নতুন ভার্সন নিয়ে কাজ করছেন। তারা চেষ্টা করছেন বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যারে অভ্রকে আরো বেশি ব্যবহারবান্ধব করে তুলতে।
অভ্র না থাকলে সোশ্যাল মিডিয়াতে ও ব্লগে এত মানুষ বাংলা অক্ষরে বাংলা লিখতে পারত না। বাংলা ভাষার অস্তিত্বকে দীর্ঘায়ু করে রাখার জন্য অভ্র’র উদ্ভাবক মেহেদী হাসান খানের কাছে বাঙালি কৃতজ্ঞ।
ধন্যবাদ অভ্র টিমকে যারা প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে সহজতর করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকওে ধন্যবাদ।
পড়ে খুবই ভালো লাগলো। আমি লেখায় সবসময় অভ্র ব্যবহার করি…। অভ্রতে দ্রুত লেখা যায়… অভ্রের জন্য শুভকামনা…।
আপনার জন্যও শুভ কামনা, পাঠক।