আমাদের বহু রক্তমূল্যে কেনা স্বদেশ আজ যে অপরাধের স্বর্গরাজ্য একমাত্র দলকানা ও বিবেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ তা অস্বীকার করবে না। দুর্নীতি যে সর্বগ্রাসী তা আজ বলাই বাহুল্য। অপরাধের মধ্যে খুন, গুম, ছিনতাই, ধর্ষণ ইত্যাদি আজ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেছে।

এ সকল অপরাধের আর্থ-সামাজিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক অনেক কারণ অবশ্যই আছে যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে, কিন্ত সাধারণ মানুষের একটি সাধারণ ধারণা যা যুক্তিগ্রাহ্য রূপে প্রতিভাত হচ্ছে তা হলো অপরাধের শাস্তি থেকে অব্যাহতি তথা বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এ যে অপরাধী সাজা না পাওয়া কিংবা বিচার যথাযথভাবে না হওয়া তথা বিচারহীনতার অনেক কারণ বিদ্যমান-যে বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বিচার পদ্ধতি তথা সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে অনেক কথা বলতে হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা বিদ্যমান। তারপরও কোন অপরাধীকে অপরাধী সাব্যস্ত করার পূর্বেই তাকে তো সাজা প্রদান করা যায় না। যে কোন সভ্য, গণতান্ত্রিক ও আধুনিক সমাজে এটা সম্ভব হতে পারে না ।

কিন্তু বিভিন্ন অপরাধে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ সঙ্গত কারণেই আজ বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাই তারা বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতা সহ্য করতে পারছে না বলে তারা অপরাধীর তাৎক্ষণিক শাস্তি কামনা করছে।

হ্যাঁ, অপরাধীর তাৎক্ষণিক শাস্তি কিংবা স্বল্পতম সময়ে শাস্তি সকলেরই কাম্য যা সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্ত সমস্যা হল-কে অপরাধী, যাকে অপরাধী হিসাবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সে সত্যিই অপরাধী কিনা তা নির্ধারণের পূর্বে আমরা কাকে শাস্তি দিব, কিভাবে দিব?

একটি বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া তা কিভাবে সম্ভব? তবে হ্যাঁ, আমাদের দেশে বিদ্যমান ঔপনিবেশিক আমলের বিচার পদ্ধতিকে আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। আমাদের পদ্ধতিগত আইনগুলোকে (Procedural code, evidence Act) আরো সহজ ও জটিলতামুক্ত করতে হবে। তবে কোন নিরাপরাধ মানুষ যাতে শা্স্তি না পায়, তার শতভাগ নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

আমাদের সমাজেই তো শত সহস্র নজির আছে যে, অপারেশন ক্লিন হার্ট, মাদকবিরোধী অভিযান ও জঙ্গী দমন করতে গিয়ে ক্রস ফায়ারের নামে যে শত সহস্র লোককে মারা হল তারা কি সবাই সত্যিই অপরাধী ছিল? এ প্রশ্নের এখনো মিমাংশা হয়নি। হয়ত কখনো হবে না।

বিনা অপরাধে বছরের পর বছর জেল খেটে পরে নিরাপরাধ সাব্যস্ত হওয়ার নজিরও ভূরি ভূরি আমাদের দেশে ।

আধুনিক বিশ্বে প্রত্যেক দেশের নিজস্ব একটি সংবিধান আছে-লিখিত কিংবা অলিখিত-যার ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হয়।দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সহ দেশ পরিচালনার যাবতীয় মৌলিক বিষয়গুলো দেশের সংবিধানেই লিপিবদ্ধ থাকে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধানের বাহিরে গিয়ে দেশ পরিচালনার কোন সুযোগ থাকে না।

আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬ নং অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭ নং অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ আছে।

২৭ নং অনুচ্ছেদে আছে আইনের দৃষ্টিতে সমতা-সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

৩১ নং অনুচ্ছেদে আছে-আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার-আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইন আনুযায়ী এবং কেবল আইন আনুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।

৩২ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে-জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ-আইন আনুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।

আমাদের সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদে আছে:

(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এ সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।

(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এ সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।

সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলো যদি আমরা একত্রে মনোযোগ দিয়ে পড়ি, তাহলে সহজে বোধগম্য হবে যে, সংবিধানের নির্দেশনার বাহিরে যেমন কোন কাজ করার সুযোগ নেই, তেমনি সংবিধানের আইনের সাথে অসামঞ্জস্য কোন আইন পাশ করার এখতিয়ারও সংসদের নেই।

আমাদের সাংসদগণ নির্বাচন-উত্তর যখন সাংসদ হিসাবে শপথ নেন, তখন তারা দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেন (অবশ্য অনির্বাচিত হয়েও যারা শপথ নেন, তাদের শপথে উচ্চারিত অঙ্গীকারের কোন মূল্য আছে কিনা আমার জানা নেই)। সে সাংসদেরই যখন খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে সংবিধান পরিপন্থী বিচারের দাবী তুলেন-তখন তাদের সংসদ সদস্য পদ থাকে কিনা সে প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বটে।

বিষয়টি আমাদের নিদারুণ ভাবে শঙ্কিত ও হতাশ করে।

হতাশ এ কথা ভেবে যে এরাই আমাদের সাংসদ? এদের হাতেই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা? এরাই আমাদের সংবিধানকে রক্ষা করবে? দেশে আইনের শাসন কায়েম করবে?

আর শঙ্কিত এ কথা ভেবে যে, এ সাংসদেরা দেশকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবেন? বিংশ শতাব্দীর এ যুগে এসে আমাদের দেশে কি আবার ৫০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের রাজা হাম্বুরাবীর শাসন চালু হবে?

একজন জ্যেষ্ঠ সাংসদ যখন বললেন-ধর্ষণকারীদের ক্রস ফায়ারে দিতে হবে। আরেক সাংসদ তাকে সমর্থন করে বললেন-কোন আইন করার দরকার নেই-পুলিশ এখন যেভাবে করছে, সেইভাবেই ক্রস ফায়ার চলতে পারে। আরও একজন সাংসদ, নিজেই তার দাঁড়ি-টুপির দোহাই দিয়ে ফতোয়া দিয়ে ফেললেন-ধর্ষণকারীদের যে ক্রস ফায়ার করবে সে নাকি বেহেস্তে যাবে।হায় আল্লাহ!

উপরোক্ত সাংসদদের বক্তব্যের বিরোধীতা কোন সাংসদই করলেন না। তাহলে বিচার বিভাগের আর কি কোন প্রয়োজন আছে? সব উঠিয়ে দিলেই ত হয।আমাদের বিদগ্ধ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই তো দেশের সার্বিক বিচার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া যায়। তাতে বৎসরে সহস্র কোটি টাকার সাশ্রয় হবে বৈকি।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতার জন্য দেশে যে আদালতের সংখ্যা অপ্রতুল, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নেই, বছরের পর বছর বিভিন্ন আদালত বিচারক শূণ্য হয়ে আছে এ সমস্ত বিষয় আমাদের মাননীয় আইন প্রণেতাদের দৃষ্টিগোচর হল না । তারা সমাধান খুঁজছেন ক্রস ফায়ারের মাধ্যমে।বাহ্ বেশ!

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে এ যদি হয় আমাদের সাংসদদের জ্ঞান ও মূল্যবোধের নমুনা, তখন আক্ষেপ করতেই হয়-এ বাংলাদেশের জন্যই কি আমারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম !