লিখেছেন: শীলা মোস্তাফা, এলিসো ভিয়েও, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে:
কিন্তু কিছু কিছু সময় নিজেকে বড় বেমানান মনে হয়, আবার কখনো কখনো নির্দয়। যেমন গতকাল কর্মস্থলে যেখানে ৯৯.৯৯% ই অমুসলিম। আমার সহযোগী সহকর্মীকে বললাম,
-“যাও তুমি তোমার ব্রেক নিয়ে নাও আমি মিটিঙে যাওয়ার আগে।” সে হেসে উত্তর দিল,
-“ আমি ব্রেকে যেয়ে কি করবো?” আমি বললাম,
-“এটা তো তোমার ব্রেকফাস্ট ব্রেক, ব্রেকফাস্ট করে এসো”।
মেয়েটি পাকিস্তানী আমেরিকান, কাজে কর্মে খুবই স্মার্ট, খুব সুন্দর করে মাথায় চুল ঢাকা কাপড় দিয়ে, আমাদের বাংলাদেশী নব্য হিজাবিদের মত মাথা শাড়িতে পেঁচিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় বানানোর চেষ্টা নেই। মিষ্টি হেসে উত্তর দিল
-“ শীলা, আই আম ফাস্টিং!”
আমি লজ্জা মরে যাচ্ছিলাম।
-“ওহ, তুমি তো ১২ ঘণ্টা শিফট করছো আমার সাথে। বাসায় যেতে যেতে ১৩ ঘণ্টা, আগে বলবে তো।”
মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগল। হাসপাতালের এই ব্যস্ততায় মেয়েটা টিকবে কি করে! দুপুরের পর জোর করে পাঠালাম ‘নীরব রুমে’!
-“যাও একটু ঘুমিয়ে নাও”।
হাসপাতালে নার্সদের জন্য নীরব রুমে আছে, আমাদের স্ট্রেসফুল দিনগুলিতে মেসুজ এসে মেসাজ দেয়, কিংবা কোন নার্স যদি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় তখন থেরাপিস্ট এসে কথা বলে, কিংবা শুধুই নিজের মত ব্রেক নিতে চাইলে ওই নীরব রুমে যাওয়া যায়।
আমি নিজেকে কখনো আস্তিক বা নাস্তিক বলে সংজ্ঞায়িত করি না। কারণ আমি সত্যি জানি না আল্লাহ, খোদা, ভগবান, ঈশ্বর, প্রভু বলে সত্যি কেউ আছেন কিনা। যদি না থাকে তাহলে জীবনের মত বিস্ময় কে সৃষ্টি করল, মনের রহস্য কি করে হল! আর যদি থাকেন, তিনি বা তারা কোথায় থাকেন, কে তাকে/তাদের বানাল? মানুষের মত পশু পাখি, জীব জন্তুরও কি ধর্ম আছে? তাদেরও কি বেহেস্ত দোযক আছে? আমাদের আল্লাহের মত কি আরেকজন হিন্দুদের ভগবান আর খ্রিষ্টানদের প্রভু আছেন? এমন আর কত জন আছেন? তারা কি সংখ্যায় অধিক? অধিক হওয়াই স্বাভাবিক, এতো সব ধর্মের এতো লোক এতো সব ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের ঈশ্বরকে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই তারা আমার মত সীমিত মস্তিষ্ক, সীমিত বিদ্যা নিয়ে তা প্রমাণ করছেন না। যদি একাধিক ধর্মের একাধিক গড থাকেন তারা কি আমাদের মত ইজরাইল প্যালেস্টাইন নিয়ে যুদ্ধ করছেন? ইয়েমেনের হাড্ডিসার ক্ষুধার্ত শিশুদের যন্ত্রণার কথা দেখছেন নাকে সৌদিদের সাপোর্ট করছেন ? তারাও কি আমার ধর্ম সবার সেরা বলে গায়ে বোমা লাগিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন, নিদেনপক্ষে নিজের আত্ম অহংকারে অন্যকে ছোট করছে? হানাহানি করছে? রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে? জানি না। তারা কি করেন যখন একটা নিষ্পাপ ছোট শিশুকে ধর্ষণ করে পিঁপড়ের মত মেরে ফেলা হয়। মাদ্রাসার ছোট ছেলেটা দিনের পর দিন বলাৎকার হয়? এই সব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে জীবনের অনেকটা সময় নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ইদানীং মানুষ কেন যেন আর মানুষ নেই, সবাই হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান হয়ে গেছি। আমরা মানুষ হয়ে আর মানবিক হওয়ার চেষ্টা করি না বরং ধার্মিক হয়ে আরও নিজেদের গণ্ডি ছোট করে আনছি। একটা ছোট উদাহরন: ‘সুবীর নন্দি মারা গেছেন’। ফেসবুকে খবরটা পেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল, পোস্টটার নিচের একটা কমেন্টে চোখ আটকে গেল। “ মালোয়ান মরছে তাতে ………” মালোয়ান! একটা মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছি। ও তাই সুবীর নন্দি হিন্দু ছিলেন। এই মাত্র জানলাম, আর তিনি যদি আমার মত ধার্মিক হন তাহলে তার নামের শেষ টাই তার একমাত্র পরিচয় কিংবা আদৌ পরিচয় কিনা ভাবতে হবে। তিনি একজন শিল্পী ছিলেন, তার চলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গীতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
মুসলমানের ঘরে জন্মেছি বলেই আমি মুসলমান আর আমি সৃষ্টির সেরা আর সবাই দোজখে যাবে আর কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেনের মত ভাজা ভাজা হবে এটা তো মেনে নিতে পারি না। অন্য ধর্ম বিশ্বাসী বলে তাদের কোন ভাল কাজের মূল্যায়ন হবে না! এটা কোন সুস্থ চিন্তার স্বাভাবিক মানুষ ভাবে কি করে? আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মটা জানার চেষ্টা যে করি নি তা কিন্তু নয়। ছোট বেলায় বাবা মা, বাসায় হুজুর রেখে দিয়েছেন। তাঁদের কর্তব্যে কোন অবহেলা ছিল না। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে তার পাশাপাশি স্কুলে পাঠিয়েছেন, কতসব বই পড়তে উৎসাহী করেছেন। আর বোকার মত মাথাটা কত প্রশ্ন করতে শুরু করলো। কোরান শরিফ পড়ছি অন্ধের মত। গা হেলিয়ে দুলিয়ে, সুর করে পড়েও এক বিন্দু অর্থ বুঝলাম না। কি আশ্চর্য, কেন পড়ছি না বুঝে? বুঝে পড়তে চাইলাম বাংলাতে, ইংরেজিতে, অথচ কোন মানে খুঁজে পেলাম না, মজা পেলাম না, তাই কোরান শরিফ পড়ার সেখানেই ইতি। পড়াশুনা করেছি, যুক্তিতর্ক ছাড়া কিছু কেন মেনে নেব? যা মেনে নিলাম, বুঝলাম, তা হচ্ছে একটা সময় ছিল বর্বর, যখন আইন শৃঙ্খলার প্রয়োজনে, সমাজের প্রয়োজনে ধর্মটা প্রয়োজন ছিল। এখন কেন দরকার? জানি না। যার সেই আশ্রয়টা এখনো দরকার সে করুক আমার তাতে একদম আপত্তি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা না হয়। আশা ছিল এক সময় মানুষ, সমাজ, দেশ ধর্মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে বিজ্ঞান আর আইনের শাসনে আস্থা রাখবে। কিন্তু তা হয়নি বরং তার উল্টোটা হচ্ছে। কিন্তু ধর্ম পালন তো শুধু নামায আর কোরান শিক্ষা নয়। অন্ধের মত মন্ত্র পড়ে উঠবস করা নয়। তার চেয়ে বড় কিছু। নিজের বিবেককে জাগ্রত রাখা, সচেতন ভাবে নিজের আদর্শকে অনুসরণ করা। তা নয় কি? মানুষেকে, মানুষের ভাবনাকে দু’হাত দিয়ে বরণ করা। আমরা কি তা করি? না, তা কেন করব? আমরা পণ করেছি, “ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে জানিনে শুধু তোমারে জানি!” সব প্রেমিক পুরুষ। ধর্ষকদের মহারাজ্যে আবার ধর্ম অধর্ম।
আমি সারা দিন না খেয়ে থাকার কোন কারণ খুঁজে পাই না তাই রোজা রাখি না।আমার না খাওয়া খাদ্য যদি ইমেনের এটা শিশুরও ক্ষুধা নিবারণ করতো তাহলে একটা যুক্তি ছিল। এখন যদি রোজা রাখি তা শুধু রাখবো গিল্টি ফ্রি ইফতার করার জন্য। আহা রুয়াফযার শরবত বেগুনি আর পেঁয়াজু। আহা হালিম। তবে আমি সব ধর্মের কালচারটা খুব এঞ্জয় করি। এই যেমন শবে-বরাতের রাতে সবার বাড়ী বাড়ী হালুয়া রুটি বিলানো। পূজায় মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে কিত্তন শোনা, মিঠাই মণ্ডা খাওয়া। ক্রিসমাসে উপহার দেয়া পাওয়া। অনেক বছর পর দেশে যেয়ে দেখলাম, এখন শবে-বরাতে আর হালুয়া রুটি বিলায় না, পূজার সময় মন্দিরে মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গার মহাউৎসব হয়। দেশে এখন ধর্ম চর্চা বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্ষণ, বলাৎকার, শিশু হত্যা। এসব কাজ ধার্মিকরাই করেন ধর্মের লেবাসে। কারণ তারা দাঁড়ি রাখেন, ইয়া লম্বা জুব্বা পড়েন, নূরানি চেহারা। আমরা আমাদের সন্তানদের তাদের হাতে সঁপে দেই। আমাদের পরকালে বেহেস্তের রাস্তা লাগুনা বিচের প্রশান্ত সমুদ্র সৈকতের পাশ দিয়ে যাওয়া ১০১ সাউথের মত মসৃণ করতে বলিদান হয় আমাদের নিষ্পাপ সন্তানেরা। আর কত? দেশে ধার্মিক আছে ধর্ম নেই, সরকার আছে বিচার নেই। উন্নয়নের মহাসড়কে জুড়ে ধর্ষিত শিশুদের মুখ, না মুখ নয়, তাদের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত যনি, গুহ্যদ্বার, নিষ্পাপ শরীরে প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে বিচারবিহীন রাজত্বের চিৎকার।
মনের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেছেন , চমৎকার ভাবে । লিখতে পারার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।
জীবন যাপন করার আপনি যে পদ্ধতি অনুসরণ করছেন এবং সকলের অনুসরণ কামনা করছেন তা নিশ্চিত ভাবেই উন্নত । কিন্তু আপনার মতো চিন্তাধারার কয় জন মানুষ “আধুনিক সভ্যতা” সমাজকে উপহার দিয়েছে ? হাতে গোনা যাবে , আমি নিশ্চিত আমেরিকার মতো দেশেও । যাইহোক এটার উপর নির্ভর করে মানুষের কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাচীন পদ্ধতি গুলো (ধর্ম) কে ধান্দাবাজ,ভন্ড,বাজে শাষক, সন্ত্রাসী রাষ্ট্র , এদের হাতে তুলে দিয়ে আপনার আমার মতো নৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন মানুষরা হয়তো ভুল ই করছি ।
খুব ভালো লেখা।
রোজা মানে আপনি বোঝেন উপোস থাকা,
আর মোমেন বোঝে বিরত থাকা…
কি হতে বিরত থাকবেন….!!!
আপনি আপনার লেখায় যত কুকর্মের ফিরিস্তি দিয়েছেন সে সকল কুকর্ম হতে….
আপনার লেখা পড়ে মনে হল আমার নিজের কথাগুলোই যেন পড়ছি।দেশে থাকতে রমজান মাস আসলেই মনে হত এক মাসের জন্য মুসলমানহীন কোনে দেশে চলে যাই।আমেরিকা আসার পর ভেবেছিলাম সেই মানসিক টর্চার থেকে মুক্তি পাব কিন্তু বাস্তবে দেখছি কিছুই বদলায়নি।পরিবারের সবাই রোজা।কর্মস্থলের সবাই রোজা।কারো সাথে দেখা হলেই প্রথম প্রশ্ন-কেমন যাচ্ছে রোজা?যেন পৃথিবীতে একটাই ঘটনা এখন রোজা আর রোজা।রেখে ঢেকে লুকিয়ে চাপিয়ে খাওয়া আমি পছন্দ করিনা।প্রকাশ্যেই খাই।বুঝতে পারি আড়ালে সবাই আমার সমালোচনা করে।মহিলারা করে বেশি।চক্ষুলজ্জার কারণে ‘রোজা রাখিনা’ না বলে ‘রাখতে পারিনা’ বলি।এ টুকু মিথ্যাচারের জন্যও নিজের কাছে নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়।এ কেমন ধর্মাচার?
ধন্যবাদ। নামাজ কিন্তু সবাই পড়ে না কিন্তু এটা নিয়ে অপরাধবোধে তেমন দেখা যায় না। বা নামাজ নিয়ে বুলিং করতেও তেমন দেখা যায় না। কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে রোজা রাখার মধ্যে একটা প্রাইড কাজ করে সাথে সাথে অন্যকে বুলিং করাও চলে, এবং মেয়েদের মধ্যে এটা বেশী চোখে পড়ে।মানুষ যতটা মন থেকে ধর্ম মানে তার চেয়ে বেশি মানে সমাজের ভয়ে।
রোজার মর্যাদা আলাদা,
মহান আল্লাহ নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেবেন।
অনেক সুন্দর ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করেছেন কিন্তু আমার কিছু বলার আছে
আমি একটা মেয়েকে চিনি ঠিক আপনার মতই চিন্তাধারা, ওর বড় বোন আমার বন্ধু ছিল সেই সুবাদে ওর সাথে আমার ভালোই সখ্যতা। দেশে একটা হিন্দু ছেলের সাথে প্রেম তারপর ঢকায় রজেস্ট্রি বিয়ে করে দুজনেই লন্ডন চলে আসে স্টুডেন্ট ভিসায় এতদুর পর্যন্ত সব ঠিকই ছিলো যে যার ধর্ম।
সংসারে একটা ছেলে সন্তান আসার পরই কেমন যেন বদলে গেলো সবকিছু ছেলের পদবি নিয়ে। অত:পর ওর স্বামিকে মুসলিম হতে হলো তবে মেয়েটি এখনোও প্রগতিশীল আছে নামাজরোজা কোন কিছুতেই ততটা মনযোগী নয় । আচ্ছা! এর মানে কি হলো?
very confusing situation.মেয়েটির যদি প্রগতিশীল হয়ে থাকে তাহলে স্বামীকে কেন ধর্মান্তর করালো।
মুক্তমনা’য় স্বাগতম শীলা মোস্তফা।
মনে হল যেন মুক্ত মনের একজন স্বাভাবিক মানুষ নির্মোহ ও সংশয়ী দৃষ্টিতে সহজ সরল করে ভেবেছে। প্রশ্ন তুলেছে উত্তরের জন্য।
আশা করব উত্তরগুলো খুঁজে পাবার জন্য সক্রিয় ভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এই কুঁকড়ে থাকা সময়ে কেউ মন খুলে যুক্তির প্রশ্ন তুলেছে দেখে খুব ভাল লাগলো। এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত আরো বেড়ে চলুক।
আরো লিখুন।
আপনাকে ধন্যবাদ 🙂
আপনি ধার্মিক হলে প্রশ্ন করবেন না। অন্তত সব ধর্মই তাই বলে।
মুক্তমনায় স্বাগতম। 🌷
ধন্যবাদ বিপ্লব। রিলিজিয়াস আর স্পিরিচুয়ালিটির মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি কোন প্রথাগত রিলিজিয়ান এ বিশ্বাস করি না। I am exploring spirituality.
স্পিরিচুয়ালিটি? ইহা হয় কী বস্তু, শীলা? ঈশ্বর বিশ্বাস করলে ভুত প্রেত জ্বীনও বিশ্বাস করতে হয়…
ধর্মে থাকলে জিরাফে থাকা চলে না! এটা যুক্তির কথা,ভাববাদের জায়গা নাই.