(পর্ব-১)
নদীর পাশে একটা বাংলোর ছাদে, উপুড় হয়ে শুয়ে, আকাশের তাঁরা দেখতে দেখতে যেই অনুভূতিটার সৃষ্টি হয় তার নাম আমি জানি না। শুধু এই সময়টার জন্য অনুভব করতে পারছি। দূরের একটা তাঁরা জ্বলছে আর নিভছে, জ্বলছে আর নিভছে। তাঁরাটির নাম অরুন্ধতি। তার পাশের বড় তাঁরাটির নাম বশিষ্ঠ। সপ্তর্ষি মন্ডলের অন্যতম এক সদস্য। অরুন্ধতি ছিল বশিষ্ঠের স্ত্রী। বশিষ্ঠের মতন সাতজন ঋষির এই সপ্তর্ষিমন্ডলটা ধ্রুবতারার চারিপাশে ঘুরছে। আমি সেই ঘুর্নন অনুভব করি না, বুঝতেও পারি না। শুধু মহাকালই সেই ঘুর্নন বুঝতে পারে।
আকাশের তাঁরাগুলো সবাই ধেয়ে চলে। যতই রাত গভীর হয় পূর্ব থেকে ততই পশ্চিম আকাশের দিকে হেলে পড়ে। ঋতু পালটায় তো তাঁরার অবস্থানও পাল্টায়। পালটে যায় না শুধু সেই ধ্রুবতারাটি। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। কী উদ্দেশ্য তার এই স্থবিরতার তা নিয়ে আমি বড়ই চিন্তিত থাকতাম কোন একটা সময়। প্রায়শই ভাবতাম এটা কেন এমন ভাবগম্ভীর হয়ে আছে, কাছের মানুষজন হারিয়ে পাথর হয়ে যাওয়া মালীটার মতন। কিন্তু পরে জানলাম এই ধ্রুবতারাও ধ্রুব নয়। আমার মতন শতকোটি মানুষের জীবনকাল পেরিয়ে যাবে ধ্রুব তাঁরার চলে যাওয়া দেখতে হলে। শুধু মহাকালই সেই ইতিহাসের সাক্ষী। যেইদিন জানলাম ধ্রব তাঁরাও পালটে যায়, সেইদিন কেন জানি না খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। খুব!
দোতলা এই বাংলোটায় মানুষ বলতে শুধু আমি আর অরুন্ধতিই থাকি, আমার স্ত্রী অরুন্ধতি। তবে আমি বশিষ্ঠ নই। মহাভারতের মতন মহাকালের অন্তরে অন্তরেও যে বশিষ্ঠই অরুন্ধতির স্ত্রী হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। কারন কোন কিছুই তো ধ্রুব নয়। ধ্রুবতাঁরাও ধ্রুব নয়।
এই বাংলোটায় আর একজনও আছেন আমাদের সাথে। বাগানের মালী। তাকে পুরোপুরি মানুষ বলা যায় না। কখনও সে মানুষ আবার কখনোবা একটা পাথরের তৈরি জড়বস্তু।
তাঁরা দেখার ফাঁকেই হটাত অরুন্ধতী এসে আমার পাশে বিছানো পাটিটাতে শুয়ে শুয়ে আকাশের তাঁরা দেখতে লাগল।
আমি বললাম, অরুন্ধতি, বশিষ্ঠের পাশেই থাকে যেন সবসময়।
অরুন্ধতি বলল, তুমি জানো? আমি তাঁরাদের কথা খুব বুঝতে পারি।
আমি বললাম, তারারা কথা বলতে পারে না কি?
– কেন? পারলে কি বিশেষ সমস্যা হয়ে যাবে?
– নাহ, চমৎকার হত। সবাই তাঁরাদের সাথে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রকৃতি কাউকেই সেই ক্ষমতা দেয়নি, কিছু পাগল ছাড়া।
অরুন্ধতী বেশ শক্তমক্ত করে আমাকে একটা চিমটি দিল। এই মেয়ে নতুন করে নখ বড় রাখা শিখেছে। ধারও কম নয় তাতে। ছোটবেলা থেকে শুনেছি নারীজাতি মমতাময়ী হয়। কিন্তু এই মেয়ে এত নৃশংস কেন কে জানে?
অরুন্ধতী আমাকে বলল, অরুন্ধতী, বশিষ্ঠকে কী বলছে জানো?
না জানি না, আর পাগলদের পাগলামি জানতে চাইও না।
ও আমার গলা টিপে বলল, অরুন্ধতী বলছে, দেখ বশিষ্ঠ, অরুন্ধতীর পাশে একটা হতচ্ছারা শুয়ে আছে। হতচ্ছারাটার নাম – অরন্য, আসলে সে জঘন্য।
আমি বললাম- পাবনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই খারাপ, জানো??
অরুন্ধতী পারলে ওর পুরো শক্তি দিয়ে আমার গলা চিপে ধরত। এই মেয়ে সত্যই নৃশংস।
নদীর ঢেউ গুলো তীরে এসে আঘাত করছে। সেই শব্দগুলো যেন ভাষা হয়ে আমার কাছে আসছে। আমি সেই ভাষাগুলোকে হয়ত বুঝতে পারছি হয়তবা পারছি না। অরুন্ধতীকে একলা পাগল বললে বড়সড় অন্যায় হয়ে যাবে। আমিও যে কিঞ্চিত পাগল তাও অস্বীকার করা যাবে না। তবে সেটা অরুন্ধতীকে বুঝতেও দিতে চাই না আমি। নদীর শব্দ, অরুন্ধতীর স্পর্শ, অনন্দনক্ষত্রবীথির এই অনিন্দ্য সাজ আর পাশের বাগান থেকে ভেসে আসা বেলিফুলের গন্ধ- এটাই কী মাহেন্দ্রক্ষণ? আমার পাশে শুয়ে থাকা পাগল মেয়েটা কী এর উত্তর জানে? থাক, জানলে জানুক, পাগলদের কথা বেশি শুনতে হয় না। আমি বরং এখানেই ঘুমিয়ে পড়ি।
হটাত ঘুম ভেঙে গেল আমার। অরূন্ধতী আমার ডান হাতের উপর শুয়ে ছিল। আমি কিছু সময়ের জন্য চোখ খুলে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। এরকম একটা জীবন কী চমৎকার আনন্দের।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমার জন্য এক কাপ চা বানালাম আর অরুন্ধতির জন্য। বেচারিকে ঘুম থেকে ডাকি নি। ওর পাশে চায়ের কাপটা রেখে আমি বেরিয়ে এলাম, পাশের সৃষ্টি গাছটার কারনে রোদ ওর গায়ে লাগবে না। ঘুমাক মেয়েটা। আর চা ঠান্ডা হলেও সমস্যা নেই। ওর কাছে সেটাই বরং বেশি ভাল লাগে।
আজ আমার একটা বই বের হবার কথা ছিল। উপন্যাস।
“আকাশগঙ্গা”। আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা। সেই নাম থেকেই উপন্যাসের নাম রেখেছি আকাশগঙ্গা। যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় মিল্কিওয়ে।
গল্পের নারী চরিত্রের নাম গঙ্গা আর প্রধান চরিত্রের নাম আকাশ। আকাশ আর গঙ্গা মিলে হয় আকাশ গঙ্গা। আকাশের সাথে গঙ্গার প্রথম দেখা হয়েছিল লঞ্চে। রাত্রির বেলা লঞ্চ যখন নিকশ কালো নদীর বুক দিয়ে ধেয়ে চলে তখন নদীর ঢেউ গুলোর মুহুর্মুহু শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। আর একটা শব্দও শোনা যায়। তবে সেটা কখনো সখনো। সবসময় নয়। বাতাসের শো শো শব্দ। গঙ্গা লঞ্চের করিডোর দিয়ে বাতাসে মুখ উলটো করে ছায়াপথের দিকে তাকিয়েছিল। বাতাসে মেয়েটার চুল গুলো খুলে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। হটাত করে গঙ্গা মুখের উপর পানির ঝাপটা অনুভব করে। আকাশ তিন তলার বারান্দা দিয়ে কুলি করে পানি ফেললে সেগুলো এসে গঙ্গার মুখের উপর এসে পড়ে। গঙ্গার পক্ষে চিৎকার করে প্রতিবাদ করার খমতা নেই। সে শক্তপোক্ত মেয়ে নয়। নিতান্তই নরম গোছের মেয়ে। তাই তিন তলায় উঠে সে দেখতে গিয়েছিল কে তার মুখে পানি ফেলেছে। আকাশ তখনো জানত না এভাবে সে কারো মুখে পানি ফেলছিল। আর গঙ্গা নিজেও জানত না পানির উৎস কী?
রিকশা থেকে নামতে গিয়ে আমি একটা হোচট খেলাম। খুবই খারাপ লক্ষন। অরুন্ধতি আজ ঘুমে ছিল বলে দোয়া কালাম পড়ে দেয় নি। তাই এরকম হয়েছে হয়ত। মেয়েটা জেগে থাকলে এই দোয়া কালাম পড়ে আমাকে বড্ড জালাতন করে। আমি যত পারি তাকে ঘুমে রেখে চলে আসি। আচ্ছা ঘুম থেকে উঠে ও আমাকে না দেখে কেমন করে?? কী ভেবে উঠে? বাচ্চা ঘুম থেকে উঠে মা কে না দেখলে যেমন করে অরুন্ধতিও কি সে রকমই করে??
আজকে ওকে কথা দিয়েছিলাম নৌকা করে ঘুরতে বেড়ুব। তাই যত কাজ সব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। রাতের বেলা আমি আর ও নৌকা করে ঘুরব। আমি চালাব আর অরুন্ধতি আমার পাশে বসে গান গাইবে। “নেশা লাগিলো রে বাকা দুই নয়নে নেশা লাগিলো রে” এই গানটা গাইতে বলব ওকে।
(চলবে)
ভালো লেখা । তবে তারা বানান টা দৃষ্টিকটু ভাবে তাঁরা হয়ে আছে
অসাধারণ
ধন্যবাদ আপনাকে
অসাধারণ!! পরের পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম…
ধন্যবাদ আপনাকে। খুব তাড়াতাড়িই পোস্ট করব