১৮৯৭ সালের এপ্রিলে নয় মাস ব্যাপী ইওরোপের বৈজ্ঞানিক মিশন শেষ করে দেশে ফিরে এলেন জগদীশচন্দ্র। ইওরোপে তাঁর বৈজ্ঞানিক সাফল্যের কাহিনি কলকাতার সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইওরোপ জয়ের কাহিনি বাঙালির জন্য তো বটেই, যে কোন ভারতীয়র জন্য গৌরবের। বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করা এই বিজ্ঞানীর সাথে পরিচিত হয়ে অভিনন্দন জানানোর জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিদেশ থেকে ফিরে জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু তখন থাকতেন ধর্মতলা স্ট্রিটে আনন্দমোহন বসুর বাড়িতে। একদিন রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের সাথে দেখা করার জন্য গেলেন সেই বাড়িতে। অভিনন্দন জানানোর জন্য সাথে নিয়ে গেলেন একটি ম্যাগনোলিয়া ফুল। কিন্তু জগদীশচন্দ্র তখন ভীষণ ব্যস্ত, বাড়িতে ছিলেন না সেই সময়। রবীন্দ্রনাথ টেবিলের উপর ম্যাগনোলিয়াটি রেখে চলে আসেন। তারপর তাঁদের দু’জনের মধ্যে পরিচয় কীভাবে গাঢ় হলো এবং কীভাবে তা বন্ধুত্বে পরিণত হলো তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসেব নেই।
জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বের সূচনাকালের নিদর্শন পাওয়া যায় লন্ডন থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখা জগদীশচন্দ্রের চিঠিতে। ১৯০০ সালের ২ নভেম্বর তিনি লিখেছেন:
“তিন বৎসর পূর্বে আমি তোমার নিকট এক প্রকার অপরিচিত ছিলাম। তুমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ডাকিলে। তারপর একটি একটি করিয়া তোমাদের অনেকের স্নেহবন্ধনে আবদ্ধ হইলাম। তোমাদের উৎসাহ-ধ্বনিতে মাতৃস্বর শুনিলাম।”
প্রথমবার দেখা করতে গিয়ে জগদীশচন্দ্রের দেখা পাননি রবীন্দ্রনাথ। দ্বিতীয়বার যখন দেখা করতে যান সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ন’বছরের শিশুপুত্র রথীন্দ্রনাথকে। এ প্রসঙ্গে “আচার্য জগদীশচন্দ্র আমার বাল্যস্মৃতি” প্রবন্ধে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন:
“আমি তখন ন-বছরের শিশু, তবু কেন জানি না, পিতা আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই বন্ধুতে কী কথাবার্তা হয়েছিল তা বুঝতে পারা বা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, এইটুকুই কেবল মনে পড়ে। জগদীশচন্দ্র উচ্ছ্বসিত ভাবে ইওরোপ-ভ্রমণের কাহিনী অনর্গল বলে যাচ্ছেন আর আমার পিতা সাগ্রহে তা শুনছেন এবং মাঝে মাঝে দুজনে মিলে খুব হেসে উঠছেন।”
প্রবাসী পত্রিকায় ১৩৩৩ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখা জগদীশচন্দ্রের চিঠিগুলো যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে তখন তার ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
“সেই তার ধর্মতলার বাসা থেকে আরম্ভ করে আমাদের নির্জন পদ্মাতীর পর্যন্ত বিস্তৃত বন্ধুলীলার ছবি।”
কবি ও বিজ্ঞানীর দুর্লভ মিলনকে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
“চলা আর পথ বাঁধা এই দুই উদ্যোগের সব্যসাচিতায় জীবন ছিল সদাই চঞ্চল। এমন সময়ে জগদীশের সঙ্গে আমার প্রথম মিলন। তিনি তখন চূড়ার উপরে উঠেননি। পূর্ব উদয়াচলের ছায়ার দিক্টা থেকেই ঢালু চড়াই পথে যাত্রা করে চলেছেন, কীর্তি-সূর্য আপন সহস্র কিরণ দিয়ে তাঁর সফলতাকে দীপ্যমান করে তোলেনি। তখনো অনেক বাধা, অনেক সংশয়। কিন্তু নিজের শক্তিস্ফুরণের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের যে আনন্দ সে যেন যৌবনের প্রথম প্রেমের আনন্দের মতই আগুনে ভরা, বিঘ্নের পীড়নে দুঃখের তাপে সেই আনন্দকে আরো নিবিড় করে তোলে। প্রবল সুখদুঃখের দেবাসুরেরা মিলে অমৃতের জন্য যখন জগদীশের তরুণ শক্তিকে মন্থন করছিল, সেই সময় আমি তার খুব কাছে এসেছি।”
জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে তুলে ধরার জন্য বারে বারে কলম ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। ইওরোপের প্রথম বৈজ্ঞানিক মিশনের সাফল্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের প্রতি’ শিরোনামে কবিতা:
“বিজ্ঞান-লক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিমমন্দিরে
দূর সিন্ধুতীরে,
হে বন্ধু, গিয়েছ তুমি; জয়মাল্যখানি
সেথা হতে আনি
দীনহীনা জননীর লজ্জানত-শিরে,
পরায়েছ ধীরে।”
রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের পর জগদীশচন্দ্র আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে বাস করেন বেশ কিছুদিন। এই বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জগদীশচন্দ্রের। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার, লোকেন পালিত প্রমুখ এই বাড়িতে নিয়মিত আসতেন। রবীন্দ্রনাথ একাধিক চিঠিতে এই সার্কুলার রোডের বাড়িতে জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুর বন্ধুত্বপূর্ণ সাহচর্যের উল্লেখ করেছেন। ইংল্যান্ড-প্রবাসী জগদীশচন্দ্রকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
“কলকাতায় আমার সুখ নেই। পূর্বে এখানে যখন আসতুম তোমাদের ওখানেই সর্বপ্রথম ছুটে যেতুম। এবারে সেরকম আগ্রহের সঙ্গে কোনখানে যাবার নেই। আজ প্রভাতেই তোমার চিঠিখানি পেয়ে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হলো। তোমার সেই ছোট ঘরটি থেকে তোমার আলাপ গুঞ্জন যেমন আমি হৃদয়ে পূর্ণ করে নিয়ে আসতুম নিজেকে আজও সেই রকম পূর্ণ বোধ করচি।”
আরেকটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন:
“তোমার সার্কুলার রোডের সেই ক্ষুদ্র কক্ষটি এবং নীচের তলায় মাছের ঝোলের আস্বাদন সর্বদাই মনে পড়ে।”
দেশে পল্লীশিল্প পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে রেশম শিল্পের ব্যাপারে উৎসাহী হন রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহের বাড়িতে তিনি রেশম-কীটের চাষ শুরু করেন। তাঁর উৎসাহে জগদীশচন্দ্র তাঁর সার্কুলার রোডের বাড়িতে রেশম-কীটের চাষ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের রেশম-চাষে সহায়তা করতেন তাঁর ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষক লরেন্স। কিন্তু জগদীশচন্দ্রকে সাহায্য করার কেউ ছিল না। তিনি রেশম-চাষে তেমন সুফল পাচ্ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথকে এ ব্যাপারে তিনি লিখলেন:
“কয়দিন হইল একটি প্রজাপতি সুস্থ শরীরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তাহার পর ২/৩টি অর্ধমৃত অবস্থায় জন্মিয়াছে, আর কয়টি অর্ধেক বাহির হইয়া রহিয়াছে। এরূপ অবস্থায় কী করিতে হইবে জানি না। যে একটি সুস্থ শরীরে বাহির হইয়াছিল, তাহাকে কী আহার দিতে হইবে জানি না। অনেক পুষ্প সংগ্রহ করিয়া দিয়াছি, কিন্তু মধু সঞ্চয় করিতে তাহার কোন আগ্রহ নাই। কোন বন্ধু আমের চাট্নি দিতে বলিয়াছেন।”
পরে শিলাইদহে বেড়াতে গিয়ে রেশম-কীট পালনের তত্ত্বাবধায়ক লরেন্স সাহেবের সাথে আলোচনা করেছেন জগদীশচন্দ্র। সেখান থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথকে তিনি লিখলেন:
“প্রজাপতিগুলি এখনও জন্মগ্রহণ করে নাই। গত শনিবার হইতে প্রত্যহ গুটিগুলিকে নাড়িয়া দেখিতেছি, ভিতরে যেন পূর্ণতর হইয়া আসিতেছে। আশঙ্কা হয়, এত ঘন ঘন কম্পনে প্রাণবায়ু হয়ত বাহির হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলেও একরূপ নিশ্চিন্ত হইতাম, কারণ যে এরন্ড বৃক্ষের কথা বলিয়াছিলাম তাহার পাতাগুলি একেবারে নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং এই দুর্ভিক্ষের সময় সহসা প্রজাবৃদ্ধি মনে করিয়া ভীত আছি। বিশেষত লরেন্স সাহেবের নিকট আমি কি করিয়া মুখ দেখাইব জানি না।”
জমিদারি দেখার কাজে প্রায়ই শিলাইদহে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। শীতের সময় পদ্মায় বোটে বসে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময় প্রতি শনিবার রবীন্দ্রনাথের অতিথি হয়ে সেখানে যেতেন জগদীশচন্দ্র। তাঁর জন্য একটা বজরা সবসময় প্রস্তুত থাকতো সেখানে। দু’রাত শিলাইদহে কাটিয়ে সোমবার সকালে কলকাতা ফিরতেন জগদীশচন্দ্র। সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে ছোটোগল্প লেখার উৎসাহ দিতেন তিনি। অনেকটা জোরই করতেন বলা চলে। প্রতি শনিবার একটা করে নতুন গল্প লিখতে হতো তাঁর জন্য।
বালক রথীন্দ্রনাথও সেখানে যেতেন মাঝে মাঝে। জগদীশচন্দ্র তার সাথে বালির উপর খেলা করতেন, কচ্ছপের ডিম খুঁজে বের করতেন, কচ্ছপ ধরতেন। কচ্ছপের মাংস খেতে খুব পছন্দ করতেন জগদীশচন্দ্র। পদ্মার চরে বালির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থেকে গরমে আধসেদ্ধ হবার পর ঝাঁপিয়ে পড়তেন পদ্মার পানিতে। তিনি বলতেন, “পদ্মাচরের মতো এমন সুন্দর স্বাস্থ্যকর স্থান পৃথিবীতে কোথাও নেই।”
১৮৯৮ সালে জগদীশচন্দ্রের পরিচয় হয় ভগিনী নিবেদিতা ও আমেরিকান ধনী বিধবা সারা বুলের সাথে। পরবর্তীতে নিবেদিতা জগদীশচন্দ্র, অবলা, রবীন্দ্রনাথ, এবং স্বামী বিবেকানন্দের পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝে অনুঘটকের কাজ করেছেন। আবার মাঝে মাঝে নিরোধকের কাজও করেছেন।
নিবেদিতার জন্ম ১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর ইংল্যান্ডে। তাঁর আসল নাম মার্গারেট নোবল। মা মেরি ইসাবেল ও বাবা স্যামুয়েল নোবল। স্যামুয়েল ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট পাদ্রি। মার্গারেটের বয়স যখন মাত্র দশ বছর তখন স্যামুয়েলের মৃত্যু হয়। মার্গারেট ও তার বোনকে নিয়ে মা ইসাবেল চলে আসেন বাপের বাড়িতে। ইসাবেলের বাবা হ্যামিল্টন ছিলেন আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। বাপ-মরা নাতনিদের কোলে পিঠে করে নিজের আদর্শে মানুষ করেছেন হ্যামিল্টন সাহেব। ছোটবেলা থেকেই মার্গারেট জেনে এসেছে – ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। লন্ডনে চার্চের বোর্ডিং স্কুলে থেকে লেখাপড়া শিখেছে মার্গারেট ও তার বোন। হ্যালিফ্যাক্স কলেজ থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করেছেন আর্টস, ফিজিক্স, মিউজিক, লিটারেচার ইত্যাদি সাবজেক্ট নিয়ে। ১৭ বছর বয়স থেকে স্কুলের শিক্ষকতা ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা শুরু করেন মার্গারেট। উইম্বলডনে একটি স্কুল স্থাপন করেন তিনি। লন্ডনের বুদ্ধিজীবী মহলে মার্গারেট খুব পরিচিত হয়ে ওঠেন। ওয়েল্স-এর এক তরুণের সাথে তার বিয়ের বাগদান সষ্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের আগেই ছেলেটি মারা যায়। প্রচন্ড মানসিক অবসাদের সময়
১৮৯৫ সালে তার ২৮ বছর বয়সে লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে পরিচয় হয় মার্গারেটের।
স্বামী বিবেকানন্দের টানে সবকিছু ছেড়ে ১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি কলকাতায় আসেন একত্রিশ বছর বয়সী মার্গারেট নোবল। তার কয়েক মাসের মধ্যেই জগদীশচন্দ্রের সাথে পরিচয় হয় তাঁর। ১৮৯৮ সালের ১১ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ স্টার থিয়েটারে রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে এক সভার আয়োজন করেন। সেখানে এদেশীয় বিদ্বান ব্যক্তিদের সাথে মার্গারেটকে পরিচয় করিয়ে দেন। মার্গারেট সেখানে বক্তৃতা দেন ইংল্যান্ডে ভারতীয় আধ্যাত্ম্য-ভাবনার বিস্তার সম্পর্কে। সেই সভায় জগদীশচন্দ্রও আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু সেদিন তাঁর সাথে আলাপ হয়নি মার্গারেটের। পরিচয় হয় আরো কিছুদিন পরে। সেই বছর পঁচিশে মার্চ বিবেকানন্দ মার্গারেটকে হিন্দুধর্মে দীক্ষা দিয়ে নাম রাখেন নিবেদিতা। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে সবার ‘ভগিনী নিবেদিতা’ হয়ে ওঠেন তিনি অচিরেই।
১৮৯৮ এর শেষ দিকে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মসমাজে ‘শিক্ষা’ বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন নিবেদিতা। সেখানে ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষিতা মেয়েদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি ইন্দিরা দেবী ও ভাগনি সরলা দেবীর সঙ্গে জগদীশের বোন লাবণ্যপ্রভাও যেতেন। জগদীশ বোনের কাছ থেকে নিবেদিতা সম্পর্কে শুনেছিলেন।
সেই সময় স্বামী বিবেকানন্দের আরো দুজন বিদেশী শিষ্যা – মিসেস সারা বুল ও মিস ম্যাকলাউড ভারতভ্রমণ করছিলেন। নিবেদিতার মতো এরা তাদের সবকিছু ত্যাগ করে একেবারে চলে আসেননি, তবে স্বামীজির জন্য এঁদের টানও অফুরন্ত। জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক জীবনে মিসেস সারা বুলের অবদানও অনেক। সারা বুলই জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারের প্যাটেন্টগুলো করিয়ে দেন। তাই মিসেস সারা বুল সম্পর্কেও একটু বিস্তারিত জানা দরকার।
নিউইয়র্কের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জোসেফ থ্রপ ও সুসান থ্রপের কন্যা সারা চ্যাপম্যান থ্রপের জন্ম ১৮৫০ সালে। সারার জন্মের কয়েকবছর পর তার বাবা নিউইয়র্ক থেকে ব্যবসার খাতিরে উইসকনসিনে চলে যান এবং সেখানে পরবর্তীতে সিনেটর নির্বাচিত হন। তার মা ছিলেন সমাজসেবী। সারা ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি আসক্ত। একেবারে ছোটবেলা থেকেই পিয়ানো বাজাচ্ছে সে, পরে বেহালা।
সারার বয়স যখন ১৮, তখন নরওয়ের বিখ্যাত বেহালাবাদক ওলে বুলের সাথে পরিচয় হয় তার। ওলে তখন বিপত্নীক, চারটি প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের জনক এবং বয়সে সারার চেয়ে চল্লিশ বছরের বড়। ১৮৬৮ সালের শেষের দিকে তিনি চতুর্থবারের মতো আমেরিকা সফরে এসেছিলেন। এক বছর ধরে অনুষ্ঠান করেছেন আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। উইসকন্সিনে অনুষ্ঠান করার সময় শহরের যে ধনী পরিবারে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন সেটা ছিল সারাদেরই বাড়ি।
ওলে বুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সারা। কয়েক মাসের মধ্যেই গভীর প্রেম হয়ে যায় এই ৫৮ বছর বয়সী বেহালাবাদক আর অষ্টাদশী সঙ্গীত-পাগল সারার মধ্যে। ১৮৬৮ সালের জুন মাসে গোপনে বিয়ে করে ফেলে সারা ও ওলে। বিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয় সারার মা-বাবা। সারা ও ওলে নরওয়ে থেকে ফেরার পর ম্যাডিসনে তাদের বিয়ের রিসেপসান হয়। বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বেশ জাঁক-জমকের সাথে।
১৮৭১ সালের মার্চে সারার মেয়ে ওলিয়ার জন্ম হয়। সারাকে তার বাবা আমেরিকায় একটি বাড়ি দিয়েছিলেন। সারা ও ওলে সেখানে ছিলেন কয়েক বছর। সঙ্গীতের প্রয়োজনে তারা আমেরিকা ও ইওরোপের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, অনুষ্ঠান করতেন। স্বামীর বেহালার সঙ্গে পিয়ানো বাজাতেন সারা। বাবার মৃত্যুর পর ১৮৭৯ সালে মা, মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে আমেরিকার কেমব্রিজে চলে আসেন সারা। তাদের বাড়িটা সঙ্গীত, সাহিত্য, ও দর্শনের আলোচনার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক অধ্যাপকদের আসর বসতো সারাদের বাড়িতে নিয়মিত। সিরিয়াস সেমিনার হতো, বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা ও বক্তৃতামালার আয়োজন হতো।
১৮৮০ সালে ওলে মারা যান। মাত্র ৩০ বছর বয়সে একটিমাত্র কন্যাকে নিয়ে বিধবা হন সারা। ১৮৮২ সালে তিনি স্বামীর একটা জীবনী লিখে প্রকাশ করেন এবং আস্তে আস্তে ইওরোপীয় দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। দর্শন পড়তে পড়তে প্রাচ্যদর্শন এবং ভগবদ্গীতাও পড়েন। ভারতীয় মুনি-ঋষিদের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা ও আগ্রহ অনুভব করতে শুরু করেন সারা। এভাবে তিনি একজন গভীর ধার্মিক ব্যাক্তিতে পরিণত হন।
১৮৯৪ সালে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে পরিচয় হয় সারার। বিবেকানন্দ তখন বোস্টনে ধর্মপ্রচার করতে গিয়েছিলেন। সারা বুল নিজে খুব ধার্মিক হওয়াতে বিবেকানন্দের আদর্শে খুবই আপ্লুত হয়ে পড়েন।
১৮৯৫ সালে সারা বুল বিবেকানন্দকে আমন্ত্রণ জানান তাঁর বাড়িতে। বিবেকানন্দের মাঝে সারা এমন এক আকর্ষণ খুঁজে পান- যাতে তিনি অদ্ভুত একধরনের শান্তি পান। বিবেকানন্দের বয়স তখন মাত্র ৩২ বছর, আর সারার ৪৫। বিবেকানন্দ সারাকে মা বলে সম্বোধন করায়- সারা বুল হয়ে ওঠেন বিবেকানন্দের আমেরিকান মা। বিবেকানন্দ অনেক সময় সারাকে ‘ধীরা মা’ বলেও সম্বোধন করতেন।
বিবেকানন্দের সাথে পরিচয়ের পর সারা অনেকবার ইন্ডিয়া ভ্রমণ করেছেন। হিন্দু ধর্মের প্রসারে, বৈদিকতার প্রচারে অংশ নিয়েছেন। প্রচুর টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠায় এবং উন্নয়নে।
১৮৯৮ সালে যখন সারা বুলের সাথে জগদীশচন্দ্রের পরিচয় হয় তখন সারা ও মিস্ ম্যাকলাউড ছিলেন কলকাতার আমেরিকান কনসালের অতিথি। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর মাধ্যমে তাঁরা কলকাতার কিছু বিশিষ্ট ব্রাহ্ম ব্যাক্তিত্বের সাথে পরিচিত হন। হিন্দুধর্মের দর্শন ও ব্রাহ্মধর্মের দর্শনের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করে অনেক চিন্তার খোরাক পান সারা বুল। তাঁরা দেখতে পান যে তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের চেয়ে ব্রাহ্মরাই বেশি প্রগতিশীল। মেয়েদের মধ্যে সেটা আরো প্রকাশ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জগদীশচন্দ্র বসুর কাজের ব্যাপারেও তাঁদের উৎসাহ।
১৮৯৮ এর ডিসেম্বরে আমেরিকান দূতাবাসে নতুন ব্রাহ্মবন্ধুদের আমন্ত্রণ করে একটা পার্টিতে নিবেদিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সারা বুল। সেদিন মুখোমুখি আলাপ হয় নিবেদিতার সাথে জগদীশচন্দ্রের। প্রথম আলাপেই নিবেদিতার মনে হতে থাকে এই মানুষটার সাথে তার মনের অনেক মিল। নিবেদিতার বয়স তখন ৩১ আর জগদীশের ৪০। কালক্রমে সেই পরিচয় পরিণত হয় বন্ধুত্বে। এক ব্যতিক্রমী বন্ধুত্ব ছিল জগদীশ ও নিবেদিতার, ছিল এক অচেনা গভীর সম্পর্ক।
প্রথম পরিচয়ের দিন কথা প্রসঙ্গে ব্রাহ্মদের অদ্বৈত-তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নিবেদিতা। উত্তরে জগদীশচন্দ্র জ্ঞিজ্ঞেস করেন, “বিজ্ঞানের প্রমাণ চান অদ্বৈত-তত্ত্বের পক্ষে?
“হ্যাঁ চাই।”
“জ্ঞান আর বিজ্ঞানের অনুভব যে অভিন্ন তা বিশ্বাস করেন?”
“উপনিষদে তো সেরকম ইঙ্গিতই আছে।”
জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-প্রতিভা দেখে নিবেদিতা মুগ্ধ হন। তিনি বুঝতে পারেন পরাধীন ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে জগদীশচন্দ্রের গবেষণার গুরুত্ব অসীম। অবলা বসুর সাথেও বেশ ঘনিষ্ঠতা হয় নিবেদিতার। অবলা শিক্ষিতা, সমাজ-সচেতন, স্ত্রী-শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রচুর কাজ করছেন দেখে খুবই ভালো লাগলো নিবেদিতার। সময় সুযোগ পেলেই তিনি জগদীশের বাড়িতে গিয়ে অবলা ও জগদীশের সাথে কথা বলেন। উৎসাহ দেন জগদীশের বিজ্ঞানচর্চায়।
নিবেদিতার ডায়েরি থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রথম সাক্ষাতেই খুব ভালো লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথের ব্যাক্তিত্ব, কন্ঠস্বর, আদবকায়দা সবকিছুতেই মুগ্ধ হয়ে যান নিবেদিতা। এ প্রসঙ্গে ১৮৯৯ সালের ১৬ জুন রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে নিবেদিতা লেখেন:
“I really wanted a new friend to those with which India has already blessed me, and you are so dear to my friend Dr Bose, that I could not help hoping you should be my friend too!”
আর রবীন্দ্রনাথেরও প্রথম পরিচয়ে ভালোই লাগে নিবেদিতাকে। ‘ভগিনী নিবেদিতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
“ভগিনী নিবেদিতার (তখনও মিস মার্গারেট নোবল) সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি অল্পদিন মাত্র ভারতবর্ষে আসিয়াছেন। আমি ভাবিয়াছিলাম সাধারণ ইংরেজ মিশনারি মহিলারা যেমন হইয়া থাকেন, ইনিও সেই শ্রেণীর লোক, কেবল ইহার ধর্মসম্প্রদায় স্বতন্ত্র।”
ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর ছোটমেয়ে মীরাকে ইংরেজি শেখানোর জন্য। নিবেদিতা এই প্রস্তাব শুনে রেগে গিয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, “সেকি! ঠাকুরবংশের মেয়েকে এক বিলাতী খুকু বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে?”
নিবেদিতা মনে করতেন একটি জাতি গড়ে ওঠে তার নিজস্ব শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষার মুক্তচর্চার মাধ্যমে। ঠাকুরবাড়ির সবকিছুই যেখানে দেশীয় সংস্কৃতিকে স্বাধীনভাবে বিকাশের পক্ষে, সেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিনা চাচ্ছেন নিজের মেয়েকে ইংরেজ বানাতে! নিবেদিতা রবীন্দ্রানাথকে বলেছিলেন, “ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতায় আপনি এমনই আবিষ্ট হয়েছেন যে নিজের মেয়েকে ফোটাবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চান?”
জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যেই নিবেদিতা বুঝতে পারেন যে হিন্দুধর্মের প্রবল প্রচারক স্বামী বিবেকানন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথ বা জগদীশচন্দ্রের সম্পর্ক খুব একটা মাখামাখি পর্যায়ের নয়। বিবেকানন্দের অনেক নীতির সাথে এঁদের মতের মিল নেই। নিবেদিতাকে বিবেকানন্দ কাজ দিয়েছিলেন হিন্দুধর্ম প্রচারের। অথচ নিবেদিতা ঘনিষ্ঠভাবে মিশছেন রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রের মতো ব্রাহ্মদের সাথে। এ নিয়ে তাঁর মনের মধ্যে সামান্য অপরাধবোধও কাজ করছিল।
তিনি ভাবলেন ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়কে রামকৃষ্ণ আন্দোলনের পথে আকৃষ্ট করতে পারলে- অন্তত করার চেষ্টা করলে কেমন হয়। তাতে তাঁর মেলামেশার ব্যাপারটাতে আর দোষের কিছু থাকবে না। স্বামী বিবেকানন্দর কাছ থেকে এব্যাপারে অনুমতি আদায় করেন নিবেদিতা। ১৮৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারি বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে পরামর্শ দেন, “Make in roads into the Brahmos.”
বিবেকানন্দের অনুমতি পেয়ে নিবেদিতা ব্রাহ্মবন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেন একটি টি-পার্টিতে। নিমন্ত্রিতদের তালিকায় একেবারে প্রথমদিকে ছিলেন জগদীশচন্দ্র ও অবলাবসু। ১৮৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারি নিবেদিতার বাগবাজারের বাড়িতে টি-পার্টিতে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, প্রসন্নকুমার রায়, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, সরলা ঘোষাল, স্বর্ণকুমারী দেবী- সবাই এসেছিলেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ সেখানে তাঁর ‘in road’ বানানো শুরুই করতে পারেননি। প্রবল ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে ও উচ্চমার্গের তাত্ত্বিক আলোচনায় বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ-কথামৃত খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।
নিবেদিতা বুঝতে পারেন ব্রাহ্মদের মধ্যে তাঁর হিন্দুত্বের প্রভাব খাটানোর আবেগী ইচ্ছাটা বাস্তবসম্মত ছিল না।
ব্রাহ্মদের সাথে ধর্মীয় যোগাযোগ স্থাপনের ইচ্ছাটা বাদ দিলেও জগদীশচন্দ্রের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আরো গভীর হলো। সম্পর্কটা কীভাবে গভীর হলো সেটাই একটা রহস্য। বৈজ্ঞানিক ধর্মের মতোই হয়তো opposite attracts – বিপরীত মেরুর প্রতি আকর্ষণ!
প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান থেকে ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা’ এই আইরিশ ভদ্রমহিলার সাথে ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের বিশ্বাসের কোন মিল নেই। তাছাড়া জগদীশচন্দ্র এমন গোঁয়ার, বদমেজাজী এবং ঠোঁটকাটা যে কোন আলগা ভদ্রতার ধার ধারেন না। এদিকে নিবেদিতাও ছেড়ে কথা কইবার মানুষ নন। তাই দু’জনই অকপট যে কোন ব্যাপারে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়, অথচ এই দুই প্রবল ব্যক্তিত্ব কীভাবে কাছাকাছি এলেন!
নিবেদিতার চিঠি থেকে জানা যায়, জগদীশচন্দ্র মার্গারেটের ‘নিবেদিতা’ নামটাই পছন্দ করেননি।
“আপনাকে মিস নোবলের পরিবর্তে সিস্টার নিবেদিতা বলে ডাকতে আমার কষ্ট হয়।”
“কেন?”
“নাম বদলের ফলে মনে হচ্ছে আপনার মানবিক সম্পদে টান পড়েছে। নাম বদল করে আপনি নিজেকে সংকীর্ণ করে ফেলেছেন- যা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।”
একথা শুনে নিবেদিতার খুব খারাপ লাগে। কষ্ট পান। কিন্তু কিছু বলতেও পারেন না। কষ্টের কথা বন্ধু মিস্ ম্যাকলাউডকে লিখে জানান, “একটা দুঃস্বপ্নের মতো তার কথাগুলো আমাকে তাড়া করে ফিরছে। আমি যাকে ভালবাসি, বিশ্বাস করি, তাদের কেউ কি কখনো আমাকে সংকীর্ণমনা মনে করেছে? তোমরা কখনও করেছো, তুমি বা সারা?”
জগদীশচন্দ্র যতই আঘাত দিচ্ছেন ততই যেন আকৃষ্ট হচ্ছেন নিবেদিতা তাঁর প্রতি। জানতে চাচ্ছেন কোথায় কোথায় অমিল আছে তাঁর আর নিবেদিতার?
জগদীশচন্দ্র অকপটে জানিয়েছেন –“তোমাদের স্বামীজি যে রামকৃষ্ণকে দেবতা বানিয়ে দিচ্ছেন দেখেই বিরক্ত লাগছে আমার।”
“রামকৃষ্ণ কি দেবতা হবার যোগ্য নন?”
“দেবতা! রামকৃষ্ণ! সংকীর্ণ ছাঁচে গড়া এক মানুষ, যিনি মেয়েদের প্রায় আধা-শয়তানী বলে মনে করতেন, আর মহিলা দেখলেই মূর্চ্ছা যেতেন!!!!!!”
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি জগদীশচন্দ্রের এই মনোভাব জানার পরেও নিবেদিতার রাগ হয়নি। কেবল ছয়টি বিস্ময়সূচক চিহ্ন দিয়ে নিজের অনুভূতি জানিয়েছেন।
নিবেদিতার এত পরমতসহিষ্ণুতার বদলেও জগদীশচন্দ্র নিজের মতবাদ একটুও নরম করেননি। তাঁর আসলেই খুব বিরক্তি লাগছিলো বিবেকানন্দের সাম্প্রতিক কাজকর্মে। অথচ ইংল্যান্ডে থাকতে তিনি বিবেকানন্দের বক্তৃতা শুনে শিহরিত হয়েছিলেন। বিবেকানন্দ যখন বলেছিলেন, “আমার জীবনের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌরুষ আনা”- বেশ ভালো লেগেছিলো তাঁর। কিন্তু যখন দেখলেন যে সেই তেজদীপ্ত মানুষটি রামকৃষ্ণকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করতে শুরু করেছেন, কালী পূজার ধ্যানে মগ্ন হচ্ছেন – তাঁর মনে হলো ‘বীরনায়ক’ থেকে বিবেকানন্দ পরিণত হচ্ছেন একজন সাধারণ ধর্মগুরুতে।
নিবেদিতা এ ব্যাপারে জগদীশচন্দ্রের সাথে কেন কোন তর্ক করেননি তাও এক রহস্য। অথচ তিনি খুবই আবেগপ্রবণ। তাঁর গুরুর সমালোচনা তিনি বিনাতর্কে মেনে নেয়ার মানুষ নন। এ ব্যাপারে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ১৮৯৯ সালের ১০ জানুয়ারি প্রসন্নকুমার রায়দের সাথে চা-পান ও ডিনার করার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার আন্দোলন সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনা করায় মেজাজ খারাপ করে ঝগড়া করেছিলেন নিবেদিতা। তবে জগদীশচন্দ্রের বেলায় কেন নয়? কেন এত সহনশীলতা? কেন জগদীশের কটুবাক্যও মিষ্ট মনে হয় নিবেদিতার?
তার উত্তর নিজেই দিয়েছেন তিনি মিস ম্যাকলাউডের কাছে লেখা চিঠিতে- “I love that man.”
কিন্তু কেমন ভালোবাসা এটা? প্রেম? মনে হয় না। কারণ নিবেদিতা সন্নাসিনী। তার কামনাবাসনা সব জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি নিবেদিতা হয়েছেন। কিন্তু সব যে জলাঞ্জলি দিতে পেরেছিলেন তার নিশ্চয়তা কী? জগদীশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রেম হলেও কারো কি কিছু করার আছে?
তথ্যসূত্র:
১। প্রবাসী, আষাঢ়, ১৩৩৩, পৃ-৪১২।
২। পত্র পরিচয়, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩।
৩। চিঠিপত্র, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ- ১৫।
৪। দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত, নিবেদিতা ও জগদীশচন্দ্র, এক অচেনা সম্পর্কের সন্ধান, গাঙচিল, কলকাতা, ২০১০।
৫। লিজেল রেঁম, নিবেদিতা, অনুবাদ নারায়নী দেবী। উমাচল প্রকাশনী, কলকাতা, ১৩১২ বাংলা, পৃ: ২৭৩।
৬। চিঠিপত্র, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ – ১৪৬।
৭। Letters of sister Nivedita, Vol. I., editor Sankari Prasad Basu, Nobabharot publishers, Calcutta, 1982.
If you want to know India, study Vivekananda. In him everything is positive and nothing negative. (Romain Rolland, in a letter written to Swami Ashokananda informed that Rabindranath Tagore once told him these words. Acknowledgement: Sandeep Biswas, see discussion in the comment section below. —Ed.)
In recent times in India, it was Vivekananda alone who preached a great message which is not tied to any do’s don’ts. Addressing one and all in the nation, he said: In every one of you there is Brahman (Bengali: ব্রহ্ম); the God in the poor desires you to serve Him. This message has roused the heart of the youths in a most pervasive way. That is why this message has borne fruit in the service of the nation in diverse ways and in diverse forms of sacrifice. This message has, at one and the same time, imparted dignity and respect to man along with energy and power. The strength that this message has imparted to man is not confined to a particular point; nor is it limited to repetitions of some physical movements. It has, indeed, invested life with a wonderful dynamism in various spheres. There at the source of the adventurous activities of today’s youth of Bengal is the message of Vivekananda— which calls the soul of man, not his fingers.[Source]
Some time ago Vivekananda said that there was the power of Brahman in every man, that Narayana (God) wanted to have our service through the poor. This is what I call real gospel. This gospel showed of infinite from man’s tiny egocentric self beyond the limits of all selfishness. This was no sermon relating to a particular ritual, nor was it a narrow injunction to be imposed upon one’s external life. This naturally contained in it protest against untouchability— not because that would make for political freedom, but because that would do away with the humiliation of man— a curse which in fact puts to shame the self of us all.
Vivekananda’s gospel marked the awakening of man in his fullness and that is why it inspired our youth to the diverse course of liberation through work and sacrifice. (see image below)[Source]
Image.
এই কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ খেলাচ্ছলে বলেছিলেন বলে তো মনে হয় না। আসলে এই দুজনের সম্পর্ক এত সহজে মাপতে যাওয়া মূঢ়তা। সনৎবাবুর লেখাটি নিরপেক্ষ নয়। একপেশে দৃষ্টিসম্পন্ন।
লেখাটি পড়ে সারা সম্পর্কে বোনাস তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ।
হিন্দু ধর্মের দীক্ষা অথচ ব্রাহ্মসমাজে জ্ঞানদান; একটু ঝামেলা লাগছে যে প্রদীপ দাদা। সিষ্টার নিবেদিতা আসলে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন, নাকি হিন্দু ধর্মের কনভার্ট হয়েছিলেন; না’কি ভজঘট ব্রাহ্ম-ধর্মের কেউ ছিলেন? সমাজ-হিন্দু-ধর্ম না’কি? 🙂 অবশ্য ……. ,
বেশ বেশ;
প্রদীপ দা, নাটক তো জমে উঠেছে; দারুন 🙂
আমার মনে হয়, ব্রাহ্মসমাজ যে সেই সময়ের হিন্দু ধর্মের চ্যালেঞ্জ হয়েছিলো আর ব্রাহ্মসমাজ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে ব্রাহ্মধর্ম হয়ে যাচ্ছিলো; একই সাথে বিবেকানন্দ ধরনের নানা মতের শক্তিশালী চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান ছিলো এগুলো এখানে এলে আমাদের মত আলসে পড়ুয়াদের জন্য সুবিধা হতো।
আরো একখানা অসাধারণ লেখা উপহার দেবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় প্রদীপ দেব।
অনেক ধন্যবাদ বিপ্লব রহমান।
জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনে নিবেদিতার একটা আলাদা ভূমিকা আছে। বিজ্ঞানী হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসুকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে নিবেদিতা বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। জগদীশচন্দ্রের প্রথমদিকের রিসার্চ পেপার ও কয়েকটি বইও লিখে দিয়েছেন নিবেদিতা। বসু বিজ্ঞানমন্দির প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন যদিও তিনি সেটা দেখে যেতে পারেননি।
জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান ও জীবন নিয়ে আমার “জগদীশচন্দ্র বসু: বিশ্বের প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী” প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালের বইমেলায়।
সে অর্খে তো ঠিকই আছে। বরং জগদীশ-নিবেদিতা আলাদা পর্ব করলে হয়তো আরো ভাল হতো।
এই ধারবাহিকের আগের পর্বগুলো পড়তে শুরু করেছি।
আপনার বইটি পড়ারও খুব আগ্রহ হচ্ছে। ভাল থাকুন।
লেখাটি অনবদ্য। এই রকম লেখা অনলাইনে বোধহয় খুব বেশী লেখা হয়নি। রবী-জগদীশ বন্ধুত্বে চমৎকৃত।
তবে লেখাটি শেষাংশটি খানিকটা বাহুল্য মনে হয়েছ। সেটি খুব সংক্ষেপে সারা যেত। :rose:
বিবেকানন্দ আপনার চোখে অপরাধী। দয়া করে এক আদর্শের দৃষ্টান্ত দেন যাকে আশ্রয় করে সুন্দর যথার্থ মানুষ হতে পারি