সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়কে মর্যাদা দিতে, তাদের দৈনন্দিন উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিতে, তাদের স্বাভাবিক সুযোগকে বিবেচনা করতে,তাদের নাগরিক অধিকারকে মানতে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে সহিষ্ণু হতে হবে। মানবিক হতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উগ্র আবেগকে, ব্যক্তি স্বার্থকে একটু আধটু সংযত করা প্রয়োজন এবং উচিত।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯ঃ সরকারী নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতাঃ ‘(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
(২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’’
সংবিধানের এ সমতার বাণী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত অনেক নাগরিকদের দায়িত্ব পালনের সময়ই মনে থাকে না বা রাখেন না। এ বিষয়ে উদাহরণ দিচ্ছি।

সরকারী চাকরির পদোন্নতির তালিকা দেখে একজন সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তার মন্তব্য— আরে, আমার আগে জেষ্ঠ্যতার তালিকায় কয়েকজন মালু না ঢুকলে আমি আরেকটা পদোন্নতি নিয়েই এল পি আর এ যেতে পারতাম।
এ কোন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে লালিত লোকের এবং কোন মানসিকতা প্রসূত সংলাপ ? মালুরা (?) কি উড়ে এসে জুড়ে বসা গোষ্ঠী? প্রশ্নটা অবান্তর হলেও উত্তরটা ঐতিহাসিক বৈ কি। কোন কোন সময় যে পদোন্নতির তালিকার বহু জেষ্ঠ্য মালুকে ডিঙানো হয় এ উদাহরণ অবশ্য দুর্লভ নয় মোটেই।
একটি সর্বজনবিদিত সংলাপ, গতানুগতিক ধারণা, চিরন্তন সত্যও বটে যে, মানুষের মনোজগত জটিল, মানব চরিত্র বুঝা সহজ নয়।
আমার অভিজ্ঞতায় মানুষের মধ্যে সচেতন সংখ্যালঘুদের মন আরও বিচিত্র ও জটিল, ক্ষেত্রবিশেষে মনোবৈকল্যও রয়েছে। নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমানের প্রচেষ্টা তাদের টনটনে। স্বজাতি, স্বধর্মীয়দের প্রতি যে পক্ষপাতিত্ব নেই তা জাহির করতে তাদের প্রতি অনেক সময় অবিচারও করা হয়।

আমার জানা এমনি একটি ঘটনা। এক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু। আরেকজন ঐ বিভাগেরই জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং তিনিও ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু। জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তার কাংঙ্ক্ষিত জায়গা ঢাকার কাছের এক জেলায় বদলি আটকে দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন – তাকে এখানে নিয়ে আসলে স্বধর্মীয় লোকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন বলে রটবে এবং তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাটি রাগে,ক্ষোভে, দুঃখে ও কষ্টে আমাকে বললেন — উনি মহাপরিচালক হলেও কিন্তু হিন্দুই রয়ে গেলেন। আর আমি সৎ, দক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ কর্মকর্তা হলেও উনার কাছে একজন হিন্দুই রয়ে গেলাম। বর্তমানে ঢাকার আশেপাশে তিন তিনটি জেলার অফিসার এমাসেই এল পি আর এ যাবার পরও আমার বদলি উনি আটকে দিয়েছেন।
আমি আমার চাকরির অবস্থানগত কারণে চুপচাপ থেকেছি। তবে মনে মনে ভেবেছি—মহাপরিচালকের হীনমন্যতা ঢাকার মতো জল তো মেঘনায় ও নেই।

আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও শহীদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটর ছিলেন। শামসুন্ননাহার হলে আবাসিক ব্যবস্থার জন্যে যিনি আমার স্থানীয় অভিভাবকও ছিলেন। জার্মানী থেকে পি এইচ ডি এর গবেষণা করেছেন। পরে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। এ নিয়ে আমার অনেক জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন এবং কৌতুহলও ছিল। দেশ ছাড়ার বিষয়ে তার পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে অনেক কানাঘুষাও ছিল। উত্তর শুনলাম প্রায় একযুগ পরে কিছুদিন আগে তার ছোট ভাইয়ের কাছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অপেক্ষমান তালিকা থেকে নিয়মমাফিক একজন সংখ্যালঘু ছাত্র ভর্তি হবার পর উনাকে স্বধর্মীয়ের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টের কথা বলেন। তবে কথাটা তার এক সহকর্মী অভিযোগ আকারেও বলেননি। তাতেও তিনি ভীষণ রকম অপমানিতবোধ করেন এবং দেশান্তরী হবার সিদ্ধান্ত নেন। পরিণামে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চলে যান।
প্রথমত, তিনি যদি মনের ক্ষোভে পৃথিবীর অন্য কোন দেশে যেতেন তবে এ নিয়ে কোন রকম কৌতূহলী হতাম না বা এ নিয়ে আমার মনেও কোন প্রশ্নের উদ্রেক হতো না।
দ্বিতীয়ত, তার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বা মৌখিক কোন অভিযোগ ছিল না। কোন এক সহকর্মী কথা প্রসঙ্গে পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলেন মাত্র। এ অজুহাতে দেশান্তরী হতে গিয়ে শুধুই সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি কি হীনমন্যতার পরিচয় দেননি?
তৃতীয়ত, কোন দুর্নীতি,স্বজাতি প্রীতি,স্বজনপ্রীতি, স্বধর্মী প্রীতির মতো পক্ষপাতিত্বের কোন মিথ্যা অভিযোগ থাকলে তা খন্ডন না করে একি অভিমান না পলায়নবৃত্তি। আর এমন মনোভাব তো সামাজিক সুস্থতাকে ব্যাহত করে। রাজনৈতিক পরিবেশকে কলুষিত করে। যেমন — উনার দেশান্তরী হবার উদাহরণ আশেপাশের আরও দু’চার দশটা সংখ্যালঘু পরিবারকে সংক্রামিত করেছিল। এখনো অনেকে নিজেরা না হলেও তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ক্লাস নাইনে উঠলে ভারতীয় হিসেবে ভারতে পড়ানোর জন্যে উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
এ উদ্যোগের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে।
-চলবে-