রোবট বন্ধু
আব্ধুল্লাহ-আল-মামুন

সেলুলয়েডের জানালার পাশে আধা শোয়া হয়ে, মাথায় লাগানো “রিক্রিয়েশন মেশিন” টার রিমোট হাতে, ইমোশোনাল মুড, দ্রুত পরিবর্তন করে চলেছে ১৮ বছর বয়সি ম্যাক। একবার স্নেহ, একবার ভালবাসা পরক্ষনেই আবার রোমান্স মুড, কোনটাতেই যেন শান্তি পাচ্ছে না ম্যাক। সবগুলা মুডই তার কাছে কৃত্তিম মনে হচ্ছে, সবগুলাতেই তার মনে হচ্ছে কি যেন নেই। শুরু থেকেই এই যন্ত্রটা তার কখনই ভালো লাগে নাই। বহুবার সে যন্ত্রটা মাথা থেকে টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই পরিচারিকা রোবট বাধা দিয়ে বলেছে, এটা খুলে ফেলা রাষ্ট্রিয় আইনে দন্ডনীয় অপরাধ। এটা নাকি এই শতকের শ্রেষ্ঠ আবিস্কার, এটা দিয়ে যেমন ইচ্ছা অনুভুতি নেয়া যায়।কিন্তু এই কৃত্তিম অনুভুতিতে ম্যাক হাফিয়ে উঠেছে।তার অসহ্য লাগে। রিমোট টা রেখে সামনের দেয়াল জুড়ে থাকা অতি আধুনিক কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকাল। মুখে চ্যাট করার কমান্ড উচ্চারণ করতেই মুহুর্তেই তার ফেস ডিটেক্ট করে অথেন্টিকেশন সম্পন্ন করল কম্পিউটরটি এবং সে থ্রী ডি দেয়ালে দেখতে পেল থোকায় থোকায় মানুষ বসে গল্প করছে। কেউ কেউ আবার উত্তাল সমুদ্রের নিচ দিয়ে পাশাপাশি হেটে বেরাচ্ছে আর গল্প করছে।কেউ আবার আকাশে উড়ছে দল বেধে।ম্যাক বিশাল মনিটর এর সামনে রাখা ইনপুট প্যাডের উপর যেয়ে দাড়াল। এর পর হাটা শুরু করল।সবাই বসে গল্প করছে,কিম্বা ভার্চুয়াল প্রকৃতি উপভোগ করছে। সবাই যেন ব্যাস্ত।এই ভার্চুয়াল জীবনেও কারো যেন এক চিলতে সময় নাই।ম্যাকের গল্প করার জন্য কাউকে ডাকতে ইচছা করছে না। সে একটা ঝর্ণার পাশে গিয়ে একা একা বসল। ম্যাক এই ঝর্ণাটাকে খুব ভালবাসে। যদিও এটা কৃত্তিম,থ্রি ডি দেয়ালে আলো আধারের খেলা ছাড়া আর কিছুই না। তবুও ম্যাক এর এই ঝর্ণাটাকে খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝেই সে চ্যাট রুমে এসে এই খানে বসে একা একা, উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকিয়ে থাকে ঝর্ণার দিকে।
“হ্যালো,আপনার পাশে একটু বসতে পারি”-একটা মেয়েলী কন্ঠ শুনতে পেল ম্যাক। ঘুরে তাকাতেই দেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “নিশ্চয়,প্লীজ”- বসার জন্যে ইশারা করল ম্যাক। মেয়েটা বসতে বসতে বলল,এই ঝর্ণাটার সফটয়্যার আরকিটেক্ট আমার মামা হন, ওনি বলছিলেন, ওনি নাকি বিংশ শতাব্দির একজন পরিচালক এর তৈরি করা একটি ডকুমেন্টারি তে, একটা বাস্তব ঝর্ণার বিবরণ দেখে এইটা ডিজাইন করেছিলেন। তার মানে এই রকম কিম্বা এর কাছাকাছি একটা আসল ঝর্ণা পৃথিবীতে ছিল-ম্যাক খুব আগ্রহ নিয়ে বলল। হমম, মেয়েটা হ্যা সুচক মাথা নাড়াল।ম্যাক বলল, এই কৃত্তিম ঝর্ণাটাই এত্ত সুন্দর, তাহলে, পৃথিবীর আসল ঝর্ণাটা কতই না সুন্দর ছিল!মেয়েটা বলল, আমার মামা আনেক ডকুমেন্টারি দেখেন,উনি বলেন, আগেকার কবিদের কবিতা কিম্বা অনলাইনে লেখা ব্লগগুলোর ডকুমেন্টারি দেখলে নাকি বোঝা যায়, পৃথিবী আসলে কত্ত অপরুপ ছিল।মেয়েটা বলল,আহা!এই যে, আপনার সাথে পরিচিত না হয়ে শুধু শুধু বকবক করছি। আমি কার্টার, ক্লাস ২০ পর্যন্ত একাডেমিক জ্ঞান ব্রেন এ কপি করেছি, এখন ক্লাস ২১ এর টা কপি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, থাকি এলেঙ্গা,চাঁদ এ।ওপ, আমি ম্যাক, ক্লাস ২৫ কপি করে আর ইচ্ছা করে না এখন এমনি বসে থাকি। আর বাসা জিনেদিন,পৃথিবী তে। হুমম, আর কপি করতে ইচ্ছা করে না কেন?-কার্টার জানতে চাইল।ম্যাক বিরক্তি সরে বলল-এইগুলা কপি করার মধ্যে আমি কোনো কৃতিত্ব দেখি না, শুধু শুধু কপি করার আগে ও পরে ৩ মাস হিমাগারে শুয়ে থাকতে হয়। আর আমার রিসার্স কিম্বা মহাকাশে অভিযানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই, আর পৃথিবীতে সব কাজ করার জন্যে ওই বোকা রোবটগুলা তো আছেই। তাই এই জ্ঞান কপি করার আমি দরকার মনে করি না। কিন্তু এই রোবটগুলা অন্তত কন্ট্রোল করার জন্যে কিম্বা এদের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যে তো আন্তত তোমার এই বিদ্যা জানা দরকার-কার্টার বলল। ম্যাক বলল, আররে এইসব চিন্তা করার জন্যে রাষ্ট্র আছে, রোবট ডাক্তার আছে।কার্টার-সব ঠিক আছে কিন্তু মাঝখানে যে হয়রানি হবে তোমার, বার বার ইনস্টান্ট মেসেজিং, ভিডিও কনফেরেন্সিং সেটা তে টাইম লস,তাই না?ম্যাক এবার হা হা করে হেসে উঠল এবং বলল, আররে, টাইম সেভ করেই কি করব বল, সারাদিন “রিক্রিয়েশন মেশিন” এর রিমোট টিপে আর চ্যাট করেই তো কাটাতে হয়। এর চাইতে বরং ওইটা হয়রানি হলেও তো আন্তত কাজ মানে বিজি থাকা যায় (দু জনেই হেসে উঠল।) আচ্ছা ম্যাক, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল, আমাকে যেতে হবে, মামা ভিডিও কনফারেন্সিং ইনভাইটেশন পাঠিয়েছেন।ওক কার্টার, ভাল থাক, পরে দেখা হবে। মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল কার্টার।

“ফ্রিকোয়েন্সী আর্কাইভ” যন্ত্রটা হাতে নিয়ে ম্যাক বিংশ শতকের মানুষের, কথা শোনার চেষ্টা করছে।এই যন্ত্রটা তার কাছে অদ্ভুত লাগে।অক্ষাংশ,দ্রাঘিমাংশ আর তারিখ ও সময় দিয়ে দিলে ঐ সময়ে ঐ স্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনার বহু পুরোনো কথা শোনা যায়।শক্তির ক্ষয় নেই, একে শুধু এক শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রুপান্তর করা যায়।শক্তির এই নিত্যতার সুত্রের আর একটা বাস্তব প্রতিফলন অতি আধুনিক এই যন্ত্রটি।শুন্যে জমে থাকা বহু পুরোনো শব্দশক্তিকে সময় আর স্থানে ইনডেক্স করে শুন্যতেই রেখে দেয়া হয়েছে। এই যন্ত্রটি সেই বিশাল ভান্ডার থেকে ইনডেক্স অনুসারে শোনাতে পারে একটা নির্দিষ্ট স্থানের নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে যাওয়া শব্দ।ম্যাক মুগ্ধ হয়ে পুরোনো মানুষের কথা শোনে, সে এই কথা শুনে শান্তি পায়।ঐ মানুষ গুলোকে তার খুব আপন মনে হয়। নিজেকে তাদের বংশধর মনে করে সে উত্তফুল্ল হয়। ম্যাক এই যন্ত্র দিয়েই খুজে পেয়েছে তার আরো একটা প্রিয় ঘটনা এবং তা হচ্ছে ৮৯ ডিগ্রি অক্ষাংশ আর ৯৬ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে ঘটে যাওয়া কিছু প্রাণচ্ছল যুবকের প্রাণবন্ত আড্ডা।ঐ দিনকে ওরা থার্টি ফার্স্ট নাইট বলে।কিছু যুবক, খুব প্রাণচ্ছল কন্ঠে আড্ডা মেরে যাচ্ছে।ম্যাক তাদের সব ভাষাই বুঝতে পারে কারণ, যন্ত্রটির সাথে যে ভয়েস ইন্টারপ্রেটর লাগানো আছে, সেটা সব ভাষাকেই ম্যাক এর ভাষায় পরিবর্তন করে দেয়। ম্যাক তাদের আড্ডা মুগ্ধ হয়ে শোনে আর ভাবে,ইশ! বিংশ শতকে যদি আমি থাকতাম! কি সুন্দর,যৌবন উদ্দিপ্ত আড্ডা,নিস্পাপ,নির্সাথ বন্ধুত্ব। কোনো যান্ত্রিকতা কিম্বা অসহ্য রোবট গুলার যান্ত্রিক কন্ঠের প্যানপ্যানানি নেই।মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করা যায়, মানুষের সাথে ঘুরে বেড়ানো যায়-আড্ডা মারা যায়। ম্যাক এর ভাবনার ছেদ পড়ল, চ্যাট ইনভাইটেশনের একটা নটিফিকেশন এলার্টে। স্ক্রিনে কার্টার এর ছবি দেখা যাচ্ছে, সে ম্যাক কে ডাকছে চ্যাট রুমে।ম্যাক “ফ্রিকোয়েন্সী আর্কাইভ” যন্ত্রটা বন্ধ করে কার্টারের ইনভাইটেশন গ্রহন করল।
শুভ অপরাহ্ন ম্যাক,কেমন আছো-খুব উত্তসাহ নিয়ে কার্টার জিজ্জেস করল। রোবট আর এত্ত যন্ত্র আমার ভালো লাগে না, অস্থির লাগে, মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছা করে, একটা মানুষের পাশাপাশি হাটতে ইচ্ছা করে। কার্টার তুমি আমার বন্ধু হবে?-এক নিংশ্বাসে বলল ম্যাক। নিশ্চয় ম্যাক। তোমাকে বন্ধু বানাতে পেরে আমি সুখ অনুভব করছি-রোবটিক সুরে কার্টার জবাব দিল। দেখ কার্টার, আমি রোবটদের ঘৃনা করি, তুমি রোবোটদের, প্লীজ অনুকরণ করবা না। আদেশের সুরে ম্যাক বলল।দুজনেই চুপ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, ম্যাক শান্ত কন্ঠে নিরবতা ভাঙ্গল, কার্টার ভার্চুয়াল লাইফ,রোবট আর যান্ত্রিকতায় আমি হাফিয়ে উঠেছি। রোবট ফ্রেন্ডগুলা আমার অসহ্য লাগে, আর এই চ্যাট রুমে মানুষের মত দেখতে অসংখ রোবট আছে, দেখে বোঝার উপায় নাই, কিন্তু কথা বললে বোঝা যায়,ওরা আসলে মানুষ না,রোবট।যদিও ওরা খুবই বুদ্ধিমান এবং মানুষকে আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু একটা যন্ত্রকে আমার বন্ধু ভাবতে খারাপ লাগে। জানো কার্টার আমি বহুদিন পর তোমার সাথে মানে কোনো মানুষের সাথে কথা বললাম।খুব আবেগ ঘন কন্ঠে ম্যাক কথাগুলো বলল। কার্টার ম্যাক এর আবেগকে বুঝতে পারল, সে ও ম্যাক এর জন্যে একটু কষ্ট অনুভব করল। মুখে বলল, ম্যাক এখন আমি আছি না, আর তোমাকে রোবটদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে না। আমি আর তুমি মিলে সারাক্ষণ আড্ডা মারব,ঘুরে বেড়াব। ঠিক আছে? সত্যি বলছ কার্টার-ম্যাক কার্টারের দিকে তাকিয়ে চিতকার করে বলল। হ্যা ম্যাক, তুমি প্রতিদিন সুর্যমান সময় ১৭ টাই আমাদের প্রিয় ঐ ঝর্ণাটার কাছে আসবা,আমিও আসব।আমরা খুব মজা করে আড্ডা মারব,ঘুরে বেড়াব, ঝর্ণা দেখব।ম্যাক একটু ব্যাথিত হল, সে ধীরে ধীরে বলল, আবার ভার্চুয়াল লাইফ, ভার্চুয়াল কন্ঠ, ভার্চুয়াল আড্ডা! তাহলে রোবট আর তোমার মধ্যে পার্থক্য কি হল।ও ম্যাক, ওক, তুমি বল,তুমি কি চাচ্ছ?ম্যাক বলল-তুমি শুনবে আমার কথা? ম্যাক আমি তোমাকে বন্ধু মেনে নিয়েছি, খুব কাছের একজন বন্ধু,তুমি বল আমাকে কি করতে হবে?-আন্তরিকতার সাথে কার্টার কথাগুলো বলল।এ কথা শুনে ম্যাক এর চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল,সে খুব তড়িঘড়ি বলল – কার্টার আমি তোমার সাথে বাস্তবে দেখা করতে চাই, বাস্তবে আড্ডা মারতে ঘুরে বেড়াতে চাই, ভার্চুয়াল জগতে না।কার্টর বলল, ঠিক আছে, তুমি তাহলে চাঁদে চলে আস, আমাদের এখানে একটা বিশাল সুইমিং পুল আছে, চাদে মানুষ যখন প্রথম বসবাসের জন্যে আসে তখন তারা স্নান করার জন্যে নাকি এটা তৈরি করেছিল।খুব সুন্দর!ওইখানে বসে আমরা আড্ডা দিব।ম্যাক খুব উতসাহ নিয়ে বলে, হ্যাঁ আমি ও ঐটার একটা ডকুমেন্টারি দেখেছি, খুব সুন্দর। খুব মজা হবে।কার্টার বলল- ওক ম্যাক,তাহলে কখন আসবা? ম্যাক বলল, এখন সুর্যমান সময় ৪৫, আমার এখান থেকে সুর্যমান সময় ৬৯ এ একটা এয়ার বাস ছাড়বে চাঁদের উদ্দেশ্যে,আমি ঐটাতে রওয়ানা দিব। ওক ম্যাক আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। ঠিক আছে কার্টার তাহলে এখন বিদায়, দেখা হবে। ভাল থাক।ওক ম্যাক সী ইউ।

ম্যাক তার ড্রাইভার রোবটকে গাড়ী বের করতে বলে বাথরুমে ঢুকল।বাথরুমে ঢোকা মাত্র তার সমস্ত শরীর স্ক্যান করে সেন্ট্রাল হেলথ কম্পিউটারে মুহুর্তের মধ্যে সয়ংক্রিয়ভাবে পাঠিয়ে দেয়া হল তার রিপোর্ট।এক মুহুর্ত পর বাথরুমের দেয়াল জুড়ে লাগনো স্ক্রিনে ফুটে উঠা তার শারিরীক রিপোর্টের একটা এলার্ট ম্যাকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটা লাল এলার্ট মেসেজ জ্বলছে নিভছে।তাতে লেখা,”মিঃ ম্যাক, আপনার হার্ট স্বাভাবিকের চেয়ে ১০% বেশি দ্রুত কাজ করছে এবং ব্রেন স্বাভাবকের চেয়ে ০.৯৯১৯ গুন দুশ্চিন্তা গ্রস্ত-যা আপনার স্বাস্থের জন্য ০.০১৮৯% ঝুকিপুর্ণ।আপনার ঘুমের প্রয়োজন ১৭% এবং এই মুহুর্তে ভ্রমন করলে হার্ট ফেইল হওয়ার ১২.৫৯৪৮% সম্ভাবনা আছে।পরামর্শগুলো মেনে চলার জন্য ধন্যবাদ।”—উউফফ ম্যাকের এই টাইপের ন্যাকামিগুলো অসহ্য লাগে।কিন্তু প্রত্যেক বাথরুমে এই স্বয়ংক্রিয় হেলথ চেক যন্ত্র বসানো রাষ্ট্রিয় আইন অনুসারে বাধ্যতামুলক। ম্যাক চোখে-মুখে পানি দেয়ার জন্যে বাথরুমে ঢুকেছিল।সে বিরক্ত হয়ে দ্রুত বাথরুম থেকে বের হয়ে দ্রুত পায়ে বাসার সামনে গেল। একটা রোবট গাড়ী নিয়ে দাড়িয়ে আছে।ম্যাককে আসতে দেখে সে গাড়ীর দরজা খুলে ধরে তার যান্ত্রিক কন্ঠে বলল,”আপনার যাত্রা শুভ হোক,স্যার”। ম্যাক গাড়ীতে চেপে বসল।১মিঃ ৪৫ সেঃ এর মাথায় ৮৯ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করে ম্যাক রকেট বন্দরে এসে পৌছল। রকেট এ উঠার জন্য দরজার সামনে যেতেই তার সমস্ত শরীর স্ক্যান করে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সিকিউরিটি চেক এবং অথেনটিকেশন মুহুর্তের মধ্যে সম্পন্ন করে রকেটের অদৃশ্য দরজাটি খুলে গেল।ম্যাক ধীর পায়ে রকেটের মাঝামাঝি একটা জায়গায়, বিশাল আকৃতির এক জানালার কাছে যেয়ে তার আসন গ্রহণ করল।ম্যাকের রকেট থেকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে খুব ভাল লাগে। রকেটের জানালা দিয়ে আকাশ দেখার জন্যে এর আগে সে বহুবার বিনা কারণে চাদে গেছে। আজকে ও তাই জানালার পাশে বসার সুযোগটা সে ছাড়তে চাই নি।৫ সেঃ ৩ মুহুর্ত পর রকেটটি চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।ম্যাক জানালা দিয়ে আকাশ আর মেঘের লুকোচুরি দেখতে দেখতে পৃথিবীর মহাকর্ষণ শক্তির মায়া কাটিয়ে, বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে চাঁদের দিকে যেতে থাকল। এই চাঁদে যাওয়ার যানগুলা খুবই আধুনিক। এই যানে, এখন আর বিংশ শতাব্দির নভোচারীদের মত স্পেশাল পোশাক পড়তে হয় না, কিম্বা এটা কোনো বহিঃ শক্তি কিম্বা মহাকর্ষ-অভিকর্ষের বিপাকে পড়ে ধংস হবে এমন কোনো ঝুঁকি নেই। এই যান আলোর কাছাকাছি বেগ এ চলে। পৃথিবী থেকে চাঁদে যেতে মাত্র ১৫ মিঃ সময় লাগে। “সম্মানিত যাত্রী মন্ডলী,কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা চাঁদে অবতরণ করতে যাচ্ছি, আমাদের সাথে ভ্রমণ করার জন্য ধন্যবাদ।ভালো থাকুন সব সময়”- একটা রোবটিক কন্ঠে ঘোষণা হল। ঘোষণা শুনে ম্যাকের মণটা পুলকিত হল। আর কিছু মুহুর্ত পরই সে পেতে যাচ্ছে বন্ধু হিসেবে একজনে মানুষকে।ম্যাক এর আর তর সইছে না। কি কথা বলবে কার্টারের সাথে। মেয়েটি কেমন ফ্রেন্ড হবে, দেখতে কেমন সে। মেয়েটা বাস্তবে তাকে দেখে,তার কথা শুনে তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইবে তো! এমন নানা ভাবনার দোলাচলে ম্যাকের মণ আনচান করছে। এই রকম বিচিত্র এক অনুভুতি নিয়ে, এক অজানা সুখের রোমাঞ্চিত আশায় চাদের বুকে পা রাখল ম্যাক।

ওয়েলকাম ম্যাক-আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি।ম্যাক বিস্মিত স্বরে বলল- কিন্তু আপনারা কারা, কার্টার কই? আমি তো কার্টারের কাছে এসেছি। হুম ম্যাক, তুমি ঠিকই এসেছ। কিন্তু কার্টারের ব্রেনে আরো কিছু স্বংক্রিয় বুদ্ধি এবং সেলফ গ্রোথ ইমোশন এন্ড ইন্টেলিজেন্সি বসানোর জন্যে ওকে হিমাগারে রাখা হয়েছে।তুমি অন্য রোবোটদের সাথে গল্প কর। আমরা আশা করছি আর ৩ ঘন্টার মধ্যেই কার্টার সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে, আগের অবস্তায় ফিরে আসবে।খুব বুদ্ধিদীপ্ত কন্ঠে ভাবলেশহীন কন্ঠে ঘোষনা করল লোকটি।হোয়াট !!…ম্যাক চিত্তকার করে উঠে।কি বলছেন আপনারা? কার্টার মানুষ না?…না ম্যাক, আমরা গত ১ বছর ধরে ৯৯ জন রোবট বিজ্জানী এবং ৭ জন মনুষ বিশষজ্ঞ মিলে কার্টারকে ডেভেলপ করছি, আমরা কার্টরের অনুভুতি,আবেগ,ভালোবাসা,চিন্তা-ধারা,আচরণ সবকিছু মানুষের মত করার চেষ্টা করছি। রোবট ওরগানাইজেশনের রিপোর্ট অনুসারে, ০.১৫৯৮% মানুষ গতানুগুতিক রোবটকে বন্ধু কিম্বা সংগী হিসেবে পছন্দ করছে না, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রোবটকে গতানুগতিক ধারা থেকে বের করে হুবহু মানুষের মত করার।আর তার ই ধারাবাহিকতাই কার্টারকে ডেভেলপ করা হয়েছে। কার্টার ৯৮.৮৯৭৬% মানুষের মত আচরণ করতে সক্ষম এবং ।০.০০৪৫% মানুষ বুঝতে পারে, কার্টার একটা রোবট। যাই হোক ধন্যবাদ ম্যাক, আমাদের কাজে সহযোগীতা করার জন্যে।মিঃ ম্যাক আপনি একটু অপেক্ষা করুন, কার্টার যেগে উঠবে- বলে লোকটি চলে গেল। ম্যাক হতাশা, ঘৃনা অর ব্যার্থতার মিশ্র অনুভুতি নিয়ে আর একজন রোবট কিন্তু মানুষের মত একজন রোবট,কার্টারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। এই অপেক্ষার প্রতিদান হিসেবে রোবটিক ওরগানাইজেশন হয়তো তাকে কার্টারের অনুলিপি দিবে, বন্ধু হিসেবে।ম্যাকের বন্ধু হিসেবে একজন মানুষ কে পাওয়া হয়ত আর হল না। তবুও ম্যাক অপেক্ষায় আছে, সে দেখতে চাই, নতুন কার্টার আসলে কতটা মানুষ হতে পারে!