২৬শে জানুয়ারি ভারতীয় সময় রাত তখন আনুমানিক ১১টা হবে, সারাদিনের কাজের ক্লান্তি শেষে বিছানায় শুয়ে ফেসবুক খুলেছি মাত্র, একটা পোষ্ট দেখে চোখ আটকে গেল, “অভিজিৎ-দা এবং বন্যাআপা গুরুতর-ভাবে দুষ্কৃতিদের হাতে জখম, ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসুন, রক্তের প্রয়োজন হতে পারে।‘’ পোষ্টটা দেখেই হতভম্বের মতো অন্য পোস্টগুলি দেখতে গিয়ে বন্ধু-প্রতিম দীপ্তরূপ ভট্টাচার্য্যর একটা পোষ্ট দেখলাম “অভিজিৎ রায় আর নেই”। ধীরে ধীরে অনলাইন ভিত্তিক সংবাদগুলি চোখের সামনে আসলো, ঘটনার ছবিগুলিও আসলো, বীভৎস ছবিগুলি দেখে চোখের জল আটকাতে পারিনি। চোখের সামনে কম্পিউটারের স্ক্রিনটা ঝাপসা হয়ে যেতে লাগলো , ভাবতে থাকলাম যতই মতবিরোধ থাক, যতই শত্রুতা থাক একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে কিভাবে নৃশংসভাবে কোপাতে পারে?
বিছানা থেকে উঠে পড়লাম, কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, গেস্ট হাউসের বারান্দায় হাঁটছি উ-ভ্রান্তের মতো। মোবাইলটা ব্যর করে ভাবলাম, ত্রিপুরার বিজ্ঞান-কর্মীদের ঘটনাটা জানাই, তাও চেয়ে দেখি মোবাইল টাওয়ার নেই। রুমে এসে ফেসবুক খোলে একটা স্ট্যাটাস দিলাম- “ফেসবুকে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের উপর প্রাণঘাতী হামলা করেছে সন্ত্রাসীরা। আমার মুক্তবুদ্ধি চর্চায় যে কজন লোক আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ছেেন তার মধ্যে এই অভিজিৎ দা একজন। আর কতকাল ঈশ্বরের গুন্ডাবাহিনীর কাছে আমাদের প্রাণ সপতে হবে?”
ফেসবুকে চ্যাট বক্সে দেখলাম বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য বন্ধুরা রাত জেগে অনলাইন, অনেকের সাথে কথা বলে বুঝলাম সবাই হতবাক, দু:খিত এবং ক্ষোব্দ।
এই রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না. সকাল ৫টার দিকে ব্লক কর্ডিনেটর আমার রুমে আলো দেখে জিজ্ঞেস করছেন, সুমিত তুমি ঘুমাও নি? আজ ৭টা থেকে কাজ করতে হবে। উনাকে সব ঘটনা খুলে বললাম, বললাম আজ আর কাজ করার মন নেই, আমি বাড়ীতে চলে যাব। অন্যসময় হলে তিনি বাঁধা দিতেন, এইদিন আর বাধা দিলেন না। আনন্দবাজার থেকে কাঞ্চনপুর এসে মোবাইল টাওয়ার পেলাম। ত্রিপুরার অনেক বিজ্ঞান-কর্মীর ফোন পেলাম। সবাই জানতে চাইলেন কিভাবে ঘটনা ঘটল? সবাই উৎকণ্ঠিত, হতবাক এবং ক্ষোব্দ। সবার একি প্রশ্ন, আমরা কি করতে পারি? আমি জানতাম আমাদের আমজনতার প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে? তাই বললাম সব বিজ্ঞান-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিক করা হোক কি করা হবে?
এদিকে বাড়ী এসে টিভি চালিয়ে দেখলাম প্রায় সব ভারতীয় নিউজ চ্যানেল ঘটনাটা প্রচার করছে এবং নিন্দা করছে। সংবাদপত্রগুলির শিরোনামে ছিল “ঢাকায় মুক্তমনা ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় নৃশংসভাবে খুন”, আবার অনেক সংবাদপত্র ছাপিয়েছে “ঢাকায় হিন্দু বুদ্ধিজীবী খুন” হিন্দু শব্দটা দৃষ্টিকটু এবং একজন মুক্তমনার পাশে বসানো অপমানকর। আসলে ভারতের মুক্তমনের মানুষরা যেমন ঘটনায় তীব্র ক্ষোব্দ ছিলেন, তেমনি একটা সাম্প্রদায়িক গোষ্টি একে মুসলিম দ্বারা হিন্দু হত্যা নামে চলাতে চেষ্টা করেছে যদিও পরে মুক্তমনাদের তীব্র প্রতিবাদ, মিছিল-সভা-সমাবেশের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। শুনলাম ঢাকার শাহবাগ এবং কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়েছে।
এদিকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় ডি ওয়াই এফ আই এবং এস এফ আই- ছাত্র সংগঠনের ডাকে রাজপথে শত শত মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সংবাদে ছিল – “আগরতলা ক্রুদ্ধ ; অভিজিতের হত্যাকারীর দ্রুত বিচার চায় ; মুক্তমনাতে আরও বেশী বেশী করে ত্রিপুরা-বাসীর অংশগ্রহণের আহ্বান রাখছে”।
খবর পেলাম আগরতলায় ‘যুক্তিবাদী ঐক্য-মঞ্চ’ নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন ৪ মার্চ অভিজিৎ হত্যা এবং মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধের বিরোধে প্রতিবাদ সভা এবং প্রতিবাদ মিছিল করবে, সেখানে যোগ দেয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এমন একটা কাজে আছি যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কড়া নির্দেশ ১৫ মার্চের ভিতরে কাজ শেষ করতে হবে, তাই ছুটি পাওয়া দুষ্কর। পরে জানলাম এবং ছবি পেলাম যে তাদের সমাবেশ, মিছিলে প্রচুর মানুষ হয়েছে এবং সুস্থভাবেই সম্পূর্ণ হয়েছে।
আরেকটা আবছা খবর ছিল কমলপুরেও ভারতীয় বিজ্ঞানও যুক্তিবাদী সমিতি (ত্রিপুরা শাখা) এবং কমলপুর শাহবাগ সংহতি মঞ্চের ডাকে কমলপুরে অনুরূপ প্রতিবাদ মিছিল এবং সমাবেশ হবে এবং এতে যোগ দেয়ার একটা ইচ্ছা ছিল, অভিজিৎ-দার হত্যার একটা প্রতিবাদ অনলাইন ছাড়া করতে পারছি না বলে নিজেকে অপরাধীই লাগছিলো। কিন্তু কবে সভা-মিছিল কিছুই জানতাম না। একদিকে কাজের চাপ অন্যদিকে মোবাইল টাওয়ার নেই, খোজও নিতে পারছি না। ৫ মার্চ সকালে আমাদের বলা হল কাঞ্চনপুর মহকুমায় কাজ শেষ আজ আমরা পানিসাগর চলে যাবো। পানিসাগর আসলাম প্রায় বেলা ১১:৩০মি, এসে মোবাইল টাওয়ার পেয়ে ফোন করলাম ভারতীয় বিজ্ঞানও যুক্তিবাদী সমিতি (ত্রিপুরা শাখা) সম্পাদক দুলাল ঘোষের কাছে, তিনি ফোন ধরে বললেন সুমিত তোমাকে ফোন করে পাই না যেমন হোক তুমি কমলপুর আজ বিকাল ৫টার ভিতরে আসো, আজ আমরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করবো। সাথে সাথে গাড়ীতে ওঠে পড়লাম কমলপুরের উদ্দেশ্যে। বিকাল ৪:৫০ মি গিয়ে কমলপুর পৌঁছে দেখি শত শত মানুষের ঢল হাতে প্ল্যাকার্ড, ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ, আমি পৌছতেই মিছিল শুরু হলও, সামনে একটা গাড়ী থেকে ধারাভাষ্য ভেসে আসছিলো, অভিজিৎ-দার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে, ধিক্কার জানানো হচ্ছিল খুনি মৌলবাদী হায়েনাদের। মিছিল যত অগ্রসর হচ্ছিল পথচারী মানুষরাও মিছিলে যোগ দিচ্ছিলেন, মিছিল গিয়ে থামলও কমলপুর বাস টার্মিনালে যেখানে পথ-সভার আয়োজন করা হয়েছিল । সেখানে শহীদ-বেদীতে মোমবাতি প্রজ্বলন ও পুষ্পাঘ অর্পণ করেন বিশিষ্ট-জনেরা। নিহতের স্মৃতির প্রতি সন্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বক্তৃতা দেন অনেকে, ওঠে আসে ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদের করাল থাবার কথা, আমাদের ভয় পেয়ে পিছু হটলে হবে না, সত্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে অভিজিৎ রায়ের লড়াই থেকে ইত্যাদি।
এদিকে কৈলাশহর মহকুমায় চলা বইমেলাতেও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। অয়নরায় নামে একজন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন –
কুমারঘাট, উদয়পুর এবং ধর্মনগরেও বিক্ষোভ মিছিল হবে বলে খবর পেয়েছি।
এদিকে ত্রিপুরার বিশিষ্ট বিজ্ঞানমনস্ক লেখক সুদীপ নাথ মহোদয় যেমন অনলাইনে প্রতিবাদ করেছেন এই বর্বরোচিত হত্যার,যুক্তিবাদী ঐক্য-মঞ্চের প্রতিবাদী সভায়ও সক্রিয় ছিলেন, তেমনি ত্রিপুরার সর্বাধিক প্রচারিত ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় লিখলেন “নয়া সক্রেটিস অভিজিৎ রায়’ নামে আর্টিক্যাল। পড়া যাবে এখান থেকে
এখন প্রতিদিনই অভিজিৎ-দাকে নিয়ে লেখা ব্যর হচ্ছে দৈনিকগুলিতে, গতকাল সুদর্শনা চক্রবর্তী লিখলেন “প্রতিবাদের শুধু নাম বদলে যায়” নামে আর্টিক্যাল পড়া যাবে –এখান থেকে
আজ আবার দেখলাম শঙ্খশুভ দেববর্মণ লিখেছেন “ধর্মান্ধতা অভিশাপ ও অভিজিৎ রায়” পড়া যাবে এখান থেকে
অভিজিৎদা দুই-বাংলার লেখকদের উৎসাহ দিতেন মুক্তমনায়, চাইতেন দুই-বাংলার সেতুবন্ধন। অজয় স্যার যখন উনার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য কলকাতা এসেছিলেন তখন অভিজিৎদা আমাকে বলেছিলেন এ-বাংলার মুক্তমনাদের নিয়ে অজয় স্যারের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু আমি এত দূরে থাকি কলকাতা থেকে যে সেটা সম্ভব হয় নি। শুধুমাত্র একদিনই অজয় স্যারের সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম।
আজ অভিজিৎদা সশরীরে নেই কিন্তু রয়ে গেছেন উনার সৃষ্টির মধ্যে, বিশ্বের কোটি কোটি মুক্তমনাদের মধ্যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে। এইভাবে ইতিহাসেও ধর্মান্ধ হায়েনারা হত্যা করেছে মুক্তচিন্তকদের , আজ তারাই ক্ষমা চাইছে, তারা ভুল ছিল বলে। এই ভারতীয় উপমহাদেশেও আজ যারা মুক্তকন্ঠরোধ করছে, এরাই একদিন ক্ষমা চাইবে, চাইতেই হবে কারণ আমরা সত্যের পথে। জয় আমাদের হবেই।
অভিজিতদা আছে – থাকবে আমাদের মননে, আমাদের কলমে। সালাম।
অভিজিৎ দা’র মৃত্যু নেই, তিনি আছেন আমাদের মাঝে যতদিন মুক্তমনা আছে, যতদিন এই পৃথিবীতে একজন হলেও প্রথাবিরোধী আছে, ততদিন অভিজিৎ দা’র মৃত্যু নেই।
মুক্তমনার সংগ্রাম চলবেই। :good:
লেখাটি পড়ে খুবই ভাল লাগল। অভিজিতদাকে ভুলা যায় না, সম্ভব না।
ভারতে এই নৃশংস ঘটনার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর জন্য ধন্যবাদ!