আব্বা তুমি হয়ত বাংলাদেশের নামী দামী কেউ ছিলেনা,
কিন্তু আমার কাছে তুমি রুপকথার রাজকুমার !
মনে পড়ে প্রাইমারীতে পড়ি তুমি আমাদের ও খালাতো বোনদের রিক্সায় ভরে,
রংপুর ক্যান্টনমেন্টের হেলিপ্যাডে হেলিকপ্টার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলে।
তুমুল বাতাসের আন্দোলনে চারপাশের বাশঁঝাড়গুলোকে একেবারে প্রবলমত্তে নাচিয়ে হেলিকপ্টার যখন অবতরণ করল মাটিতে, শৈশবের রোমাঞ্চ ভরা চোখে অবাক বিস্ময়ে দেখেছি আর মুগ্ধ হয়েছি।
আর আজ প্লেনে করেই সব যাতায়াত।প্রবাসে আছি আজ কত বছর, জীবনের প্রায় আধেক সময়.
কত কি তুমি দেখিয়েছো আমাদের। দিনাজপুরের রামসাগর!স্পীডবোটে তীব্রঢেউয়ে নেচেছি তোমার সাথে।
তুমি সব কিছুতে আনন্দ পেতে!।উপভোগ করতে চাইতে পৃথিবীর যত রস,সুবাস ও ছন্দ!
আর আমাদেরও উপভোগ করিয়েছো তার সাথে সাথে।
আমরা দু’বোন ছিলাম তোমার কাছে বড়’মা আর ছোট’মা।
মনে পরে,বাসায় হয়ত অনেক লোকের দাওয়াত।অনেক আয়োজন।।মা রান্নাঘরে হিমশিম।কাজের মেয়েদের দিয়েও কুলায়না।
মা বলতেন লাইজু আসনা একটু এদিকে, আর আমি মহাফাঁকিবাজ !
পড়ারবইয়ের চেয়ে গল্পেরবইই পড়ি তখন বেশী। গল্পেরবইয়ের নেশা কাটেনা।কিছুতেই পড়ারটেবিল ছেড়ে উঠিনা।
আব্বা তোমার গলার আওয়াজ শুনি-মাকে বলছ, আহা অত ডাক কেন,
সারাজীবন তো করবেই। আমি বেঁচে যাই।
কিন্তু আব্বা তুমি জাননা, আজ প্রবাসজীবনে তোমার আদরের মেয়ে চাকরী করেও
রান্নাবান্না,ঘরপরিস্কার,থালাবাসন সব করছে, কোন মাপ নেই, কেউ আগলে ধরার ও নেই।
তুমি ছিলে অনেকট পাইওনীয়ার।প্রথমে তুমি শিক্ষকতা করেছো।গ্রামের হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলে।
দেখেছি কি প্রবল উদ্দীপনায় সাংস্ক্রিতিকঅনুষঠানের আয়োজন করতে।
মাইকটেস্ট থেকে শুরু করে গান, কবিত্,আবৃতি, নাটক সব নিবার্চন করতে।
সুন্দর করে উপস্থাপনা করতে, তোমার বড়’মাকে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে আবৃত্তি করার জন্য।
আর আমারতো তখন বয়সই হয়নি,মাইকের সামনে দাঁড়ানোর সবে ওয়ানে পড়ি!
মানুষের ওপর ভালবাসা আর মমতা ছিল তোমার অপার।প্রায়ই দুপুরে খাবার সময় ভিক্ষুকেরা দরজায় হাজির হত।
খাবার চাইত।মা বলতেন প্রতিদিন এরা খাবার সময় হাজির হয়।তুমি বলতে দাওনা কিছু আমার পাত থেকে তুলে।
মা বাধ্য হতেন ওদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিতে।
তুমি সমবায় বিভাগে চাকরি করতে।নজরুলগীতি ছিল তোমার খুব প্রিয়।
প্রায়ই নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করতে–
“ওরে নিপীড়িত ওরে ভয়ে ভীত,
শিখে যা আয়রে আয়,
দুঃখ জয়ের নবীন মন্ত্র,
সমবায় সমবায়”।
সমবায় বিভাগে ভাল পারফরমেন্সের জন্য কয়েকবার তুমি শ্রেষঠ অফিসারের পদক পেয়েছো।
তুমি ছিলে দারুন সংগঠক, সমবায় দিবসের অনুষঠানে নাটকে এমন অভিনয় করতে তুমি যে সবাই হাসিতে গড়াগড়ি খেতাম।
তোমার বিভাগের সবার কাছে আমাদের বাড়ীর নাম ছিল তোমার হোটেল।
মনে পরে ছোটবেলায় শীতের দুপুরে লেপের নীচে শুয়ে, তোমার কাছে রুপকথার গল্প শুনতাম,
রাজা সন্ন্যাসীর আদেশে সিংহাসন ছেড়ে বনবাসে চলে যান।তারপর রাজার হাতী শুঁড়ে করে রাখালছেলেকে উঠিয়ে এনে
সিংহাসনে বসায়।রাখালছেলে রাজা হয়। শুনতে শুনতে রাজ্যের ঘুম নেমে আসত চোখে।
আহা সেই রুপকথার দিনগুলি আজ কোথায় !
তুমি বদলি হয়েছো যশোরে, আমরাও গিয়েছি, যশোরের সাগরদাড়িঁতে কবি মাইকেরল মধুসূদনের জন্মদিন উপলক্ষে
বিরাট মেলা।ঢাকা থেকেও অনেকে গিয়েছে।মানুষের মিছিল।বড় বোনের সাথে খেলত খেলতে কখন যেন বারান্দা থেকে নেমে রাস্তায় ঐ মিছিলের সাথে মিশে গিয়েছিলাম।এজন্য বড় বোনও কম বকুনি খায়নি।পরে অফিসের সবাই খোঁজাখুঁজি করে
আমাকে নিয়ে এসেছে।ভাবতেই শিউরে উঠি এখনও!
রাজশাহী বিশশবিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ারের অনিন্দ্যসুন্দরি ছাত্রী নীহারবানু নিঁখোজ। একদিন সকালে পড়ছি।
ড্রইংরুমে উপস্থিত নীহারবানুর বড় বোন ডাঃমনজিলা।এসে হাউমাউ কান্না।চাচা আপনার কথা শুনেছি।
আপনি পারবেন আমার এ উপকার করতে।(১৯৭৯ দিকে নীহারবানু সহপাঠি বন্ধুদের হাতে নিহত হয়।ঘটনার নায়ক প্রেমিকবর রংপুরের আলালের ঘরের দুলাল একমাএ সন্তান বাবু।ডাঃ মনজিলার বাবা ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।তিনিও সমবায় বিভাগে চাকরি করতেন।রাজশাহী সমবায় বিভাগের লোকেরা মনজিলাকে তোমার কাছে পাঠায়।)তুমি সারাদিন সব কাজ ফেলে মনজিলাকে নিয়ে নিখোঁজ রহস্য উদঘাটনের জন্য সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছো।
তোমার পরোপকার ছিল তুলনাবিহীন!পরে অত্যন্ত আলোচিত নীহারবানু হত্যাকান্ড বিচারের বিবরণী সেসময়কার ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রায়’অনেকদিন ধরে প্রকাশিত হয়েছে।
আব্বা তুমি ছিলে ভীষন রোমান্টিক। তোমার কয়েকটা প্রেমপএ মার পুরোনো ট্রাঙ্কে পেয়েছিলাম।।তাতে মাকে সম্ভোধন করতে বাঁশি বলে।মার ডাক নাম বেণু তাই।
আর তোমার পোষাকের ওপর ঝোঁক ছিল দূর্নিবার।রংপুর কারমাইকেলে পড়ার সময় তুমি নাকি প্রতিদিন পোষাক বদলাতে।আর সে পোষাক যেত কলেজ শেষে ফেরার পথে ধোপার বাড়ি।ইস্ত্রি ছাড়া চলতনা।বিয়ের পর মাকেও তুমি সে হিন্দুস্তানি ধোপার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলে।সেই ধোপানি নাকি আধভাঙ্গা বাংলায় বলেছিলো মাকে–“আরে তোর বর তো রাজকুমার আছেরে”।
অনেক পরে মার কাছে শুনে খুব হেসেছি।
তুমি আজ এ পৃথিবীতে নেই।আমাদের ছেড়ে চলে গ্যাছো পরপারে!তোমার যাওয়ার সময় কাছে থাকতে পারিনি।
ছিলাম প্রবাসে।।তুমি যে এত অসুস্থ কেউ আমাকে জানায়ওনি চিন্তা করব বলে।
আব্বা তোমাকে মাঝে মাঝে সপ্নে দেখি, ফুল বাগানের মাঝখান দিয়ে হাসতে হাসতে যাচ্ছ।
তুমি সবসময় হাসছ বা আনন্দ করছ, এই দেখি সবসময়।
তুমি যা ভালবাসতে এ পৃথিবীতে তাই!
তুমি ভালো থাকো!আনন্দে থাকো!
আমারো কাছেও ছেলেবেলার স্মৃতি মধুর। কিন্তু এমন অনেকে আছেন যারা ছেলেবেলায় মা-বাবা হারিয়েছেন তাদের কাছে লেখাটি পড়ে বিষাদ লাগবে। এটা এমন যে কোন ধনী লো্ক তার আরম-আয়েশের কথা গরিব লোকের কাছে বরন্না দেবার মতো।
@ব্রাইট স্মাইল্,
আপনি যা বলছেন তা সত্যি।
অতটা ভেবে লিখিনি।
শুধু আব্বার স্মৃতিচারনের জন্যই এ লেখা ।
ধন্যবাদ
@ব্রাইট স্মাইল্,
একমত হতে পারলাম না, হতে পারে কারো কারো সেরকম খারাপ লাগবে তবে সবার নিঃসন্দেহে লাগবে না। আমার নিজের বাবা আমার ১২ বছর পুরো হবার আগেই মারা যান। তার মধ্যেই তাকে নিয়ে আমার যত সোনালী স্মৃতি আছে তাতে বাকি জীবন কেটে যাবে। অন্যেদের একইরকম অভিজ্ঞতা শুনতেও খুব ভাল লাগে।
ভাল লাগল।
বাবা মার স্নেহ ভালবাসায় ভরা ছেলেবেলার কি কোন তূলনা হতে পারে?
এসব স্মৃতি কোনদিন ম্লান হবার নয়।
@আদিল মাহমুদ,
আসলেই ছেলেবেলা মেয়েবেলার স্মৃতি সততই মধুর!
অনেক ধন্যবাদ!
খুব ভালো লাগলো । বাবা-মা কে মনে রাখা সন্তানদের পবিত্র্র কর্তব্য ।
@অশোক লাহিড়ী,
ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ !
মনটা বিষাদক্লিষ্ট হয়ে গেল এই লেখা পড়ে।
আমি আমার পিতাকে হারিয়েছি আট বছর আগে। তিনি যখন মারা যান তখন আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। পিতাকে নিয়ে আমার কোন সুখস্মৃতি নেই, তারপরও সেই মৃত্যু সংবাদ বিশাল এক অপ্রত্যাশিত আঘাত হয়ে এসেছিল আমার জন্য। ওরকম অনুভূতি যে হবে সেটাই আমার জন্য বিস্ময়কর ছিল।
আজ এত বছর পরেও মগজের গভীরে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা টের পাই আর নিজেই অবাক হই।
@ফরিদ আহমেদ,
আপনার বাবাই তো আপনার জনক।
তার জন্যই আজ আপনি এ পৃথিবীতে!
এটাই নিয়ম।
ভালো থাকুন।
ধন্যবাদ
লাইজু নাহার, আপনাকে ভাগ্যবান বলতেই হবে এমন বাবা আপনার জীবনে পেয়েছিলেন।এমন বাবারা যদি আমাদের জীবনে বেশী থাকত তাহলে বাংলাদেশে আমাদের জীবনটা আরো অনেক অনেক বেশী মানবিকতা ও ভালোবাসাময় হতো।
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
আসলেই আমি ভাগ্যবতী যে আমি এমন বাবা পেয়েছিলাম।
কামনা করি পৃথিবীর সব বাবাই এমন মানবিক ও মানবপ্রেমিক
হোক!
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!