পরাধীন স্বপ্নজগৎ
আদনান আদনান

উৎসর্গ
হারুকি মুরাকামি


আজ হলুদ প্যান্ট, লাল শার্ট, আর কালো চশমায় তাকে অদ্ভুত একটা জন্তু বলেই মনে হচ্ছে। তার চশমায় চোখ পড়তেই সে দাঁত বের করে হাসে। এমন ভাব যেনো সে আমার বাঙলার শিক্ষক। তাকে ঠিক ভদ্রলোক বলা যায় না, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বলতে হচ্ছে। ভদ্রলোক আমার পিঁছু লেগেছেন চাঁচড়ার মোড় থেকেই। সে এতো কাছে যে আমি আমার কাঁধের উপর তার নিঃশ্বাসের গরম বাতাস অনুভব করছি। আমি বুঝতে পারছি তিনি আমার প্রায় শরীর ঘেঁষেই হাঁটছেন, কিন্তু আমি পিছনে ফিরে তাকাচ্ছি না। আমি শহরময় সাইকেল চালিয়েই ঘুরে বেড়াই। যশোরে আমার গণ্ডি চাঁচড়ার মোড়, পাল বাড়ির মোর, শেখ-হাটি, আর মণিহার সিনেমার হল, এই চার বিন্দুর ভিতরের ক্ষেত্রটিতেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে আমি অনেকদিন যাইনি। যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আমি যে আজ পায়ে হেঁটে কেনো আরবপূরের দিকে যাচ্ছি তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। আরবপূরে তো আমার কিছু করার নেই। অথবা আছে হয়তো যা মনে পড়েবে গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে। আমি হঠাৎ করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে বলি, “আমি তো আপনাকে বলেছিই যে আমি আপনাকে চিনি না। আপনি এটা কি শুরু করেছেন? আমার পিছু লেগেছেন কেনো?”
ভদ্রলোক আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বললেন, “আপনি কিন্তু খুব বেপরোয়া মানুষ। আপনি বেশ অসতর্কভাবে চলাচল করেন। রাস্তা-ঘাটে আপনার চলাচল খুবই অগোছালো। একটু আগেই আপনি কিন্তু ট্রাকের ধাক্কা খেতে যাচ্ছিলেন। অথচ আপনি তা লক্ষ্যও করেননি।”
“আচ্ছা বড়োভাই আপানার নামটা কি? আর আমার এতো উপকার করতে আপনাকে কে বলেছে শুনি?”
“না মানে, আপনি তো জানেন-ই আজকাল চাকরির কি অভাব। আপনি ট্রাকের নিচে পড়ে মরলে আমার চাকরিটা যাবে যে!”
“আপনার চাকরিটা কি? আমাকে পাহারা দেওয়া?”
“ঠিক তাই।”
“আপনি যেতে পারেন। আপনি একজন বিরক্তিকর মানুষ!”
“তা তো সম্ভব না। এতে আপনার কোনো লাভ নেই, কিন্তু আমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।”
“কেনো?”
“আমার চাকরি থাকবে না।”
“আরে আমি তার জন্য কি করতে পারি? এ তো এক চরম ভেঁজাল রে ভাই!”
“আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান। আমি তো আর কোনো ক্ষতি করছিনা।”
“ক্ষতি না তো আপনি কি করছেন? আপনি কার চাকরি করছেন? আমার পিছন পিছন একজন হাটছে, তাকে আমি চিনি না, এটা কি আপনার ভালো লাগতো? আপনি তো দেখছি দারূণ ফালতু ব্যক্তি!”
“আপনি রেগে যাচ্ছেন। রাগ মানুষের শত্রু। আমার মনে হয় আমি আপনাকে রক্ষা করছি। আর আমি ঠিক জানি না আমি কার কাজ করছি। আমাকে পাঠানো হয়েছে, আমি এসেছি। আমাকে জানানো হয়নি কে আমাকে পাঠিয়েছে। কে যে আমাকে আসতে বলেছিলো তাও মনে করতে পারছি না। আমি দুঃখিত।”
“আপনার কি মনে হয় যে আমি কোনো বিপদে আছি? আমাকে রক্ষা করতে হবেনা। আপনি এখন যান। আমার অনেক কাজ আছে।।”
“আপনি জানেন না আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আপনার কোনো কাজ নেই। আমি তা জানি।”
“আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না আপানার সাথে বকবক করে। আপনি যা পারেন করেন। আমাকে এখন যেতে হচ্ছে।”
“আপনি আমাকে এইমাত্র যে গালাগালিটা দিলেন তা কিন্তু আপনার উচিৎ হলো না।”
“আমি আবার কখন গালাগালি দিলাম?”
“এই যে বললেন মনে মনে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কে?””
“বলেছি নাকি? জানলেন কীভাবে? হাত-টাত দেখার বা ভাগ্য গণনার ধান্দাবাজী জানা আছে নাকি?”
“আমরা সব জানতে পারি।”
“আমরা কারা?”
“আমরা হলাম আমরা। আপনাদের শুভাকাঙ্খী।”
উন্মাদটার সাথে আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। পরিবেশ বেশ ঠান্ডা, কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি যে আমি ঘেমে উঠছি। আমি বলি, “শালা আমার পিছনে লাগলে কিন্তু খবর আছে তোর। তুই আমারে চিনিস না।”
“কতো সহজেই আপনি নষ্ট হতে পারেন! আজেবাজে কথা বলতে পারেন। মানুষের এ এক আসাধারণ গুন। আমাদের পুঁজি কিন্তু আপনাদের এই গুনটিই।”


আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাকে পিছনে ফেলে হাটতে শুরু করি। আমি বুঝতে পারি তিনি পিছন পিছন আসছেন, কিন্তু আমি তার দিকে আর তাকাই না। তিনি বেশ দূরত্ব রেখে হাঁটছেন। সামনে ট্রেন লাইন দেখেই আমি ডান দিকে হাঁটতে শুরু করি ট্রেন লাইনের উপর দিয়ে। এটা এম এম কলেজ বা জেলা স্কুলে যাওয়ার এটা একটা সহজ রাস্তা। এম এম কলেজের মোড়ে নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে! অনেক দিন পর ট্রেন লাইন ধরে হাটছি। বেশ লাগছে। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম কমিউনিষ্ট পার্টির কথা শুনি। যা শুনি তা বেশ লাগে। কেউ না খেয়ে মরবেনা। সবাই সমান খাবে। এ ধরনের কথাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিলো, আমার তা মনে পড়ে। বয়সটাও ছিলো সমান অধিকারের স্বপ্ন দেখার। হঠাৎ আমার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নিচেটা ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে আর সুরসুড়ি লাগে, যেনো আমার বিড়ালটা আমার পায়ের তলা ঘুমের ভিতরে চাটছে। আমি ট্রেন লাইনে কয়েকবার লাথি মারি, চুলাকানো বন্ধ করার জন্য। তাতে কিছুটা কাজ হয়। আমি দেখি দূরে দাঁড়িয়ে তিনি হাসছেন। তাকে ধরে টেনে একটা চড় মারতে ইচ্ছে হয় আমার। কিন্তু বয়সে অনেক বড়ো তিনি। চড় মারাটা চরম অভদ্রতার কাজ হবে। আমি তাকে চড় মারিনা। আমি হাঁটতে শুরি করি। মনে পড়ে অনেক কাল আগে, পায়ে হেঁটে রোজ এই পথে স্কুলে যেতাম। যশোর জেলা স্কুল। তখন আমরা সবে নিজেদেরকে কমিউনিষ্ট ভাবতে শুরু করেছি। আমরা বন্ধুরা কথা বলাবলি করতাম যে একদিন আমরা এই ট্রেনে চড়ে রাশিয়া চলে যাবো। আমাদের কেউ কখনো প্রশ্ন করেনি যে এই ট্রেনে চড়ে রাশিয়া যাওয়া যায় কিনা! আমরা ভাবতাম আমরা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবো বরফের মধ্যের ট্রেঞ্চ থেকে। আর রাশিয়ান একটা মেয়েকে বিয়ে করবো, যে হবে মিখাইল লেরমন্তভের আমাদের সময়কার নায়ক উপন্যাসের নায়িকা বেলার মতো সুন্দর। বেলাকে আমার বন্ধু শোহেব আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, আর বেলার মতো একটা মেয়েকে বিয়ে করার চিন্তা আমার মাথা-ই প্রথম আসে।
শোহেব একদিন বলে, “আমাদের সবার বউ দেখতে হবে বেলার মতোন?”
পল্লব বলে, “হ্যাঁ।”
“তার মানে যা দাঁড়াছে তা হলো আমাদের সবার একটা বউ হবে, আর তাকে ভাগাভাগি করে চালিয়ে দিতে হবে?”, বলে দার্শনিক রাসেল।
অলিদ বলে, “ব্যাপারটা কিন্তু কমিউনিষ্ট আইডিয়ার দিক থেকে ঠিকই আছে!”
আমরা সবাই সেদিন সারাদিন একজন আর একজনের দিকে বারবার তাকিয়ে হেসেছিলাম। আমাদের এতো হাসির কি কারন তা আর কেউ ধরতে পারে না। আমাদের ইংরেজির শিক্ষক আমাদেরকে সেদিন বেত মেরেছিলেন মনের সুখে। এইসব ভাবতে ভাবতে এম এম কলেজের সামনে এসে পড়ি। দেখা হয় রাসেলের সাথে।


রাসেলকে দেখে দূর থেকেই আমি হাত উঁচু করে ডাক দিয়ে বলি, “চল চা খেয়ে আসি।”
“আরে ব্যাপার কি? না চাইতেই বৃষ্টি যে! সত্যি তো?”
“আরে চলনা কাজ আছে।”
“চল। কোনো মেয়ে ঘটিত ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। তা কে? শেখ-হাটির লুবনা নাকি?”
“আরে না। চল আগে, পরে বলছি…”
চায়ের দোকানে বসতেই রাসেল চায়ের সাথে তিনটা ৫৫৫ এর অর্ডার দেয়। বলে, “দোস্ত অনেকদিন পর খাওয়াচ্ছিস। তারপর বল কি বলবি।”
এমন সময় লোকটা আমার পাশে এসে বসেন, আর বলেন, “দারূণ ট্রেন লাইন। আপনার সাথে এ-পথে আমার আগে হাটা হয়নি। কি সুন্দর সবুজ ধানক্ষেত দু’পাশ দিয়ে। রাশিয়াতে কিন্তু ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে এরকম ধানক্ষেত নেই।”
রাসেল আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “উনি কে? তোর খালু নাকি?”
আমি বুঝে উঠতে পারিনা কি বলবো। কি-ই বা বলতে পারি। বলি, “আমার এক বড়ো ভাই। ফুফাতো ভাই। দূর-সম্পর্কের। আমাকে আপনি করে বলেন আদর করে। দেখা সাক্ষাৎ না থাকলে যা হয় আরকি!” তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলি, “রাসেল আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড।”
রাসেল বলে, “ভাই, চা খান, আর বিড়ি কোনটা খাবেন?”
“চা-বিড়ি তো খাইনা। মদ থাকলে দিতে বলেন।”
রাসেল এতো জোরে হেসে ফেলে যে তার মুখ থেকে চা বের হয়ে আমাদের গায়ে এসে লাগে। বলে, “মাফ করবেন বড়ো ভাই। আপনি ফানি লোক আছেন! আপনার নামটা কি?”
আমি বলি, “পান-বিড়ির দোকানে মদ?”
“না মানে ঠিক আছে… আমার কোনো নাম নেই। মানে আমি জানিনা। মদ না হলেও চলবে।”
রাসেল আমার দিকে তাকায়ে চোখ ঘোরাই। মানে জিজ্ঞেস করে, এর কি মাথা খারাপ? আমি মাথা নাড়ি হ্যাঁ সূচকভাবে। এতে করে রাসেলের ভক্তি তার উপরে বেড়ে যায়।
“বড়ো ভাই আপনারা কোন এলাকার লোক?”
“স্বপ্ন ও চিন্তা জগতের।”
“দারুণ। দারুণ বলেছেন। এই এলাকাটা আমারও খুব পছন্দের। তা আপনি আদনানের সাথে শহর দেখতে বেরিয়েছেন নাকি?”
“তা বলতে পারেন।”
“আমাদের এখানে তেমন কিছু নেই দেখার। তারপরও নতুন একটা শহর দেখছেন এতে একটা মজা আছে।”
রাসেল বলে, “তা তুই যেন কি বলতে চাচ্ছিলি?”
“চল লাইব্রেরি থেকে কিছু বই চুরি করে আনি। বেশ কিছু বই আমার পছন্দ হয়েছে।”
“চল যাই। আমারও কিছু দরকার। রাসেলের দুটো বই দেখলাম সেদিন। চল নিয়ে আসি। এ-সব বই তো আর কেউ পড়ে না আজকাল। চুরি করলে ক্ষতি নেই। বড়োভাইকে বাড়িতে পাঠায়ে দে। সে একটা ভেঁজাল বাঁধাবে।”
“আমাকে নিয়ে ভয় পাবেন না। আমার কাজ শুধু দেখে যাওয়া। এর বেশি কিছু না। আমি বাইরে দাড়িয়ে থাকবো। আপনারা ভিতরে চুরি করতে যাবেন।”
আমার পিঠে মশার অনেক কামড় অনুভব করি। কিন্তু রাসেল কোন মশা দেখতে পায় না। অথচ আমি আমার পিঠে বুঝতে পারি ৭/৮ টা মশা লেগে আছে। আমি বুঝতে পারছি, অথচ রাসেল দেখতে পারছে না। এ কি কান্ড! আশ্চর্য ব্যাপার তো!


আমরা এম এম কলেজের ভিতর দিয়ে হেটে, ষ্টেডিয়াম আর পার্কের পাশ দিয়ে গিয়ে উঠি ইদ্গাহের ময়দান। ময়দানে ঢুকেই তো আমাদের চোখ কপালে। ইদগাহ ময়দান আর কোর্টের মাঝখানের মাঠে দুটো তাল গাছ দাউ দাউ করে জ্বলছে, কিন্তু কোনো তাপ নেই। বরং বেশ শীত শীত লাগছে। আমি আর রাসেল একটু দ্রুত হেটে দেয়ালের কাছে যাই। দেখি যে কেউ আগুনের দিকে খেয়াল দিচ্ছেনা। সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমরা দেয়াল টপকিয়ে গাছের নিচে গিয়ে দাড়ায়। একটা ঠাণ্ডা বাতাস আমাদেরকে ধাক্কা দেয়। আমাদের চোখ পড়ে কোর্টের বারান্দায়। দেখি বেশকিছু মানুষের ফাঁসি হয়েছে। বিল্ডিংয়ের চারপাশ দিয়ে ছাদের থেকে দড়ি দিয়ে তাদেরকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু শকুন কিছু লাশের কাঁধে বসে তাদের জিহ্বা টেনে ছিড়ে খাচ্ছে। আর তার নিচে কিছু উকিল আর পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। আমার নতুন ফুফাতো ভাই দেখি একজন কালো পোষাক পরা লোকের সাথে কথা বলছেন আর আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আমার একটু ভয় লাগছে। আবার লাগছেনা। কি করবে শালা? যশোর আমাদের এলাকা। আমি রাসেলকে বলি, “রাসেল তোর কি ভয় লাগছে?”
“ভয় লাগবে কেনো? এসব তো আর নতুন কিছু না।”
“মানে? একটু আগেই তো তোর ছোখ বেরিয়ে যাবার যোগাড়!”
“আরে ও তো একটা সাময়িক ব্যাপার। তুই এসব আগে দেখিস নি? আমারে অবাক করলি তো তুই।”
“না আমি আগে দেখি নি। তাল গাছে আগুন কেনো? আর সেই আগুন ঠান্ডাই বা কেনো? আর মানুষগুলো এতো জানোয়ারের মতো ব্যবহার করছে কেনো?”
“এ আর এমন কি। আমি কাল যা দেখেছি তা তো তোরে বলিনি এখনও।”
“কি দেখলি? কখন?”
“কখন মনে নেই। আমি রেলষ্টেশনের দোকানটা থেকে কিছু বই কিনছি, আর দেখি শতো শতো মানুষ সেচ্ছায় ট্রেনে কাঁটা পড়ে মরছে। আমি তো দেখে ভয়ে বাঁচিনে। আমি বই ফেলে দৌঁড়ে বাড়ি ফিরি।”
“আমি তো শুনলাম না কিছুই। এমন খবর তো সবার জানার কথা?”
“যা দেখেছি তাই বললাম। আর একটা কথা, যারা মরছিলো তারা সবাই মরার আগে বলছিলো, “ভিতরটাও যখন ওদের দখলে তখন বেঁচে থেকে আর কি লাভ?” আমি তাদের কথা কিছুই বুঝিনি। চল লাইব্রেরিতে যাই।”
“এ সব ফেলে রেখে?”
“কি সব? আরে এ তো কিচ্ছু না। চল একটু পরেই দেখবি সব ভুলে গেছিস। বড় ভাইরে ডাক দে! চল যাই।”
আমি বড়ো ভাইরে ডেকে বললাম, “ভাই চলেন যাই। আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই।”
তিনি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “এইতো আপনার শিখতে শুরু করেছেন? আপনারা খুব মেধাবি ছাত্র। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের আর বেশি দিন লাগবেনা আমাদের কাজ শেষ করতে। চলেন যাই কিছু বই চুরি করে আনি। তা কি বই চুরি হবে আজ? রাসেল আর আজাদের?”


আমরা যখন পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে পৌঁছায় তখন ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “আমরা আপনাদের খবরাখবর রাখছি বেশ কিছুদিন ধরেই। আপনাদের যখন তখন বিপদ হয়ে যেতে পারে।”
“কিসের বিপব? কেনো?”
“মানে আমরা আপনাদের একদম ভিতর থেকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। আপনাদের আর কিছুই আমাদের অজানা থাকবে না। থাকছেও না।”
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“না বোঝার কিছু নেই। আপনি ছাত্র ভালো। আপনি কেনো বুঝবেন না? আমি তো সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।”
আমি রাসেলের দিকে তাকাই। সে দেখি মনের আনন্দে এক কানা ফকিরের পেটে লাথি মারছে জোর দিয়ে, আর ফকিরটি খিলখিল করে হাসছে, আর মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আমাদের কথপকথন হচ্ছে, কিন্তু রাসেলের তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হচ্ছেনা। ব্যাপার কি? রাসেল কি না শোনার না দেখার ভাণ ধরেছে নাকি? হয়তো সে ব্যস্ত লাথি মারতে। তার হাতে হয়তো সময় কম। থামার আগে তাকে হয়তো আরো কয়েকটি লাথি মারতে হবে।
ভদ্রলোক আমাকে বলেন, “আপনি কিন্তু খুব ভালো মানুষ না। আপনি একবার ভিড়ের ভিতরে এক মেয়ের পাছা টিপে দিয়েছিলেন এই মাঠেই এক বই মেলায়। ব্যাপারটা এইমাত্র আপনার মনে পড়লো। মেয়েটা আপনার দিকে রেগে তাকিয়েছিলো, কিন্তু কিছু বলেনি বলতে পারেনি। আপনি দাঁত বের করে হাসছিলেন তার দিকে তাকিয়ে, আর একটা মজা পাচ্ছিলেন, আমি যেমন একটু আগে হাসছিলাম।”
“আপনি জানেন কিভাবে? আমি তো কোনোদিন তা কাউকে তা বলি নি!”
“আপনি এতো চিন্তা করেন কেনো? আমরা সবই জানি। আমরা এখন বাস করি আপনাদের অন্তরগহনে। আমাদের আর কিছুই অজানা নেই বা থাকবেনা। জানাই আমাদের কাজ। জানার এই এলাকাটা আমাদের আয়ত্তে ছিলো না এতোদিন। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ তা আমাদের আয়ত্তে এসে গেছে। এতে করে আপনাদেরই উপকার। আপানারা আর বাজে কাজ করবেন না। আপনারা ভয়ে ভয়ে থাকবেন। ভয়ে যারা থাকতে শেখে তারাই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে। এটাই সুখের গোপনতম সূত্রটি। আপনাকে জানিয়ে দিলাম। আমরা এই সূত্রটিকে আর কারো অজানা রাখতে চাই না।”
আমি রাসেলকে জোরে ডাক দিই। রাসেল ফকিরটির পেটে কষে মারে আরো একটা লাথি। ফকিটির হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের হতে থাকে। আমারও বেশ লাগে দৃশ্যটি দেখতে।


রাসেলকে ফেলে রেখেই আমি আর বড়োভাই লাইব্রেরিতে ঢুকি। ঢোকার সাথে সাথেই বড়োভাই বলেন, “আমরা কিছু বই চুরি করতে এসেছি।”
লাইব্রেরির সবাই আমাদের দিকে একবার তাকায়। যে লোক দায়িত্বে আছে তিনি এসে বলেন, “চুরি করতে এসেছেন তো চিৎকার করছেন কেনো? যান যা ইচ্ছে চুরি করে নিয়ে যান। আপনারা চুরি করুণ আর আমি আপনাদের ধরার চেষ্টা করি। আসেন চোর-পুলিশ খেলি।”
আমরা বেশ কিছুক্ষণ চোর-পুলিশ খেলে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমি লাইব্রেরির মেঝেতে শুয়ে পড়ি। হাঁপাতে থাকি প্রচন্ডভাবে। দেখি আমার মা আমার হাত ধরে ঝাকাচ্ছেন আর বলছেন, “এই তুই বই চুরি করতে এসে খেলাধুলায় মেতে গেলি কেনো? যা যা পারিস নিয়ে দৌঁড় দে। তোরে কি আর ঐ বুড়ো তাড়ায়ে ধরতে পারবে নাকি? পাগল ছেলে কোথাকার।”
আমি লেনিনের লেখা কিছু বই বুকে জড়িয়ে ধরে দৌঁড়ে পালায়। কেউ আমাকে ধরতে চেষ্টা করেনা। আমি এক দৌড়ে রেললাইনের কাছে এসে পড়ি। আমার দমবন্ধ হবার জোগাড়। আমি মাটিতে বসে পড়ি। আমি আমার মার গলা শুনতে পারি। সে যেন কাকে বলছে, “আজ সপ্তাহ খানেক হোলো ও এমন করছে। ডাক্তার সাহেব আপনি ওরে বাঁচান।”
কিন্তু মা কোথায়? আমি তো মরার মতো শুয়ে আছি রেল লাইনের ধারে লেনিনের কিছু বই বুকে জড়িয়ে ধরে। আমি মাকে আশে পাশে খুঁজতে থাকি। কিন্তু সে নেই। আমি কি এতই ক্লান্ত যে কানে ভুল শুনছি?


আমি উঠে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক আমাকে বলেন, “কিন্তু আপনি কমিউনিষ্ট না। আপনি আপনার ঘরে গড়ে তুলছেন নিজস্ব একটা লাইব্রেরি। আপনাকে কিভাবে কমিউনিষ্ট বলা যায়? আপনি একটা ভন্ড। অবশ্য সেটা আমাদের জন্য সুখের বিষয়। আমাদের খাঁটতে হবে কম।”
“তার মানে?”
“আপনি নিজের মতো করে একটা লাইব্রেরি চাচ্ছেন। অথচ আপনি মনে মনে ভাবেন যে আপনি একজন কমিউনিষ্ট। এটা ভন্ডামি।”
“আপনি আসলে কে?”
“আমি আপনার পরম বন্ধু।”
“বন্ধু আমার কিছু হবেনা তো?”
“কি হবে? আপনার কি পাপ?”
“আমি পাপী। আমার পাপের শেষ নেই।”
“আমি তো এখন থেকে আপনার ভিতরেই থাকবো। আপনি শুধু আমাদেরকে ভয় পাবেন। আমরা যারা ভয় পায়, তাদেরকে রক্ষা করি। আপনি রক্ষা পাবেন।”
“আমার ভিতরে আপনি থাকবেন কীভাবে?”
“আপনার সব স্বপ্ন ও চিন্তা আমাদের দখলে। এটাই ছিলো আমাদের দখলের শেষ জায়গা। আপনি চিন্তা না করে আর স্বপ্ন না দেখে বাঁচতে শিখুন। আমি আপনাকে তা শিখতে সাহায্য করবো। আপনি ভালো ছেলে।”
“কিন্তু চিন্তা না করে বা স্বপ্ন না দেখে তো থাকা সম্ভব না?”
“সম্ভব।”
“কিন্তু কিভাবে?”
“সেটাই তো আমাদের লক্ষ্য। আমরা আপনাদেরকে তা শিখিয়ে দেবো। আপনি একদিন তা ঠিকই শিখে ফেলবেন। মানুষ সব পারে। আপনি তো মানুষ, আপনিও পারবেন। আর আপনিতো শিখতে শুরুই করেছেন। আপনাকে নিয়ে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। আমাদেরকে নিয়ে আপনারও আর কোনো চিন্তা নেই। আপনি বেঁচে গেলেন।”

*** এমনই একটা স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম ২০০১-এ, যা আমার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই গল্পটি তার অনেক পরে ২০০৭-এ লেখা, আর টাইপ করা হলো আজই, মিনিট পাঁচেক আগে। আমি লক্ষ্য করেছি যে আমার স্বপ্নগুলো খুব উদ্ভট হয়ে থাকে, কিন্তু তার ভিতরেও কাহিনির একটা ক্ষীণরেখা থেকে যায়। এই গল্পটিকে স্বপ্নে পাওয়া গল্প বলা যেতে পারে! ই-মেইলঃ [email protected]