চারটায় অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা। হলরুমের মোট ধারণক্ষমতা দুইশো জন। চারটার কথা না বলে, বরং সাড়ে চারটার কথা বলি। দুইশো আসন কানায় কানায় পরিপূর্ণ, পেছনে লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে আরো অনেকজন। সাড়ে চারটার কথাতো বলা হলো, এবার সাড়ে তিনটার অর্থাৎ অনুষ্ঠান শুরুর আধ ঘণ্টা আগের কথা বলা যাক। হলরুমটার মূল দরজা এখনো খোলা হয়নি। দরজার সামনের সোফায় বসা মোট তিনজন। তার মধ্যে একজন আমি, বাকী একজন ইরানি শিক্ষার্থী, অন্য আরেকজন ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অধ্যাপক সাহেব গর্ব করে বলতে শুরু করলেন, যে মানুষটা একটু পরে এখানে এসে উপস্থিত হবেন, তার সাথে তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীর সাথে সাথে কথা বলার জন্য এখানে এসেছেন। অন্যদিকে, ইরানি মেয়েটা এসেছে তার দেশের সেই মহান ব্যক্তিটিকে কাছ থেকে দু’নজর দেখতে, যিনি সমস্ত বিশ্বের সামনে তার দেশ ইরানকে তুলে ধরছেন নতুন এক পরিচয়ে। ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত হবেন এই হলরুমে। আমি জীবনে কখনো নোবেল লরিয়েট দেখিনি, তাই প্রয়োজনের থেকে বেশি আগ্রহ নিয়ে আধঘণ্টা আগেই এসে বসে থাকলাম।
প্রফেসর সাহেবের গর্ব করতে করতে যখন ক্লান্ত হবার পর্যায়ে, তখন আমি আর শ্রোতা হয়ে বসে থাকতে পারলাম না। বললাম, আমাদের নোবেল লরিয়েটদের একজনও এখন এই শহরেই আছেন। ডক্টর ইউনূস। নিজের কথা শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কথাটা এমন শুনালো যে, আমাদের যে অসংখ্য নোবেল লরিয়েট আছেন, তাদের মধ্য থেকে মাত্র একজনের কথা বলছি আমি। প্রফেসর সাহেব চমকে উঠে বললেন, ওহ! আই নৌ হিম। দ্যা মাইক্রোফিন্যান্স ম্যান। এবার আমার গর্বিত হবার পালা। নোবেল লরিয়েটের দেশের মানুষ হওয়া যে কি আনন্দের ব্যাপার, সেটা বিদেশের মাটিতে না থাকলে বুঝা যায় না। আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় যখন নিজের দেশের নাম বলেছি, অনেক দেশের অনেকে বিব্রত হয়ে বলেছে, সরি তোমার দেশের নাম শুনিনি। তারা আমার দেশের নাম জানে না, আমার দেশে রাজতন্ত্র না গণতন্ত্র সেটাও জানে না। তবে, সে-সব না জানলে কি হবে, তাদের অনেকই কিন্তু ডক্টর ইউনূসের নাম ঠিকই জানে। যখন বলি আমি ডক্টর ইউনূসের দেশের মানুষ, তখন তাদের সে-কি আগ্রহ। জানতে চায় তার কাজ সম্পর্কে। অনেকে আবার একধাপ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, যদি তুমি কিছু মনে না করো, তোমাদের মত একটা দেশ থেকে তিনি কিভাবে এতটা সফল হতে পারলেন। শুধু নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নয়, বরং যে উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে ডক্টর ইউনূস কাজ করছেন সেটাই তাঁকে এনে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী সমাদর। নোবেল প্রাইজ তাঁকে দিয়েছে পরিচিতি, আর তাঁর নিজের কাজ এবং পরিশ্রম তাঁকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রার উচ্চতা। অন্যদেশগুলোতে কি অবস্থা দেখতে পারিনি, কিন্তু বর্তমানে ইউএসএ’র বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো বক্তা হিসেবে ডক্টর ইউনূসকে পেলে নিজেদেরকে ধন্য হবার থেকেও বেশি কিছু মনে করে।
কিন্তু, বেশিক্ষণ সুখে থাকা মনে হয় আমাদের কপালে নেই। ক্যালিফোর্নিয়ান প্রফেসর যখন বললো, মাইক্রোফিন্যান্স ম্যান। আমি একটু যোগ করে বললাম, মাইক্রোক্রেডিট ম্যান। এরপরেই প্রফেসর আঘাত করলেন আসল জায়গায়। বললেন, ইরানের সরকার শিরিন এবাদিকে ভালো চোখে দেখছে না, তিঁনি সরকারের বিরাগভাজন। ইউনূস সাহেবের কি অবস্থা? আমি উত্তরে বললাম, ওহ! হলরুমের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। আমাদের এখনি উঠা উচিৎ। উনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো সামনের সিট দখল করি।
শিরিন এবাদি চলে আসলেন যথা সময়ে। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট শিকাগোর পক্ষ থেকে যখন তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছিলো, তখন বারবার বলা হচ্ছিলো, ১৯৩১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া প্রথম আমেরিকান মহিলা জেইন অ্যাডামসও এই ইউনিভার্সিটির সাথে কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্কিত ছিলেন। নোবেল লরিয়েট জেইন অ্যাডামসের পদচারণাধন্য এই ক্যাম্পাসে আরেকজন নোবেল লরিয়েটকে পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আজ সত্যিই আনন্দিত। পূর্বপুরুষ কোনো এক কালে ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছিলো, উত্তরপূরুষ হাতের তালুতে এখনো সে ঘি’য়ের ঘ্রাণ খুঁজতে চেষ্টা করলে যেমনটা হয়, ঠিক তেমনটাই যেন হচ্ছিলো। তারা যখন পূর্বপুরুষের ইতিহাস খুঁজতে ব্যস্ত, তখন আমার মনে হলো, ১৯৩১ সালে নোবেল পাওয়া একজনের নাম নিতে নিতেই তারা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে, অথচ আমাদের নোবেল পাওয়া বর্তমান মানুষকেই আমরা ক্লান্ত করে মারছি!
শিরিন এবাদি বক্তব্য শুরু করলেন ইরানি (পারসি) ভাষায়। সাথে দাঁড়িয়ে আরেকজন ইংরেজী অনুবাদ করে গেলেন। একটা বাক্য বলেন, তো একবার থামেন। অনুবাদ শেষ হলে আবার বলেন। বক্তব্যে তিনি বললেন, ধর্মের নামে ইরানে হয়ে যাওয়া অন্যায় অবিচারের কথা, সেখানকার নারীর করুণ দূর্দশার কথা। মদ্যপান করলে কি শাস্তি এবং কতবার মদ্যপান করলে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় বললেন সে কথাও। আরো বললেন, একটু পান থেকে চুন খসলে কি করে কারাগারে নেওয়া হয়। তবে, সব শেষ করে বললেন, ইরানে অন্যায় অত্যাচার হচ্ছে, তার প্রতিবাদ আমরা করছি এবং করবো; কিন্তু, তার মানে এই না যে অন্য আরেকটা দেশ আমার দেশকে আক্রমণ করার হুমকি দেবে। আমেরিকায় বসে সরাসরি আমেরিকাকেই হুঁশিয়ারী। কিন্তু, সৌন্দর্যটা হলো, সমস্ত আমেরিকানরাই সেই বক্তব্যের পর করতালিতে ভরিয়ে তুললো সমস্ত হলরুম।
বক্তব্যের শেষে শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। সর্বশেষ প্রশ্নে একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি মনে করেন রাজনীতির সাথে ধর্মের সম্পর্ক থাকা উচিৎ? শিরিন এবাদি জোর দিয়ে বললেন, আমি মনে করি না, রাজনীতির সাথে ধর্মকে নিয়ে আসা উচিত। তবে, হ্যাঁ! জনগণ যদি ধর্মীয় কোনো দলকে নির্বাচিত করে ফেলে, তখন প্রশ্ন আসে, জনগণের সেই রায়কে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি কি না। সেক্ষেত্রে, আমি বলবো, ধর্মের ইচ্ছামতন ব্যাখ্যা দাঁড় না করিয়ে, সঠিক এবং মানবিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে হবে।
শিরিন এবাদি যখন মঞ্চে আসলেন, কিংবা যখন মঞ্চ থেকে চলে গেলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, স্টুডেন্ট, সমস্ত হলভর্তি মানুষজন উঠে দাঁড়িয়ে উনাকে সন্মান দেখালেন। উনার বক্তব্যে বার বার উঠে এসেছে ইরানের কথা, ইরানের মানুষের কথা, তাদের অধিকারের কথা। ডক্টর ইউনূস যখন কোথাও যান, নিশ্চয় এভাবেই দাঁড়িয়ে বিশ্বের মানুষজন উনাকে সন্মান দেখান। আজ যদি বাংলাদেশের মানুষের উপর, বাংলাদেশের উপর অন্য কোনো দেশ অন্যায় ভাবে কিছু করে বসে, বাংলাদেশেকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, সে যে-দেশই হোক-না কেন, তাহলে, সমস্ত বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিবিদের কথায় ভরসা করবে না, কোনো কূটনৈতিক-হাইকমিশনার-রাষ্ট্রদূতের কথায়ও ভরসা করবে না, বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু, ডক্টর ইউনূস বললে সেটাতে অন্তত তুলনামূলকভাবে বেশি ভরসা করবে, বেশি বিশ্বাস করবে। বস্তুত, এই মানুষটার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমরা দারুণভাবে ব্যর্থ হচ্ছি।
একজন মানুষের কর্মের সমালোচনা অবশ্যই হবে। ডক্টর ইউনূসের গড়া প্রতিষ্ঠানে যদি সমস্যা থাকে, সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব; সেটাকে আন্তরিকভাবে দেখা উচিত। যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয়, বছরের পর বছর সাধনার ফলে গড়ে উঠা তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে, তাঁর অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, তার মানেতো এই না যে, তিনি দেশের শত্রু হয়ে গেলেন। আজ থেকে দশ, বিশ, তিরিশ কিংবা পঞ্চাশ বছর পরে, তাঁর মৃত্যুর পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে আবাসিক হল হবে, পাঠ্যপুস্তকে তার নামে অধ্যায় হবে, সাইন্স ল্যাবরটরিতে তার নামে গবেষণাগার হবে, শাহবাগের মোড়ে তার জন্য ভাস্কর্য হবে। কিন্তু, তখন তিনি আর আমাদের মাঝে থাকবেন না, তখন তিনি আর বিশ্বের দরবারে গিয়ে বাংলদেশকে তুলে ধরতে পারবেন না, বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে কাউকে অনুরোধ করতে পারবেন না; তখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশেগুলোর প্রেসিডেন্টরা তাঁকে দেখলে সন্মান দেখাতে উঠে দাঁড়িয়ে যাবেন না।
আমরা কি পারি না, আত্মঘাতী জাতি আপবাদটা মুছে ফেলতে?
মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]
সুন্দর লেখা।
প্রথম নারী হিসেবে নোবেল পাওয়া মানে বুঝলাম না।
@প্রদীপ দেব,
আসলে বাক্যটা সঠিকভাবে সাজাতে পারিনি। উনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া প্রথম আমেরিকান মহিলা। লেখাতেও ঠিক করে দিলাম। 🙂
কোথায় যেন পড়েছিলাম , বাঙালি হিংসুক, পরনিন্দাকারী, পরচর্চাকারী , অন্যের
ভাল দেখতে পারেনা ।
এর সত্যতা পেয়েছি অনেকবার, আমরা কেন এমন ?
নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বাঙালির এমন প্রতিক্রিয়া ?
হয়তো মনোবিজ্ঞানীরা বলতে পারবে !
কেউ ওপরে উঠছে, তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়াতে বাঙালির জুরি নেই !
আসলে আমার মনে হয় , দেশের বেশিরভাগ জায়গাতেই অযোগ্যরা
চাপাবাজি করে খাচ্ছে, তাই যোগ্যদের দেখলে ওদের সব হারানোর ভয় পেয়ে বসে,
তাই এই প্রতিক্রিয়া !
আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকই নৈতিকতার , যৌক্তিকতার ধারধারেনা ফলে বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই ব্যাপার গুলোর করুণ পরিণতি ঘটে !
যৌক্তিক আচরণ করলে হয়ত আমাদের সবারজন্যইই তা মঙ্গলময় হত ।
@লাইজু নাহার,
এ-ধরণের কথা বলার সাহসতো একজনেরই ছিলো। হুমায়ুন ‘আজাদের বাঙালিঃ একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠী?’ প্রবন্ধটিতে পড়ে থাকতে পারেন।
আমার মনে হয়, অযোগ্য লোকেরাতো চাইবেই যোগ্যদেরকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে, না-হলে তারা কি করে টিকে থাকবে। প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিলেতো যোগ্যতমের জয় হয়ে যাবে। যোগ্যদেরকে এখন শুধু যোগ্যতা নিয়ে বসে থাকলে হবে না, ব্যতিক্রম কিছু করতে হবে, জিনিসটা যদিও কঠিন।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। 🙂
(Y)
@লীনা রহমান,
ধন্যবাদ 🙂 ।
আজ্ঞে আমরা বরাবরই আমাদের একজন উঠলে তার লুঙ্গিতে টান মেরে নামিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত। বাঁশ মারায় আমরা গর্ববোধ করি। অন্য কেউ ভালো করলে ভাবি এ আর এমন কি, আমিও চেষ্টা করলে পারতুম। কারো ভালো করার আগে ভালো করলে নিজের লাভ কি তার হিসাব করি।
আত্মঘাতী জাতিই বটে।
@অমিত,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ অমিত। তুমি এখানে লিখতে পারো। প্রোগ্রামিং বা ইন্টারেস্টিং টেকনিক্যাল টপিক নিয়েই লিখতে পারো। তোমার লেখা বেশ ভালো। বাংলা ডিজাইন প্যাটার্ন নিয়ে লেখাটা পড়েছিলাম, তোমার ব্লগও পড়ি মাঝে মাঝে। 🙂
@অমিত,
মইনুল ভাইয়ের কমেন্টটা দেখে গুগল সার্চ করে singleton নিয়ে আপনার লেখাটি পড়লাম। বেশ ভালো লিখেছেন। ডিজাইন প্যাটার্ন নিয়ে বাংলায় আর কোনো লেখা আছে আপনার? আপনার লেখার মান ভালো,নিয়মিত বাংলায় এধরনের লেখা লিখলে সবার উপকার হয়। আর মুক্তমনায় লেখা শুরু করলে অনেক ভালো লাগবে।
বিচিত্র আমাদের দেশ, বিচিত্রতর তার মানুষ। দেশের ঠাকুরের চেয়ে বিদেশের কুকুরে আমাদের আসক্তি বরাবরই বেশি।
@ইরতিশাদ,
ব্লগের লেখায় সবকিছুতো বলতেও পারি না ইরতিশাদ ভাই। কারো একজনের জীবনকে দূর্বিষহ করে তোলার জন্য আমাদের কোনো তুলনা নেই।
Excellent writing. Waiting to get more.
@Imranul Hoque,
শেষ পর্যন্ত ওখানেও লিঙ্ক চলে গেলো। :)) ধন্যবাদ। 🙂