হাসিনা-খালেদা আলোচনাঃ প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন

 

সমরেশ বৈদ্য

 

প্রায় দুই দশক ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে একটি কথা বার বার শুনছিতাহলে- দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের দু‘’নেত্রী এক সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে দেশেরবিভিন্ন মিডিয়াতে বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এর পক্ষে তাদের বেশ তীক্ষè জোরালো যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরছেনবিষয়টি সাধারণ জনগণের মধ্যেও এক ধরনের মুখরোচক আলোচনায় পরিণত হয়েছে

 

হ্যাঁ একথা অনেকাংশেই সত্য যে অনেক সংকটপূর্ণ বিষয় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিস্পত্তি সম্ভববিশ্বব্যাপী তা সমাদৃতও বটেঅসংখ্য উদাহরণ রয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অনেক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান হয়েছেসেক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই নমনীয়-সংযত ও বাস্তবমুখী আচরণ করতে হয়যার কমবেশি আমরা জানিবাংলাদেশেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে, সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছে, কিছুটা সমাধান বা পূর্ণ সমাধানের পথ বের করা গেছেআলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারলে অবশ্যই সংঘাত বন্ধ বা রোধ করা সম্ভব

 

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের সময় থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের মধ্যে একধরনের আলাপ আলোচনা হয়েছিলতখন এদেশের অনেকেই বলছিলেন যে, হাসিনা-খালেদার মধ্যে আলোচনা হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেসত্যিকার অর্থে কি তখন এই দুনেত্রীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ? হয়তো হয়েছিলতবে আমার জানা নেইআমার জানার মধ্যে ঘাটতি থাকতে পারে- তা অকপটে স্বীকার করছিসেই ৯০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় গড়িয়েছেরাজনৈতিক অনেক উত্থান-পতন হয়েছেবাংলাদেশের জনগণ তার সরব-নীরব সাক্ষী

 

গত ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখেছি, পড়েছি, শুনেছি এই দুনেত্রী একসাথে বসে আলাপ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বাংলাদেশের- এমনই অভিমত অনেকেরকি জানি কোন অদৃশ্য যাদুবলে তা হবে তা যেসব বিজ্ঞজনেরা বলেন, তারাই ভালো বলতে পারবেনতাই বলে কেউ আবার ভেবে বসবেন না যেন যে আমি আলাপ-আলোচনার বিরোধীতা করছিসমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্যই আন্তরিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছেযা থেকে দেশ পরিচালনার জন্য নতুন দিক নির্দেশনাও আমরা পেতে পারি হয়তোআশা করতে দোষ কোথায় ? আমরা আশাবাদী বলেই তো বার বার বাঙালি শত ঝড়-ঝাপটা, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছি, ওঠার চেষ্টা করছি প্রাণান্তকর

 

সম্প্রতি ২৫ ফেব্রয়ারি ঢাকার বিডিআর হেডকোয়ার্টারে পিলখানায় ঘটে যাওয়া বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির   অস্তিত্ব নিয়ে যে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে তাকে কোন ভাষায় অভিহিত করা যায় তা আমার বোধগম্য হচ্ছে নানিঃসন্দেহে এ মর্মান্তিক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পিছনে যে অনেক বড় ষড়যন্ত্র ছিল তাতো দলমত নির্বিশেষে সবাই বলছেনঘটনার তদন্ত চলছেপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত দুরদর্শী, রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপের কারণে এ যাত্রা আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশটি রক্ষা পেলো আরো ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকেকিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত সময়োচিত পদক্ষেপটি পছন্দ হয়নি অনেকেরকারা তারা? যারা আপাত: শান্তিপূর্ণ সমাধানটিকে মানতে পারছেন না? তাদের পরিচয় ও অতীত কর্মকাণ্ড নিশ্চয় দেশবাসীর অজানা নয়অনেকভাবে উস্কানি দেয়া হচ্ছিল, এখনো অব্যাহত রয়েছে তাদের সেই উস্কানি–দেশ রক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর প্রতিকিন্তু আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর প্রতি যারা সেই উস্কানির ফাঁদে পা দেননি১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর অন্তত এবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে দেশাত্ববোধ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাশীলতা ও চরম ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছে তাতে অবশ্যই প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির গর্বিত হওয়া উচিতজাতির অত্যন্ত সংকটময় মূহুর্তে যে দায়িত্বশীল পরিচয় দিয়েছেন সেনাসদস্যরা তাতে মনে হয়েছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে এদেশের মানুষ আস্থাশীল হতে পারছে হয়তো পারবে

 

একথা বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই কালো অধ্যায় শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়েতারপর দীর্ঘকাল কারণে-অকারণে মুষ্টিমেয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে হারাতে হয়েছে অনেক মেধাবী দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতাকেসেনা অভ্যন্তরে ক্যু, পাল্টা ক্যু এসবের ফলে আমরা হারিয়েছি অনেক সেনাসদস্যকে (আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্সসহ)  যা কোনভাবেই কাম্য ছিল নাতবে এবার আমরা আশাবাদী হতে চাই অতীতের সব অপকর্ম ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েকেন আমরা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর প্ররোচনায় ভাই ভাইয়ের রক্ত নিচ্ছি ? কার স্বার্থে ? নিজের দেশের স্বার্থে নিশ্চয়ই নয়- আশা করি সে ব্যাপারে আমাদের দেশ প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরা অনুধাবন করতে পারছেন  এবং ভবিষ্যতেও করবেন

 

 

গত ২০০৮ সালের  ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অবাধ, সুষ্ঠ ুও নিরপেক্ষ  নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে যারা মানতে পারেনি তারাই যে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে তাতো আর নতুন করে বলে দেয়ার অপেক্ষা রাখে নাসরকার ও দেশকে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে পারলে তাদেরইতো লাভকারণ বাংলাদেশের প্রতি এদেশের মানুষের প্রতি যাদের ন্যূনতম দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ আছে তারা কখনো ২৫ ফেব্রয়ারির মতো জঘন্য ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারে না

 

তখনই অর্থাৎ ফেব্রয়ারির শেষে পিলখানা ঘটনার পর থেকে বিভিন্নভাবে শুনে আসছি এ সংকটের সময় দুই প্রধান দলের দুনেত্রীর এক সাথে বসলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেকোন অসুবিধা কি আদৌ ছিল তাতে ? সংসদতো রয়েছেইসেখানেই তো আলোচনা করা যেতোসাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলো তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার জন্যহায়রে দেশনেত্রী ! হায়রে তার উপদেষ্টা পর্ষদ ! ঘরে যখন আগুন লাগে তখন কি ঘরের যিনি প্রধান থাকেন তার আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করেন ? এই সহজ বিষয়টিকে বিএনপি-জামাত গোষ্ঠী কেন ঘোলা করতে চাইছে তা নিশ্চয় এতদিনে দেশবাসীর বুঝতে বাকী নেই

 

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য এ পর্যন্ত কতবার অপচেষ্টা করেছে এদেশের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দেশি বিদেশী গোষ্ঠী ও ইসলামী জঙ্গীরা তাতো জানে এদেশের জনগণ২০০৪ এর ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তাকে হত্যার জন্য যে গ্রেনেড হামলাও গুলিবর্ষণ তার সাথে কারা জড়িত ছিল? তখনকার বিএনপি-জামাত জোট সরকারের মন্ত্রী এমপিরা উল্টো আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করার অপচেষ্টা করেছেনঅথচ তদন্তে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উপমন্ত্রী আবদুস সালামের সংশ্লিষ্টতাইসলামী জঙ্গী সংগঠন হরকাত-উল-জেহাদের সঙ্গে জামাত-বিএনপি নেতাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে কি ? আরো অনেকের নামই শোনা যাচ্ছেসাবেক বিএনপি স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজামান বাবর, তৎকালীন কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তারেক জিয়ার নামও বিভিন্ন মিডিয়াতে এসেছে সেই ২১ আগস্ট হামলার সাথে সংশ্লিষ্ট অভিযোগে

 

তবে সবই তদন্তের বিষয়সঠিক তদন্ত হলে সবই বের হয়ে আসবে বলে আশা করছে দেশবাসীহয়তো তদন্তের স্বার্থে তদন্তাধীন বিধায় অনেক কিছুই প্রাথমিকভাবে জানানো হয় নাকিন্তু ঘটনাতো চাপা থাকে নাএক সময় না এক সময় প্রকাশ পাবেই

 

আশ্চর্যের বিষয় হলো ২১ আগস্টের মর্মান্তিক হামলার পরতো তেমন কোন উচ্চবাচ্য শুনিনি যে দুই প্রধান নেত্রী হাসিনা-খালেদা বসে আলোচনা করলে সব সমাধান হয়ে যাবেএকটি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হলো তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী বেগম জিয়া এড়াতে পারবেন কোনভাবে? যিনি ঐ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পক হিসেবে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে সমর্থন দেন, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীকে পরিচালনার মদদ দিয়েছেন ও দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে সেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কিনা যাকে খুন করার পরিকল্পনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আলোচনা ? খুনের মদদদাতার সাথে যিনি খুন হতে যাচ্ছিলেন তার আলোচনা ? কি আলোচনা ? শেখ হাসিনাকে কীভাবে খুন করা যায় নির্বিঘ্নে সেই আলোচনা হবে ?- এমন প্রশ্ন যদি কেউ তোলেন কোন বিক্ষুব্ধ নাগরিক তাকে কী দোষ দেয়া যাবে ?

 

হ্যাঁ তারপরও আলোচনা হতে পারে দুনেত্রীর মধ্যেযে আলোচনা কোনভাবেই আপনি কেমন আছেন ? ভালো তো ? আপনার শাড়িটি বেশ সুন্দর, ভাত কি দিয়ে খেলেন….নিশ্চয়ই দেশবাসী তেমন কোন আলোচনা চায় নাআলোচনা হবে উন্মুক্ত, জাতীয় সংসদে-সুনির্দিষ্ট এজেণ্ডা নিয়ে, বাংলাদেশকে কিভাবে দারিদ্রমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, অশিক্ষামুক্ত, জঙ্গীমুক্ত, ষড়যন্ত্রমুক্ত, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের ভিত্তিতে যার যা অবস্থান তার মূল্যায়ণ করে একটি গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত, ক্ষুধা-দারিদ্র-বৈদেশিক ঋণের বোঝামুক্ত আত্মনির্ভরশীল দেশ ও জাতি হিসেবে গড়ে তোলার আলোচনাআমরা সে প্রত্যাশাই করিতেমন ভবিষ্যৎ কি সত্যিই আসবে আমাদের এই হতভাগ্য দেশের হতভাগ্য জনগণের সামনেপ্রত্যাশা করতে ক্ষতি কি ?

 

সমরেশ বৈদ্য,চট্টগ্রাম থেকে, ২৬.০৩.০৭

সংবাদকর্মী. email—[email protected]