আমি ছোট্ট একটি রূপবতী,মায়াবতী দ্বীপের গল্প বলছি; যেখানে আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে।মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন,চারিদিকে সমুদ্রের নীলজলে পরিবেষ্টিত,আকণ্ঠ সমুদ্রে নিমজ্জিত সে দ্বীপখানি যেন সৌন্দর্যের এক আশ্চর্য লীলাভূমি।উপরে নীল আকাশের নীলছায়া,নিচে সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি ও সবুজের অপারমায়া। পুরো দ্বীপটিই যেন কোন সুদক্ষ শিল্পীর তুলিতে অতিযত্নে আঁকা অনিন্দ্যসুন্দর নিখুঁত একটি ছবি।দ্বীপের গায়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ,পথের দুধারে সবুজ বনানী আর নানান রঙের ঝোপঝাড়।এখানকার আকাশ অপরাজিতার মতো নীল,এখানকার অপরাজিতা আকাশের মতো নীল।সাগরের ঢেউগুলো গভীর মমতায় বারবার আছড়ে পড়ে দ্বীপটির গায়ে,সোঁসোঁ শব্দে কথা কয় মানুষের সাথে।এখানকার তালগাছ,নারিকেলগাছ গুলোতে ; মৃদুবাতাসে দোলে প্রকৃতির নিপুণ শিল্পী বাবুইপাখিদের বাসা।ছোট্ট ছোট্ট কুটির গুলোতে বাস করে প্রকৃতির মতো সহজ-সরল,প্রাণবন্ত কিছু মানুষ।
এ দ্বীপের প্রতিটি কাজেই যেন উ¬¬ৎসবের আমেজ। ভোরে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুতে পুকুরে যাওয়ার সময় প্রতিবেশীকে ডাকা হয়।দুপুরে গোসলে যাওয়ার সময়,স্কুলে যাওয়ার সময়,এমন কী সন্ধ্যায় পা ধুতে যাওয়ার সময় ও।উল্লেখ্য যে ,আমরা সারাদিনই খালিপায়ে থাকতাম। ঘরে-বাইরে ,মাঠে-ঘাটে সর্বত্রই খালিপায়ে অবাধ বিচরণ।সন্ধ্যায় দলবদ্ধ ভাবে পা ধুয়ে ঘরে ফিরতাম।আজকাল অধিকাংশ গাঁয়ের ছেলেমেয়েরাই জুতা,স্যান্ডেল পড়ে স্কুলে যায়,আমরা যেতাম খালিপায়ে।স্কুলে কোন বিশেষ অনুষ্ঠান থাকলেই শুধু জুতা,স্যান্ডেল পড়া হতো।অনভ্যাস বশত পাদুকাযুক্ত পদযুগল সবসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখার বার্থ চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে হতো।জুতা পড়ার লজ্জা ছিল ভীষণ লজ্জা! তাই শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা সব ঋতুতেই খালিপায়ে স্কুলে গমন।আমরা ছিলাম অনেকটা জন্মসূত্রে পদাতিক বাহিনীর মতো। যেকোন অদূরবর্তী যায়গায় যাওয়ার জন্য পা দুখানিই ছিল একমাত্র সম্বল। অনেকটা পদব্রজে দ্বীপ ভ্রমণের মত।
এই দ্বীপটি অনেকটা রূপকথার জলকন্যার মতো।আজীবন তার জলে বাস।দ্বীপটির গায়েও কয়েকটি স্বচ্ছ জলের খাল বয়ে গেছে এঁকেবেঁকে।এখানে প্রতিটি বাড়িতেই এক বা একাধিক পুকুর আছে।আমরা গোসল করতাম পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে।এখানে ভেতরে –বাইরে সবখানেই জল। তাই এখানকার শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি সাঁতার শিখে যায়,চার-পাঁচ বছর বয়েসে। তাই বাবা-মায়ের ছোট শিশুদের নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা নেই।খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা গোসল করতাম বাবা-মায়ার সাহায্য ছাড়া,বন্ধুরা দল বেঁধে;স্কুলে ও যেতাম দল বেঁধে।
এখানকার শীতকাল যেন প্রকৃতির অপূর্ব-সুন্দর এক দান। ভোরবেলায় কুয়াশার আর্দ্র-শীতল চাদরে ঢাকা থাকে চারিদিক। সূর্যোদয়ের সাথে-সাথে কোমলতাপে কুয়াশা আস্তে আস্তে ঝরতে থাকে। পুকুরপারের গাছগুলো থেকে টুপটুপ শব্দে কুয়াশা ঝরে পরে পুকুরের জলে। শীতের সকালে খেজুরের রসের তৈরী নানান রকমের পিঠা-পায়েস। রাতভর চলে রসের পায়েস (সিন্নি)রান্নার উৎসব। চারিদিকে টাটকা শাক-সবজি,পুকুরের মাছ,সমুদ্রের মাছে ভরপুর। কারো বাড়িতে পিঠা-পায়েস বানানো হলে প্রতিবেশীদের পাঠানো হয় অথবা খেতে ডাকা হয়।
বর্ষাকালে দ্বীপটি সাজে ভয়ানক সুন্দর এক সাজে। নীল আকাশটি তখন সাজে কেশবতীকন্যার কালোকেশের সাজে। কালোমেঘ হতে অঝোরে ঝরতে থাকে রূপালীবৃষ্টি। চারিদিক পানিতে থৈথৈ করতে থাকে। বর্ষার গান,বৃষ্টির নৃত্য,বজ্রের মাদল বাজতেই থাকে অবিরত। টিনেরচালে বৃষ্টির রিনিঝিনি গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর মজাই আলাদা। ঘোরবর্ষায় ছাতা নিয়ে স্কুলে যেতাম কিন্তু বৃষ্টির প্রচণ্ড ঝাপটায় ছাতা কোন কাজেই আসতো না। তাই ভিজে লুটোপুটি হয়েই স্কুলে যাওয়া আসা হতো। আমাদের কোন স্কুল-ব্যাগ ছিলনা তাই বইগুলো ও যেতো ভিজে। কিন্তু পারতপক্ষে কখনো স্কুল কামাই করতামনা। আমার অতিপ্রিয় স্কুলটি আমার কৈশোর সৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে। আমার বন্ধুরা,আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগন ,স্কুলের প্রতিটি মুহূর্ত আছে আমার স্মৃতির পাতায় পাতায় উজ্জ্বল আলোকময় হয়ে।
শ্যামলাশাড়ী পরিহিতা ছোট্ট-দ্বীপটির আনাচে কানাচে পাখির গান,রাখালের বাঁশি,আকাশের গায়ে মেঘের আলপনা। দূরাকাশ হতে পূর্ণিমার চাঁদটি নেমে আসে এখানকার সাগরজলে।সাগরজলে লুটোপুটি খায় জ্যোৎস্না-ধারা। আঁধাররাতে জোনাকিরা প্রদীপ জ্বালে মিটিমিটি। অনন্ত-নক্ষত্রলোক হতে নক্ষত্রগুলো আলো জ্বেলে দেয় তার আঁধার ঘোচাতে। দ্বীপটির পূর্বসাগরে সূর্য উদিত হয় জ্বলজ্বলে লাল বর্ণে,অস্ত যায় পশ্চিমসাগরে ধীরপায়ে শান্ত গম্ভীর লালবর্ণে। তখন এ অসাধারণ ব্যাপারগুলো খুব বেশি সাধারণ মনে হতো। মনে হতো এগুলোতো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার এখানে দেখার কী আছে! সে অতিসাধারণ ,নিত্যদিনের সহজলভ্য ,হেলায়-ফেলায় ভেসে যাওয়া জিনিসগুলো এখন আমার জীবনে অসামান্য দুষ্প্রাপ্য জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জিনিসগুলোর প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কিনা কখনো বুঝতে পারিনি ,সে জিনিসগুলোর তীব্র প্রয়োজনীয়তা ও না পাওয়ার বেদনা অনুভব করছি প্রতিটি ক্ষণে।
কোথায় হারিয়ে গেল সে নিশ্চিন্ত কৈশোর ,কোথায় হারিয়ে গেল সে সোনালি দিনগুলো,কোথায় হারিয়ে গেল সে নিত্যদিনের খেলার সাথীরা,কোথায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল একটি ছোট্ট কুটিরে বসবাসরত ছোট্ট একটি পরিবার; যে পরিবারের বাসিন্দারা বাস করতো একই ছাউনির নিচে,খেত একসাথে,ঘুমাতো একই ছাউনির নিচে,সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতো পরস্পরের সাথে । তারা এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রন্তরে,জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে। বর্তমান যান্ত্রিক-জীবনে আগের ফুলের মতো সুন্দর দিনগুলোকে রূপকথার গল্প বলে ভ্রম হয়। সে দিনগুলো এখন কেবলই হারানোর বেদনা,কেবলই কেবলই স্মৃতি,কেবলই বুকভাঙ্গা কান্না।

¬¬