তখন ও এখন
গীতা দাস
(২৮)
আমার ছেলেমেয়ে ছোটবেলায় বাসে ঢাকা থেকে নরসিংদী যাতায়াতের সময় বিরক্ত করতো। আমি তখন তাদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতাম। বাসের বাইরে তাকিয়ে বলতাম —- আমি যা দেখি তোমরা কী তা দেখো?
ওরা বলতো —- হ্যাঁ, দেখি।
দেখাও তো দেখি — দুটো গরু ঘাস খাচ্ছে।
ওরা তখন দুটো গরু দেখাতো।
আমি যে দুটো গরু দেখে তাদেরকে প্রশ্ন করেছি ইতোমধ্যে চলতি বাস হয়তো বা ঐ দুটো গরু ফেলে এসেছে। কিন্তু মাঠে আরও গরু থাকতো ।
এমন করে বলতাম —- দেখাও তো একটা বাড়ির পাশে কয়েকটা কলাগাছ।
অথবা কয়েকজন ক্ষেত নিড়াচ্ছে।
এমন করে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরে ভুলিয়ে রাখতাম। এক সময় আমার উপরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো।
এখনও একই পথে যাই, কিন্তু গরু, বাড়ির পাশে কলাগাছ বা ক্ষেত নিড়ানি চোখে পড়ে না। দেখি না।
দেখি ইটের ভাটা।কাপড়ের মিল। মেলামাইনের ফ্যাক্টরি। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
এখন আমার ছেলেমেয়ে যা দেখে আমি তা দেখি না।
তারা ফেস বুক দেখে। আমি তা দেখি না।
তারা গোগল আর্থ দেখে —যা আমি বুঝি না বলে দেখি না।
তাছাড়া, তাদের বাস এতো দ্রুত চলে যে আমি এর সাথে পাল্লা দিতে পারি না।
আমার মেয়ে আমার ফেস বুক খুলে দিতে উদ্যোগ নিয়েছিলো। আমি রাজি হইনি। এর ব্যবস্থাপনায় ও সংরক্ষণে যে মেধা, ধৈর্য, কারিগরী জ্ঞান,গতি ও সময় দিতে হবে —- এর কোনটাই আমার নেই।
বাবুয়ানা, নব্য বাবু সংস্কৃতি, ভদ্রতা, কালচার্ড, আধুনিক এমনি বিভিন্ন শব্দে বুঝানো যায় কিছু মানুষের আচরণ, মনোভাব, চরিত্র ও কার্যকলাপকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় ইতিবাচক অর্থে।
আমাদের গ্রামে বিয়েতে মহিলারা একসাথে বসে দুই দলে ভাগ হয়ে গান গাইতো। এ গান বিয়ের চার পাঁচদিন আগে থেকেই শুরু হতো। আদা দিয়ে লবণ চা খেতো একবার। আরেকবার দুধ চা। আদা চা খেতো স্বরের জন্য। তবে কাপের সাথে পেয়ালা দেয়া হতো না। চায়ের কাপ ট্রে বা থালায় করে নিতো এবং সাথে মুড়ি।
শুধু বিয়ে উপলক্ষ্যে নয় — ঘরোয়া কীর্তনেও চায়ের রেওয়াজ ছিল এবং যথারীতি পেয়ালা ছাড়া কাপ। পেয়ালা ছাড়া হলে অনেক কাপ চা একসাথে নেয়া যায়, ঝামেলা কম এবং এতো পেয়ালাও ছিল না।
এরকম পেয়ালা ছাড়া কাপে চা খেয়েছিলাম ১৯৯৭ সালের জুন ? মাসে ডাবলিনের এক ঘরোয়া গানের রাতের অনুষ্ঠানে। তখন আমি কনসার্নে ( আইরিশ প্রতিষ্ঠান) চাকরি করতাম। আইরিশ সহকর্মী এ্যাডেন মুলকিনকে আমার গ্রামের সাথে ঘরোয়া পরিবেশে গান এবং পেয়ালা ছাড়া কাপে চা খাওয়ার সামঞ্জস্যতা বিষয়ে আলাপও করেছিলাম। এতে সে বেশ মোহিত ও অবাক দুই ই হয়েছিল।
কিন্তু আজকাল শহুরে জীবনে পেয়ালা ছাড়া কাপে ঘরের অতিথি বা কোনো অনুষ্ঠানে চা দেয়া ভদ্রতার খেলাপী — যা ঋণ খেলাপীর চেয়েও মারাত্মক।
তবে অফিসে মগে চা খাওয়া নব্য বাবু সংস্কৃতির মতোই হালে চালুকৃত প্রথা। পেয়ালার প্রয়োজন নেই।
প্রথমে কফি মগ ছিল । পরে চা মগ।
অনেক দৈন্যতা — প্রচুর সীমাবদ্ধতা —-অসংখ্য নমনীয়তা — অজস্র আকুলতা নিয়েই না জীবন। যে জীবন যাপন করি তাতে অস্বস্তি আছে— অনাকাংঙ্ক্ষিত ফলাফল আছে—আরও আছে অশুভ শক্তির দাপট। অযাচিত ঘটনাকে নিজের জীবনের সাথে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মিলিয়ে নিতে হয় — মানিয়ে নিতে হয় — মাখিয়ে নিতে হয়। সেই মাখামাখিতে অনেক সময় মনে কাদা লাগে বৈকি। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়েই কিছু করার থাকে না। কাদা মুছাও যায় না, আবার কাদা নিয়ে বসবাসেও খুত খুত লাগে। আর এ খুত খুত নিয়েই চলে যাপিত জীবন। কূট কূট করে অনেক সময় মন কাটে। এমনি একদিনের মন কাটার ঘটনা।
একদিন এক দাপ্তরিক সভায় আমার এক সহকর্মী চা বেশি গরম বলে সময় মতো শেষ করতে পারছে না বুঝে পেয়ালায় ঢেলে খেতে শুরু করেছে। আমিও সচরাচর বাসা থেকে বের হবার সময় তাড়াহুড়ায় তা করি। কিন্তু আমাদের এক উর্ধ্বতন সহকর্মী হাসতে হাসতে বললেন —জনসমক্ষে পেয়ালায় চা ঢেলে খাওয়া শোভন নয় — দৃষ্টিকটূ লাগে। অথচ আমার কাছে কটূ বা নন্দন কোনোটাই লাগেনি। প্রয়োজন। প্রয়োজনে পেয়ালায় চা ঢেলে খাওয়া যায়। একদিন একজনকে তাড়াহুড়ায় দেখেছি গরম চায়ে ঠান্ডা জল মিশিয়ে চা খেতে। বিস্বাদ চায়ের চেয়ে পেয়লায় ঢেলে খাওয়া মন্দ কী !
পেয়ালায় চা ঢেলে খেলে নব্য বাবু সংস্কৃতির কোথায় বাধে তা বুঝিনি।
হায়রে আমার সংস্কৃতিবান!যে দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে চা খাওয়া এখনও বিলাসিতা সে দেশে সংস্কৃতিবান হবার মানদন্ড পেয়লায় চা ঢালাঢালি!
আর এমন তথাকথিত অসংস্কৃত কাজ যে কত করে ফেলি তা ভেবে অবাক হই।
গীতা দাস
৩ ফাল্গুন, ১৪১৫/ ১৫ ফেব্রুয়ারি , ২০০৯
Leave A Comment