অনন্ত বিজয় দাশের কাফকাসুলভ সমাজে নিজেকে রক্ষার তেমন কোনো পথ ছিল না। বিবিসি নিউজ (১২ মে ২০১৫) জানায়, “সুইডেন নিশ্চিত করেছে যে তারা এপ্রিল মাসে মি. দাশের ভিসার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁকে সুইডিশ পেন লেখক সংগঠনের একটি সংবাদপত্র স্বাধীনতা বিষয়ক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু ঢাকায় সুইডেনের দূতাবাস তাঁর ভিসার আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে, কারণ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেন তিনি হয়তো আর নিজ দেশে ফিরবেন না।”
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো অত্যন্ত জটিল, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই বাস্তবতা থেকে একটি জরুরি প্রশ্ন উঠে আসে—রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মতবাদ ও ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো কি ২১শতকেও বিজ্ঞানকে বিকৃত করতে পারে? উত্তর—হ্যাঁ। অনন্ত বিজয় দাশ তাঁর বইতে [সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়] দেখিয়েছেন, সোভিয়েত রাশিয়া ও পাশ্চাত্যেও বিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বিকৃতির শিকার হয়েছেন। ক্ষমতার রাজনীতি বিজ্ঞানের নীতিশাস্ত্রকে প্রভাবিত করেছে এবং সত্য অনুসন্ধানকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
অনেক বিজ্ঞানীকে রাশিয়ায় “বুর্জোয়া সমর্থক” হিসেবে অভিযুক্ত করে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। ত্রোফিম লিসেঙ্কো রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে মেন্ডেলীয় জেনেটিক্সের বিরুদ্ধে ছদ্মবিজ্ঞান প্রচার করেন। তিনি বিরোধীদের বন্দি করেন এবং ভুল তথ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। বিজয় দেখিয়েছেন—শেষ পর্যন্ত লিসেঙ্কোর মতবাদ প্রমাণের অভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন, কোনো মতাদর্শই বিজ্ঞানের সত্য অনুসন্ধানের পথে টিকে থাকতে পারে না। আজকের বাংলাদেশ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য এই বইটি এখনো প্রাসঙ্গিক। অনেক দেশেই মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিজ্ঞান বিকৃত করা হচ্ছে। বিজ্ঞানচর্চার নৈতিকতা ও নীতিমালা উপেক্ষিত হচ্ছে। বিজ্ঞানকে কখনো “বুর্জোয়া বিজ্ঞান”, কখনো “পশ্চিমা প্রচারণা” বলে হেয় করা হয়, কিন্তু এই মানসিকতা বিজ্ঞানচর্চার আদর্শের পরিপন্থী। বিজয় দাশ এই সংকটকেই তাঁর লেখায় চিহ্নিত করেছেন।
সোভিয়েত রাশিয়ায় এমনকি অনেক বিজ্ঞানীকে সরকারের নির্দেশ না মানায় অপহরণ ও হত্যা করা হয়েছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সঙ্গে অনুরূপ, যেখানে একাধিক মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার হত্যা করা হয়েছে। বিজয় দাশ নিজেও এই নির্মম বাস্তবতার শিকার হন। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয় এবং পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখকের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য। তাঁর সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়াটিও এক করুণ বাস্তবতা—একজন মুক্তচিন্তার মানুষ এই জটিল ও শ্রেণিভিত্তিক সমাজে কতটা অসহায় হতে পারে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবুও, ব্লগার, বিজ্ঞান লেখক ও অ্যাকটিভিস্টরা লড়ে যাচ্ছেন—বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থা, মতবাদ ও ধর্মীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে। এটি আজকের সভ্যতার অগ্রগতির জন্য এক জরুরি সংগ্রাম। সমস্ত হুমকি ও নির্যাতনের মুখেও তাঁরা সত্য ও যুক্তির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।
বিজয়ের বইয়ে দেখা যায়—সোভিয়েত রাশিয়ায় বিজ্ঞানীরা দেশ ছাড়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিলেন, তাঁরা নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির আওতায় ছিলেন। তবুও, আজও বিজ্ঞান বিকৃতির চক্র থেমে নেই। মানুষের মনের পক্ষপাতদুষ্টতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু বিজ্ঞান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিরপেক্ষ ও প্রমাণনির্ভর থাকার চেষ্টা করে এসেছে। মুক্ত অনুসন্ধান ও তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পরিবেশ ছাড়া বিজ্ঞান অগ্রসর হতে পারে না। পরীক্ষাধর্মী পদ্ধতি আমাদের যুক্তিনির্ভরভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের সুযোগ দেয়।
বিজয় দাশ এটাই বোঝাতে চেয়েছেন—যতক্ষণ বিজ্ঞান মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত না হয়, ততক্ষণই সে নৈতিকতা ও সত্য অনুসন্ধানের পথে থাকতে পারে।
পাকিস্তানি নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ মোহাম্মদ আব্দুস সালামের মন্তব্যও উল্লেখযোগ্য। তিনি পারভেজ হুদভয়ের বই *Islam and Science: Religious Orthodoxy and the Battle for Rationality*-এর ভূমিকায় লিখেছেন:
“…[হুদভয়] ঠিকই বলেছেন—নাসর ও সারদার মতো চিন্তাবিদরা মুসলিম দেশগুলোতে বিজ্ঞানের ব্যাপারে বড় ক্ষতি করছেন, যদি তাঁরা ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রসূত ‘ইসলামী বিজ্ঞান’ চালু করতে চান—যেটার অর্থ-তাত্ত্বিক ভিত্তিও অস্পষ্ট। বিজ্ঞান একটিই—সার্বজনীন বিজ্ঞান। তার সমস্যা ও পদ্ধতি আন্তর্জাতিক। যেমন কোনো হিন্দু বিজ্ঞান, ইহুদি বিজ্ঞান, কনফিউশিয়ান বিজ্ঞান বা খ্রিস্টান বিজ্ঞান নেই, তেমনই ইসলামী বিজ্ঞানও নেই। আমি তাঁর (হুদভয়ের) এই বক্তব্যের সঙ্গেও একমত যে, পাকিস্তানের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হকের প্রস্তাবিত ‘ইসলামী বিজ্ঞান’ ছিল প্রতারণা, এবং এর প্রবক্তারা (যাঁদের হুদভয় যথাযথভাবে ব্যঙ্গ করেছেন) বিজ্ঞান নামে যা করেছেন, তার জন্য তাঁদের লজ্জিত হওয়া উচিত।”
সালামের এই বক্তব্য সোভিয়েত রাশিয়ার মতাদর্শভিত্তিক বিজ্ঞান বিকৃতির সঙ্গে গভীর সাদৃশ্য তৈরি করে। মতাদর্শ যখন বিজ্ঞানের উপরে আধিপত্য বিস্তার করে, তখন বিজ্ঞান আর সত্যের পথে থাকে না, বরং হয়ে ওঠে প্রচারযন্ত্র। সালামের মতো একজন বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকে এমন সমালোচনা কেবল ইসলামী বিশ্বের জন্য নয়, বিশ্বের সব মতবাদ-আক্রান্ত সমাজের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
সিসিন লিউ তাঁর উপন্যাস The Three-Body Problem-এর শুরুতেই চমৎকারভাবে বিজ্ঞানকে কমিউনিস্ট মতাদর্শ থেকে পৃথক করে এক অনন্য দৃশ্য নির্মাণ করেছেন—একটি দ্বান্দ্বিক কৌশলের মাধ্যমে তিনি এই পার্থক্যটি তুলে ধরেন। আসলে, এটি বিজ্ঞানের এক বিব্রতকর ও ঘৃণ্য অপব্যবহার, যাকে বিভিন্ন মতাদর্শ তাদের স্বার্থে বিকৃত করার চেষ্টা করে এসেছে। উপন্যাসের এক অধ্যায়ে দেখা যায়, একজন পদার্থবিদ স্পষ্টভাবে একটি মতাদর্শগত ‘কাল্ট’কে অস্বীকার করেন:
- “দর্শন কি পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে পথ দেখাবে, না পরীক্ষা-নিরীক্ষা দর্শনকে?”
ইয়ে ওয়েনজিয়ের এই হঠাৎ পাল্টা প্রশ্ন সংগ্রামসভার নেতৃত্বে থাকা লোকদের হতচকিত করে দেয়। এক মুহূর্ত তারা বুঝতে পারে না কী বলবে বা কী করবে।
- “অবশ্যই, সঠিক মার্কসবাদী দর্শনই তো বিজ্ঞানকে পরিচালিত করবে!”
অবশেষে এক পুরুষ রেড গার্ড বলে ওঠে। তখনই ইয়ি পাল্টা বলেন:
- “তাহলে আপনি বলছেন সঠিক দর্শন আকাশ থেকে ঝরে পড়ে? এটা তো সেই ধারণার বিপরীত যে সত্য অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়। প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ যে নীতিগুলি অনুসরণ করে, এর সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক।”
শাও লিন এবং সেই দুই কলেজপড়ুয়া রেড গার্ডের এই বক্তব্যের কোনো জবাব ছিল না। জুনিয়র হাইস্কুলের রেড গার্ডদের মতো তারা সম্পূর্ণভাবে যুক্তিকে উপেক্ষা করতে পারেনি। (The Three-Body Problem, পৃ. ১৬)
মার্কসবাদ, কিংবা অন্য কোনো দার্শনিক বা ধর্মীয় মতাদর্শ দিয়ে বিজ্ঞান পরিচালনা করা উচিত নয়।
একটা সহজ উদাহরণ দিলে বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। ডিএনএ আবিষ্কারের পরে ডাবল হেলিক্সের একটা মডেল তৈরি করা হলো। একটা থিওরি কিন্তু সাধারণ মানুষ সহজে বুঝে না, সায়েন্টিফিক কমিউনিটির ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ে, কিন্তু ওই সায়েন্টিস্ট যদি থিওরিটা বুঝানোর জন্য একটা মডেল তৈরি করে, তাহলে সেটা সংক্ষিপ্তভাবে আরও সহজ হয়ে যায় বুঝার জন্য। তারপরের স্টেজটা হলো অগ্নি পরীক্ষা। মানে এক্সপেরিমেন্ট। ধরুন ডারউইন তার থিওরি অফ ইভোলিউশন প্রোপোজ করে, তার বইয়ের শেষ পেজে একটা লাইফ ট্রি-এর ছবি আঁকলো কীভাবে সিঙ্গেল অর্গানিজম থেকে বিলিয়ন ইয়ার্সের ইভোলিউশনে আমরা এখানে পৌঁছলাম। এই একটা ছবি কিন্তু তার ফুল বইয়ের একটা সংক্ষিপ্ত মডেল, কিন্তু এক্সপেরিমেন্টগুলো ১০০ বছরের উপরে চলছে তার থিওরি ভুল প্রমাণ করার জন্য। সায়েন্স এটা স্বাগত জানায়। আইনস্টাইন যে থিওরি দিয়েছিলো জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি র উপর। লাইট বেন্ড হয়ে যাওয়ার স্পেস এবং টাইম কার্ভেচারের ফলে। তাহলে দুর্বল কোনো তারা যদি সূর্যের পিছনে থাকে, সূর্যের মতো ভারী বস্তু কিন্তু স্পেস টাইমকে বাকা করে দেয় আর তখনই ডেফ্লেকশন অফ লাইট হবে। এই এক্সপেরিমেন্টের জন্য সোলার ইক্লিপসের জন্য অপেক্ষা করা লাগছিলো বিজ্ঞানীদের। অবশেষে ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমার এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে ওটা প্রমাণ পেয়েছিলো। এখন যদি লাইট ডিফ্লেক্ট না করতো, স্পেস টাইম কার্ভেচারের জন্য, আইনস্টাইনের থিওরি সহজেই ফলসিফাই হয়ে যেতো। এখন সায়েন্স যারা মার্ক্সিস্ট এবং ধর্মীয় আইডিওলজি নিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা মিসইউজ করে, ফোর্স দিয়ে ন্যারেটিভ চেঞ্জ করার চেষ্টা করছেন, তারা কিন্তু ভুল পথে এগোচ্ছেন, এবং স্টুডেন্টস অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিংরা সেগুলো ধরে ফেলবে। সায়েন্টিস্ট কমিউনিটিতে এই ধরনের লোকের অভাব নেই, তারা তাদের আইডিওলজিকে সাপোর্ট করার জন্য থিওরি বানায়, কিন্তু যখনই এক্সপেরিমেন্টের ধারায় আসে, সত্যটা কিন্তু রিভিল হয়ে যায়। অনন্ত বিজয় দাশ এই জিনিসগুলো সুন্দর করে তুলে ধরেছেন তার বইয়ে। তাকে হত্যা করা, সত্যটা কিন্তু লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বাংলা তে একটা কথা আছে “সত্য কখনো চাপা থাকে না”। ব্লগারদের মারার আগে, পারলে পরিশ্রম করে মাথা ঘামিয়ে পরে, বুঝে, তার পরে পারলে লেখনীর মাধ্যমে জবাব দেন। কোটি কোটি স্টুডেন্টরা কিন্তু আপনাদের ন্যাস্টি কার্যকলাপ দেখতে পাচ্ছে, কীভাবে আপনারা সত্যকে রামদার মাধ্যমে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
তথ্যসূত্র:
1. BBC News. (2015, May 12). Bangladesh blogger Ananta Bijoy Das hacked to death. BBC. https://www.bbc.com/news/world-asia-32701001
2. সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায় Science and Revolution in Soviet Union: The Lysenko Chapter (2012)
3. Hoodbhoy, P. (1991). Islam and science: Religious orthodoxy and the battle for rationality. Zed Books.
4. Liu, Cixin, and Ken Liu. The Three-Body Problem (E-book). New York: A Tom Doherty Associates Book (Macmillan). Accessed 13th,May, 2025. https://us.macmillan.com/piracy, p.16
Leave A Comment