করোনা অতিমারীর আগে বাবা-মার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য দেশে গিয়েছিলাম। সেসময় বাবা জি ডব্লিউ চৌধুরীর লেখা The Last Days of United Pakistan নামে একটা বই দিয়েছিলেন। লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গবেষণা বিভাগের মহাপরিচালক এবং পরবর্তীতে যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী এই অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ইংল্যান্ডের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। লেখকের পরিচয় তুলে ধরার উদ্দেশ্য তাঁর লেখাকে একটি বস্তুনিষ্ঠ তথ্যসূত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।
বইটিতে অধ্যাপক চৌধুরী একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার আগের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার চাক্ষুষ বর্ণনা দিয়েছেন এবং সেগুলোর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি সামরিক একনায়কতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের ভূমিকা নিয়ে গভীর মতামত দিয়েছেন, সেই সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত। নিঃসন্দেহে, বইটি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স বই হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক একটি ভিডিও নিয়ে কথা বলতেই জি. ডব্লিউ. চৌধুরীর বইটির প্রসঙ্গ টানা।
গতকাল পিনাকী ভট্টাচার্যের পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক শোষণের কথা অস্বীকার করে বানানো ভিডিওটা দেখে বিস্মিত হয়েছি। ভিডিওতে পিনাকী যা বলেছেন, তা প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক সত্যের সাথে একেবারেই মেলে না। তাঁর ভিডিও একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক সমালোচনার দাবি রাখে, তবে আপাতত সময়ের অভাবে অধ্যাপক চৌধুরীর বইটি নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।
জি ডব্লিউ চৌধুরী পাকিস্তান ভাঙার পেছনের বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন:
“The real tragedy was not just economic injustice, but the refusal of the ruling elite to share power with the majority. Democracy could have held Pakistan together.”* (কেবল অর্থনৈতিক অবিচারই না, বরং দুঃখজনকভাবে শাসকরা সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে ক্ষমতা দিতে চায়নি। যদি তখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকতো, পাকিস্তান ভাঙতো না)। তার এই বক্তব্যের সাথে আমিও একমত; অখণ্ড পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় যদি প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা হতো, তাহলে হয়তো সংস্কৃতিগত, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে কারণগুলো পাকিস্তান ভাঙার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, সেগুলোর অভিঘাত এতটা গভীর হতো না।
যাই হোক, বইটিতে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে অধ্যাপক চৌধুরী খুব স্পষ্টভাবে তাঁর বক্তব্য জানিয়েছেন। তাঁর মতে, অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই ছিল এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও সেগুলোর সমাধান হয়নি। শেষের দিকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। বইটির প্রথম অধ্যায়ে তিনি যা লিখেছেন তার একাংশের অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো:
“এই পরিস্থিতিতেই শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচি তৈরি করেন। এখন আমি বাংলা অঞ্চলের আলাদা হতে চাওয়া আন্দোলনের কিছু অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই। বাঙালিদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উপর যে “অর্থনৈতিক শোষণ” চালিয়েছে, সেটা পুরোপুরি অন্যায়। অনেক নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ—বিশেষ করে আমেরিকান ও ব্রিটিশ—বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভীষণভাবে অবহেলিত হয়েছে এবং এ নিয়ে কিছু করা দরকার।
একসময়ের এক ও অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণায় বিশ্বাসী হিসাবে আমি নিজেও আগের লেখাগুলোতে লিখেছি যে, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে থাকা অর্থনৈতিক বৈষম্য। নুরুল আমিনের মতো অনেক মধ্যপন্থী পূর্ব পাকিস্তানি নেতা, যারা একটি একতাবদ্ধ পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন, জোর দিয়ে সরকারকে বলেছিলেন যেন পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন তাড়াতাড়ি করা হয়—যাতে বাঙালিদের প্রধান অসন্তোষ কমে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কেউ সে কথাগুলো মন দিয়ে শোনেনি বা গুরুত্ব দেয়নি। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে, যারা পুরো বিষয়টা দেখত যেন উপনিবেশ শাসনের মতো—যেখানে শুধু “আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখা”ই মূল বিষয়। তাই তাদের কাছ থেকে ভিন্নধর্মী বা নতুন ধরনের কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা আশা করা অবাস্তব ছিল।
স্বাধীনতার পর দেশে উন্নয়নের গতি বাড়াতে বড় ধরনের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেই পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নে পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়নের হার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কম। এই বৈষম্য দেখাতে অনেক পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। কিছু তথ্য হয়তো রাজনৈতিক কারণে বাড়িয়ে বলা হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় কতটা উপেক্ষা করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থকে।
দেশের মোট রাজস্বের বড় অংশ খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, কারণ রাজধানী ছিল ওখানেই। পাশাপাশি, বাজেটের একটা বড় অংশ যেত প্রতিরক্ষা খাতে, যা ছিল পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক। উন্নয়নের খরচ, বিদেশি সাহায্য আর ঋণ—সবকিছু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান বেশি পেত।
যদিও পাট রপ্তানি থেকে দেশের বেশিরভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে, তবুও সেই টাকার বড় অংশ খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়ে তোলার জন্য। সেটা রাজস্ব খরচ হোক, উন্নয়ন খরচ হোক, বিদেশি সাহায্য হোক বা বৈদেশিক মুদ্রা—পূর্ব পাকিস্তান কখনোই তার প্রাপ্য অংশ পায়নি, যদিও দেশের বেশিরভাগ মানুষই বাস করত পূর্ব পাকিস্তানে।
১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের এক দল বিশেষজ্ঞের তৈরি করা একটি রিপোর্টে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রমাণ তুলে ধরা হয়। সেই রিপোর্টের সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো তথ্য ছিল—একজন গড় পশ্চিম পাকিস্তানি আর একজন গড় পূর্ব পাকিস্তানির আয়ের পার্থক্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে।”
উপরের অংশটুকু পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায়—খোদ পাকিস্তান সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যিনি এক সময় পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্যের পক্ষে ছিলেন, তিনিই স্বীকার করে নিচ্ছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য করা হয়েছে এবং এর জন্য দায়ী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী (অন্য বৈষম্যগুলো আলাদাভাবে আলোচনার দাবিদার হলেও এই মুহূর্তে তা না-ই বললাম)।
পিনাকীর এই বিভ্রান্তিকর ভিডিওর উদ্দেশ্য শুধু ইতিহাস বিকৃতি নয়, বরং একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত কারণকে আড়াল করে তাকে গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা—যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগে এই ভিডিও প্রকাশ নিঃসন্দেহে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টার অংশ বলেই মনে হয়।
পিনাকীর অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত, কিন্তু এই বিষয়ে আমার অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতীয় উপমহাদেশের নানা জাতিসত্তার মধ্যে কেবল পূর্ববঙ্গের মানুষই নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে পেরেছে—এটি সত্যিই অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটি যে কতটা সঠিক ছিল, তা বোঝাতে খুব বেশি পড়াশোনার প্রয়োজন পড়ে না—শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট যে শেখ হাসিনার সরকারের টানা পনেরো বছরের অপশাসনের পরেও একসময় পিছিয়ে থাকা পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাংলাদেশ, অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে একটিমাত্র কারণে—আমাদের বাবা-চাচারা এবং তাঁদের পূর্বপ্রজন্মের মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামের পর যুদ্ধ করে এই দেশটিকে স্বাধীন করেছিলেন।
সবাইকে মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।
(*পিনাকীনামা অনুসরণে- ইংরাজীত যখন লিখিচ্ছে, ঠিক-ই লিখিচ্ছে!)
Leave A Comment