গত আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মুক্তমনায় প্রকাশিত একটা পোস্টে লিখেছিলাম—

পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে সর্বত্র। বহুদিন পর দেশে গিয়ে দেখলাম, কৃষকরা আদিযুগের কাঠের লাঙলের পরিবর্তে আধুনিক যন্ত্রচালিত টিলার ব্যবহার করছেন, যা অনেক বেশি কার্যকর। তারা উচ্চফলনশীল ধানের চাষ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। খাল-বিল, নদী-নালায় লগি-বৈঠার নৌকার জায়গায় যন্ত্রচালিত নৌকার ব্যবহার সময় ও শ্রম বাঁচাচ্ছে। হাট-বাজারে প্রচলিত দাঁড়িপাল্লার পরিবর্তে ডিজিটাল স্কেলের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

তবে হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে এই পরিবর্তনের ঢেউ দেশের রাজনীতিতে লাগতে দেয়া হয়নি। দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দেওয়ার দাবি করা হয়েছিল ঠিকই, তবে তা বাস্তবসম্মত করার পরিবর্তে যা করা হয়েছিল তা অনেকটাই ধার করে ঘি খাওয়ার মতো—অস্থায়ী এবং আত্মঘাতী। বাইরের ঝাঁ চকচকে উন্নয়নের খোলসের ভেতরটা ছিল একেবারে ঘুণে ধরা কাঠের মতো ঠুনকো। স্বৈরাচারী শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত একচ্ছত্র ক্ষমতার অপব্যবহারের অনিবার্য পরিণতি ছিল দমনমূলক, দুর্নীতিপরায়ণ এক চোরতন্ত্রের বিকাশ। কেবল নিজেদের দলের শাসন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতেও দ্বিধা ছিল না দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের।

আমি সেই পোস্টেই উল্লেখ করেছিলাম নতুন রাজনৈতিক শক্তি গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা। জনগণ, ছাত্র নেতৃত্ব ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন একটি শক্তি গড়ে উঠতে পারে, যা প্রতিনিধিত্বশূন্য রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের শূন্যস্থান পূরণ করবে। লিখেছিলাম—

আন্দোলনকারী তরুণ নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে দেশব্যাপী একটি সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ শুরু করেছেন। আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব গড়ে উঠলে তারা জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারবেন। জনগণের চাওয়া-পাওয়া সরকার পর্যন্ত দ্রুত পৌঁছবে, সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে, এবং ভুল-বোঝাবুঝি দূর করা সম্ভব হবে। এই নেটওয়ার্ক যদি সফল হয়, তবে তা ভবিষ্যতে একটি সত্যিকারের জনবান্ধব ও প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক দলের ভিত্তি স্থাপন করবে।

অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে ছাত্র নেতৃত্বে একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, যা রাজনৈতিক পরিসরে সৌজন্যতার ইতিবাচক বার্তা বহন করে। তবে দল গঠনের সূচনাতেই কিছু অংশের মধ্যে পদ নিয়ে মারামারির ঘটনা হতাশাজনক। যারা কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, তারাই এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্ব চাইছে—এটাও তো এক ধরনের কোটা! দাবি থাকতেই পারে, তবে সেটি অগ্রাহ্য হলে সংঘাত কেন? বরং আলাদা দল গঠন করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত!

নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব অনেকের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও দলবাজদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে! তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন দল আর তার নেতাদের নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে—”জনসমর্থন নেই,” “নির্বাচনে জামানত হারাবে,” “অর্থসংকটের কারণে দল টিকবে না।” ইত্যাদি, ইত্যাদি! এমনকি দলের নাম ঘোষণার আগেই নেতার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, সেটাই গবেষণার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! যেন নেতা নিজের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে দল চালাবেন! অবশ্য যারা দেশের চেয়ে নিজেদের রাজনৈতিক দল, আর দলের চেয়ে নেতাকে বেশি গুরুত্ব দেন—যাদের কাছে রাজনীতি মানেই নিজের ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য—তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না।

অতীতের নেতারা দল চালানোর নামে সৎ-অসৎ সব উৎসের টাকা এমনভাবে ব্যবহার করতেন, যেন সেটা পারিবারিক সম্পদ—আর সেই অর্থ ভোট কেনা, সন্ত্রাসী পোষা, বিদেশে পাচারসহ কত মহৎ (!) কাজে যে ব্যবহার হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! নতুন দলের নেতারা এসব মহান (!) ঐতিহ্য মেনে চলবেন না বলেই মনে হচ্ছে, তাই তাদের অর্থসংকট ও ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের সমালোচনা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। এ যেন নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্পের মত মেয়ে পানি আনতে গিয়ে কাঁচের গ্লাস ভাঙতে পারে বলে আগেভাগেই তাকে চড় মেরে বসা !

কিছু মানুষ আশঙ্কা করছেন যে মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় হলে শিক্ষা, প্রযুক্তি, প্রশাসন ও চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মেধাসঙ্কট তৈরি হবে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। তরুণ শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে আগ্রহী। তাদের সবাই রাজনীতিতে জড়াবে—এমন ধারণার ভিত্তি নেই। তাছাড়া, দক্ষ নেতৃত্বের জন্য শুধু রাজনৈতিক ক্যাডার নয়, যেকোনো পেশার যোগ্য ও আদর্শবান ব্যক্তিরাই আসতে পারেন। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমরা তার সফল উদাহরণ দেখি।

আসলে রাজনীতিতে মেধাবীদের সম্পৃক্ততা দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক। দলীয় স্বার্থে দীর্ঘদিন রাজনীতিকে যেভাবে অপরাধীকরণ করা হয়েছে, তাতে নেতৃত্বের গুণগত মান ভয়াবহভাবে নিচে নেমে গেছে। খুনি, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজরা সরকারি দলগুলোর শীর্ষ পদে আসীন হয়েছে, অথচ বর্তমান বিশ্বে এরা আমাদের নেতৃত্ব দিতে সম্পূর্ণ অযোগ্য। মেধাবী তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণই এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রদের মুখ্য ভূমিকা ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। ছাত্ররা রাজনীতি সচেতন হোক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করুক, তবে সেটি যেন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির রাজনীতি না হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মূল লক্ষ্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। ছাত্ররাজনীতি যেন কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না করে। রাজনীতিতে সবাই নেতৃত্ব পাবে না, তাই ভবিষ্যতে সফল পেশাজীবী হয়ে ওঠার লক্ষ্যে ছাত্রজীবনে দক্ষতা বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের তোষামোদি করে, টেন্ডারবাজি আর চাঁদাবাজি করে আখের গুছিয়ে নেয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে—এটা বুঝতে হবে।

নতুন রাজনৈতিক দলের সামনে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, খুব শীঘ্রই যেগুলোর মোকাবেলা তাদের করতে হবে—

প্রথমত, পরাজিত শক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব রাজনৈতিক দলই নতুন দলটির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হবে। গতানুগতিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য নতুন দলকে নানা উপায়ে দমন করার চেষ্টা করবে। আসন্ন নির্বাচনের পর অন্য দল ক্ষমতায় এলে তারা নতুন দলের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক বাধা তৈরি করতে পারে, রাজনৈতিক নিপীড়ন চালাতে পারে, কিংবা মিডিয়া প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জনমনে সংশয় সৃষ্টি করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, নতুন দলটির জন্য অর্থায়ন একটি বড় সমস্যা হতে পারে, কারণ প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর মতো তাদের ব্যবসায়ী লবি বা বিদেশি মদদ নেই। তবে সাধারণ জনগণের মধ্যে, দেশ-বিদেশে, তাদের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। অবশ্য জনগণের চাঁদার ওপর নির্ভর করতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে—যা এদেশের রাজনীতিতে একেবারেই নতুন ধারণা।

তৃতীয়ত, নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ধরে রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন দলের মূল ভিত্তি তরুণরা, কিন্তু নেতৃত্ব গঠনে পরিণত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাব নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। যদি আদর্শগত বিভক্তি, পদ-পদবি নিয়ে বিবাদ, বা ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ দলে ফাটল ধরায়, তাহলে দলটি খুব দ্রুত অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।

চতুর্থত, নতুন দলের প্রতিনিধিদের জন্য নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রবেশ করাটাও হবে কঠিন কাজ। এদের বেশীর ভাগেরই তেমন রাজনৈতিক পরিচিতি নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় দলীয় প্রতীকের বাইরে কেউ জয়ী হতে পারে না বললেই চলে। তাই নতুন দল কীভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, সেটিই তাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।

পঞ্চমত, বাংলাদেশের জনগণের মতাদর্শগত বৈচিত্র্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। দেশে একাত্তরের সংবিধান অপরিবর্তনীয় রেখে ভবিষ্যৎ রাজনীতি পরিচালনার দাবি যেমন আছে, তেমনি কেউ কেউ সংবিধান একেবারে পাল্টে ফেলারও কথা বলছেন। এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ, আওয়ামী লীগের পরিণতি, এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোর সমাধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও রয়েছে।

সামনের দিনগুলো যত কঠিনই হোক নতুন রাজনৈতিক শক্তির আত্মপ্রকাশ জাতিকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করেছে। রাজনীতিতে অনীহাগ্রস্ত অনেক মানুষ আবার নতুন করে আগ্রহী হচ্ছেন। একটি সফল জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের প্রয়োজন যোগ্য শাসনব্যবস্থা ও দক্ষ নেতৃত্ব। নতুন দলটি যদি সততা, ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণমূলক রাজনীতির আদর্শ ধরে রাখতে পারে, তাহলে এটি দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে।

আমরা স্বপ্ন দেখি—সেই ভবিষ্যতের, যেখানে দেশ পরিচালনায় সৎ ও দক্ষ নেতৃত্ব থাকবে। নতুন প্রজন্মের এই প্রয়াস যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। গত জুলাইয়ের বিপ্লবে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা রক্ত ও জীবন দিয়ে আমাদের যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছিল, তা বাস্তবে রূপ পাক।