দেশের চলমান কোটা আন্দোলনে এতগুলো সম্ভাবনাময় প্রাণের ঝরে যাওয়ার ঘটনা আরও বহু মানুষের মতো আমাকেও বেশ অস্থির করে তুলেছে। বারবার মনে হচ্ছে সরকার একটু উদ্যোগী হয়ে শুরুতেই আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। এদেশের মানুষ আসলে যথেষ্ট সহনশীল। এতো অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি আর অভাব-অনটনের মধ্যেও তারা মোটামুটি নীরবেই তাঁদের নিত্যদিনের কাজ করে যাচ্ছেন। সেই মানুষগুলোরই একটা অংশ যখন একটা ন্যায্য দাবীর সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসেন, তখন সরকারের উচিত তাঁদের কথা শোনার চেষ্টা করা, এমনকি একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারেরও তা করা উচিত।

দেশের পরিস্থিতি বেশ উত্তাল! আন্দোলনে ছাত্রলীগ আর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ আর বিষোদ্গার হচ্ছে প্রচুর। তবে এরা তো দাবার ঘুটি মাত্র! শহীদ আবু সাঈদের বুকে গুলি চালানো পুলিশ সদস্য দোষী, কিন্তু সে হুকুমের দাস। সঠিক তদন্ত হলে আমরা জানতে পারব সে কারও নির্দেশে, না কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গুলি চালিয়েছে এবং এক্ষেত্রে তার পদ্ধতিগত কোন গাফিলতি ছিল কি না। তবে যদি সমালোচনা করতে হয় তাহলে এসব চুনোপুঁটির বংশনাশ না করে শীর্ষ নেতৃত্বের সমালোচনা করাটাই বেশী যুক্তিযুক্ত হবে।

সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কোটা সংস্কার নিয়ে পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য এসেছে। একদিকে বলা হচ্ছে সরকার হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল করেছে, বিচার বিভাগের মাধ্যমে সমাধান হবে বলে আশা দেখানো হচ্ছে, আবার অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের কঠোর সমালোচনা করে কোটা ব্যবস্থা চালু রাখার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় মনে হয়েছে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার চেয়ে সংঘাতের পথে হাঁটার দিকেই ঝোঁক বেশী ছিল – উপরমহলের ইঙ্গিত ছাড়া ছাত্রলীগ এভাবে মারমুখী হয়ে উঠবে এটা বোধহয় পাগলেও বিশ্বাস করবে না।

সরকারের উপরমহলে জনগণকে অগ্রাহ্য করার মনোভাব ভালভাবেই দৃশ্যমান। দেশের নির্বাচনগুলো যেভাবে হয়ে আসছে তাতে অবশ্য এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটা ভিডিও ক্লিপ এ দেখলাম যে প্রধানমন্ত্রী তাচ্ছিল্যভরে একজন সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীকে তুই-তোকারি করে সম্বোধন করে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলছেন। এই ভাষায় কথা বলার অধিকার তাঁকে কে দিল? তিনি তো আর সত্যিই জনগণের রাণীমা নন। দেশটা জনগণের, তিনি তাঁদের প্রতিনিধি মাত্র! তাও আবার যেচে জোর করে এই দায়িত্ব নিয়েছেন। যাদের সাহায্যে এই দায়িত্ব নিয়েছেন সেইসব বেনজীর-আজিজ এন্ড কোং জনগণের করের টাকায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও যে কি খেয়ে দলদাস-মার্কা রাজনৈতিক বুলি কপচাত তাও এখন পরিষ্কার। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন তার পিয়ন চারশো কোটির কারিগর! এবার ভাবুন, তার কাছের পারিষদদের মধ্যে যেসব কামেল দরবেশের দল মাদারীর খেলা দেখিয়ে হিসাবের খাতা ফকফকা করে দিচ্ছে তাদের সংখ্যা কতো আর হাপিস করা টাকার পরিমানই বা কতো? জনগণের রক্ত পানি করা উপার্জন বিলিয়ন ডলার কিভাবে সিঙ্গাপুরে চলে যায় সেই সহজ হিসাবই তো এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না (বেশী বোঝার চেষ্টা করলে আবার আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হতে পারে)।

সরকারের কেউ কেউ অবস্থা বেগতিক দেখে এখন তৃতীয় পক্ষ হিসাবে আবার সেই মাজা-ভাঙ্গা বিএনপি, জামাত আর শিবিরের জুজু দেখানোর চেষ্টা করছেন। ঠিক আছে, তৃতীয় পক্ষ এধরনের অবস্থার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতেই পারে, করছেও, কিন্তু প্রিন্ট এবং ডিজিটাল মিডিয়াসহ অন্তর্জালের ব্যক্তিগত পাতাগুলোতে চোখ রাখলে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে কোটা-বিরোধী আন্দোলন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিংবা কোন তৃতীয় পক্ষের প্ররোচনায় ঘটে নি। দলমত নির্বিশেষে মানুষ সংস্কারের দাবী তোলা আন্দোলনকারীদের সমর্থন করছেন। এদের মধ্যে সরকার-সমর্থকরাও আছেন, অবশ্যই কিছু মুখ-চেনা দলদাস হেলদোল-হীন সমর্থক ছাড়া।

দলদাসদের কথা যখন উঠলই, তখন অবশ্যই জাফর ইকবাল স্যারের কথা না বললেই না, যিনি এর মধ্যেই জাতীয় স্যার থেকে জাতীয় ভাঁড়ে রূপান্তরিত হয়েছেন (দুঃখিত এই অ্যাডহোমিনেমটুকু বাদ দিতে পারলাম না)। কোটার স্বপক্ষে বলার মতো শক্ত যুক্তি না পেয়ে তিনি এক হাস্যকর কারণ দেখিয়ে তার অপরিণত লেখাটিকে জরায়ুতেই হত্যা করেছেন। আরে মিয়া, আপনি এদ্দিন আছিলেন কই? ছেলেমেয়েরা অসহায় ক্ষোভে নিজেদের রাজাকার বলছে আর এ নিয়ে আপনার মগজ বিস্ফোরিত হচ্ছে। কিন্তু কারণে, অকারণে, যাকে, তাকে রাজাকার বানিয়ে যখন এই ঘৃণ্য অপবাদটিকে ডাল-ভাত বানিয়ে ফেলা হয়েছিল, তখন মিনমিন করেও যদি কেবল সাদাসিধে সত্যগুলো তুলে ধরতেন তাহলে বোধহয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবে জন্মের আড়ি জানাতে হত না। আর, উনি ঠিক করে দেবেন কে এই দেশে চাকুরী পাবে? কে দেশে থাকবে আর থাকবে না তাও ওনাকে ঠিক করে দিতে হবে? ভাবলে নিজের উপরই করুণা হয় যে শৈশব-কৈশোরের অতি প্রিয় এই লেখককে একসময় জাতির বিবেক হিসাবে দেখতাম। এখন তো তাকে একজন অগভীর চিন্তার দলদাস আর ইমোশনাল ফুল ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

কেবল অধ্যাপক ইকবালই দলকানা রোগে আক্রান্ত নন; সরকার-সমর্থক কেউ কেউ কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা সাংবাদিকের প্রশ্নের ধরনের সমালোচনা করছেন। প্রশ্নের ধরনই না কি এমন ছিল যা প্রধানমন্ত্রীকে বেকায়দায় ফেলে একটা ক্ষতিকর বা বেফাঁস উত্তর দিতে বাধ্য করেছে। আরে ভাই, যদি তাই হয় তাহলে সাংবাদিক তো পেশাগতভাবে দারুণ দক্ষ বলতে হবে! এমন প্রশ্ন করেছেন যে তিন বারের (না কি চার; হিসাব রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে!) প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্যাঁচ খেয়ে গেলেন। নাঃ সাংবাদিক তাঁর দায়িত্ব ভালভাবেই পালন করেছেন, বরং যেসব গুণীজন সাংবাদিকের সমালোচনা করছেন তাঁরাও হালুয়া-রুটির উচ্ছিষ্টের কথা না ভেবে কোদাল কে কোদাল বলার সৎ-সাহস দেখান। তাতে নিজ দলের রাজনীতির মান উন্নত হবে, উপকৃত হবে দেশ আর জাতি।

মৃত্যুঞ্জয়ী আবু সাঈদ তাঁর আত্মত্যাগের আগে ফেসবুকে দেয়া পোস্টে শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার উল্লেখ করেছিলেন। অধ্যাপক শামসুজ্জোহাও একজন মানুষ ছিলেন, যিনি ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে প্রাণ দিতে দ্বিধা করেন নি। আমাদের আজকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকরাও মানুষ, তাঁরা কি কেউ আন্দোলন এভাবে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার আগেই ছাত্রদের ন্যায্য দাবীর সাথে সংহতি জানিয়ে পাশে থাকতে পারতেন না? অবশ্য এমন আশা করাটাই ভুল; কবেই বা তারা পদের মায়া ছেড়ে যৌক্তিক কারণে সরকার বিরোধিতার সাহস দেখিয়েছেন!

তবে না, সবকিছুই কেবল হতাশার না! অন্য একটা ভিডিও ক্লিপে দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপক কোন উত্তেজনা না ছড়িয়ে, শান্ত অথচ সু-দৃঢ়ভাবে শাহবাগ থানার ফটক খুলিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে তাঁরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়া একজন ছাত্রকে থানা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন। এই আনন্দময় ঘটনা দেখার সময় চোখ ভিজে উঠেছিল, ভাবছিলাম কাদের সাহেবের আহবানে রাজপথে থাকা হেলমেট-ধারী নারী-নির্যাতনকারীদের কয়জন পুলিশের হাতে আটক হয়েছে?

আরও কিছু প্রশ্ন জেগেছিল মনে! যখন অতি-দুর্বল বিরোধী দলগুলোর স্রোতের শ্যাওলার মত ভেসে যাওয়া রাজনীতিতে জনগণ কোন সাড়া দিচ্ছে না, রাজনীতির মাঠ প্রায় পুরোটাই ফাঁকা, তখনই কেন কোটা -ব্যবস্থার মতো একটা বিতর্কিত বিষয় সামনে এনে মানুষের মধ্যে সরকার-বিরোধী মনোভাব আরও উস্কে দেয়া হল? এটা কি সরকারের পরিস্থিতি বুঝতে না পারার অক্ষমতা, ক্ষমতার উগ্র প্রদর্শন, নাকি কেবলই সরকারের ভেতরের নিয়ন্ত্রণ-হীন একটা অংশের স্বার্থ হাসিলের বিচ্ছিন্ন চেষ্টা?

আমার মতে সরকারের চরম অগণতান্ত্রিক আচরণ আর ভিন্নমত সহ্য না করার প্রবণতা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একটা দেশে সবাই একইভাবে চিন্তা করবেন না এটাই স্বাভাবিক, ভিন্নমত থাকবেই। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাসহ আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও কোটা ইস্যুতে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছেন। অথচ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব আর নীতি-নির্ধারকরা এককথায় কোটা-বিরোধী সবাইকে রাজাকারের বংশধর হিসাবে চিহ্নিত করতে চান, মূল সমস্যাটা এখানেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া দেশের বেশীরভাগ মানুষই স্বাধীনতার স্বপক্ষে ছিল। এই মানুষগুলোর সবাই কোন না কোন ভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দেশ স্বাধীনের তিপ্পান্ন বছর পর কেবল রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি বনাম রাজাকারের নাতি’ বিতর্কের সৃষ্টি শীর্ষ নেতৃত্বসহ আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের অপরিণামদর্শিতা আর চিন্তার দীনতাই প্রকাশ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় সত্ত্বার মূল ভিত্তি, আমাদের জাতীয়তাবোধ, চিন্তা-চেতনা আর আদর্শের বাতিঘর- সরকার সংশ্লিষ্টরা যদি সত্যি তা বিশ্বাস করেন তাহলে জাতি-বিভাজনের মত ধ্বংসাত্মক পথে না হেঁটে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরুন, এ নিয়ে তথ্য-ভিত্তিক গবেষণা করতে আগ্রহী করে তুলুন, সমান অধিকার নিশ্চিত করুন, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করুন এবং শ্রদ্ধা করতে শেখান এবং যার যার যোগ্যতা মতো ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ করে দিন। অর্ধশতক পার করে আসা বাংলাদেশে এখন সামনে চলার সময়, পেছনের তিক্ততা প্রজন্মান্তরে সামনে ঠেলে দিলে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে না।

যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা অপূরণীয়। এর দায়ভার সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এড়াতে পারেন না। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, রাজপথ শান্ত হোক, আমাদের ছেলেমেয়েরা তাঁদের ন্যায্য দাবী আদায় করে আবার মায়ের বুকে ফিরে আসুক। আর কোন মায়ের কোল যেন এভাবে কারও অদক্ষতা, ক্ষমতার দম্ভ আর লোভের বলি হওয়ার জন্য খালি করে ফেলা না হয়।