অভিজিৎ’দার সাথে সাথে ২৬ তারিখ আরেকজন লেখকের জীবন আজীবনের জন্য বদলে গিয়েছে। মেয়েটির নাম বন্যা আহমেদ। বিবর্তন নিয়ে তার লেখা ´’বিবর্তনের পথ ধরে” বইটা রোজ কত মানুষের চিন্তায় নাড়া দেয়, সে হিসেব আমরা হয়ত কখনো জানব না কিন্তু উনি লিখেছিলেন বলে বাংলায় বিবর্তন নিয়ে সব চেয়ে সহজ বইটা আমাদের পড়া হয়েছিল।

 

লেখক বন্যাকে হয়ত অনেকেই চেনে কিন্তু ব্যক্তি বন্যা কে আমার চেয়ে সম্ভবত ভাল কেউ চেনে না। ১২ বছরের বন্ধুত্ব আমাদের, এই তো মাস কয়েক আগেও পুরা একটা সপ্তাহ ডিসিতে এক সাথে কাটিয়ে এসেছি। আমি তাকে ভালোবাসি তার মেধা, তার সাহস, তার বুদ্ধিমত্তা আর তার হার না মানা স্বভাবের জন্য। কখনো আত্মজীবনী লেখার সাহস হলে এই বিষয়ে হয়ত লিখব।

 

প্রায় ১০ বছর হতে চলল ! অথচ মনে হয়, এই তো সে দিন, শুভ যখন মেসেজ দেখিয়ে বলল, অভিদা, বন্যাপা আগামীকাল আড্ডায় ডেকেছে, যাবি ?  কি প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলাম আমি ।

“অবিশ্বাসের দর্শন‘ বইটি তে আত্মা নিয়ে চমৎকার একটা অধ্যায় আছে । পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম । আড্ডায় মে-ডাম-মে-ফি, জৈন ধর্ম, অদ্বৈত দর্শন নিয়ে নিয়ে আলোচনা হবে ,  জমানো কৌতূহলের উত্তরগুলো মিলে যাবে কিংবা জন্ম নেবে নতুন কোন কৌতূহলের ।

 

সেই রাতে যখন দাদার নিথর দেহটা দেখলাম তখন কি অনুভূতি হয়েছিল , ভেতরটা কতটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে, লিখে বোঝাতে চাই না। ওটা আমার ভেতরেই থাক, আমি শুধু পাগলের মত চেয়েছি বন্যাপা অন্তত ফিরুক।

 

ওয়াসিকুর এর সাথে বহুবার দেখা হয়েছে। কোন এক অজানা কারণে আড্ডার নীরব দর্শক ছিল ছেলেটা । হয়ত চুপ থাকাটাই ওর স্বভাব ছিল ,  অথবা খানিকটা লজ্জা পেত । ঠিক জানা নেই আমার । ওর মৃত্যুটা আমাকে বারবার ভাবিয়েছে । কোন দিন আমার জানা হবে না ,  কি সে উপলব্ধি , যে উপলব্ধিতে ও অন্ধদের বায়বীয় অনুভূতিতে বারবার আঘাত করতে চাইত ? অলীক কোন শক্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে চাইত , কেনই বা ও ভ্রান্তির দরজা ভেঙে বেরিয়েছিল ।

 

অনন্ত বিজয় এর সাথে পরিচয় শুধুই তার লেখায়। আমার আলসেমি আর তার স্বল্পভাষী স্বভাবের জন্যই হয়ত ইনবক্স আলাপচারিতাটা খুব একটা এগোয়নি । তাছাড়া দুজনের লেখার ধরন , বিষয়বস্তুতে মতভেদ থাকায় সাবলীল আলাপচারিতার পথটাও সরল হয়ে ওঠেনি কখনো । তবুও জানতাম একজন মেধাবী লেখক ধীরে ধীরে তার আলো ছড়াচ্ছেন । রাজীব হায়দার , অভিজিৎ রায় , ওয়াসিকুর বাবুর পরে তিনিও আজ কেবলই অতীত ।

 

এই মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে । সত্যিকার অর্থে এরা শুধুমাত্র চারটা মানুষ নন। তারা চারজনই চারটা ভিন্ন ধারার ধারক। তারা প্রত্যেকেই এক একটা নদীর মত । তাদের প্রত্যেকের চিন্তা , মেধা,  লেখার আলাদা আলাদা প্যাটার্ন ছিল । এই গুণাবলী দুর্লভ । একথা সত্যি যে পূর্বজদের আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলো উপস্থাপন, সম্প্রসারণ, সংশোধন নিয়েই ওনারা কাজ করছেন এবং খুব অল্প সময়ে কাজের সফলতাও পেয়েছেন । বিশেষ করে অভিজিৎ রায় এই ক্ষেত্রে শতভাগ সফল। এরা বিকশিত হয়ে একদিন সমুদ্র হতে পারত ।

 

সাধারণ কারো মৃত্যুর সাথে এখানেই তাদের মৃত্যুর পার্থক্য । সক্রেটিস, হাইপেশিয়া, ইহুয়ান ক্রুজ, নাগীব মাহফুজ,  হুমায়ুন আজাদদের মৃত্যুতে দেশের যে ক্ষতি হয়, সে ক্ষতি পূরণ হতে শত সহস্র বছর লেগে যায় । ততদিন দেশ নিষ্ফলা বিরানই থেকে যায়।

 

যে দেশে গুণীর কদর হয় না সে দেশে গুণী জন্মায় না, আর যে দেশে গুণীর হত্যা হয় সে দেশ নির্বোধের দখলে চলে যায়।

 

মুসলিম দেশগুলোতে ভিন্ন ধারার সৃজনশীল মানুষরা এখন বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। পাকিস্তানে সাবিন মাহমুদের হত্যা হল । সেখানকার শিল্পীরা বেশিরভাগই ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বাকিরা ইউরোপ অ্যামেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে।

 

শুধু মাত্র ব্লগ লেখার অপরাধে সৌদি আরবে রাইফ বাদাউয়িকে ১০ বছরের জেল দিয়েছিল সৌদি আদালত।

 

ইরানী পরিচালক জাফর পানাহি পরিচালিত সিনেমাগুলো বিশ্ববাসীর ভূয়সী প্রশংসা কুড়ালেও তার নিজের দেশেই সেগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে । ইরানের মেধাবী চলচ্চিত্রকাররা নিজ দেশেই অবাঞ্ছিত হয়ে এখন প্রবাসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে। একই অবস্থা তাদের লেখক, সাহিত্যিক, চিত্রকর , শিল্পীদেরও। নোবেল বিজয়ী লেখিকা শিরীন ইবাদী কেও দেশ ছাড়তে হয়েছে।

 

সোমালিয়া ,সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান এর বর্তমান অবস্থা গুণী বেড়ে ওঠার অনুকূলে নেই ।

নাগীব মাহফুজ কে ছুরি মেরে হত্যা করতে চেয়েছিল। ছুরির আঘাত নিয়ে লিখতে কষ্ট হত, তবুও আমৃত্যু লিখেছেন ।

 

সালমান রুশদি তার এক চোখের অন্ধত্ব নিয়েও লিখে যাচ্ছেন। শারীরিক এবং মানসিক ক্ষত তাকে হারিয়ে দিতে পারেনি ।

 

বন্যা আহমেদ তার লেখায় অভিজিৎ রায় সম্পর্কে লিখেছেন ,

 

আমি নিশ্চিত জানি অভিকে যদি বলা হত যে তুমি হয় এভাবে যা বিশ্বাস কর তার জন্য অকালে জীবন দাও অথবা লেখালিখি বাদ দিয়ে অনেকদিন বেঁচে থাক, আমার দৃঢ় ধারণা সে প্রথমটাই বেছে নিত

 

মুক্তমনা লেখকরা জানেন, মৃত্যু খুব কাছেই। তবু লিখে যায় , কাজ করে যায়। তারা জানে ব্রুনোকে হত্যার শত শত বছর পরে পৃথিবী বুঝেছে কত বড় অন্যায় করা হয়েছে তার সাথে। ইতিহাস সাক্ষী, যারা প্রগতির পথে হেটেছে তাদের পথটা কখনো সহজ ছিল না। সে শিক্ষা ধারণ করে, মৃত্যু দরজায় দাড়িয়ে আছে জেনেও, বন্যা আহমেদরা আলো ছড়ায়। অন্ধত্ব দূর করে যায়।

 

বিবর্তনের পথ ধরে বইখানি পড়তে এখানে ক্লিক করুন