লিখেছেনঃ মেহবুব

এক)

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিষ্কার করে। –

উপরের কথাগুলো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। অভিজিৎ রায়ের ভীষণ পছন্দের ছিল এই পংক্তিগুলো। আর তার পছন্দের ছিল ফ্রান্সের ভাস্কর আগুস্ত রোঁদা, রোঁদার ‘চিন্তিত মানুষ’ ভাস্কর্যটি যেন অভিজিতের জীবনকেই প্রতিনিধিত্ব করে।

ভাস্কর আগুস্ত রোঁদার ‘চিন্তিত মানুষ’ ভাস্কর্য

অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০১ সালে, যখন মুক্তমনা ইয়াহু গ্রুপ তৈরী হয়। তখন অনলাইনে বাংলাদেশের সব পত্র-পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। সেই সুবাদে এই গ্রুপের সন্ধান পাই। পেয়েই অভিজিৎ রায়কে একটা মেইল পাঠাই। মেইল করার কিছুক্ষণ পরেই আমি তাঁর কাছ থেকে মেইলের উত্তর পাই। সে তখন সিঙ্গাপুরে বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারং-এ পিএইচডি করত। সেই থেকে আমাদের পথ চলা শুরু। পরে সে যুক্তরাষ্ট্রে যাবার পরে টেলিফোনে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। অনেক বিষয় নিয়েই আমরা কথা বলতাম। কথা বলতাম মুক্তমনার ভবিষ্যৎ, কাজের পরিধি, বাংলাদেশের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানমনষ্ক মন-মানসিকতা তৈরীর জন্য বিজ্ঞান আন্দোলন, জীবন, জগত থেকে শুরু করে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের কথা।

অভিজিৎ রায় কোনো একটা লেখা লিখলেই সেই লেখায় রেফারেন্স হিসাবে থাকত ৫০ থেকে ১০০ টা বইরের রেফারেন্স। সবার মধ্যেই তখন একটা বড় প্রশ্ন ছিল যে, সে এতো বিজ্ঞানের বই কখন পড়ে শেষ করে, কীভাবে এটা সম্ভব ছিল ? শুধু কি বিজ্ঞানের বই! থাকত সংস্কৃতি থেকে শুরু করে বিশ্ব-সাহিত্যের অসংখ্য বইয়ের রেফারেন্স।

তখন ‘মুক্তমনায়’ লেখা হতো বিজ্ঞান, দর্শন, ভ্রমণ, ধর্ম, সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়, কী না! যেটাই লেখা হোক না সেটা নিয়ে, অনেক সময়, দেখা যেত ভীষণ বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়েছে। সেই বিতণ্ডার কিনারা যখন হতো না, তখন অভিজিৎ রায় এসে, সেটার উপর যেন এক চিলতে বরফের টুকরো ঢেলে দিয়ে, তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে সবাইকে আবার বরফের মতোই ঠান্ডা করে দিত। কেউ এনিয়ে আর রা করত না। অভিজিতের শান দেওয়া যুক্তির কাছে সবার অসার যুক্তি প্রবল স্রোতের বন্যার বানের মতো ভেসে যেত।

ওর জীবনের সবচাইতে বিশেষ যে গুণ ছিল সেটি হলো মানুষের সাথে তার সজ্জন আচরণ, সে মানুষ যেই হোক। সেই মানুষকে সে যেন বহু যুগ ধরে চিনত। কোনোদিন যে এক লাইনও লেখে নি তাকে সাহস দিয়ে, অভয় দিয়ে অভিজিৎ রায় তাকেও লেখক বানিয়ে ছেড়েছিল।

এমনই পরোপকারী আর আকাশের মতো বিশাল উদার মন, সহনশীল মানুষ ছিল অভিজিৎ রায়। আর যারা তাঁকে শত্রু হিসাবে গণ্য করত তাদের সাথে কথা বা দেখা হলেই তারা হয়ে যেত অভিজিৎ রায়ের এক বড় অনুসারী এবং তাকে আপন করে নিত সহজেই।

প্রিয় বন্ধু, সহধর্মিনী রাফিদা আহমেদ বন্যা ছিল তাঁর জীবনের সেরা বন্ধু এবং সাথী। বন্যার গলায় যখন থাইরয়েড ক্যন্সার ধরা পড়ে, তখন অভিজিৎ বন্যার উদ্দেশ্যে যে প্রেমের চিঠি লেখে, সেটা ওই সময় যারা পড়েছিল তাদের সবারই চোখ অশ্রুসিক্ত করেছিল। চিঠিটি ছিল যেন একটি রজনীগন্ধা ফুল, সে ফুলের করুণ ঘ্রাণ আর স্নিগ্ধতা যেন সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল।

সে আজীবন ছিল রসবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। প্রতিদিনের জীবনে যা কিছু ঘটে তাকে ভালোভাবে সে গ্রহণ করত। যত দু:খজনক ঘটনাই হোক না কেন জীবনে ? কাজের দায়িত্ব এবং বাবা হিসাবে ছিল সে ভীষন দায়-দায়িত্বশীল মানুষ। বন্যার মেয়ে তিশাকে নিজ কন্যার মতো মানুষ করেছে। তিশা অভিকে বাবা বলে ডাকে, অভিই যেন তার জীবনে সেরা বন্ধু, সেরা মানুষটি।

অনন্ত বিজয় দাশকে নিয়ে ছিল অভিজিৎ রায়ের ভীষণ গর্ববোধ, সে গর্বের যেন শেষ হতো না। বলত, হাজার হাজার, লাখ লাখ অনন্ত আমাদের দরকার নেই,এক অনন্ত-ই লাখ লাখ অনন্তের সমান।

দেশীয়-বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সামাজিকতা, রাষ্ট্র ,দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম, মানবজাতির অগ্রগতি ইত্যাদি নিয়ে ছিল তাঁর গভীর দৃষ্টিভঙ্গি। সেই ২৫ বছর আগেই সে বলেছিল যে, আজ বিশ্ব এক ভয়ংকর বিশ্বাসের কালো ছায়ায় আটকে যাচ্ছে। তা হলো বিশ্বাসের ভাইরাস। মানবজাতি যেন সেই অন্ধকার বিশ্বাসের ভাইরাসে ভীষন আক্রান্ত। তাই লিখেছিল ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামে বই।

অনেক অনেক বছর আগেই অভিজিৎ রায় বুঝতে পেরে লিখেছিল ‘সমকামিতা- একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ নামের একটি বই যার প্রভাব তখন দেশের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষিতশ্রেনীর উপর ভীষণ প্রভাব পড়ে। মানুষের জীবনে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সমাজে, রাষ্ট্রে সবচাইতে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে সেক্সসুয়ালিজম, সেটা হাতে গোণা কয়েকজনই মাত্র বুঝতে পেরেছিল। যদিও সমস্যাটা সবসময়ই ছিল। সেটার মধ্যে প্রধান একটা বিষয় হবে ‘সমকামিতার’ বিষয় নিয়ে।

অভিজিৎ রায় সবসময় বলত বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে ? কাউকে না কাউকে তো বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে হবে-ই, কিন্তু তার পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর, সে তাঁর সাথীদের নিয়ে জীবন দিয়ে সেটার প্রমাণ দিয়ে গেছে।
মুক্তচিন্তার ও মুক্তবুদ্ধির জয় হোক। এবং তা হতেই হয় কেউ মানুক আর না মানুক জীবনে। এছাড়া যে, জীবনে কারোরই সামনে যাবার আর অন্যকোনো খোলা পথ নেই।

‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ এবং সমকামিতা নিয়ে বই, এই দুটি বই অভিজিৎ রায়ের জীবন নাশের অন্যতম একটা কারণ ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই দুই বই তাঁর জীবন নাশ করে দিল? কী ছিল তাহলে সেই বই দু’খানায় ? তাহলে কি বই দু’খানা বাংলাদেশের মানুষের মগজে ধারন করার জন্য বিকশিত হয় নি ? হয়তো তা হয়নি।

আজ প্রিয় বন্ধু,অভিজিৎ রায়ের নবম হত্যা দিবস। ২০১৫ সালের ২৬ শে ফ্রেবুয়ারী সন্ধার একটু পরে বইমেলা থেকে বের হয়ে টি এস সি-র গোলচক্করের পাশে সরোওয়ার্দির উদ্যানের কিনারে রাস্তার উপর দিয়ে অভি-বন্যা হাতে হাত রেখে হাটার সময় তাঁদেরকে উগ্র ইসলামী প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গী গোষ্টীর সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে শত শত জনতার সামনে পিছনদিক থেকে এসে তাঁদের ঘাড়ে, মাথায়, বুকে ধারালো চুরি এবং চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়।

কেউ কাছে এসে সন্ত্রাসীদের রুখে দাঁড়ায়নি। তাঁদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়নি। চেয়ে চেয়ে দেখেছিল কীভাবে একজন মানুষকে ধারালো চুরি, চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে আঘাতে আঘাতে, কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যার উল্লাসে উমত্ত চেষ্টারত ছিল জঙ্গী সন্ত্রাসীরা। বন্যা আহমেদকেও চাপাতি দিয়ে তাঁর ঘাড়ে, মাথায় কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। চাপাতির আঘাতকে রুখতে গিয়ে তাঁর বাম হাতের আংগুল হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। সেদিকে বন্যার একবিন্দু খেয়াল ছিল না। শুধু প্রাণের বন্ধু, স্বামী অভি যেন বেঁচে থাকে তার জন্য মরিয়া হয়ে, পুরো শরীর রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে জেনেও, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার চেচামেচি করে যাচ্ছে রাস্তার পাশে চারিদিকে দাঁড়ানো জনতার কাছে বাঁচাও বাঁচাও, সাহায্য চেয়ে। সে-ই গগনবিদারী চিৎকার আর চেঁচামেচি জনতার কানে পৌঁছেনি, সাহায্য সহযোগিতা তো দূরের কথা, জনতা শুধু বীভৎস রক্তাক্ত শরীর চেয়ে চেয়ে দেখেছিল। বন্যা আহমেদের হাজারো গগনবিদারী আকুতি আর্ত-চিৎকারেও কারো মন গলেনি যে, তাদেরকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়া দরকার।

সবচেয়ে জঘন্যতম দৃশ্য এবং বর্বরতা ছিল যে, সে সময় হত্যাকান্ডের আশেপাশে চারিদিকে অসংখ্য রাষ্ট্রের জনগনের টাকায় বেতন ভোগী পুলিশবাহিনী কর্তব্যরত ছিল। তারা যেন ছিল অথর, নিথর,বোবা বাহিনী। কীভাবে এটা সম্ভব হয়? পুলিশের কাজ বা দায় কী? এ কোন অসভ্য নগরী যে নগরীতে যারা সবার জান-প্রান-মালের রক্ষাকারী তাদের এ কেমন কান্ড-জ্ঞানহীন বেহায়া তামাশা ছিল?

অবশেষে জীবন নামে এক সাংবাদিক এসে তাদেরকে সি এন জি-তে উঠিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

কে জানত, এই অভিজিৎ রায়, পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহতে জন্ম নেওয়া তরুণ যুবক নক্ষত্র অভিজিত রায়, তার জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে বর্বর জংগী সন্ত্রাসীদের ধারালো চাপাতির আঘাতে আঘাতে। কিন্তু মানুষ নামের দ্বিপদী প্রাণী অভিকে হত্যার উল্লাসে নেচেছিল, আনন্দ উৎসব করেছিল। মানুষ নামের বর্বর, নরখাদক, জংগী সন্ত্রাসীদের হাত কি তখন একবিন্ধুও কাঁপেনি ? তাদের মাথার মগজে তখন মহাকালের কোন অন্ধকার নেমে এসেছিল ? তাদের মস্তিষ্কের সব নিউরন কি তখন স্তব্ধ হয়ে আফ্রিকার সাভানার জংগলের মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এসেছিল? আসে নি। কারণ তারা জানতো তারা কাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হত্যা করছে ?

সন্ত্রাসীরা জানতো মহাকালের এক ক্ষণজন্মা নক্ষত্র-কে হত্যা করছে। হত্যার মদতদাতা ছিল নৈপথ্যে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ধার্মিক জংগী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হোতারা। পরিকল্পনা করেছিল তারা-ই। তারাই নিতান্ত মূর্খ ব্রেইন-ওয়াশড ধার্মিক জংগীদের দিয়ে অভিজিৎ রায়কে হত্যার ছক আঁকে। তারা ঠান্ডা মাথায় দীর্ঘ সময় ধরে অভিজিৎ রায়-কে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল এবং তাঁকে খুন করিয়েছিল।

দুই )

প্রশ্ন হলো, এরা কারা? কেন অমন বীভৎস আনন্দ, উৎসব আর উল্লাসে তারা ,মেতে উঠেছিল অভিজিৎ রায়-কে হত্যা করার জন্য ?

এ-এক কঠিন বিষয় যার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বড়ই জটিল। যদিও আজ আপামর জনগন জানে এই হত্যার হোতা কারা ? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো রাষ্ট্রের উপর সম্পূর্ণভাবে বর্তায়। রাষ্ট্র তো আজ প্রায় ১০ বছরেও এর উত্তর দিতে পারেনি। কেন দিচ্ছে না, যারা মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক সরকার বলে নিজেদেরকে দাবি করছে এবং যারা বাংলাদেশের রাষ্ট ক্ষমতায় সেই ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। যে সরকার দাবি করে যে, তারা দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরকার কেন এখনো অভিজিৎ রায়ের হত্যার খোঁজ বের করতে পারেনি ? এই দেশ-তো ৩০ লক্ষ প্রানের বিনিময়ে পাওয়া দেশ। যে দেশের উৎপত্তি হয়েছিল বাক স্বাধীনতা আর জনগনের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়া জন্য।

তাহলে এটা কোন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ? যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের জান মালের দায়-দায়িত্ব নিতে পারে না ? যে রাষ্ট্র সমাজের প্রথম সারির বিজ্ঞান মন-মানসিকতার মুক্ত বুদ্ধিজীবিদের জীবনের একবিন্দু-ও নিরাপত্তা দিতে পারে না । বাংলাদেশের বিজ্ঞান আন্দোলনের একজন পুরোধা ছিল অভিজিৎ রায়। সে একটি আন্দোলনের নাম। সে একটি আইকন। সে বাংলাদেশের জ্ঞানের জগতে আধুনিক নতুন রেনেসাঁসের জনক, যেমন করে ইউরোপে সত্যিকারের রেনেসাঁর জন্ম হয়েছিল ১৬ শতকের প্রথমদিকে জর্জ কোপার্নিকাসের হাত ধরে। কোপার্নিকাস থেকে শুরু করে জিয়োর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলি ইউরোপে সত্যিকারের বিজ্ঞানের রেনেসাঁর, দর্শনের তথা বিজ্ঞান মন-মানসিকতার বিকাশ ঘটায়।

তিন )

অভিজিৎ রায়ের বাবা একুশে পদকপ্রাপ্ত ডক্টর অজয় রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। সেই অজয় রায় ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক সংগঠক ছিলেন যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। অজয় রায় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা বিভাগের অন্যতম সম্মানিত সদস্য ছিলেন।

ভাষা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে-ও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহন ছিল। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্য অন্যতম ছিলেন। সেই বাবা দেশের কথা মাথায় রেখে দেশের সব মানুষের জীবনের সর্ব তরে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে। সেই ১৯৭১ সালেই অভির জন্ম হয়েছিল। কিন্ত ছেলের জন্মের খবর পেয়েও বাবা মুক্তিযুদ্ধের কারণে তাকে দেখতে আসতে পারেননি। তিনি এমন হতভাগা বাবা যে নিজের জীবদ্দশায় ছেলের হত্যা দেখতে হয়েছিল।

সেই বাবা ডক্টর অজয় রায়ের ছাত্র ছিল আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের স্বামী ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়া। সেই সূত্রে অজয় রায় শেখ হাসিনাকে ‘তুমি; বলে সম্বোধন করতেন। অভিজিৎ রায় কে হত্যা করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অজয় রায়কে ফোন করে বলেছিলেন যে, তিনি এই হত্যাকান্ডের সর্বোচ্চ বিবেচনা নিয়ে ঘটনার উদ্ঘাটন এবং বিচার করবেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই জঘন্যতম হত্যাসহ মুক্তমনার অনন্ত বিজয় দাশ থেকে শুরু করে অন্যান্য সদস্যদের হত্যার সুষ্ঠ বিচারের ভার আরও ভারী হয়ে উঠল। কিন্তু আমরা কী দেখতে পেয়েছি, পাচ্ছি তা অনেকেই জানেন।

এর পরে এক এক করে দেশের মেধাবী সূর্যসন্তানদের ইসলামী জঙ্গী সন্ত্রাসীদের দ্বারা হত্যা করা হলো ঠিক যেমন ১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর রাতে ধরে ধরে দেশের অন্যতম প্রধান প্রধান বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করেছিল। সেই খেলা আজও চলছে। কিন্তু কেন ? এই রকম দেশের জন্য কি ৩০ লাখ বাঙলি নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিল? উত্তর হলো অবশ্যই না, একেবারেই দেয়নি।

বাংলাদেশের মানুষ সামগ্রিক অর্থে জীবনের মুক্তি চায়। মুক্তি চায় চিন্তার ও বাক স্বাধীনতার, ফিরে পেতে চায় ১৯৭১ সালের মূল চার নীতির। তারা মুক্তি চায় অপরাজনীতির আর অপসংস্কৃতির থেকে। সেই সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ধনী আর গরীবের বিভাজনের রাজনীতি থেকে মুক্তি। চায় প্রকৃত শিক্ষা।

এসবই ছিল অভিজিৎ রায়ের আজন্ম স্বপ্ন। সে স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে তাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে ঘাতকদের চাপাতির করাল গ্রাসে।

২০১৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে এবং আজকেরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডক্টর অজয় রায়-কে ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, এই হত্যার তিনি সুষ্ঠ বিচার করবেন। তা না হলে সময়ের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সবাইকে একদিন ক্ষমতার নামে হোক আর ক্ষমতার বাইরে থেকে হোক সবাইকে ক্ষমা চাইতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। একদিন মুক্তচিন্তার ও মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চা বাংলাদেশে নিরাপদভাবে নিশ্চয় করা যাবে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা সত্যিকার অর্থে আধুনিক হবে। সেটা হলে-ই অভিজিৎ রায়সহ তাঁর সাথীদের রক্তের দাম শোধ হবে।