বৃত্ত: যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, আমার বন্ধু প্রিজম প্রশ্ন করেছিল, আপনি কি পরকালে বিশ্বাস করেন? আমি তাকে বলেছিলাম, আমি পরকালে বিশ্বাস করি। আমার কথা শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো। কারণ সে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, একজন নাস্তিক পরকালে বিশ্বাস করতে পারে। সে আমাকে আবারও বলেছিল, আপনি কী ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? আমি তাকে বলেছিলাম যে, হ্যাঁ, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। তবে সে ঈশ্বর অসীম কোনো সত্তা নয়, সে তিন ফুট উচ্চতাসম্পন্ন একটি জীব, অনেকটা মানুষের বিলুপ্ত প্রজাতি হোমো ফ্লোরেনসিয়েসিস। এভাবেই কথা শুরু হয়েছিল আমাদের।
সে হাসবে নাকি কাঁদবে সে ঠিক বুঝতে পারছিল না। তার চেহারা দেখে আমার মনে হয়েছিল, আমি তার সাথে মজার কোনো কৌতুক করছি। যাই হোক। আমি তাকে বললাম, মনে করুন, আপনার মৃত্যু হলো, আপনি এখন পরকালে। কিন্তু আপনি পরকালে গিয়ে দেখলেন ঈশ্বর মোটেও জ্ঞানী নয়, সে দেখতে ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি আকারের একটি হবিটের মতোই ক্ষুদ্র, আনস্মার্ট ও আনইন্টিলিজেন্ট । এই নির্বোধ ঈশ্বর আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছে না, তাকে আপনার কথার মিনিং বোঝানোর জন্য বিভিন্ন ছবি এঁকে এঁকে দেখাতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে, তারা আপনার কথা বুঝতে পেরেছে বলে মাথা নাড়ায়, কিন্তু আসলে তারা আলোচনার ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেছে, তারা কনফিউজড। আপনি পরকালে চোখ খোলার পর দেখলেন, এ মানুষগুলো আপনার চারপাশে ছোটাছুটি করছে, তারা আপনাকে নিয়ে খুব উত্তেজিত। তারা আপনাকে কেবল একটাই প্রশ্ন করছে, তোমার কাছে কী এই প্রশ্নের উত্তর আছে? তোমার কাছে কী এই প্রশ্নের উত্তর আছে?
কিন্তু চিন্তা করবেন না, এই জীবগুলো খুবই ইনোসেন্ট ও ক্ষতিহীন। আপনি হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কী হচ্ছে এসব আমার সাথে? কিন্তু তারা আপনার এক্সপ্রেসনের দিকে ধাঁধার মতো তাকিয়ে থাকবে কারণ তারা আপনার কথা কিছুই বোঝেনি। একটি কুকুর যেমন আইনস্টাইনের সমীকরণ বোঝে না, তার পক্ষেও আপনার কথা বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। তারা কৌতুহলের সাথে প্রশ্ন করছে, তোমার কাছে কী এই প্রশ্নটির উত্তর আছে? বল, বল, আমাদের বুঝিয়ে বল। আপনি বিস্মিত হয়ে হয়তো প্রশ্ন করবেন, Where the heck I am ?
প্রিজম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবার সে সম্ভবত গল্পের মধ্যে ডুবে গেছে, সে আমার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তিন ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন এই প্রাণীরা কীভাবে আমার ঈশ্বর হয়, আর তারা কেনই বা তাদের সৃষ্টির কাছে প্রশ্ন করবে? কীভাবে একজন ঈশ্বর তার সৃষ্টির চেয়ে নির্বোধ হয়?
আমি বললাম, আপনি এখন কোথায় আছেন, আর কেন এখানে আছেন__ সেটা জানার জন্য আপনাকে কিছুক্ষণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুনতে হবে। আপনাকে এই ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন ঈশ্বরের সোসাইটি সম্পর্কে জানতে হবে। হবিটদের সামাজিক উন্নয়নের এক পর্যায়ে, তারা একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল, আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী? এটি ছিল খুবই কঠিন একটি প্রশ্ন। এ প্রশ্নটি তাদের কাছে এতটাই কঠিন ছিল যে, তারা এ প্রশ্নটিকে সরাসরি আক্রমণ করতে চায়নি। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য, তারা একটি সুপারকম্পিউটিং মেশিন তৈরি করবে। আর এটি ইঞ্জিনিয়ার করার জন্য তারা দশ প্রজন্ম পর্যন্ত পরিশ্রম করেছিল। সেই সুপারকম্পিউটার ছিলাম আমরা।
প্রিজম বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সে আমাকে বলল, সাংঘাতিক! তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আমরা এই তিন ফুট উচ্চতাসম্পন্ন ঈশ্বরের তৈরি একটি সুপারকম্পিউটার, যাদের ঈশ্বর তৈরি করেছে তার নিজের অস্তিত্বের রহস্য জানার জন্য? কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তারা আমার কথা বুঝতে পারছে না?
আমি মৃদু হেসে বললাম, অ্যাকসেক্টলি, এখানেই তো মূল সমস্যা। তারা এই মেশিনকে তাদের থেকেও স্মার্ট করতে চেয়েছিল। তারা এই মেশিনকে এত বেশি জটিল করে তুলেছিল যে, একটা সময় তারা মেশিনের ইন্টারনাল জটিলতা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা এখন নিজেরাই জানে না, এই মেশিন কোন পদ্ধতিতে কাজ করে। কিন্তু একদিন এই বিশ্বের মানুষগুলোর জীবনের সময় শেষ হয়। যখন তাদের জীবনের টাইম শেষ হয়, ঈশ্বর কম্পিউটার থেকে তাদের সফটওয়্যার বা চেতনা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে ল্যাবরেটরিতে আপলোড করে।
প্রিজম আমার দিকে সাপের চোখে তাকিয়ে আছে। সে আমাকে বলল, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে, আমি এ মুহূর্তে মরে গেছি, আমি আমার যে রূপ দেখছি, এটি একটি সফটওয়্যার, আমার ওপর এখন তারা এক্সপেরিমেন্ট করছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ, যখন ল্যাবে আপনার সফটওয়্যার আপলোড করা হয়েছিল, ওমনি আপনি জেগে উঠলেন। এখন কী আপনি বুঝতে পেরেছেন, কেন আপনার চারপাশে এত হাজার হাজার মানুষের ভীড়?
প্রিজম বলল, না, আমি এখনো বুঝতে পারিনি। তারা আমাকে পরকালে কেন এক্সপেরিমেন্ট করছে। কী চায় তারা?
আমি তাকে বললাম, তারা আসলে তাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে বিগ কোয়েশ্চান জানার একটি পদ্ধতি হিসেবে আপনাকে তৈরি করেছে। আমরা মহাকাশে রিচ করার জন্য যেমন স্পেসশিপ তৈরি করি, তারা তাদের অস্তিত্বের অন্তিম প্রশ্নে পৌঁছানোর জন্য আমাদের তৈরি করেছে। কিন্তু আমাদের সৃষ্টি করার পর, আমরা একটি নিজস্ব বিশ্ব তৈরি করেছি, আমরা সমাজ, প্রযুক্তি এবং মেশিন তৈরি করেছি, যেগুলো এতটাই জটিল ছিল যে, তারা কোনোকিছুই বুঝতে পারছে না। তারা আপনাকে তৈরি করেছিল, তাদের অস্তিত্বের অন্তিম প্রশ্ন জানার জন্য, আর আপনি একটি কমপ্লেক্স সিভিলাইজেশন তৈরি করলেন, প্লেন, রকেট, স্পেসশিপ এবং বিশাল বিশাল শহর গড়ে তুলেলন। আপনি সৌরজগত দখল করার জন্য রোভার প্রেরণ করলেন। একটা সময় আপনি গ্যালাক্সিতে কলোনি বিস্তার করলেন। আপনি টাইপ-৫ সিভিলাইজেশনে পরিণত হলেন, যারা মহাবিশ্বের মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে মুহূর্তেই কমিউনিকেশন করতে পারে, যারা প্রাইম ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে মহাবিশ্বের এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যোগাযোগ করে এবং ব্লাকহোল থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। কিন্তু আপনি এতদিন জানতেন না যে, আপনি একটি সুপারকম্পিউটার। আপনাকে তৈরি করেছে ৩ ফুট আকারের একটি নিরীহ সত্তা, যে আপনার ঈশ্বর। সে আপনার কাছে একটি প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু আপনি এতটাই জটিল একটি সত্তায় পরিণত হলেন, তারা আপনাকে দেখে কনফিউজড, আপনি কেন সৌরজগতের এক গ্রহ থেকে আর এক গ্রহে ছোটাছুটি করছেন, সেটা তারা সেন্স করতে পারছে না, তারা ভাবছে যে এভাবে ছোটাছুটি করে আপনি তাদের প্রশ্নের উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আপনি বিশাল বিশাল স্পেস স্ট্যাশন ও স্যাটেলাইট তৈরি করে, তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা কিছুতেই তাদের প্রশ্নের সাথে এই উত্তরগুলো রিলেট করতে পারছিল না।
প্রিজম আমার দিকে খুব গভীর চোখে তাকিয়ে আছে, সে বলল, লিহন, আমার প্রচণ্ড মাথা ঝিমঝিম করছে। তার মানে ঈশ্বর আমাদের সিভিলাইজেশনকে তার প্রশ্নের উত্তর ভেবে কনফিউজড? আমি মাস্টারবেট করছি, আর সেই বুদ্ধিহীন ৩ ফুট লম্বা জীব মনে করছে, এটা আমার কোনো কৌশল, যার মাধ্যমে আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি, তাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী? কারণ তারা এতটাই মূর্খ যে, তারা বুঝতেই পারছে না, কেন আমাদের এত এত পারমাণবিক বোমা ও স্পেসশিপ?
আমি প্রিজমকে বলেছিলাম, ইয়েস! একটা মাকড়সাকে রবীন্দ্রনাথের গান শোনালে যেমন সে এটাকে তার মতো করে ব্যাখ্যা করবে, তেমনি তিন ফুট লম্বা এই ঈশ্বর আমাদের এত জটিল করে তৈরি করেছে যে সে এখন নিজেই বুঝতে পারছে না, আমরা আসলে কী করছি? আমাদের সকল আচার আচরণ থেকে সে অর্থ বের করার চেষ্টা করছে কারণ তার তো উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের মাধ্যমে তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য জানা। যাই হোক, আপনি তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, আমরা নিজেরাই আবার মেশিন তৈরি করেছি, আমাদের অস্তিত্বের রহস্য সমাধান করার জন্য, আমরা তোমার অস্তিত্বের রহস্য সমাধান করছি না ঈশ্বর। কিন্তু তারা আপনার কোনো শব্দই বুঝতে পারছে না, ঠিক যেমনি একটি ভাইরাসকে কম্পিউটারের কোড বোঝানো সম্ভব না। তারা আমাদের মেশিনগুলো দেখেও কিছু রিয়ালাইজ করতে পারছে না। যেই সিভিলাইজেশন সুপার কম্পিউটার তৈরি করেছিল, তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য জানার জন্য, তারই তৈরি সুপারকম্পিউটার হয়ে আপনি অজস্র মেশিন তৈরি করলেন, আপনার নিজের অস্তিত্বের রহস্য জানার জন্য। একটি পারফেক্ট বৃত্ত।
দুর্দান্ত দু’টো ছোট গল্প মানুষের মগজে যে বিশ্বাসের ভাইরাস গেঁথে আছে হাজার হাজার বছরের কুসংস্কার দ্বারা সে-সবের মূলে আঘাত করতে পেরেছে গল্পগুলো।
গল্পাচ্ছ্বলে বলা হলেও আসলে এগুলো মানুষের মনোজগৎ পরিবর্তনে যেমন সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে তেমনি মানুষ প্রজাতির অস্তিত্ব বাঁচানো নিয়েও মানবজাতিকে ভাবতে হয় খুব।
পাশাপাশি গল্পে ভাববাদের বিপরীতে বস্তুবাদের বাস্তবতা নিখুঁতভাবে বর্ননা করা হয়েছে।অন্যদিকে তাঁর লেখা মানুষের উন্নত মনন গঠনে বিকাশ ঘটায়।চিন্তা -চেতনার মান উচ্চতর শিখরে আরোহন করতে শেখায়। যার প্রভাবে মানুষের ভাববাদী চেতনার মূলে ভীষণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
তাঁর লেখা সবসময় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভংগি ও বিজ্ঞানের দর্শনের দ্বারা পরিচালিত হয়।বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব প্রযুক্তির উৎকর্ষ মানুষের মনোবৈকল্যের বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে সে-সবও নিখুঁতভাবে ফুটে উঠে ।
লিহনের লেখায় সুপার কম্পিউটার, রবোর্ট, এ আই, ন্যানোটেকনোলজি, ইনফোটেকনলজি,বায়োটেকনোলজি এবং বিবর্তনবাদ ও বিবর্তনীয়মনোবিদ্যার সংযোগ থাকেই।
লিহনের লেখা মানেই পাঠক একেবারে নতুন নতুন বিজ্ঞানের অগ্রসর, অগ্রগতি ডেটা অ্যানালাইসিস সহ বহুবিধ জিনিস জানতে পারে।
আপনার কলমের লেখা চলতে থাকুক অনবরত। পাঠক হিসেবে আমরা তা গিলতে থাকি। সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।