আজ ৭ অগাস্ট। নিলয় নীলের অষ্টম হত্যাদিবস।
অগাস্টের ১ তারিখে ওঁর সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল। মসজিদ নিয়ে কিছু-একটা লিখে আমাকে জানিয়েছিল পড়ার জন্য। আমি তাকে দেশে থাকাকালীন অবস্থায় লেখালেখি করতে বারণ করেছিলাম। কারণ পরিস্থিতি তখন ছিল ভয়াবহ। প্রতিমাসে ১ জন করে ব্লগার খুন হচ্ছিল।
নিলয় যখন অনুসরণের শিকার হয় আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল। পুলিশ তাকে কোনোভাবেই সাহায্য করছে না, এমনকি থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত নিচ্ছে না সেই অভিযোগ করেছিল। ও ভেবেছিল, আমি যেহেতু বিসিএস ক্যাডার, প্রশাসনের কারো না কারো সাথে আমার সুসম্পর্ক থাকার কথা। আমি যেন আমার কানেকশন ব্যবহার করে ওকে কোনো না কোনো ভাবে হেল্প করি।
আমি চেষ্টাও করেছিলাম। একজন মন্ত্রীর একান্ত সচিব স্যারকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম : স্যার আমার এক বন্ধু, নাম নিলয় নীল, প্রচণ্ড বিপদে আছে। তাকে জঙ্গিরা অনুসরণ করছে। প্রতিটি মুহূর্তে নজরে রাখছে। পারলে আপনি ওর জন্য কিছু করুন।।
আর নিলয়কে ফোন করে বলেছিলাম, ভাই আমিও অনুসরণের শিকার হচ্ছি জায়গায় জায়গায়। আমার বাসা থেকে কর্মস্থল বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ অবধি আমার পেছনে পেছনে লোক আসে। থানায় ডায়েরি করেছি। পুলিশের আচরণ সন্দেহজনক লাগছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি কী ঘটতে যাচ্ছে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের বিপক্ষে। আমি নিজেও দেশছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
ওকে বলেছিলাম, ইয়োরোপের ভিসার জন্য ট্রাই করে সময়ক্ষেপণ করো না। অতো সময় আমরা পাবো না। অনন্ত বিজয় দাশ ইয়োরোপের জন্য সময়ক্ষেপণ করে যে ভুলটা করেছিল আমি সেই ভুল করব না। আমি খুব দ্রুত কোলকাতা চলে যাচ্ছি। পারলে তুমিও চলে যাও। আর লেখালেখি আপতত বন্ধ রাখো। মোবাইলের সিম, ব্যাটারি সব কিছু খুলে রাখো যেন ফোনসেট ট্রাক করতে না পারে… এই ছিল নিলয়ের সাথে আমার শেষ কথোপকথন।
তারপর, তারপর হাড় হিম করা খবরটি পেলাম! ঢাকার গোরানে ওর বাসার ভিতরে ঢুকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ওকে। ভীষণ অসহায় অবস্থায় অনুসরণের কথা লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস পর্যন্ত দিয়েছিল ও। বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে নি।
পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের বিপক্ষে কাজ করছিল তখন। সাহায্য তো দূরে থাক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন খোঁজ করছিল কারা কারা ধর্মীয় “উস্কানিমূলক লেখা” লিখে সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে, ধর্মান্ধ জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলছে, তাদের তালিকা। যে আল্লামা শফি বলেছিল—নাস্তিকদের কতল করা এখন ওয়াজিব—সেই শফির মাদ্রাসাকে দেয়া হয়েছিল তৎকালীন ৩২ কোটি টাকা দামের রেলওয়ের সরকারি জমি। আনাস মাদানিসহ হেফাজতের অনেক নেতা রাতারাতি কোটিপতি হলো। পরে সেই শফি মদিনাসনদপ্রেমী প্রধানমন্ত্রীকে ভূষিত করেছিল ‘কওমিজননী’ উপাধিতে।
নিলয়, ভাই আমার! তুমি নেই আজ আট বছর। ৯ বছর, ১০ বছর, ১২ বছর, ১৮ বছর… এভাবে দেখতে দেখতে একদিন ১০০ বছরও পেরিয়ে যাবে। যে কুৎসিত লোকগুলো তোমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল তাদের নামও একদিন মুছে যাবে। কিন্তু তুমি তখনও ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে। দিনকে দিন অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত বিজয়, নিলয় নীল… এই নামগুলোর উজ্জ্বলতা আরো বাড়বে। কারণ মুক্তচিন্তকদের সংখ্যা বছরান্তে বাড়তে থাকবে। এটা অবশ্যম্ভাবী। কোনো শক্তিই মানুষের উন্নতিমুখি বিবর্তনকে বাধা দিয়ে স্তব্ধ করতে পারবে না। ব্যাহত করতে পারবে, কিন্তু মূলোৎপাটন করতে পারবে না। কারণ মানুষকে হত্যা করা যায়, আদর্শকে হত্যা করা যায় না।
—আবদুল্লাহ আল তারেক
নির্বাসিত কবি, ব্লগার।
জ্ঞান অজ্ঞনতার শত্রু।নিলয়ের বেচে থাকার আকুতি ছিল কিন্তু তা ছিল ভুল মানুষদের কাছে।স্বয়ং রাস্ট্র যন্ত্রই যখন খুনি হিসাবে আবির্ভাব হয় তখন সাহায্য চাইবে কার কাছে।