মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়’কে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বইমেলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ১২ মে ২০১৫ সিলেটে নিজ বাসার সামনে বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা, ৩০ মার্চ ২০১৫ বেগুনবাড়ীতে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা, ৭ আগষ্ট ২০১৫ নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়কে তার বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা, নিজ বাসার সামনে আহমেদ রাজিবকে জবাই করে হত্যা, প্রকাশক ফয়সল আরেফিনকে তার কার্যালয়ে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা এসকল হত্যাকাণ্ড ভুলিনি। যত খুন হয়েছে এদের জন্য পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী যারা তাদেরকে আমরা ধিক্কার জানাই। বন্যা আহমেদকে খুনের অভিপ্রায়ে যে চাপাতির আঘাত করা হয়েছিল তা এখন মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। অন্য যাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল তারাও মানসিক ও শারীরিক ভাবে ভালো নেই। এদের খুন জখম যারা করেছে, দায়ী যারা তাদের বিচার করে দন্ড দিলেও অপরাধীরা পালাতে পারে।

গত বছর অভিজিৎ রায়’এর হত্যাকারীরা আদালতের মৃত্যুদন্ডকে কাঁচকলা দেখিয়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়ে গেল, পুলিশের কিছুই করার রইলো না। হত্যাকারীদেরকে পালিয়ে যেতে দিয়ে এবং এই ব্যাপারে উদাসীন থেকে সরকার কী বার্তা দিচ্ছে? মৌলবাদী খুনিরা অন্য খুনিদের সাথে বসে বসে নিরাপদ কোথাও ফন্দি আঁটবার সুযোগ পেয়ে কাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকলো? এই ঋণশোধ খুনিগণ করবে নিশ্চয়। এমন বন্ধুদের ক্ষমতায় রাখবে তো নিশ্চয়, তা সে যে ছদ্মবেশেই হোক না কেন।

চরমপন্থা বা মৌলবাদের আড়ালে চরমপন্থীরা এভাবে বারবার জিতে যাচ্ছে, এই বিজয় দেখে ধূর্ত রাজনীতিবিদগণ যে যার মত লভ্যাংশ বুঝে নিচ্ছে দ্রুততায়। ক্ষমতাবানেরা নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে এবং তা করছে নাগরিকের অধিকার বিক্রি করে দিয়ে। একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে মগজ ধোলাই করতে দিয়ে নাগরিকদেরকে যুক্তি ও বিজ্ঞানবিমুখ করেছে। ধর্মানুভূতির মত অব্যর্থ কৌশল ব্যবহার করেছে শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকতে এবং সাথী করে নিয়েছে হেফাজতে ইসলামের মত কট্টর ধর্মবাদীদের। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাতে জোর করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। বিজ্ঞান প্রযুক্তি সাহিত্য ইতিহাসকে তুচ্ছ করছে। ফ্যাসিবাদী ও মৌলবাদীদের এখন পথ দেখাচ্ছে সেইসব সুযোগসন্ধানী পাল্টিবাজ বিদ্বান ছদ্মবেশী রাজনীতিবিদেরা যারা সাধারণ মানুষকে পুঁজি করে ব্যবসা করে। তারা নিজেরা পুঁজিবাদের সবটা ভোগ করে, করে নব্য কোন সাম্যবাদের ওকালতি। এদের সবার তাল একই, নাগরিক যদি চায় এভাবে চলবে তাহলে অন্যদের গাত্রদাহ কেন? এই তালে যে সুর নেই, এই তালে যে বাঙালিত্ব নেই, নেই ছন্দ, নেই সততা সেটা সাধারণ নাগরিক বুঝবে কেন? মগজধোলাই করা নাগরিকের তো এ দায় নয়। জনগণ, নাগরিক যাদেরকে তার সেবার জন্য ঠিকাদারি দিয়েছে, চাকুরী দিয়েছে, সেই গোষ্ঠী, তারা সকলেই কি এভাবেই নাগরিকদের ঠকাতে থাকবে অবিরাম?

হাজার হাজার ওয়াজে অন্য ধর্মের নিকৃষ্টতা প্রতিদিনই দাবি করা হয়। তাতে কিন্তু সংখ্যালঘুরা ক্ষেপে গিয়ে বাড়িঘর পোড়ায় না, পুলিশও এই হুজুরদের গ্রেপ্তার করে না। বরং ফেসবুকের সামান্য কোনো উক্তির জন্য (বেশিরভাগই যেগুলো মিথ্যা) তরুণ কিশোর সংখ্যালঘুকে স্বতঃপ্রোণোদিত হয়ে গ্রেপ্তার করে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে নাকি বাংলাদেশ, কিন্তু ১৯৭১ এর রাষ্ট্রীয় চেতনাকে পুরোপুরি সে বিসর্জন দিয়েছে। রাষ্ট্রের এই দ্বিচারিতা নিয়ে বেশিরভাগ নাগরিক মোটেও চিন্তিত না, কারণ তারা নিজেদেরকে সুবিধাবাদী হিসেবে রুপান্তরিত করেছে। যুক্তি ও প্রমাণ দেখিয়ে এদের থামাতে চাইলে সুস্থ মনের মানুষেরা খুন হয়ে যায়। ভোট-উন্মাদ ক্ষমতাধারীরা এদেরকে নিরাপত্তা দেয়, অনুভূতিকে পুঁজি করতে দেয়, কেন? শুধুই লভ্যাংশের জন্য? শুধুই গদিকে পাকাপোক্ত করবার জন্য? শাসক ও শোষকেরা এই ঘৃণালব্ধ লভ্যাংশের ভাগ নিয়ে উৎসব করাবে আর কতকাল? আর কতদিন শান্তিপ্রিয় নাগরিক ভয় ও বিভ্রান্তিতে মেনে নেবে এইসব?

জন্মভূমির এই ক্রান্তিকালে আমাদের বুদ্ধিজীবি মহলের – সমাজের তথাকথিত শিক্ষিতদের কি কিছুই বলার নেই? সাহসী, যুক্তিবাদী, মুক্ত, স্বাধীন নাগরিকেরা কোথায়? সবাই কি গত হয়েছেন?

অভিজিৎ রায়ের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে বইমেলা অভিজিৎ রায়কে আর স্মরণ করে না। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ এমন কি মুখেরও দুটি সস্তা শোকবাণীও এই মাসে খরচ করতে নারাজ তারা। তারা নিজেদের বাঁচিয়ে যা রচনা করে তা কি সুন্দর, সত্য অথবা কালোত্তীর্ণ হবে? এক’শ বছর পরে তাদের লেখা কি পড়া হবে? বাংলাদেশে যুক্তিবাদ ও বিচারবুদ্ধির চর্চাকে প্রতিষ্ঠা করতে নিজের প্রাণ বলি দিয়ে অভিজিৎ রায় যে আত্মত্যাগ করেছে একদিন তা বিশ্বস্বীকৃত হবে, জিয়োর্দানো ব্রুনোর মতই অভিজিতের মৃত্যু লোকমানসে ঠাঁই করে নেবে। অভিজিতের এই মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের আশা হবে নিকট ভবিষ্যতে আমরা বাংলাদেশে একটি যুক্তিবাদী, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন উদার সমাজের উত্থান দেখব।