লিখেছেনঃ জিসান

Google play store এ God Simulator লিখে সার্চ দিলে একটি বেশ ভিডিও গেমের সন্ধান পাওয়া যায়। বিষয়টা সহজ, 2D গ্রাফিক্সে তৈরি একটা ‘পৃথিবী’ দেয়া হয়, সেখানে একজন খেলোয়াড় গাছপালা , বৃষ্টি , পশুপাখি মানুষ ইত্যাদি ডাউনলোড করতে পারে । প্রানিদের প্রোগ্রাম করা আছে। যেমন মানুষেরা গাছ কেটে ঘর বানায়, পশু পালন করে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা গ্রাম দাঁড় করিয়ে ফেলে। খেলোয়াড় চাইলে তারপরে গ্রামবাসীদের জন্য নিয়ম-নীতি রচনা করতে পারে,  গ্রামগুলোর মধ্যে যুদ্ধ লাগাতে পারে,  প্রাকৃতিক দূর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে,  বজ্রপাত বা নিউক্লিয়ার বোমা ফেলে সব ধ্বংস করেও ফেলতে পারে। গেমটা নিয়ে কিছুক্ষন ঘাটাঘাটি করেই আমার মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসে। What about us?  আমরা কেমন করে জানবো যে আমরাও এমন কোন গেমের চরিত্র নই? অনেকের মতে ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার অর্থাৎ যথেষ্ট শক্তিশালী কম্পিউটারের মাধ্যমে পুরো পুরো মহাবিশ্বের সিম্যুলেশন তৈরী করা যাবে। তাহলে আমরা নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছি যে ইতোমধ্যেই আমাদের সাথে তা ঘটছে না?

এটা ঠিক , মহাবিশ্ব এতটাই জটিল যে তাকে কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা অনেক উন্নত সভ্যতার পক্ষেও অসম্ভবের কাছাকাছি , অন্তত আমাদের কাছে তো তাই মনে হয়। কিন্তু আসলে কিন্তু পুরো মহাবিশ্বকে প্রোগ্রাম করার দরকারও নেই। শুধু আমাদের, অর্থাৎ সিম্যুলেশনের চরিত্রদের বোকা বানানোর জন্য যথেষ্ট প্রোগ্রাম  হলেই চলবে। অবশ্যই, মহাবিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে, কিন্তু কম্পিউটার প্রোগ্রামে গ্যালাক্সিগুলো সত্যি সত্যিই থাকার প্রয়োজন নেই। প্রোগ্রামার যদি ঠিক করে, গ্যালাক্সিগুলো শুধু তখনই অস্তিত্ত্ব পাবে যখন আমরা সেদিকে টেলিস্কোপ তাক করবো, কিংবা আমাদের শরীরের ভেতরে আসলে কিছু নেই, প্রোগ্রাম অনুযায়ী শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তখনই অস্তিত্ব পায় যখন আমরা সেগুলো দেখার চেষ্টা করি। তবে আমরা অর্থাৎ চরিত্রগুলো কিন্তু কোনভাবেই জানতে পারবে না যে তাদেরকে দেখা হচ্ছে। তাহলে খুব সহজেই অনেক মেমরি ও প্রসেসিং পাওয়ার বেঁচে যাবে ।

যেই গেমের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই গেমের চরিত্রগুলো কি জ্ঞাত যে তারা আসলে বাস্তব না, তারা নিতান্তই এক ধরণের প্রোগ্রাম? সুনির্দিষ্ট ভাবে এই গেমের ক্ষেত্রে উত্তরটি সহজ, যাকে বলে obvious । চরিত্রগুলি বা তাদের পক্ষে কিছুই জানা সম্ভব না, তাদের আমিত্ব অর্থাৎ ঠিক করে বললে consciousness নেই । তারা অন্যান্য জড় পদার্থের মতই । Consciousness আমাদের কি আছে? আছে বলেই তো মনে হয় । আমরা কত কিছু জানতে পারি, ভাবতে পারি, conscious না হলে কীভাবে সেই সব পারতাম ? কিন্তু শুনে থাকবেন নিশ্চয়ই  A.I প্রযুক্তির মাধ্যমে কম্পিউটারকেও বুদ্ধিমান করা সম্ভব (অন্তত ভবিষ্যতে সম্ভব হবে) । A.I এর যথেষ্ট উন্নতি হয়ে গেলে আমরা না দেখে একজন মানুষের সাথে এবং একটা কম্পিউটারের সাথে কথা বলে তাদের আলাদা আলাদা করে শনাক্ত করতে পারব না (আগ্রহীরা ‘টুরিং টেস্ট’ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখতে পারেন) । তখন কি আমরা তাদের conscious বলতে পারব? Consciousnessএর সংজ্ঞা কী? Oxford Dictionary ‘র মতে consciousness হলো ,

“the state of being aware of and responsive to one’s surroundings”

অর্থাৎ , “কারোর পারিপার্শ্বিকের সাথে প্রতিক্রিয়াশীল ও পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে জ্ঞাত থাকার অবস্থা”

এই সংজ্ঞাটি খানিকটা ভেবে দেখলেই আমরা টের পাবো তখন ওই টুরিং টেস্টে পাস করা কম্পিউটারটিকে নির্দ্বিধায় conscious বলা যাবে ( অবশ্য অক্সফোর্ড ডিকশনারীর সংজ্ঞায় One’s ব্যাবহার করা হয়েছে , স্বভাবতই thing’s নয় ) । কাজেই কম্পিউটার সিমুলেশন এর চরিত্রের পক্ষেও conscious হওয়া সম্ভব। এবারে আমরা নিজেদের ওইরকম কোন Advanced গেমের চরিত্র থেকে আলাদা করি কীভাবে? আমরা কীভাবে জানবো যে আমরাও কোন ডেভেলপার এর প্রোগ্রাম করা গেমের চরিত্র নই ?

কী ভাবছেন ? আমরা জীবিত? । হুম, তা বটে । ঠিকই ভাবছেন । এবার তাহলে আমাদের জীবিত ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখতে হয়। জীবিত বলতে আমরা কী বুঝি? জীব বিজ্ঞান জীবের বেশ নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারে, তবে আমাকে ‘কিন্তু’ বলা থেকে আটকাতে পারে না। আজ বিজ্ঞানীরা জানেন জীবদেহের অভ্যন্তরের কোন কর্মকাণ্ডই প্রকৃতির কোন সুত্র লঙ্ঘন করতে পারে না । সমস্ত ক্রিয়াকলাপই আমাদের পরিচিত (বা অপরিচিত ) পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের সুত্র বা নিয়ম মেনে চলে। যে কোনো জৈবিক ঘটনাকে পর্যাপ্ত (অথচ সসীম) সংখ্যক বার “কেন”  প্রশ্ন করলে শেষমেষ আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানে গিয়ে পড়তে হবে । এখানে ধরে নিয়েছি যে জবাব দেবার জন্য আমাদের কোন সবজান্তা আছেন।  এখন পদার্থ বিজ্ঞানে পৌঁছেই আমাদের এই শক্তিশালী “কেন” প্রশ্নটি নিজের যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলতে শুরু করবে। আমরা প্রশ্ন করতে পারব না  “কেন মহাকর্ষীয় ধ্রুবক G এর একটি নির্দিষ্ট মানই আছে” । কিংবা “আমাদের স্পেস কেন ত্রিমাত্রিকই হল , দ্বিমাত্রিক বা চতুর্মাত্রিক নয়।” ( তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান এইসব যদিও এইসব কেন’র উত্তর দিচ্ছে কিন্তু দিতে গিয়ে অন্য কোন অনির্ণেয় কেন প্রশ্নের সৃষ্টি করছে ) । এমন কি হতে পারে এই সব শেষ কেন’র নীরব উত্তরহীনতা আমাদের গেম ডেভলপার এর মর্জি? আফটার অল, প্রোগ্রামারদের প্রোগ্রাম রচনায় স্বাধীনতা থাকতে পারে!

ব্রিটিশ গনিতবিদ জন কনওয়ে ১৯৭০ সালে তার ছাত্রদের নিয়ে একটা মজার ‘জিরো প্লেয়ার’ গেম তৈরী করেছেন৷ অর্থাৎ একবার শুরু করা হলে প্রোগ্রামটিতে কোন ইনপুট প্রয়োজন হয় না। গেমটি ‘Conway’s game of life’ নামে পরিচিত৷ কম্পিউটারে অসীম ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট  একটা সমতল থাকে,  ওতে দাবার কোটের মতো অসীম সংখ্যক ঘর বা সেল দেয়া থাকে।  সেলগুলো ‘জীবিত’  বা ‘মৃত’ অবস্থায়  থাকতে পারে , দাবার কোটের সাদা আর কালোর মতো।  ঘর গুলোর জীবিত বা মৃত থাকা সম্পর্কে সরল কিছু নিয়ম প্রোগ্রাম করে দেয়া হয়৷

 নিয়মগুলো সহজ, বুঝতে না পারলে বোঝার দরকার নেই , এড়িয়ে যেতে পারেন :

1. কোন সেলের পার্শ্ববর্তী কমপক্ষে দুটি জীবিত সেল না থাকলে সেই সেলটি মারা যায়৷

2.  পাশে দুটি বা তিনটি সেল থাকলে তা বেঁচে থাকে,  এবং আরেকটি সেল জীবিত করে৷

3. মৃত সেলের সাথে  তিনটি জীবিত সেল থাকলে মৃত সেলটি জীবিত হয়৷

4.  পাশে তিনটির বেশী জীবিত সেল থাকলে সেলটি মারা যায়৷

এই মাত্র চারটি নিয়ম,  আর কোন প্রারম্ভিক নকশা থেকে কয়েক প্রজন্মে খেলাটিতে আশ্চর্য রকমের জটিল নকশা কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ অর্থাৎ ইনপুট ছাড়াই সৃষ্টি হতে পারে৷ তার মধ্যে কিছু নকশা নিজের প্রতিরুপ সৃষ্টি  অর্থাৎ  প্রজনন পর্যন্ত করতে পারে, ঠিক যেন দ্বীমাত্রিক জীব৷

ছবি : গেম অফ লাইফের একটি দৃশ্য ( উইকিপিডিয়া)

পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে আমাদের এই মহাবিশ্বও এমনই সরল  কিছু নিয়ম এর দ্বারা চালিত হয়,  যাদের আমরা সুত্র বলি৷ এবং কত ধরনের জটিল সত্ত্বা সৃষ্টি হয় তার উদাহরন পাঠক নিজেই৷আমাদের ত্রিমাত্রিক জগৎ এর সাথে গেম অফ লাইফের  আশ্চর্য মিল রয়েছে বুঝতে পারছেন?

কম্পিউটার সিম্যুলেশনের সাথে ‘বাস্তব’ এর আরো একটি মিল উল্ল্যেখযোগ্য৷ সিম্যুলেশনের  প্রোগ্রাম যত জটিলই হোক না কেন,  তাকে স্ক্রীনে দেখাতে একধরনের ক্ষুদ্রতম একক, ‘পিক্সেল’ এর সাহায্য নিতে হয়৷একটি পিক্সেলের চেয়ে ছোট কিছু দেখানো কম্পিউটারের পক্ষে সম্ভব নয়৷ পাঠকদের অনেকেই জানেন না যে এমন ‘পিক্সেল’ আমাদের মহাবিশ্বেরও রয়েছে৷ যাদের বিজ্ঞানীরা বলেন প্লাঙ্ক ইউনিট৷ প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য হলো মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম সম্ভাব্য দৈর্ঘ্য আর প্ল্যাঙ্ক সময় সম্ভাব্য ক্ষুদ্রতম সময়৷এদের চেয়ে ছোট দৈর্ঘ্য ও সময়ের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই৷ এক প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘের চেয়ে ছোট কোনো কণা  বা ‘ স্থান’ এর অস্ত্বিত্ব নেই। ঠিক যেমন একটা পিক্সেলের চেয়ে ছোট কোনো রঙের বিন্দু স্ক্রিনে দেখানো যায় না । আবার প্লাঙ্ক সময় কে সিমুলেশন এর ‘ফ্রেম’  এর সাথে তুলনা করতে পারেন ! (ডিজিটাল কম্পিউটারে যেকোনো ভিডিও বা চলমান গ্রাফিক্স ন্যূনতম ২৬ টি ফ্রেম পরপর দেখিয়ে তৈরি করা হয় ) । স্পেস এবং টাইম নিজেই যেন অনেক ছোট্ট ছোট্ট টুকরো দিয়ে গঠিত৷ তবে প্ল্যাঙ্ক এককের মান এত কম যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তো দুরের কথা, অনু পরমানুর কার্যকলাপে পর্যন্ত তাদের কোনো প্রভাব দেখা যায় না৷ অন্য কথায় বললে মহাবিশ্বের রেজুলেশন অনেক বেশি এবং ফ্রেমরেটও, কম্পিউটারের যাকে fps দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এমন নয় তো , যে আমাদের host computer এর সসীম মেমরি এবং প্রসেসিং পাওয়ারই এই সীমাবদ্ধতার কারণ ?

নরওয়ের লেখক ইয়াস্তিন গার্ডারের খুবই উল্লেখ্যোগ্য একটি উপন্যাস ‘ Sophie’s World’ , বাংলা অনুবাদ ‘সোফির জগৎ’  হিসেবে বিখ্যাত ( যারা বইটি পড়বেন বলে ভেবে রেখেছেন তারা এই অনুচ্ছেদটি বাদ দিয়ে যেতে পারেন,  মজা নষ্ট হতে পারে) ৷ উপন্যাস হলেও এটি উপন্যাসের বেশি কিছু!  উপন্যাসটি একজন টিনএজ রহস্যময় মানুষ সোফিকে দর্শনের কোর্স করানো শুরু করে।  প্রি-সক্রেটিক থেকে ফ্রেঞ্চ এনলাইটমেন্ট, রেনেসা এবং আধুনিক দর্শন এমন ভাবে শেখায় যে পাঠক ভুলেই যাবেন তিনি একটা উপন্যাস পড়ছেন৷ মাঝে মাঝে তারা বেশ রহস্যময় ঘটনার সম্মুখিন হয়৷ কিন্তু উপন্যাসের মাঝামাঝি তারা বুঝতে পারে তারা নিজেরাই ‘ সোফির জগৎ ‘ নামেরই একটা উপন্যাসের চরিত্র, যেটা এক ভদ্রলোক লিখেছেন তার মেয়ে হিল্ডেকে জন্মদিনের উপহার দেবার জন্য৷ মজার বিষয় তারা সেই  ‘বাস্তব’  মেয়েটির সাহায্য নিয়েই উপন্যাসের জগৎ থেকে মুক্তি পেয়ে ‘স্বাধীন অস্তিত্ব লাভ করে৷ লক্ষনীয়,  সোফি প্রথমে নিজেকে বাস্তব ভাবলেও পরবর্তীতে জানতে পাড়ে যে সে বাস্তব নয়৷ কিন্তু  হিল্ডে জানে সোফি হচ্ছে সেই উপন্যাসের চরিত্র মাত্র, এবং, সে নিজে বাস্তব ৷ কিন্তু আমরা তো জানি, হিল্ডেও একই নামের একটা উপন্যাসের চরিত্র,  এবং আমরা বাস্তব৷ বুদ্ধিমান পাঠকেরা,  এই সিকোয়েলের পরের বাক্য অনুমান করতে পারছেন কি? উপন্যাসটি আজগুবী মনে হলেও পাঠককে চিন্তায় এবং অস্তিত্ব সম্বন্ধে ভালোভাবেই প্রশ্নে ফেলে দিতে সমর্থ হয়৷

এমনই সব প্রশ্নে ডুবে ছিলেন আধুনিক দর্শনের জনক খ্যাত রেনে দেকার্তে । দেকার্তের পক্ষে অবশ্য কম্পিউটার গেম নিয়ে চিন্তা করার মত সুযোগ ছিল না । দেকার্তের সন্দেহ ছিল তার পুরো জীবন কোন স্বপ্ন ছিল কি না । হ্যা, স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে আমরা বুঝতেই পারি যে এতক্ষন আমি স্বপ্ন দেখছিলাম , কিন্তু জন্ম থেকে পুরো জীবনটাই যদি কোন স্বপ্ন হয় তাহলে আমরা জানবো কীভাবে? দেকার্তে এর কোন উত্তর পেতেন না , তিনি ছিলেন সবকিছু সম্পর্কেই সংশয়বাদী বা ‘skeptic’ । তাঁর নিজের দেখা বা শোনা কিছুই তিনি ঠিক করে মেনে নিতে পারতেন না। ( ইন্দ্রিয় যে আমাদের কতভাবে বোকা বানাতে পারে আনেকের’ই সেই সম্বন্ধে মোটামুটি ধারনা আছে ) তার নামানুসারে এধরনের সংশয়বাদকে Cartesian Skepticism বলা হয় । দেকার্তে প্রায় শেষ জীবনে দিব্য দর্শনের মত এর একটা সহজ উত্তর পেয়ে গেলেন । তার মনে হলো স্বপ্ন দেখতে হলে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা থাকতে হয় , কল্পনা করতে গেলেও কল্পনাকারী থাকা চাই । Thinking requires thinker. যদি সব কিছু তার স্বপ্নও হয় , তাহলেও তিনি ধরে নিতে পারেন যে তিনি আসলেই আছেন, না হলে স্বপ্নটা দেখছে কে? বাকীসব মিথ্যে হলেও অন্তত পক্ষে তার মন, বা যাকে তিনি বলতেন ‘আত্মা’ আছে । তার এই উক্তিটি বেশ বিখ্যাত , “I think, therefore I am.” আজ এদ্দিন পরে কি তার সেই যুক্তি মেনে নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহে থাকতে পারি? AI ব্যাপারটার কথা আবার ভেবে দেখুন , এবারেতো অস্তিত্ব ধারনাটাই প্রশ্নের মুখে পড়বে।  সিমুলেশনের AI ও তো নিজেদের সম্পর্কে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারে । অর্থাৎ যদি বলি আমাদের অস্তিত্ব ঠিকই আছে কিন্তু Cosmic কোন কম্পিউটারের মেমরির মধ্যেই? বলাই বাহুল্য, দেকার্তে AI এর কথা জানলে আরও বেশি চিন্তায় পড়ে যেতেন৷

এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর পাবার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা কী জানেন? আসলে সর্ষের মধ্যেই ভুত। অর্থাৎ সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আমাদের মস্তিস্ক নিজেই। সত্যি বলতে আমাদের মস্তিস্ক মহাবিশ্বের মহা-রহস্য নিয়ে ভাবার জন্য মোটেই বিবর্তিত হয় নি । Natural selection অনুযায়ী মূলতঃ আমাদের মস্তিষ্ক বিবর্তিত হয়েছে আমাদের সিংহের হাত থেকে বাঁচা কিংবা হিংস্র পশুর উচ্ছিষ্ট খাবার উপযোগী হবার জন্য। সহজ কথায় টিকে থাকার (survival) এর জন্য। ( আগ্রহীরা Yuval Noah Harari’র “Sapiens” বইটা সম্পর্কে ঘাটতে পারেন, আরও বেশি আগ্রহীরা পড়ে দেখতেও পারেন । ) এটা তো জানা কথা, শিকারি যাযাবরদের যে ভাবুক ছেলেটা আকাশের রহস্য নিয়ে মজে থাকবে, হিংস্র প্রকৃতি তাকে কোন প্রকার ছাড় দেবে না ।বাঁচতে হলে তাকে শিকার আর শিকারি নিয়েই ভাবতে হবে। তাই আমাদের মস্তিষ্ক বিবর্তিতই হয়েছে এ রহস্য সমাধানে অনুপযোগী হিসেবে । একটা উদাহরন দেয়া যায় । আমরা যত চেষ্টাই করি , যত ভাল শিক্ষককেই নিয়োগ করি, যত ভাল ও উন্নত, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশযুক্ত , শিক্ষার্থী-বান্ধব , রাঙ্কিং-প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি করি, আমরা একটা কুকুরকে নিউটনের সূত্র শেখাতে পারব না। তার মস্তিষ্কেরই একটা physical বা ভৌত লিমিট আছে । সে চার বা পাঁচ পর্যন্ত গুনতে পারে , এর বাইরের সকল গনিতই তার কাছে অর্থহীন বা Non-sense। কী ভাবছেন? আমরা বুদ্ধিমান? হ্যাঁ, কুকুরের তুলনায় তো বটেই, কিন্তু গোটা মহাবিশ্বকে জানতে যে পরিমান বুদ্ধিমত্তা দরকার তার তুলনায়? মন দিয়ে ভেবে দেখলে এই শিকারি পালানো মস্তিষ্ক দিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি সে পরিমানটাই বিস্ময়কর। সবটা আমরা জানতে বা বুঝতে পারি না। এ সময়ের অত্যন্ত বিখ্যাত astrophysicist  এবং সাইন্স কমিউনিকেটর , Neil  Degrasse Tyson তার বই  ‘Astrophysics for People in a Hurry’ বইটির শুরুতে বলেছেন, “The Universe is under no obligation to make sense to you.” অর্থাৎ, “তোমার কাছে বোধগম্য হবার জন্য মহাবিশ্ব বাধ্য নয়!” সক্রেটিসও ঠিকই বলেছিলেন , তিনি জানতেন যে তিনি কিছুই জানেন না, এ জ্ঞানটাই সবচেয়ে বড় আর সত্যি জ্ঞান।

মুল প্রশ্নে ফিরতে আরও একটা উদাহরন দিতে চাই। প্লেটোর বিখ্যাত গুহার উদাহরন । ধরা যাক কোন এক মুখ খোলা একটা গুহায়, গুহার মুখকে পেছনে রেখে তিনজন মানুষকে জন্ম থেকে বেঁধে রাখা হয়েছে । তারা পেছন দিকে অর্থাৎ বাইরের দিকে তাকাতে পারেনা। তারা শুধু গুহার দেয়ালে পড়া গুহার বাইরের জগতের ছায়া দেখতে পায়। যেহেতু জন্ম থেকেই তারা শুধু ছায়াই দেখতে পায় তাই তাদের কাছে মনে হবে এটাই বাস্তব জগৎ, ছায়া ছাড়া আর কিছু তারা কল্পনা করতে পারবে না । হঠাৎ একজন কোনভাবে ছাড়া পেয়ে বাইরে পৌছাতে পারে । বাইরের জগৎ দেখে তার অনুভুতি কেমন হবে কল্পনা করতে পারেন ? এই প্রথম বার তার বন্দি চোখ ছায়া ছাড়াও অন্য কিছু দেখতে পাবে। পৃথিবীর রঙ , গন্ধ, গভীরতা, দুরত্ব, আলোর উৎস এসব সম্পূর্ণ অপরিচিত ধারনা তার মধ্যে অসীম বিস্ময় জাগাবে। এবার ধরুন সে তার গুহায় ফিরে গেল। সে চায় বাকী দুজন কে তার এই নতুন অভিজ্ঞতার কথা জানাতে। কিন্তু পারবে কী ? তাদের দুজনকে বোঝানো সম্ভব? না, যে কোনদিন রঙ দেখে নি তাকে রঙ এর কথা বর্ণনা করবেন কেমন করে ? এবার প্লেটো একটা বড় প্রশ্ন করলেন, আমরাও এমন কোন গুহায় নেই নিশ্চিত হই কী করে?

আসলেই , মাত্র পাঁচটা তো ত্রুটিযুক্ত ইন্দ্রিয় আমাদের, আরও কোন না থাকা ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি না তো? ( উল্লেখ্য, আমাদের চোখ আলোরই বর্ণালির খুব সামান্য অংশ দেখতে পায়, কিছু বছর আগে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নামের মহাবিশ্বের একটা নতুন জানালা নির্নয় করা গেছে। এ তরঙ্গ আলো নয়, শব্দ নয় , গন্ধ বা স্বাদও নয় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মাধ্যম, যা গ্রহণ করার জন্যে আমাদের কোন ইন্দ্রিয় নেই। এমন হয়তো আরও কত কিছু থেকে আমরা বঞ্চিত হই? ) এই রকমের আদিম অর্থাৎ primitive মস্তিষ্ক আর ইন্দ্রিয় নিয়ে আমরা কি এই মহাবিশ্বের বাস্তবতা সম্বন্ধে কোন বিশ্বাসযোগ্য সিদ্ধান্তে আসতে পারি? এ যেন অন্ধের হাতিদর্শন !

এতক্ষন যে ভীতিকর কিংবা রোমাঞ্চকর সম্ভাবনার কথা বলছিলাম তা নিয়ে ভয় পাবার কারন নেই । এগুলো শুধু সম্ভাবনাই । যুক্তিবিদ্যায় Burden of Proof বা “প্রমানের দায়” নামে একটা ব্যাপার আছে । যে দাবি করে তাকেই প্রমান করতে হয় । একপক্ষের প্রমানহীনতা আরেক পক্ষের প্রমান হতে পারে না । ( উদাহরনঃ

   – আমি তোমার কাছে এক লাখ টাকা পাই।

   – কই ? কী প্রমান আছে?

   – উহঃ , তোমার কাছে কী প্রমান আছে যে আমি তোমার কাছে একলাখ টাকা পাই না?

   – অ্যাঁহ ……!! )

 তেমনই “সবই কল্পনা” এই ধারনা Disprove বা অপ্রমান করা যায় না বলেই তা সত্য হয়ে যায় না৷ এর ওপরে আবার যেকোনো বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার Falsifiability নামে একটা বিশেষ গুন থাকতে হয়।  যদি কোন অপ্রমাণিত স্টেটমেন্ট এমন হয় যে কোনোভাবেই তা মিথ্যা প্রমাণিত হবে না, তবে তা বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস হিসেবেই মর্যাদা পাবে না, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। আমাদের জানা মতে simulation সম্ভাবনার falsifiability নেই!

 কিন্তু আমাদের প্রিয় বিজ্ঞানী Carl Sagan বলেছেন , “Absence of Evidence does not mean Evidence of Absence”

এর অর্থ simulation সমস্যার কোন প্রমান নেই বলে তাকে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না । (কার্ল সেগান কথাটা বলেছিলেন ভিনগ্রহী জীবের সম্ভাবনার প্রসঙ্গে। স্বীকার করতে হবে, আমাদের প্রসঙ্গের তুলনায় সে প্রসঙ্গেই উক্তিটা অনেক বেশি যৌক্তিক)

 কিন্তু আমি বলছিলাম ‘what if’ এর কথা। একটা সম্ভাবনা তো আছে যে আমাদের কোনো বাস্তবই আসলে বাস্তব না? আসলেই কি আমরা সত্য আর মিথ্যা পৃথক করতে এতটাই অক্ষম? আমরা যা জানি সবই অলীক? সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে সূর্য থেকে সৃষ্ট এই ছোট্ট পৃথিবী, তাতে জীবনের সৃষ্টি, জলজ প্রানীদের হঠাৎ কোন এক খেয়ালে একটা একটা করে স্থলে উঠে এসে বিবর্তিত হওয়া, ডাইনোসরদের গর্জন থেকে শুরু করে মহা প্রলয়ের মাধ্যমে তাদের মহা বিদায় , সেপিয়েন্সদের আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে  বিশ্বজয় এমনকি চন্দ্রজয়, গ্যালিলিওর বিচারে নামে প্রহসন থেকে শুরু করে এডউইন হাবলের আবষ্কার যে আমাদের গ্যালাক্সিও একমাত্র নয়, এরিস্টটলের মেটাফিজিক্স থেকে শুরু করে আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ? সবই মিথ্যে? হতে পারে, কিন্তু একটা বিষয় বাদে৷ গনিত,   বা আরও Generalize করে বললে যুক্তি বা reason. ব্যাখ্যা করছি,  দুই আর দুই যোগ করলে চার হয়৷ এখন যদি আমাদের মহাবিশ্ব বাস্তব হয় তাহলেও যেমন দুই আর দুই যোগ করলে চার হয়, অলীক বা Computer simulation হলেও তাই’ই হবে৷ কিংবা সমতলের ওপর একটা ত্রিভুজ আঁকা হলে তার তিন কোনের সমষ্টি অবশ্যই 180 ডিগ্রি হবে৷ কল্পনায়ও হবে, উপন্যাসও হবে! যদি আমাদের সেই 2D গেমটির চরিত্র গুলো দিয়েও সমতলের ওপরে একটা ত্রিভুজ আঁকিয়ে তিন কোনের সমষ্টি পরিমাপ করানো হয়, তারাও 180 ডিগ্রিই পাবে৷ গনিতের যেকনো নিয়মের জন্যই এটা সত্য৷ মহাবিশ্ব বাস্তব হোক বা কল্পনা , গনিত অবশ্যই সত্য (এখানে গডেলস ইনকমপ্লিটনেস থিওরাম বিবেচনায় আনিনি।) আমরা যে আগে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কথা বলছিলাম, আমাদের অতি পরিচিত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইন্সটাইনের তত্ত্ব থেকে গানিতিক ভাবে অনেক আগেই তার সম্পর্কে ধারনা পাওয়া গেছে । আইন্সটাইন বিখ্যাত হবার পরে মিডিয়া থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল গবেষণা করতে তার কী কী প্রয়োজন হয় ( মিডিয়ার প্রশ্ন আর কতটাই বা বুদ্ধিদীপ্ত হবে আশা করেন?)। তিনি জবাব দিয়েছিলেন একটা কাগজ, একটা কলম আর আমার ভুলগুলোর জন্য বড়সড় একটা ডাস্টবিন!

এসম্পর্কে আরো একটা উদাহরন দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। প্রথম দিকে ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কারের পরে  জোতির্বিজ্ঞানীরা বেশ ঝামেলায় পড়লেন৷ ঝামেলার কারন,  আকাশে ইউরেনাস গ্রহের আবর্তন ঠিক নিউটনের সূত্র মোতাবেক হয় না, কেমন যেন বিচ্যুত হয়ে যায়৷এ সমস্যা সমাধানের জন্য তারা সঠিক ভাবেই ধরে নিলেন ( লক্ষণীয়: reason এর ক্ষমতা) ইউরোনাসের বাইরের কক্ষপথেও হয়তো আরো কোনো অজানা গ্রহ আছে,  যার আকর্ষণে ইউরোনাস গ্রহের গতিপথ বিচ্যুত হচ্ছে৷ এতবড় আকাশ, সেখানে ছোট্ট একটা বিন্দুসম গ্রহ খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে? একজন ফরাসী গনিতবিদ Urbain Le Verrier নিজ দায়িত্বে পথ প্রদর্শন করলেন ,  তিনি অংক করে সেই অজানা গ্রহের আনুমানিক অবস্থান বের করে জ্যোতির্বিদদের জানালেন৷তার মাত্র একডিগ্রি ব্যাবধানে  খুঁজে পাওয়া গেলো দায়ী গ্রহকে, আবিষ্কার হলো নেপচুন৷ শোনা যায় অবজারভেটরির একজন বিজ্ঞানী অবাক হয়ে বলেছিলেন “শেষে একজন মানুষ,  শুধু একটা কাগজ আর একটা  কলম  নিয়ে আমাদের বলে দিচ্ছে কোনদিকে টেলিস্কোপ ঘোরালে একটা গ্রহ পাওয়া যাবে! ” গনিত,  এমনই এক শক্তিশালী Tool. তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত আমাদের পুর্বোক্ত মস্তিষ্কের সাহাজ্যে কল্পনাও করা যায় না  (এর উদাহরণ দিতে গেলে এখন হয়েছেই!)৷ বিজ্ঞানীরাও কল্পনা করতে পারেন না, হাজার হলেও তাদের মস্তিষ্কও তো একই গড়নের৷তবু তাদের এক ভয়ংকর অস্ত্র আছে, এই গণিত।

Plato ও যুক্তি বা reason এর পক্ষে মত দিয়েছেন ৷ কেবলমাত্র বিশুদ্ধ চিন্তা বা pure thought (অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ এবং ইন্দ্রিয়) এর মাধ্যমেই নিঃসন্দেহ সত্য জানা যায় না ৷ প্লেটোর দর্শনের এই ধারার নাম Rationalism ৷ দেকার্তেও এই মতের অনুসারি ছিলেন ৷ পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে পাওয়া সত্যে আসলে সন্দেহ থেকেই যায় ৷ Plato’র এই ‘বিশুদ্ধ চিন্তা’র নির্ভরশীলতা নিয়েও আমাদের সংশয়, আমরা আগেই বলেছি মস্তিষ্ক অতটা নির্ভরযোগ্য নয়। আমি মোটেও এই পর্যবেক্ষণ এবং চিন্তা থেকে জানতে পারা  ‘অপ্রকৃত বাস্তব’ কে ছোট করছি না ৷ আমাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দাঁড়িয়ে আছে এই Rationalism এর বিরুদ্ধ পক্ষ Empiricism এর ওপরে ৷ কিন্তু তা গানিতিক ধারনার মতো অতটাও সত্য নয় (হ্যাঁ, আমার মতে সত্যেরও বেশি সত্য কম সত্য আছে) ! অঙ্ককে ভয় পাওয়া অনেকেই বোকার মতো প্রশ্ন করে বসে বাস্তব জীবনে গনিতের কী দরকার? আমি তাদের বলবো, তাদের ওই ‘বাস্তব’ জীবনে সত্যিই যদি বাস্তব কিছু থেকে থাকে তবে তা গনিত । পাশাপাশি সেই একটু আগে প্লেটোর গুহা থেকে মুক্তি পাওয়া লোকটার মতো গুহার বাইরে দেখার আনন্দময় অনুভুতি এই গনিত (এবং বিজ্ঞান) আমাদের দিতে পারে৷

One last question, আমাদের বিশ্ব যদি তেমন কোনো গেমই হয় তাহলে কি তার কোনো খেলোয়াড় আছে? আমরা যদি খুবই ছোট কোয়ান্টাম স্কেলে বিবেচনা করি যেখানে আইন্সটাইনের ভাষায়,  ইশ্বর পাশা খেলেন, কিংবা খুব বড়ো Cosmic স্কেলে বিবেচনাও করি তবু তেমন কোনো খেলোয়াড়ের সন্ধান মেলে না ৷অর্থাৎ গেম অব লাইফের মতো জিরো প্লেয়ার গেম বলেই মনে হয় ব্যপারটা ৷

জিসান
দ্বাদশ শ্রেণি , গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ।