আমাদের স্কুলে মেয়েদেরকে উড়না এবং মাথায় ঘোমটা প’রে আসতে হতো। আমরা তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের সহপাঠী একটি মেয়ে, নাম রাণু (ছদ্মনাম), একদিন পাতলা উড়না প’রে স্কুলে এসেছিল। আমাদের বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন তাপস স্যার। শ্রেণীকক্ষে ঢুকেই সেদিন স্যার রাণুর দিকে তর্জনী নির্দেশ ক’রে বড় বিদ্রূপের স্বরে বললেন, এইযে মশারি, তুই মশারি প’রে স্কুলে এসেছিস কেন? তোকে কি মশা কামড়ায়? আমরা, রাণু বাদে আর বাকি ছাত্রছাত্রীরা সবাই সেদিন খুব মনেপ্রাণে হেসেছিলাম; স্যারের মুখে এমন মজার কথা শুনে। আমাদের মনে হয়েছিল, পাতলা উড়না, যা অশালীন একটি জিনিস, তার এর চেয়ে সুন্দর উপমা আর হতেই পারে না। তার সঙ্গে-সঙ্গে যে ওই অশালীন জিনিসটি পরেছিল, রাণু, তারও যথোপযুক্ত বিশেষণটি স্যার আরোপ করেছিলেন “মশারি”। একই শব্দে তাপস স্যারের, রাণুর উড়না ও তার নিজের বিশেষ্য ও বিশেষণ-করণে আমরা খুব অবিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, স্যারের কত জ্ঞান আর উপস্থিত বুদ্ধি! সেদিন তাপস স্যার ও আমরা সকলে মিলে পুরোটা সময় ভীষণ হেসেছিলাম, ব্যাকরণ পড়া বাদ দিয়ে। লজ্জা আর অপমানে মরমে মরে যাচ্ছিল শুধু রাণু। রাণুর ফর্সা মুখটি ঘন মেঘের মতো কালো হয়ে গিয়েছিল। লজ্জাকালো মুখ এবং সজল চোখদুটি ও লুকিয়েছিল মাটির দিকে নীরবে তাকিয়ে থেকে। তাপস স্যার ও আমরা সেদিন রাণুকে লজ্জা দিয়েছিলাম, পাতলা উড়না পরার অপরাধে। তার নারীত্বের অপরাধে। তার নারী-শরীরের অপরাধে। রাণুও লজ্জা পেয়েছিল, ওর নারীত্বের অপরাধে, ওর নারী-শরীরের অপরাধে, পাতলা উড়না পরার অপরাধে।
সেদিনের পর থেকে রাণুকেকে দেখলেই আমরা ব’লে উঠতাম, ওই যে মশারি! ওইযে, মশারি এসেছে! ওইযে, মশারি যাচ্ছে! রাণু সব শুনেও না শোনার ভান করতো, লজ্জা আর অপরাধবোধে বাক্যহীন হয়ে যেতো। কী ভয়াবহ মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে রাণুকে যেতে হয়েছিল, তা ভাবলে এখন আঁতকে উঠি। সে-অবস্থার কারণ আমি নিজেও ছিলাম। ওকে বিদ্রূপ করতে, মশারি ডাকতে আমিও ছাড়ি নি। আমি এবং আমার অন্যান্য সহপাঠীরা, রাণুকে মশারি ডেকে আনন্দ পেতাম; এবং আমরা তা শিখেছিলাম তাপস স্যারের কাছ থেকে।
তাপস স্যারের “ওই, মশারি, মশারি পরেছিস ক্যান? তোকে কি মশা কামড়ায়?” কথাটি “ওই মেয়ে, তোর উড়না কই” এই অশালীন কথাটির চেয়ে কম অশালীন।
আমাদের বয়স তখন বারোর মতো। আমাদের বাবামায়েরা আমাদেরকে স্কুলে পাঠানোর সময় পর্যাপ্ত কাপড়ের ওপরে আরো একটি কাপড়খণ্ড পরিয়ে দিতেন। যাতে আমরা যাতাযত-পথে ও স্কুলে সুরক্ষিত থাকি। যাতে অসম্মানিত না হই। বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত যাত্রাপথে যাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হতো, যাদের কাছ থেকে আমাদের অসম্মানের আশঙ্কা ছিল, তারা আমাদের স্বজন ও স্বজাতি পুরুষ। আর স্কুলে আমাদের শিক্ষককুল, যাঁদের ওপর ভরসা ক’রে আমাদের পিতামাতারা আমাদেরকে স্কুলে জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠাতেন, তাঁদের কাছে কি আমরা নিরাপদ ছিলাম? শারীরিক ও মানসিকভাবে? আমাদের স্বজন ও স্বজাতি ভাইদের কাছে যদি আমাদের নিরাপত্তা থাকে, তাহলে কেন পর্যাপ্ত কাপড় পরার পরেও বারো বছরের একটি শিশুকে বাড়তি একটি কাপড়খণ্ড পরতে হয়? কেন তাকে পাতলা উড়না পরার কারণে তারই শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছে অপমান ও বিদ্রূপের শিকার হতে হয়?
মেয়েদেরকে উড়না প’রে, মাথায় ঘোমটা প’রে স্কুলে যেতে হতো। কিন্তু কোনো ছেলেকে এবং আমাদের কোনো পুরুষ শিক্ষককে কোনোদিন মাথায় ঘোমটা দিয়ে স্কুলে আসতে দেখি নি। এটার কারণ কী? পুরুষেরও তো নারীর মতো মাথা আছে, তাদের মাথার ভেতরেও তো মগজ ও বাইরে চুল আছে। নারীদের মাথা, মাথার মগজ ও চুল যদি পৃথিবীর কাছে থেকে ঢেকে অস্তিত্বহীন ক’রে রাখা খুব মঙ্গলের কিছু হয়ে থাকে, তাতো পুরুষদের জন্যও সমান মঙ্গলজনক হবার কথা। নাকি, আমাদের সমাজ ও স্বজনেরা কেবল নারীদের মঙ্গল নিয়ে ভাবিত, পুরুষদের মঙ্গল নিয়ে ভাববার সময় বা প্রয়োজন তাদের নেই? আবার অনেকে ব’লে থাকেন, নারীদের দেহ ও সম্মান খুব অমূল্য। তাই এসবকে মাত্রাতিরিক্ত কাপড়ে আচ্ছাদিত ক’রে, ও গৃহকোণে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখে সুরক্ষা দিতে হয়। এই যুক্তি যদি মেনে নিই, তাহলে পুরুষদের মাথা, মাথাস্থিত মগজ ও চুল, দেহ ও সম্মানের যুক্তি কী? তাদের এসকল দ্রব্যের কি কোনোই মূল্য নেই? এসবের সুরক্ষার কোনো দরকার নেই? এটা তো মারাত্মক পুরুষ-বিদ্বেষ ও অবমাননামূলক চিন্তাভাবনা।
আমাদের দেশে অনেক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের উনিফর্ম আছে। তাতে দেখা যায়, চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণী থেকে মেয়েরা আর ফ্রক প’রে স্কুলে যেতে পারে না। ওদেরকে সেলোয়ার-কামিজ পরতে হয়। এবং সঙ্গে উড়না বাধ্যতামূলক। সেলোয়ার-কামিজ বা উড়না যারা পরতে চায়, তারা অবশ্যই পরুক। কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু যারা পরতে চায় না, তাদেরকেও কেন তা পরতে হবে? উড়না নামের বাড়তি কাপড়খণ্ডটি পরার পরেও আমাদের মেয়েরা সুরক্ষিত থাকতে পারে না। উড়না হিজাব এমন কি বোরকা-পরা মেয়েরাও ইভ টিজিং ও ধর্ষণের শিকার হয় প্রতিনিয়ত, ঘরে ও বাইরে। নিরাপদ সমাজ ও মানুষের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন মানবিক আইনকানুন ও মানুষের সুন্দর মানসিকতা। মানুষের সুরক্ষা দেবে মানুষ, উড়না নয়।
অনেক পরিবারে দেখি, মেয়ের বয়স বারো-তেরো হলে তাকে আর ফ্রক পরতে দেওয়া হয় না। অথবা পরতে দিলেও ফ্রকের সঙ্গে পায়জামা পরতে বাধ্য করা হয়। তাকে উড়না পরতে উদবুদ্ধ ও বাধ্য করা হয়। ঘরের বাইরে তো অবশ্যই, এমন কি, ঘরের ভেতরে, তার অতি আপনজনদের সামনেও তাকে উড়না ও পায়জামা না প’রে যেতে দেওয়া হয় না। একটি বারো বছরের মেয়ে শিশু কি তার নিজের ঘরে তার পিতা বা ভাইয়ের কাছেও নিরাপদ নয়? নারী-দেহ নিয়ে কেন ঘরে-বাইরে কোথাও নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাঁচা যায় না? কিন্তু ছেলেদের বেলায় এমনটি দেখা যায় না। একটি বারো বছরের ছেলের শরীরেও বয়োঃসন্ধি আসে। তার শরীর পরিবর্তিত হয়, হরমোনাল কারণে তার মনোজগতে পরবর্তন আসে। তাকে এসব কারণে হাপপ্যান্ট ছাড়তে হয় না। বা উড়না পরতে হয় না।
অনেক পরিবারে এমন দেখেছি যে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেটি হাফপ্যান্ট প’রে বাইরে খেলতে যায়, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যায়। কিন্তু তার কাছাকাছি বযসী বোনটি বাসায় উড়না প’রে থাকে, বাইরে যাবার সময় বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরে এবং তার বাইরে গিয়ে খেলাধুলা বা বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা নিষেধ। ছেলে আর মেয়ের প্রতি পিতামাতার আচরণ ও মনোভাবের এমন আকাশ-পাতাল বিভেদ কেন? অনেকে বলেন, বাইরে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব। তাই মেয়েদের কাপড়চোপড় ইত্যাদিতে বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কিন্তু কেন মেয়েরা নিরাপদ নয় বাইরে? নারী দেখলেই যাদের অসম্মানমূলক কথা বলতে ইচ্ছা করে বা আরো বাজে কিছু করতে ইচ্ছা করে, সমস্যা তো তাদেরই। মানুষের সুরক্ষা যদি মানুষ দিতে না পারে, এবং সেখানে একটি কাপড়খণ্ডকে সুরক্ষা মনে ভেবে নেওয়া হয়, সেটা মনুষ্যত্বের অপমান। আর আমাদের মেয়েরা ঘরের ভেতরে নিকটাত্মীয়দের কাছেই বা কতটুকু নিরাপদ? একটুকু নিরাপদ যে সে তেরো-চোদ্দ বছর বয়েসে তার নিজের বাবা ও ভাইদের সামনে উড়না ছাড়া যেতে লজ্জিতবোধ করে!
তেরো বছর বয়েসে আমি একদিন উড়না ছাড়া আমাদের উঠোনে বের হয়েছিলাম ব’লে আমার পিতা আমাকে প্রহার করেছিলেন। এবং কিছু অসুন্দর কথা বলেছিলেন। খুব ছোট বয়স থেকেই আমাকে পর্দা উড়না আর গৃহকোণের তিমিরে আচ্ছাদিত ও বন্দি করে রাখতেন, আমার পিতামাতা দু’জনেই। আমার ভাতৃদ্বয়ও সেই বয়স অতিক্রম করেছে। ওদেরকে কোনোদিন উড়না পড়তে হয় নি, বা না পরার জন্য প্রহৃত হতে হয় নি। আমার পিতাকেও আমি জীবনে কোনোদিন উড়না পরতে দেখি নি। আমাদের সমাজে নারী-শরীর কোথায় নিরাপদ? ঘরে? বাইরে? স্কুলে? ঘরে পিতামাতা উড়না না পরলে প্রহার করে, বাইরে উড়না প’রে বের হলেও পুরুষেরা ইভ টিজিং করে, স্কুলে পাতলা উড়না পরলে শিক্ষকও বাজে কথা বলতে ও মজা নিতে ছাড়েন না। নারী-শরীর তবে কোথায় নিরাপদ?
নারীদের পোশাকে শালীনতা থাকা উত্তম তবে কেউ নারীর শরীর নিয়ে উপহাস করা বা অশালীন দৃষ্টি ছুড়ে দেওয়া আমাদের মানসিকতার প্রমাণ দেয়। প্রতিটি পুরুষের দায়িত্ব নারীদেরকে এই ব্যাপারে সম্মান দেওয়া এবং নারীরা যেন ঘরে এবং বাইরে পুরুষদের প্রতি ভরসা করতে পারে সেই আস্থা দেওয়া।
Good writting
পাঠ এবং পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ।