ভারতীয় বংশদ্ভুদ ব্রিটিশ নাগরিক ঋষি সুনাক বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন সেটা ভাল কথা। এ জন্য অবশ্যই তিনি সাধুবাদ ও শুভেচ্ছা পাবার যোগ্য। বিভিন্ন দেশের অভিবাসিদের জন্য সেটা একটা আনন্দের সংবাদ ও উৎসাহের বিষয়। কেননা এখনো অনেক বাঙালি-ভারতীয় মনে করেন, অভিবাসিরা বিদেশে ভাল কিছু করতে পারেন না, তারা শুধু সাদাদের কামলাই দেন। একবার আমার এক উচ্চশিক্ষিত বন্ধু বলেছিলেন, তিনি অনেক দেশে ঘুরেছেন কোথায়ও কোন বাঙালিকে বসা কাজ করতে দেখেননি। তাদের পক্ষে এমন সংবাদ ধারণ করা শুধু কঠিনই না সপ্তাচার্যের বিষয়। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, বিভিন্ন দেশের অভিবাসিরা যেমন সাধারণ কাজ করেন আবার একই সাথে- রাষ্ট্র-সরকার-প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়েও আছেন, যাচ্ছেন।

কিন্তু বাঙালি-ভারতীয় অভিবাসিদের মাত্রাহীন উচ্ছাস ও মন্তব্য খুব অবাক করার মত। তারা তাদের সীমাহীন আবেগ সংবরণ করতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন, ব্রিটিশরা একসময় আমাদের শাসন করেছে, এখন ভারতীয়রা ব্রিটিশদের শাসন করবে। এটা তাদের প্রতি আমাদের চরম প্রতিশোধ! বিষয়টা কি তাই? এতটাই সরল?

ঋষি সুনাক ব্রিটেনের রক্ষনশীল দলের নেতা। তিনি কোন উদারপন্থী দলের নেতা নন। আর রক্ষনশীলদের দলের নীতি কেমন হয় যারা রাজনীতি বিজ্ঞানের খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন। তারা প্রধানত অভিবাসি বিরোধী ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের নীতি হয় অনুদার। তাদের নীতি হয় সীমিত আয় বিরোধী ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদেন নীতি হয় রক্ষনশীল ভাবধারার।  তিনি বিটেনের প্রধানমন্ত্রী হবেন ঠিকই তারমানে এই নয় যে, বিৃটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতির কোন পরিবর্তন হবে। ইঙ-মার্কিন যে জুটি তা অটুটই থাকবে। ঋষি সুনাকও সে অঙ্গীকার নিয়েই ক্ষমতা বসবেন।

আপনরা যতটা উৎসাহ-উচ্ছাস প্রকাশ করছেন, আমি তা করতে পারছি না। আপনারা শুধু ঋষি সুনাক’কে এটুকু বলেন-, ব্রিটিশরা ভারত থেকে যে অর্থসম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে তা ফেরত দেয়ার একটা বন্দবস্ত করতে বলেন। সেটার সূদের দরকার নেই আসলটা হলেই হবে। সেটাই কি হবে? সেই হিসেবটা কত তা কি জানেন..??

আত্মবিস্মৃত ব্রিটিশদের সেই খতিয়ান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে Dispossession, Deprivation, and Development নামক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ উৎস পাটনায়েক। তিনি একজন খ্যাতিমান ভারতীয় অর্থনীতিক। তিনি সেখানে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের প্রায় দুই শতকের কর ও বাণিজ্যের খতিয়ান সোজাসাপটা হিসাব তুলে ধরেন। ১৭৬৫ হতে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা ভারত থেকে ৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের সম্পদ পাচার করে নিয়ে গেছে! ৪৫ ট্রিলিয়নের এই অংকের পরিমানটা কত, তা সহজ করে বুঝতে শুধু এই ধারণা রাখলেই হবে যে, এটা হচ্ছে ব্রিটিশদের বর্তমান জিডিপি’র প্রায় ১৭ গুণেরও অধিক! এ তো গেল অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসেবে একটু মানবিক ক্ষতির হিসেবটাও একটু দেখা দরকার।

“ব্রিটিশরা তাদের অন্যান্য কলোনি বিস্তারে ভারতীয় সৈন্যদের সবার সামনে এগিয়ে দিতো। চীন, ইথুপিয়া, মাল্টা, মিশর, সুদান, মিয়ানমার, পূর্ব আফ্রিকা, সিলোনে তারা এটা করেছে। মিয়ানমার যুদ্ধে  প্রতি ছয় জন ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে গড়ে একজন করে নিহত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমারে ভারতীয় সৈন্য মারা যায়  ১ লাখ। যুদ্ধ শেষে অসংখ্য ভারতীয় সৈন্য স্পানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। এই রোগ ভারতে বয়ে আনে তারা। ১৯১৮ সালে স্পানিশ ফ্লুতে ভারতে মারা যায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ।

দাসের মত ভারতীয় শ্রমিকদের খাটাত ব্রিটিশরা। তারা ভারত থেকে জাহাজে ভরে ভারতীয়দের নিয়ে যেতো। মরিমাসে ৫ লাখ ভারতীয়কে পাঠানোর তথ্য নথিতে আছে। আর ক্যারবিয় পাঁচটি দ্বীপে ২৫ লাখ ভারতীয় পাঠানো হয়েছিল জাহাজে ভরে। এতে বহু মানুষ পথেই মারা যেতো। এর মধ্যে পুরুষ ছিল ১২%, নারী ১৮%, বালক ২৮%,  বালিকা ৩৬% ও শিশু ৫৫%। মৃত ভারতীয়দের ব্রিটিশরা সাগরে ছুড়ে ফেলত।“ এভাবেই ভারতীয় নারী-শিশু-যুবকদের যুদ্ধের জ্বালানি ও দাস হিসেবে তারা ব্যবহার করতো এই ব্রিটিশরা।

এখন আপনারা ঠিক করুণ ঋষির জন্য কতটা মাত্রাহীন উচ্ছাস প্রকাশ করবেন?

ব্রিটেনের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শুধু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই বিলটা উত্থাপন করুক যে, ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশরা যে অন্যায়-অত্যাচার-শোষণ-নির্যাতন করেছে, দাস ব্যবস্যা করেছে, ভারতীয় তাদের কামানের গোলা বানিয়েছে, তার জন্য শুধু ক্ষমা প্রার্থণা করতে বলুন, দেখেন সেটাই করে কি’না? সেটাও করবে না। তাঁদের রানীর মাথায় চোরাই মুকুট শোভা পাবে- কিন্তু কখনোই শ্বেতাঙ্গ জ্যাত্যাভিমানে তারা মাথা নত করবে না, ক্ষমা প্রার্থণা করবে না। এটাই ব্রিটিশ জাতি! আর সুনাক তাদেরই প্রতিনিধি!

তাহলে আপনার যারা এমন উচ্ছাস প্রকাশ করছেন, তার কারণ কি? সেটাও তাদের মনোস্তাস্তিক শোষন ও প্রতারণা। বরং এতে তাদের বহুজাতিক শোষণ ও সাম্রাজ্য বিস্তার আরো সহজ ও সুবিধার হবে। মনে রাখবেন ব্রিটিশরা আমাদেরকে-ভারতবর্ষকে শাসন করেছে সেটা সত্য কিন্তু সেই শাসন ও শোষন তাদের এই দেশীয় প্রতিনিধি ভারতীয় স্তাবকদের দ্বারাই করেছে। তারা শুধু নির্দেশ দিয়েছে, বসে বসে পা দুলিয়েছে, আনন্দ-ফুর্তি করেছে। যুদ্ধ, হানাহানি, লুটপাট, খুনাখুনি স্বজাতির লোকজনকে দিয়েই করিয়েছে।

ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি শুধু ফেসবুক সীমাবদ্ধ নেই। ভারত-বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে এ খবর ব্যাপক উচ্ছাস-উৎসাহের সাথে প্রচার করা হচ্ছে। ভারতের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, রথী-মহারথীরাও এই আলোচনায় যুক্ত হয়ে গেছেন। তাদের উচ্ছাসের একটি প্রধান কারণ ঋষি হিন্দু এবং ভারতীয় ভাবধারার একজন ব্রিটিশ রাজনীতিক। শুধু হিন্দু মৌলবাদীরাই নয় দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ বলয়েও তার সাফল্যে উচ্ছাস প্রকাশ করা হচ্ছে। এটা নিয়ে ভারতে তো বটেই বিদেশের পত্রিকাতেও সংবাদ হচ্ছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনামটা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হলেন একজন ‘গর্বিত হিন্দু’ ঋষি সুনাক। ইন্ডিয়া টুডের শিরোনাম, হিন্দু হয়েও ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে সুনাক। তাদের সংবাদের এ সমালোচনাও আছে যে, হিন্দু হওয়ার কারণেই নাকি সুনাক আগের বার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রিত্ব পাননি। ইত্যাদি।

ঋষি সুনাককে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলা হলেও তাঁর জন্ম আসলে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে। তার বাবা যশবীর কেনিয়ার কলোনি এবং প্রটক্টোরেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা ঊষা তাঙ্গানিকায় তানজানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা-দাদির জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে। ১৯৬০ এর দশকে তারা সন্তান নিয়ে পূর্ব আফ্রিকা থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসি হন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই আপনারাই হয়তো নিজ দেশে কোন সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র বা ভিন্ন জাতি সত্ত্বার কেউ কোন শীর্ষপদে আসীন হলে তা মেনে নিতেন না। যেমন মেনে নেননি, ইতালিয়ও বংশদ্ভুদ ভারতীয় নাগরিক কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধিকে। যিনি নির্বাচিত হলেও যাঁকে আপনারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি। কিন্তু এই ঋষি সুনাক, বারাক ওবামাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছে এই সব দেশে গণতন্ত্র ও মেধা-প্রতিভা, বিকাশ-প্রকাশের অপার সুযোগ-সম্ভবনা আছে।

বারাক হোসেন ওবামা পরপর দুই টার্ম মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ওবামা কেনিয়া বংশদ্ভুদ আমেরিকান। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় কি কেনিয়ার অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কোন প্রভাব পড়েছে? আফ্রিকা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র, পশ্চাদপদ ও যুদ্ধবিগ্রহের একটি অঞ্চল। তার প্রধান দায় মার্কিনীদের। কিন্তু তাঁর মার্কিনের সর্বোচ্চ ক্ষমতার পদায়নে- আমরা অনেক উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলাম। পরবর্তিতে আমরা ততোটাই হতাশ হয়েছি। ঋষি সুনাকের ক্ষেত্রেই তার ব্যতিক্রম হবে না।

তিনি এমন এক সময় ব্রিটেনের ক্ষমতা নিচ্ছেন। যখন ব্রিটেন, ইউরোপের ও বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আর সে অবস্থা আরো জটিল থেকে জটিলতর বৈ সহজ হচ্ছে না। ব্রিটেনের এই রাজনৈতিক সংকট-জটিলতাকে ইউরোপিয় ইউনিয়নের নেতৃত্বেও তাদের সামলোচনা ও ভৎসনা করতে ছাড়ছে না। বাকিটা সময়ই বলবে, এই ব্রিটিশ-ভারতীয়র ক্ষমতার অভিষেক কেমন হবে।

————————————————————————-

ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।