লিখেছেনঃ রেবা পারভীন

আমি একজন নারী, আমি একজন বাঙালি নারী, আমি বাঙালি হিসেবে অবশ্যই গর্ববোধ করি কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতি আমাকে আমার আত্মপরিচয় অর্জন করার সুযোগ তেমন একটা দেয়নি; এর কারণ হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি হচ্ছে পুরুষতন্ত্রবাদী এবং অনেক ক্ষেত্রে নারীবিদ্বেষী; বাঙালি সমাজে নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করা মানে ছোটো বেলা থেকেই দেখা যে বাঙালি সমাজ পুরুষশাসিত এবং পুরুষাধিপত্যবাদী। সমাজ যে পরিবার চলে ওখানেও পুরুষপ্রাধান্য রয়েছে, নেই কোনো নারীপ্রাধান্য বা থাকলেও সেটা যথেষ্ট নয়।

বাঙালি নারী হিসেবে আমি পোশাক পরার স্বাধীনতা ভোগ করিনা, বাঙালি নারী হিসেবে আমি ছেলেদের মতো যত্রতত্র বাইরে ঘোরাফেরার স্বাধীনতা ভোগ করিনা, বাঙালি নারী হিসেবে আমি ছেলেদের মতো যেই সেই চাকরিতে ঢুকতে পারিনা, বাঙালি নারী হিসেবে আমি অবিবাহিত থাকলে সমাজের কটূক্তির শিকার হই, বাঙালি নারী হিসেবে আমি মানুষ হিসেবে অনেক কিছুই ভোগ করতে পারিনা, অথচ আমিও একজন মানুষ; পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

নারী ছাড়া বাঙালি পুরুষদের চলেনা, তারা জীবনে সফল হলে নারীসঙ্গ নিয়েই ছাড়বে, তাদের নারীসঙ্গ দরকারই, অবশ্যই দরকার; এই অতি আবশ্যকীয় নারী পেতে বাঙালি পুরুষরা কতো কষ্ট করে! ভালো করে পড়ালেখা করে অনেক পরিশ্রম করে, চাকরি পায় অনেক কষ্টে, তারপর তার পরিবার থেকে তাকে মেয়ে এনে দেওয়া হয়; বাঙালি সমাজ এক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রবাদী নীতিতে চললেও দেখুন নারীদেরকে পাবার জন্য কষ্ট কিন্তু পুরুষদেরকেই করতে হয়, আর সমাজে রয়েছে নারীবিদ্বেষ, নারীস্বাধীনতাবিদ্বেষ, বিভিন্ন গালি-গালাজ নারীকে ঘিরেই। যদি বাঙালি সমাজে পূর্ণাঙ্গ নারী স্বাধীনতা থাকতো এবং নারীরা যদি পুরুষসঙ্গ নিতে বাধ্য না হতো তাহলে কেমন হতো? কেমন আর হতো, পুরুষতান্ত্রিক পুরুষরা তখনো নারীদেরকে গালি গালাজ করে যেতো এখন যেমনটা করে যায়, পুরুষরা তখনো নারীবিদ্বেষী থেকে যেতো এখন যেমন আছে। নারীকে পেতে গেলে পুরুষদের এতো কষ্ট করতে হবে কেনো? আর কি দরকার অভিভাবক দ্বারা বিয়ে নামক কঠিন একটা বিয়ে পদ্ধতি রাখার? নারীদের সঙ্গে পুরুষদের ছোটো বেলা থেকে মেশার নিয়ম সমাজে রাখলেই তো হলো; স্কুলে-কলেজে যৌন শিক্ষা কার্যক্রম রাখলেই তো হলো; আর বিয়ে করার ক্ষেত্রে প্রেম-ভালোবাসার অগ্রাধিকার রাখাটা খুবই জরুরি যেখানে একটি পুরুষ বা একটি নারীর কারোরই যোগ্যতা মুখ্য যেনো না হয় এটা দেখতে হবে, অভিভাবক দ্বারা বিয়েতে পুরুষদের যোগ্যতা ছাড়া বিয়ে হয়না, এবং এই ধরণের বিয়েতে নারীদেরকে একভাবে পুরুষরা কিনে নেয় তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী, বিয়ের পরে নারীটি স্বামীর আয়ে চলে, স্বামীর পরিচয়ে চলে, স্বামীর পরিচয়ে তার সন্তানও বড়ো হয়; এখানে নারী তো সত্যি সত্যিই পরাধীন।

একজন নারী বোরকা পরবেন, না বিকিনি পরবেন না শাড়ি পরবেন না সালোয়ার কামিজ পরবেন নাকি প্যান্ট শার্ট পরবেন এটা সমাজ কেনো নির্ধারণ করে দেবে? আর কেনোই বা নারীশরীর নিষিদ্ধ থাকবে? কেনোই বা নারীশরীর গোপন রাখার বিষয়? আর বাংলাদেশের সমাজে নারীবাচক এতো গালি গালাজ কেনো চলে? কেনোই বা বাংলাদেশের সমাজে যৌনতা ঋণাত্মক ভাবে চিহ্নিত যদিও বাংলাদেশের সমাজে কামুক পুরুষদের দাপট অনেক এবং এরা কপটতাবাদী। বাঙালি কামুক স্বামী তার স্ত্রীকে বোরকা পরিয়ে রাখে, বা রক্ষণশীল শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরিয়ে রাখে, এখানে বাঙালি পুরুষ চায়না যে, অন্য পুরুষ তার স্ত্রীকে দেখুক, নিজে তার স্ত্রীকে ভোগ করবে ইচ্ছা মতো আর তাকে গর্ভবতী বানাবে, তাকে চালাবে নিজের টাকা পয়সাতে, তার স্ত্রীর কোনো ধরণের স্বাধীনতা সে সমর্থন করবেনা, তার স্ত্রী তার কাছে কিনে নেওয়া সম্পদের মতো, হ্যাঁ, এরকমটাই বলা যায় বাঙালি পুরুষ তার স্ত্রীকে পরোক্ষভাবে নিজের সম্পদ মনে করে, যে এতো কষ্টে একে পেয়েছি, একে তো ঢেকে রাখতে হবে। এ যেনো হীরে মুক্তার মতো, যে মানুষ খুব পছন্দ করে এবং লুকিয়ে রাখতে চায় তাই লুকিয়ে রাখে, বাঙালি সমাজে নারীও অনেকটা ঐরকমই। বাঙালি সমাজে স্বামী ছাড়া বাইরের কোনো পুরুষের সঙ্গে নারী কথা বললে স্বামীর গা জ্বলে ওঠে; বাঙালি পুরুষের স্ত্রীর দিকে বাইরের কোনো পুরুষ নজর দিলে বাঙালি স্বামী পুরুষ হয়েও ঐ পুরুষের প্রতি চড়াও হয়, অথচ সে নিজেও তো পুরুষ, সে কি নিজে তার স্ত্রীকে বিয়ের আগে অন্য নারীর দিকে নজর দেয়নি? সে কি নিজেকে এক্ষেত্রে নিজেকে সৎ দাবী করতে পারবে? আর অন্য পুরুষ যে তার স্ত্রীর দিকে নজর দেয় এটার জন্য সমাজে চলা পুরুষতন্ত্রবাদই দায়ী যেখানে নারীদের সঙ্গ পাওয়াটা কঠিন, এখানেও দোষটা পুরুষদেরই। কি বিচিত্র বাঙালি সমাজ; স্ত্রীকে বোরকা পরিয়ে নারীদের প্রতি অন্য পুরুষের কৌতূহল, লোভ এগুলো বাড়িয়ে তোলে; একজন নারী বোরকা পরতেই পারে যদি সে স্বেচ্ছায় পরে আবার সে প্যান্ট শার্টও পরতে পারে এটাও তার ইচ্ছা কিন্তু না স্বামী নামের কর্তৃত্ব চেপে উঠবে তার উপর।

বাঙালি সমাজে স্ত্রী, কন্যা, এবং মাতা এই তিনটি ভূমিকাতেই নারীকে রাখা হয়েছে, আরো আছে বোন, খালা – এগুলোও স্ত্রী, কন্যা, মাতারই প্রতিরূপ। পুরুষতন্ত্রবাদ নারীদের অন্য পরিচয় রাখতে চায়না, রাখতে দেয়না, যেখানে পুরুষদের কতো পরিচয় আছে, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ডাক্তার, কবি, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সবই তো পুরুষ, বাঙালি সমাজে নারীদেরকে কি এরকম পরিচয় তৈরির সুযোগ দেওয়া হয় যে, নারীরাও এসব করতে পারবে? না, দেওয়া হয়না, বাঙালি পুরুষ এখনো নারীস্বাধীনতা বিরোধী, নারীর কোনো পরিচয় সে তৈরি করতে দেবেনা। শিক্ষিত নারীদের মধ্যে যদিও ডাক্তার, কবি, লেখক, চাকরিজীবী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী দেখা যায় তবে তা পুরুষদের তুলনায় অনেক অনেক কম থাকে, আর শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, দোকানদার, বাস ড্রাইভার বা বাসের হেল্পার এগুলোতে নারীদের অনুপস্থিতি দেখা যায় বাঙালি সমাজে, বাঙালি সমাজ এগুলোতে পুরুষতন্ত্রবাদী নিয়মই পছন্দ করে, নিজেরা তো নারীবিদ্বেষীই, আবার নারীদেরকেই তৈরি করে পুরুষবিদ্বেষী হিসেবে।

অনেক সময় পার হয়েছে, বাঙালি নারীদের আত্মপরিচয় তৈরি হয়নি; এখনো বাঙালি নারীরা একটি পুরুষকে বিয়ে করে সে তার পরিচয়ে চলে, সামাজিক ভাবে এখনো বাঙালি নারী দূর্বল এবং পশ্চাৎপদ; বাঙালি নারীরা এখনো রাঁধুনি হয়, বাঙালি নারীরা এখনো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে বসে, বিয়ের পরে অনেক ক্ষেত্রেই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভবতী হয়। এখনো বাঙালি নারী স্বামীর টাকা এবং স্বামীর নির্দেশ-আদেশ ছাড়া বাইরে যেতে পারেনা, বা যেতে পারলেও তাকে স্বামীর আদেশ মেনে বোরকা পরতে হয়; এখনো বাঙালি নারী তার নিজের ইচ্ছা মতো ছেলেবন্ধু তৈরি করতে পারেনা, ছেলেদের সঙ্গে মিশতেই পারেনা। ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গ চায় কিন্তু তারা পুরুষতন্ত্রবাদের কারণে মেয়েদের সাথে মিশতে পারেনা। আবার মেয়েদের সঙ্গ পেলে অন্য ছেলে যাতে তার উপর নজর না দেয় সেই দিকে তার খেয়াল থাকে।

বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায় যে, তারা অনেকেই পুরুষতন্ত্রবাদী বিধি বিধানে দীক্ষিত হয়ে এই বিধি বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করা শুরু করে দেয়; তারা নিজেরাই তাদেরকে দূর্বল ভাবে, তারা নিজেরাই তাদের নিজেদের শরীরকে নিষিদ্ধ ভাবে, তারা নিজেরাই স্বামীর আয়ে চলাটাকে ভালো মনে করে, তারা নিজেরাই মনে করে যে, আমাদের স্বাধীনতা দরকার নেই, আমরা স্বামীর নির্দেশেই চলবো এবং পুরুষদের মতো পেশা আমাদের জন্য নয়, আমাদের জন্ম হয়েছে ঘরের কাজ করার জন্য – বাঙালি নারী এভাবে যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে আছে, শিক্ষিত নারীরাও বিয়ে করে রক্ষণশীল বিধি বিধানের কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করে এবং করছে। তারা স্বামীদের দাসী রয়ে গেছে এখনো, কথাটা ভুল না, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নারীরা কেনো স্বামী স্বামী করবে? নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে এটা বাঙালি পুরুষদেরকে শেখানো হলেও নারীদেরকে শেখানো হয়না। নারীদের স্বাধীনতা বাঙালি সমাজে থাকলে নারীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য পুরুষদের সাহচর্য নিতোনা। বাঙালি সমাজে জনসংখ্যা বেশি এখানেও নারীদের পুরুষাধীনতা দায়ী, যেখানে নারীদের নিয়তি হচ্ছে বিয়ে করে গর্ভবতী হওয়া; গর্ভধারণকে মহিমান্বিত করে বাঙালি সমাজ, যেনো গর্ভধারণেই নারীর পূর্ণতা, এখানেই যেনো নারীর জীবন সার্থকতা; আর এভাবেই নারীদেরকে বাঙালি সমাজে পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে; একজন নারী গর্ভবতী হতে না চাইলে না’ই চাইতে পারে, এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু বাঙালি সমাজে নারীদের মন-মানসিকতাও ওরকম তৈরি করে রাখা হয় যে, মাতৃত্বেই নারীর পূর্ণতা। আর বিয়েটাই বা কেনো জরুরি হবে? কি দরকার বিয়ে করার, বিয়ে ছাড়া কি নারীরা চলতে পারেনা? চলার ক্ষমতা দেওয়া হয়না কেনো? নারীদেরকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয়না কেনো যে, বিয়ে ছাড়াও যেনো তারা চলতে পারে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তো দেওয়াই হয়না সেখানে বিয়ে নামক একটি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় নারীদের ওপর। আবার কর্মজীবী নারী যে একটি সংসারের হাল ধরবে এরকম সুযোগও দেওয়া হয়না, এখানেও ঋণাত্মক চিন্তা চলে বাঙালি সমাজের, এবং এখানেও নারীর পুরুষ অভিভাবক লাগবে – এরকম ধ্যান ধারণা রয়েছে বাঙালিদের যে, এক্ষেত্রে পুরুষ অভিভাবককেও রোজগেরে হতে হবে কিন্তু নারীরা গৃহিণীর কাজ করলে সেখানে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়না এবং সেখানে সে সম্পূর্ণ ভাবে পুরুষাধীন তো অবশ্যই, সে কর্মজীবী হলেও পুরুষাধীন।