লিখেছেনঃ রুশা চৌধুরী

(এক)

হেথা হতে যাও পুরাতন
হেথায় নতুন খেলা শুরু হয়েছে

বিশাল এক যজ্ঞভূমি তৈরি হয়েই ছিল বাংলা সাহিত্য ঘিরে। সেখানে নতুন করে  আবার এক যজ্ঞের আয়োজন বা খেলা শুরু হতে লাগল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে।

আসলে পুরাতনকে কখনোই বাদ দেয়া যায় না, সে দারুণ এক ভূমি তৈরি করে রেখেছিল বলেই সে ভূমির উপরে আবার শুরু হতে লাগল নতুন এক যজ্ঞের আয়োজন। এই আয়োজনের সমারোহ দারুণভাবে নাড়া দিয়ে গেছিল বাংলা সাহিত্যকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অস্থিরতা, অভাবের হাত ধরে আসা অবক্ষয়, বৈষম্য,ইংরেজ শাসন সব মিলে একটা দারুণ  বিপর্যস্ত অবস্থা তখন চারিদিকে।

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুব সমাজের মাঝে নতুনের প্রতি, নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে যাবার প্রতি, নিত্য নতুন কবিতা, নাটক, গল্প, অংকনের প্রতি অপার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে যেন প্রকৃতিগত ভাবেই।

অন্যদিকে মাঝ গগনে তখন রবি মানে রবীন্দ্রনাথ দারুণভাবে দেদীপ্যমান!

রবীন্দ্রনাথে বুঁদ হয়ে আছে বাংলা সাহিত্য! নিজেকে, নিজের রচনাকেই তখন প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছেন  তিঁনি। আর অন্য যারা রচনা করছেন তারাও প্রায় সবাই তাঁরই অন্ধ বা চক্ষুষ্মান অনুসারী।

এই সময়ে ১৯২৩ সালে গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশরঞ্জন দাস নামে দুই উদ্যমী যুবক একটি সাময়িকী বা সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করে ফেললেন। সম্পাদক হলেন দীনেশরঞ্জন।

কেন?

বাংলা সাহিত্যকে নতুন রূপ দেয়ার স্বপ্ন ছিল নিঃশ্চয়ই! কিন্তু যদি সেই সময়টাকে ছুঁয়ে চিন্তা করতে চাই তাহলে মনে হয় সুন্দর কিছু করবার স্বপ্ন আর নতুনের প্রতি অদম্য আগ্রহই ছিল মূল। সেই সূচনাটা এতোটাই অভিনব ছিল যে বাংলা সাহিত্যের নতুনের দিকে পথ চলার। অভিনবত্ব কিসে যদি নিজের কাছেই প্রশ্ন করি তাহলে খুব গভীরভাবে দেখতে হবে সেই সময়টাকে, যে সময়টা এক ঝাঁক উজ্জ্বল, উচ্ছল তরুণ সাহিত্যকে পুঁজি করেই জীবনের পথে চলা শুরু করতে চেয়েছিলেন।

কেমন ছিল সেই পথচলা? সেই পথচলায় অসংখ্য প্রতিভাবান তরুণ একসাথে মিলেছিল। দীনেশরঞ্জন দাস আর গোকুলচন্দ্র নাগ মিলে যে সাময়িকী বা সংকলন পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন তার নাম রাখা হলো ‘কল্লোল’!

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

কিসের কল্লোল ছিল তা?

রবীন্দ্র প্রভাবকে অস্বীকার করা বা তাঁর প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে আসবার প্রচেষ্টা? না কী তার থেকেও বড়ো কিছুর দিকে এগুবার যাত্রা?

প্রশ্নগুলো একজন সাহিত্য পাঠক হিসেবে আমাকে ভাবায়, তাই এই লেখাটা শুরু করলাম।

এই কল্লোল পত্রিকার হাত ধরেই একদল তরুণ কবি, সাহিত্যিকের নতুন ধরনের পদচারণা বাংলা সাহিত্যে।

সাহিত্য স্রোতের মতো, কেউ তার গতি থামাতে পারেনি কখনো। ‘কল্লোল’ পত্রিকায় ‘কাজী নজরুল  ইসলাম’,  ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র’, ‘অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত’, শৈলজানন্দ,  মোহিতলাল সহ অনেকে লিখেছেন  তবে বারবার উচ্চারিত হয়েছে কিছু নাম এই ‘কল্লোল’ পত্রিকার সাথে আসা কল্লোল যুগের কথা উঠলেই।

সেই নাম বাংলা সাহিত্যের ‘পঞ্চপাণ্ডবের’।

এই পান্ডবদের কথাই আমি বিশেষভাবে বলতে চাই।

কারা ছিলেন সেই পাঁচজন?

তাঁরা হচ্ছেন :

১.অমিয় চক্রবর্তী
২.বিষ্ণু দে
৩. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৪.বুদ্ধদেব বসু
৫.জীবনানন্দ দাশ

এরা কিন্তু মহাভারতের যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন,  নকুল, সহদেবের মতো পাঁচ সহোদর ছিলেন না। যে বিশেষ ভাবনা থেকে তাঁদের আমি ক্রমিক অনুযায়ী সাজিয়েছি তা হয়ত এই লেখার সাথে সাথেই বোধগম্য হবে।

এঁরা আসলে কে?

ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী,  সত্যের পরাকাষ্ঠা, বিপুল শক্তিধর বা ধন্বন্তরি চিকিৎসা জ্ঞান….  এগুলো কিছুর প্রশ্নই সেই নতুন শতকের শুরুতে আসে না।

কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তাঁদের এই অদৃশ্য নামের  সুতোয় বেঁধেছিল তাঁদের কাজ। বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নেয়ার রথের রশিটা তাঁরা নিজেরাই তাঁদের হাতে নিয়েছিলেন। ভাগ্যিস নিয়েছিলেন, কিছু বিরুদ্ধতা না থাকলে জীবন যেমন আলুনি লাগে তেমনি সংস্কৃতিও থমকে যায়,  এক বৃত্তে ঘুরতে থাকে। সেই থমকে থাকাটা সচল না শুধু দারুণ গতি পেল কেমন করে সেই গল্পই এই পঞ্চপাণ্ডবের জীবনের গল্প।তাঁদের জীবন জুড়েই ছিল সৃজনশীলতা, জ্ঞানচর্চা, লেখালেখি,সাহিত্য সমসাময়িকতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

সেই গল্পগুলোই আমার ভাষায় বলার চেষ্টা করছি।

নানান রকম বই পড়তে পড়তেই আমি কল্লোলের কাছে চলে এলাম।

‘রবীন্দ্রনাথ’ আমার হৃদয়ে আছেন বহুযুগ হয়ে গেছে। সেই আসন ‘সূর্যের’ মতো।

‘সূর্যের’ ছায়ায় বেড়ে উঠা বনস্পতিরা কেমন করে ‘বৃক্ষ’ হয়ে উঠেছিল তা জানবার জন্যই আমার এই চেষ্টা।

কী ছিল আসলে সেই সময়টা? কেমন করে আমাদের সাহিত্য আলোর দিকে দীপ্যমান হয়ে উঠছিল!

‘রবীন্দ্রনাথ’ ছিলেন তখনো, ‘আলোকবর্তিকা’ কাদের কাছে দিয়ে গেছিলেন তিনি? হ্যাঁ, একজন না তাঁরা ‘অনেকজন।‘

একজন ‘রবীন্দ্রনাথ’ থেকে বাংলা সাহিত্যের আলো ‘অনেকজন’এর হাতে পৌঁছে যাওয়া।কথাগুলো আজ থেকে প্রায় ৯৯ বছর আগের।

সেই সময়, ১৯২০, ২১,২২,২৩…… যুবসমাজের মাঝে তখন নানান প্রশ্ন, সংশয়, বিদেশি সাহিত্যের স্বাদ, পরাধীনতা, দমন – পীড়ন, অভাব …  । ঠিক তখনই কিছু  নানান পথে ঘুরতে ঘুরতে এক পথে আসছিল অনেক তরুণ। আর তাঁদেরকে এক করবার জন্যই মনে হয় যজ্ঞ তৈরি করেছিলেন দুই বন্ধু ‘গোকুলচন্দ্র নাগ’  আর ‘দীনেশরঞ্জন দাস’।

যজ্ঞের নাম ‘কল্লোল’।

যজ্ঞটি আয়োজন সাহিত্যেকে ধরে পথ খুঁজে নেয়ার জন্য। এক ঝাঁক তরুণ তাঁদের সেই  অবারিত দুয়ার আমন্ত্রণে  সাড়া দিয়েছিলেন। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব!

কাজী নজরুল ইসলাম, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবোধ দাশগুপ্ত,  সুবোধ রায়,শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ,পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়,ধীরাজ ভট্টাচার্য, নৃপেনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , নলিনীকান্ত সরকার, সোমনাথ, বিজয় সেনগুপ্ত, প্রমথ চৌধুরী,  মনীশ ঘটক, আশু ঘোষ, বিজ্য সেনগুপ্ত,  বুদ্ধদেব,  অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, তারাশংকর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, শিবরাম, মোহিতলাল মজুমদার… অনেকে  বাদ পড়ে গেলেন, তাঁদেরকেও আনব ক্রমান্বয়ে।

‘সুবোধ দাশগুপ্ত’  কল্লোল নিয়ে বলেছিলেন,

“অনেক পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছিলাম, কিছু ছাপা হলো, কিছু হলো না।” কিন্তু, কল্লোল থেকে অমনোনীত করলেও আলাদা পোস্ট কার্ড এসেছিল যাতে লেখা ছিল, “দয়া করে আমাদের অফিসে আসেন একদিন আলাপ করতে” যার মানে লেখা ‘অযোগ্য’ হয়েছে  কিন্তু ‘লেখক’ অযোগ্য নয়”।

কী অদ্ভুত সুন্দর আর অন্যরকম কথা!

এমনই ছিল ‘কল্লোলে’র সুর বা স্পর্শ।

একটি পত্রিকা দিয়ে এক যুগ নির্মানের মূলমন্ত্র!

যা লেখা হয়েছে তার অসাড়তার থেকেও যা লেখা হবে তার সম্ভবনাই বেশি দেখা হতো সেখানে।

আর এই সুরটির রূপকার একজন ফুলের ব্যাপারি ‘গোকুলচন্দ্র’ তিনি ছবিও আঁকতেন, লিখতেন আর একজন জাত শিল্পী, অভিনেতা, লেখক ‘দীনেশরঞ্জন’।

১০/২ পটুয়াটোলা লেন।

ছোট্ট দোতলা বাড়ির একতলায় ছোট্ট বৈঠক্ষানায় কল্লোলের অফিস। একপাশে তক্তপোশ,  একটি আলমারি, বাকি অর্ধেকে সেক্রেটারিয়েট টেবিল।

‘দুটি চেয়ার’ আর কল্লোলের আভিজাত্য বা বিলাসিতা একটি ‘ক্যানভাসের ডেকচেয়ার’।

কল্লোলে সবাই কেন যেত?

‘শৈলজারঞ্জনে মুখোপাধ্যায়ের”র ভাষায়:

সে যুগে যত নতুন লেখক স্তব্ধ হয়ে ছিল তাদের সবার ভাষা  ছিল কল্লোল।

আর মানুষগুলোও ছিল তেমনি।

‘গোকুলচন্দের’ ভালোবাসার পাশেই ‘দীনেশরঞ্জন’…

নিবিষ্ট মনে ছবি এঁকে যাচ্ছেন, লেখা দেখছেন, ভালোবাসছেন,  নিজের টাকা না রেখে গোপনে দিয়ে দিচ্ছেন যার পকেট একদম খালি তার পকেটে।

আর ছিলেন কর্মচারী ‘মনীন্দ্র চাকী’।

অফিসের পাশে তার একচিলতে ঘর ছিল সব কল্লোলবাসীর আড্ডা থেকে শুরু করে ঘুমানোর আশ্রয় পর্যন্ত। নিয়মিত সময়ে ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ লেখা দিতে পারেননি, তাঁকে ধরে মনীন্দ্রর ঘরে আটকে দেয়া হলো, ব্যাস কবিতা লিখে দিলেন নজরুল।  ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র’ ঢাকা থেকে ফিরে কোথায় থাকবেন? মনীন্দ্রর ঘর। এমনি করে আশ্রয়ে,  প্রশ্রয়ে ‘কল্লোল’ ছিল এক খোলা হাওয়া, তাই বুঝি ‘যুগের’ তকমা পেয়ে গেছে ।

গুরুজনেরা নানান তত্ত্ব দিয়ে সেই সময়টাকে সাজাক আমার জানায় যুগটা যে চেহারা পাচ্ছে তা সৌহার্দ্য, আত্মীয়তা আর অদ্ভুত এক মনের টানের।

১। বিষের বাঁশি বাজাচ্ছে ‘নজরুল’ আর সেই সুরে সবার সুরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে।
২। সেই যুগের শুরুটা তাই ‘বিরুদ্ধবাদ’ আবার ‘ভাব বিহ্বলতা’।
৩। আদর্শবাদী যুবকেরা প্রতিকুল জীবনের যন্ত্রনা মেটাতে বারবার যাচ্ছে ‘সাহিত্যের’ কাছে।

কাছেই মহাকাল মানে ‘রবীন্দ্রনাথ’ যাকে অগ্রাহ্য করেনি ‘কল্লোল’।

‘রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে কল্লোলের যাত্রা’- এই কথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আজকের মতো শেষ করছি। ‘বিরুদ্ধতা’ দিয়ে নবজাগরণ দূরের কথা ‘জাগরন’ই সম্ভব না আর এ তো ‘নব জাগরণের’ গল্প! হ্যাঁ ‘বিরুদ্ধতা’ ছিল, সে প্রসঙ্গও আসবে, তবে সেখানেও শিল্প ছিল।

আরও পত্রিকা এসেছিল এরপরে, ‘উত্তরা’, ‘কালি কলম’,’শনিবারের চিঠি’, ‘প্রগতি’, ‘কবিতা’, ‘মহাকাল’, ‘বিচিত্র’ আরও অনেক। কোনোটিই ফেলে দেয়া যায় না, কোনোটিই বাতিলের দলে নয়।

শুরু করেছিলাম ‘পঞ্চপাণ্ডবের’ কথা বলব বলে কিন্তু পড়তে পড়তে দেখছি, মহাভারতের শুরু যেমন অনেক পেছন থেকে এই গল্পগুলোও তেমনি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়  “তীরটা ছুঁড়ে দেয়ার আগে পিছিয়ে নিচ্ছি”।

(চলবে) পরের পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

সহায়ক গ্রন্থতালিকা: অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, ক্লিনটন বি সিলি ইত্যাদি লেখকের গ্রন্থসমূহ।