আমরা অধীর আগ্রহে জেমস ওয়েব দুরবিনের উৎক্ষেপণ ও তার অভীষ্ট বিন্দুতে স্থাপনের অপেক্ষা করছি। জেমস ওয়েব যেমন জটিল একটি যন্ত্র যথাযথভাবে তাকে স্থাপনা করা তেমনই কঠিন। আর কোনো সময় মহাকাশবিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে কোনো দুরবিন পাঠাতে এতটা নার্ভাস হননি।

জেমস ওয়েব দুরবিনের বাজেট:
মানুষের বিজ্ঞান চিন্তা ভাবনার প্রকৌশলগত প্রয়োগ যে কত উন্নত হতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি জেনিভায় অবস্থিত বৃহৎ হ্যাড্রন কলাইডারে (LHC) যেখানে হিগস কণা আবিষ্কার হয়েছে, কিংবা LIGO ডিটেকটরে যেখানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিরূপিত হয়েছে। এই বছর মহাকাশে স্থাপিত হতে যাচ্ছে জেমস ওয়েব দুরবিন যা কিনা এই জটিল প্রকৌশলের ধারাকেই বজায় রাখবে। দুরবিনটির নাম দেয়া হয়েছে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত নাসার পরিচালক জেমস ওয়েবের নামে যার অধীনে চন্দ্রাভিমুখী অ্যাপোলো প্রোগ্রাম সাফল্য লাভ করে। ১৯৯৬ সনে হাবল পরবর্তী একটি দুরবিনের ভাবনা শুরু হয়, ভাবা হয়েছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলারে এটিকে বাস্তবায়িত করা যাবে, ২৫ বছর পরে এটির বাজেট ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অনেক জ্যোতির্বিদ তাই এই দুরবিনটির নাম দিয়েছেন ‘দুরবিন যা জ্যোতির্বিদ্যাকে খেয়ে ফেলেছে,’ কারণ এটির ফান্ডিং করতে গিয়ে জ্যোতির্বিদ্যার বাকি অংশগুলো কোন সাহায্য পাচ্ছে না। তবু এই দুরবিনটিকে যদি তার উদ্দিষ্ট্য জায়গায় স্থাপন করে সেটিকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা যায় তবে সেটি আমাদের মাহাজাগতিক জ্ঞানকে বর্ধিত করবে বহু গুণ, তখন ১০ বিলিয়ন ডলারের খরচ হয়তো অন্যান্য জ্যোতির্বিদরা মেনে নেবেন।

সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সি:
১৯৯০-এর দশকে হাবল দুরবিন যখন পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্তের গ্যালাক্সিসমূহের প্রতিচ্ছবি ধারণ করছিল, তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা আর একটি দুরবিনের কথা ভাবছিলেন যেটি হাবল যে দুরত্ব বা যে সময় পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে তার থেকেও দূরবর্তী গ্যালাক্সি আবিষ্কার করতে পারবে। ব্যাপারটা সহজ নয়, কারণ মনে রাখতে হবে যে, হাবল বা জেমস ওয়েব যে দূরত্বের গ্যালাক্সির প্রতিচ্ছবি ধারণ করতে চাইছে সেই সময় গ্যালাক্সিগুলো সবেমাত্র দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বিগ ব্যাং হবার পরে কয়েক লক্ষ বছর ধরে মহাবিশ্বের ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে আলোর কণা, অর্থাৎ ফোটন, মুক্ত ইলেকট্রন কণার সঙ্গে ক্রমাগতই বিচ্ছুরিত হয়ে (আঘাত করে) প্রোটন কণার দঙ্গল থেকে বের হতে পারছিল না। চার লক্ষ বছর পরে মহাবিশ্ব, প্রসারণের ফলে, তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা হলে (৩০০০ কেলভিনের মত), ইলেকট্রন প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গড়ে তুলত পারল আধানবিহীন নিউট্রাল হাইড্রোজেন পরমাণু যা কিনা ফোটন কণার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম বিক্রিয়া করে। এইভাবে ফোটন বস্তুকণা থেকে মুক্ত হল এবং সেই ফোটনগুলোকে আমরা দেখি মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি (CMB) হিসেবে। আমরা যেদিকেই তাকাই না কেন এই ফোটন পটভূমি আমাদের ঘিরে রেখেছে।

চিত্র : মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে ইলেকট্রনের ঘনত্ব কমে এলে ফোটন মুক্তি পেল বিগ ব্যাং-এর ৩৮০,০০০ বছর পরে।

এর পরে মহাবিশ্ব আরো দ্রুত শীতল হতে থাকল এবং প্রথম তারারা সৃষ্টি হল। এরা মুলত অতিবেগুনী বা আলট্রাভায়োলেট আলোয় উজ্জ্বল ছিল এবং সেই বর্ণালির আলো চারপাশের নিউট্রাল হাইড্রোজেন পরমাণু খুব সহজেই শোষণ করে নিতে পারত। এর ফলে এইসব প্রথম তারারা আমাদের কাছে অদৃশ্য থাকার কথা, এই সময়টাকে অনেক জ্যোতির্বিদ ‘অন্ধকার যুগ’ নাম দিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে হাইড্রোজেন পরমাণু এই উচ্চ শক্তির আলো দিয়ে আয়নিত হয়ে যেতে থাকে, অর্থাৎ ইলেকট্রন খুইয়ে তার শুধু প্রোটন থাকে। এই আয়নিত হাইড্রোজেন বা প্রোটন আলো শোষণ ক্রতে পারে না। এর ফলে, বিগ ব্যাং-এর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি বছর পরে এইসব তারারা বা তাদের দিয়ে গঠিত গ্যালাক্সিগুলো দৃশ্যমান হতে পারে। তবে এর আগে নিউট্রাল হাইড্রোজেন সে সব আলোর তরঙ্গই শোষণ করে নেবে তাই নয়, কিছু উচ্চ শক্তির তরঙ্গ শোষিত হবে না, এবং জেমস ওয়েব দুরবিনের সেগুলোকে শনাক্ত করার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ ‘অন্ধকার যুগের’ সময়ের তারা বা গ্যালাক্সি দেখার একটা সম্ভাবনা আছে।

চিত্র: মনে করা হয় হাইড্রোজেন গ্যাস আয়নিত হবার পরে প্রথম সৃষ্ট গ্যালাক্সিরা দৃশ্যমান হবে।

হাবল দুরবিন দিয়ে আবিষ্কৃত দূরবর্তী গ্যালাক্সি নিয়ে কিছু কথা:
হাবল দুরবিন দিয়ে সবচেয়ে দুরবর্তী যে গ্যালাক্সি আবিষ্কার করা গেছে তার নাম হল GN-z11। এটির লাল সরণ (red shift) পাওয়া গেছে ১১-র কাছাকাছি। অর্থাৎ কার্বন পরমাণু থেকে নির্গত 0.১৯ মাইক্রোমিটারের অতিবেগুনী বর্ণালি রেখা আমরা শনাক্ত করছি ২.২৮ মাইক্রোমিটার অবলোহিত বা ইনফ্রারেড তরঙ্গে। আধুনিক সময়ের মহাজাগতিক মডেল অনুযায়ী গ্যালাক্সিটি থেকে আলো বিগ ব্যাং-এর চার শ মিলিয়ন বছর পরে নির্গত হয়েছে এবং আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে দীর্ঘ ১৩.৩ বিলিয়ন বছর চলার পরে। বোঝাই যাচ্ছে যত দূরের গ্যালাক্সি হবে তার লাল সরণ তত বেশি হবে, এবং অতিবেগুনী তরঙ্গ অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে দেখা দেবে। কাজেই দুরবিনদের অবলোহিত তরঙ্গে সংবেদী হতে হবে। হাবল দুরবিনের NICMOS ক্যামেরা ০.৮ থেকে ২.৪ মাইক্রোমিটারে কাজ করছে, কিন্তু আরো দূরবর্তী গ্যালাক্সির জন্য দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ডিটেকটর দরকার – জেমস ওয়েব দুরবিনের তরঙ্গ বিস্তার হবে ০.৬ থেকে ২৮.৫ মাইক্রোমিটার।

চিত্র – হাবল দুরবিন দিয়ে তোলা মহাশূন্যের দুরবর্তী অংশের ছবি। GN-z11 গ্যালাক্সিটি বড় করে দেখানো হচ্ছে।

চিত্র: GN-z11 গ্যালাক্সি থেকে আলো ১৩.৩ বিলিয়ন পরে আলাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে সেটির কার্বন থেকে নির্গত অতিবেগুনি (আলট্রাভায়োলেট) আলো দেখা যায় অবলোহিত (ইনফ্রা-রেড) তরঙ্গে।

GN-z11 থেকে আলো ১৩.৩ বিলিয়ন বছর আগে রওনা দিলেও এর অর্থ এই নয় যে, এই গ্যালাক্সিটির বর্তমান দূরত্ব ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ, কারণ যে আলো আমরা আজ দেখছি সেটি বিকিরণের সময় এই গ্যালাক্সিটি ‘আমাদের’ অনেক কাছে ছিল (যদিও পৃথিবীর তখন জন্ম হয় নি), এবং ‘এই মুহূর্তে’ সেটার দূরত্ব ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের অনেক বেশী হবে। স্থানের (বা দেশের) প্রসারণের জন্য মহাকাশবিদ্যায় দূরবর্তী গ্যালাক্সিদের ‘বর্তমান’ দূরত্ব নির্ধারণ করা তুলনামূলকভাবে জটিল। একটি সমতল মহাবিশ্বে GN-z11’এর ‘বর্তমান’ দূরত্ব হবে ৩২ বিলিয়ন আলোকবর্ষের কাছাকাছি। এবং গ্যালাক্সিটি তুলনায় আলোর গতির চাইতে বেশি বেগে সরে যাচ্ছে এবং ‘এই মুহূর্তে’ তার থেকে যে আলো নির্গত হচ্ছে তা আমরা কোনোদিনই দেখতে পাবো না।
[কেন আবিষ্কৃত সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সির দূরত্ব বর্তমানে ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ নয়? এই আলোচনাটি পরিশিষ্টে দেয়া হল]

জেমস ওয়েব দুরবিনের সংবেদনশীলতা:
জেমস ওয়েব দুরবিনের প্রাথমিক আয়নার ব্যাস হবে ৬.৫ মিটার, হাবলের ছিল ২.৪ মিটার। এর ফলে নতুন দুরবিনের ক্ষেত্রফল হাবলের সাত গুণ বেশি হবে, অর্থাৎ এটির আয়নাতে তারা বা গ্যালাক্সির আলো অনেক বেশী পরিমাণে প্রতিফলিত হবে। ০.৬ থেকে ২৮.৫ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে জেমস ওয়েব দুরবিন ওয়েব হাবল, GEMINI, Sofia, Spitzer প্রমুখ অবলোহিত দুরবিন থেকে ১০ থেকে ১০,০০০ গুণ বেশি সংবেদনশীল হবে। বলা হচ্ছে যে চাঁদের দুরত্বে রাখা একটি মৌমাছি থেকে বিচ্ছুরিত তাপ এই দুরবিনটি শনাক্ত করতে পারবে। কিন্তু এই সাফল্য অর্জন করতে জেমস ওয়েব দুরবিনের জন্য বেশ কয়েকটি দুরূহ প্রকৌশলগত উদ্ভাবন করতে হয়েছে, নিচে একে একে সেইগুলি লিখছি।

লাগ্রাঞ্জ বিন্দু:
প্রথমত – জেমস ওয়েব দুরবিনটিকে স্থাপন করা হবে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে – L2 লাগ্রাঞ্জ বিন্দুতে। ১৭৭২ সনে ইতালীয় বিজ্ঞানী জোসেফ-লুই লাগ্রাঞ্জ গণনা করে বার করলেন যে, একটি সিস্টেমে যদি দুটি বড় বস্তু মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, তবে সেখানে পাঁচটি বিন্দু পাওয়া যাবে যেখানে তৃতীয় কোনো বস্তু রাখলে অপর দুটির তুলনায় সেটি একই স্থানে স্থিত থাকবে। L2 বিন্দুটি হল পৃথিবীর পেছনে, সূর্যের থেকে দূরে, মনে হতে পারে ওই বিন্দুতে কোনো কিছু রাখলে তার গতিবেগ পৃথিবী থেকে কম হবে, কিন্তু সূর্য ও পৃথিবীর যৌথ আকর্ষণ ওই বিন্দুকে পৃথিবীর সঙ্গেই সূর্যের চারদিকে ভ্রমণ করায়। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২১-এ দুরবিনটি দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে একটি Arianne-5 রকেট মাধ্যমে উৎক্ষেপন করা হবে এবং L2 বিন্দুর কাছাকাছি পৌঁছাতে প্রায় এক মাস সময় লাগবে। তবে জেমস ওয়েব L2 বিন্দুতে স্থিত থাকবে না, L2 থেকে কয়েক লক্ষ কিলোমিটার দূরে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে। দুরবিন-উপগ্রহের ছোট রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে এটিকে এমন কক্ষপথে রাখা হবে তাতে মনে হতে পারে সেটি L2 বিন্দুকে প্রদক্ষিণ করছে।

চিত্র: L2 লাগ্রাঞ্জ বিন্দুটি পৃথিবী থেকে ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

চিত্র: এই চিত্রে L2 বিন্দুকে ঘিরে জেমস ওয়েবের কক্ষপথ দেখালেও কার্যত দুরবিনটি সূর্যের চারদিকেই একটি পথ অনুসরণ করবে।

পৃথিবী থেকে এত দূরে থাকার কারণে দুরবিনটি কাজ না করলে সেটিকে নভোচারী পাঠিয়ে সেটিকে ঠিক করার কোনো উপায় নেই। তবে L2 নিয়ে জ্যোতির্বিদদের ভাল অভিজ্ঞতা আছে। NASAর মাইক্রোয়েভ সনাক্ত করার দুরবিন WMAP ও ESA’র হার্শেল, GAIA, Planck ইত্যাদি দুরবিন এইখানেই স্থাপন করা হয়।

সৌর ঢাল ও হিমায়ক:
আগেই উল্লেখ করেছি জেমস ওয়েব একটি অবলোহিত তরঙ্গের দুরবিন, অবলোহিত তরঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হলে দুরবিনটিকে যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা রাখতে হবে, ৫০ কেলভিন মত তাপমাত্রায়। অবলোহিত তরঙ্গ হল তাপ তরঙ্গ, যে কোনো বস্তু অবলোহিত তরঙ্গে বিকিরণ করে, এই ক্ষেত্রে দুরবিনটি এবং সেগুলোর ডিটেকটর যন্ত্র থেকেও বিকিরণ বের হবে, সেই বিকিরণের মাত্রা কমাতে শীতলতার প্রয়োজন। হাবল দুরবিন পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫৭০ কিলোমিটার ওপরে ভ্রমণ করে, এই উচ্চতায় তাপ বিকিরণ করে কোনো দুরবিনকে ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল। অন্যদিকে L2 বিন্দুতে পৃথিবী ও সূর্য একই দিকে থাকবে, এর ফলে জেমস ওয়েব দুরবিনের জন্য একদিকের পুরোটা আকাশই খোলা থাকবে, শুধু সূর্য ও পৃথিবীর তাপ এড়ানোর জন্য সেটির একটি সৌর তাপীয় ঢাল (Sun Shield) লাগবে। তাপীয় ঢাল নিয়োজিত করা একটা কঠিন ব্যাপার, কিন্তু তার আগে প্রকৌশলগতভাবে আর একটি কঠিন পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলি। জেমস ওয়েব দুরবিনটির ফোকাসে MIRI (Mid-infrared instrument) নামে একটি ডিটেকটর আছে যেটি ৫ থেকে ২৮ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করে। এই ডিটেকটরটি হল একটি সিলিকন-আরসেনিকের যৌগ যেটিকে ঠিকমত কাজ করাতে হলে, ৫০ কেলভিন নয়, পরম শূন্যতার মাত্র ৭ কেলভিন ওপরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। এর জন্য হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করে সক্রিয় একটি হিমায়ক (ক্রায়োকুলার) কাজ করবে, কিন্তু সেই হিমায়ক আবার কিছুটা কম্পন সৃষ্টি করবে এবং সেই কম্পনকে থামাবার জন্য বিজ্ঞানীদের আবার বিশেষ প্রকৌশল উদ্ভাবন করতে হয়েছে।

সৌর তাপের বিরুদ্ধে ঢালটির আকার হল ১৪ x ২১ বর্গ মিটার – একটি টেনিস কোর্টের সমান। এটি ক্যাপটন নামে এক ধরণের রাসায়নিক ফিল্ম দিয়ে তৈরি যা কিনা সহজেই তাপ শোষণ ও বিকিরণ করতে পারে। জেমস ওয়েবের তাপীয় ঢালটি পাঁচটি পাতলা স্তর দিয়ে তৈরি, প্রতিটি স্তর একটি মানব চুলের চাইতেও চিকন। এই ঢালটিকে ১২-বার ভাঁজ করে রকেটে ঢোকানো হবে এবং শুধুমাত্র L2 বিন্দুতে পৌঁছানোর পরে এক ঢালটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোটর দিয়ে ধীরে ধীরে খোলা হবে। এই ঢালটির ওপর জেমস ওয়েব দুরবিনের সাফল্য নির্ভর করছে, যদি কোনো কারণে মোটর আটকে যায় এবং ঢালটি পুরোপুরি খোলা না যায় তবে দুরবিনটি কোনো কাজেই লাগবে না।

বেরিলিয়াম আয়না:
এতো গেল সৌর তাপ থেকে মুক্ত রাখার ঢালের কথা। এবার আসি দুরবিনের মূল অংশ – আয়নাতে। জেমস ওয়েবের আয়না কাচের নয়, বরং বেরিলিয়ামের এবং তার ওপর একটি খুবই সূক্ষ্ন চিকন সোনার প্রলেপ দেয়া। বেরেলিয়ামকে বাছাই করা হয়েছে কারণ সেটি হাল্কা, কিন্তু অনমনীয়। এইজন্য জেমস ওয়েব দুরবিনের সামগ্রিক ভর হাবল থেকে কম। বেরেলিয়ামের ওপর সোনার প্রলেপের কারণ হল সোনা অবলোহিত তরঙ্গ খুব দক্ষতার সাথে প্রতিফলিত করতে পারে। ১৮টি ষড়ভূজাকৃতি ১.৩২ মিটার আকারের আয়নার অংশ একসাথে যুক্ত হয়ে ৬.৫ মিটার ব্যাসের একটি পূর্ণাঙ্গ আয়না তৈরি করবে। এত বড় ব্যাসের আয়না তো রকেটে ঢোকানো যাবে না, কাজেই এই ১৮টি ছোট আয়নাকেও ভাঁজ করে L2 বিন্দুতে পাঠানো হবে যেখানে সেগুলোকে একত্র করে বড় আয়নাটি গঠন করা হবে। সৌরীয় তাপীয় ঢালটি খোলার মত এটিও একটি প্রকৌশলগত কঠিন কাজ।

তিন আয়নার anstigmat:
জেমস ওয়েবের দুরবিনকে বলা হচ্ছে তিন আয়নার anstigmat। এটি প্রতিবিম্ব গঠনের তিনটি ত্রুটি (বা অপেরণ) ঠিক করে। একটি হল গোলাপেরণ (spherical aberration)। যদি আয়নাটি গোলীয় (spherical) হয়, তবে সেটির প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরাল আলো প্রধান অক্ষের বাইরে কোনো বিন্দুতে প্রতিফলিত হলে প্রধান অক্ষের ফোকাসে না পড়ে অন্য জায়গায় পড়তে পারে। এর ফলে প্রতিবিম্বটি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। প্রাথমিক বা মূল আয়নাটি গোলীয় না করে অধিবৃত্তীয় (parabolic) করা যায়, এতে গোলাপেরণ থেকে মুক্ত থাকা গেলেও কোমা ও অ্যাস্টিগমাটিজম থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। কোমা হল যখন দূর নক্ষত্রের আলো আয়নার প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরাল না হয়ে আয়নার ওপর আপতিত হয় এবং সব প্রতিবিম্বিত আলো আবার মূল ফোকাসবিন্দুতে মিলিত হয় না। আর অ্যাস্টিগমাটিজম হল যখন উলম্ব ও অনুভূমিকভাবে আপতিত রশ্মিরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ফোকাসবিন্দুর আশেপাশে এসে মেলে। জেমস ওয়েব দুরবিনটি ওপরের তিনটি ত্রুটিই সংস্কার করেছে মূল আয়নাটিকে তিনটি অংশে ভাগ করে।

চিত্র: তিন অংশে বিভক্ত anstigmat দুরবিন

চিত্র : গবেষণাগারে ভাঁজ করা জেমস ওয়েব দুরবিন

MIRI ডিটেকটর:
এবার জেমস ওয়েব দুরবিনের ডিটেকটরগুলি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। এর চারটি নিরূপক যন্ত্রের মধ্যে একটি মধ্য অবলোহিত তরঙ্গের (৫ থেকে ২৮ মাইক্রোমিটার) MIRI ডিটেকটরকে নিয়ে আগেই বলেছি যে সেটিকে খুবই শীতল তাপমাত্রায় রাখা দরকার। এটির অতি দূরের খগোল বস্তু শনাক্ত করা ছাড়াও আমাদের সৌর জগতের বাইরে বহিঃগ্রহ আবিষ্কারের এবং মোটা মাত্রায় কিছুটা বর্ণালি বিশ্লেষণের ক্ষমতা আছে। বহিঃগ্রহ আবিষ্কারের জন্য MIRI করোনাগ্রাফ নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করবে যেটি কেন্দ্রীয় তারাটির আলো মাস্ক দিয়ে ঢেকে দিয়ে তারাটির কক্ষপথের গ্রহ থেকে বিকিরিত অবলোহিত তরঙ্গের খোঁজ করবে।

চিত্র: ১০০ দিন ভ্যাকুয়াম চ্যাম্বারে মহাশূন্যের শীতল তাপমাত্রায় পরীক্ষা শেষ হবার পরে দুরবিনের আয়নাগুলোকে বের করা হচ্ছে।

NIRCam:
NIRCam (Near Infrared Imager) কাজ করবে ০.৬ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত। ০.৬ মাইক্রোমিটার হল ৬০০ ন্যানোমিটার যা কিনা লাল-কমলা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য, কাজেই এই ডিটেকটরটি দৃশ্যমান আলোয় ছবি তুলতে সক্ষম হবে। NIRCam-এর প্রথম কাজটি হল জেমস ওয়েব দুরবিনটি কক্ষপথ স্থাপন করার পরে উজ্জ্বল নক্ষত্র থেকে আগত আলোকতরঙ্গের দশা (phase) নির্ধারণ করে আয়নাটির ১৮টি অংশকে একীভূত করা (যাতে ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবিম্ব না সৃষ্টি হয়)। প্রতিটি ছোট আয়নার পেছনে বেশ কয়েকটি মোটর (actuator)এই কাজটি সমাধা করবে। এর ফলে সমস্ত আয়নার তলটির একটি অংশ আর একটি অংশ থেকে খুব বেশি হলে কয়েক ন্যানোমিটার কম বেশ হতে পারে (আমাদের চুলের প্রস্থ ২৫,০০০ ন্যানোমিটারের মতন)। এই ডিটেকটরটিও প্রথম সৃষ্ট খগোল বস্তুদের নিরীক্ষণ করবে, এছাড়া অন্য সৌর জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেবে। NIRCam পারদ-ক্যাডমিয়াম-টেলুরাইড (HgCdTe) যৌগ দিয়ে তৈরি একটি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলবে, কিন্তু সেটির পূর্বে আলোকরেখাকে ফোকাস করার জন্য লিথিয়াম ফ্লোরাইড, বেরিয়াম ফ্লোরাইড ও জিঙ্ক সেলেনাইডের লেন্স ব্যবহার করবে।

চিত্র : NIRCam ডিটেকটরের একটি অংশ – HgCdTe ক্যামেরা

NIRSpec & FGS-NIRISS:  
NIRSpec (Near Infrared Spectrograph) ডিটেকটরটির কাজ হবে ০.৬ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত আগত তরঙ্গের বর্ণালি বিশ্লেষণ। ১ ন্যানোমিটারেরও কম সূক্ষ্মতায় ১০০টি খগোল বস্তুর বর্ণালি এটি সমান্তরালভাবে তৈরি করতে পারে। চতুর্থ নিরূপক যন্ত্রটি হল FGS-NIRISS (Fine Guidance Sensor and Near Infrared Imager and Slitless Spectrograph)। এটির একটি কাজ হল কোনো নির্দিষ্ট তারাকে দৃষ্টিগোলকের মধ্যে রেখে সেই তথ্যকে জেমস অয়য়েব উপগ্রহটির ACS (Attitude Control System) ব্যবস্থাকে জানানো যাতে দুরবিনটি আকাশের একটি নির্দিষ্ট দিকে স্থিত করা যায়।

ইলেকট্রনিক বাস:
মহাশূন্যে স্থাপিত দুরবিনটিকে যথাযতভাবে পরিচালনার জন্য একটি ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা দরকার যাকে ‘বাস’ (Bus) বলা হয়। এটির কাজ হল (১) সমস্ত বৈদ্যুতিক শক্তি বিতরণের ব্যবস্থা করা, (২) উপগ্রহটির দিক নির্ধারণ ও পরিবর্তন করা (attitude control), (৩) ডিটেকটর যন্ত্র থেকে তথ্য আহরণ করা, (৪) পৃথিবীর সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করা, (৫) উপগ্রহের ছোট রকেট ব্যবস্থা পরিচালনা করা এবং (৬) সামগ্রিক তাপ নিয়ন্ত্রণ করা। বাসটিকে উপগ্রহের যেদিকটা সূর্যের দিকে মুখ করা সেদিকে স্থাপন করা হবে, এটি ৩০০ কেলভিন তাপমাত্রায় কাজ করবে। বাসটির কম্প্যুটারে মাত্র ৬০ গিগাবাইট সলিড স্টেট মেমরি আছে। আমাদের কাছে এটা খুব কম মেমরি মনে হতে পারে, কিন্তু আবার মনে রাখতে হবে জেমস ওয়েব দুরবিনের ওপর অন্তত ২০ বছর ধরে কাজ হচ্ছে, কাজেই ব্যবস্থাপকদের কী ধরণের কম্প্যুটার ব্যবস্থা হবে সেটা অনেক আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হয়েছে এবং সেটা সেই সময়ের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। এছাড়া এই ধরণের মেমরির মহাশূন্যের উচ্চ শক্তির কণা-বিকিরণের ধ্বংসাত্মক আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে যেটা ওই ৬০ গিগাবাইট মেমরির আছে। তবে এই জন্য প্রতিদিন কয়েকবার করে সমস্ত আহরিত তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়ে মেমরিকে শূন্য করে দিতে হবে।

চিত্র : জেমস ওয়েব দুরবিনের বিভিন্ন অংশ

অ্যান্টেনা:
আর পৃথিবীকে তথ্য পাঠানোর উপায় কী? জেমস ওয়েব দুরবিনে একটি উচ্চ-শক্তির (high-gain) অ্যান্টেনা ও একটি মধ্য-শক্তির (medium-gain) অ্যান্টেনা আছে। উচ্চ-শক্তির অ্যান্টেনাটিকে পৃথিবীতে অবস্থিত কোনো বড় গ্রহণকারী অ্যান্টেনার দিকে তাক করতে হয়, অন্যদিকে মধ্য-শক্তির অ্যান্টেনাটির থেকে বিকিরিত তথ্য একটি বড় জায়গাজুড়ে অনেক গ্রাহক অ্যান্টেনার কাছে পৌঁছাতে পারে। উচ্চ-শক্তির অ্যান্টেনাটি 0.6 মিটার Ka ব্যান্ডে এবং মধ্য-শক্তির অ্যান্টেনাটি 0.2 মিটার S ব্যান্ডে কাজ করে।

সৌর প্যানেল:
জেমস ওয়েব উপগ্রহের সমস্ত ব্যবস্থা চালানোর জন্য প্রায় দুই হাজার ওয়াট ক্ষমতা লাগবে, সেটি পুরোপুরিই আসবে সৌরীয় প্যানেল থেকে। ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের ৫-টি প্যানেলকেও উৎক্ষেপণের পরে খুলতে হবে।

অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ:
NASA, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি-এর (CSA) ১০০০-এর বেশি মানুষ এই দুরবিনের ওপর কাজ করেছে। এর সাথে যুক্ত করতে হবে Northrop Grumman, Lockheed Martin ও Ball Aerospace-এর মত কোম্পানিকে, আর আছে বহু বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার জন্য অধ্যাবসায়, ত্যাগ ও অনুপ্রেরণার প্রয়োজন, জেমস ওয়েব দুরবিনের সৃষ্টি এরই একটি নিদর্শন। ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে উৎক্ষেপণ, L2 বিন্দুর কাছাকাছি স্থাপন এবং সৌরীয় প্যানেল, সৌর-তাপীয় ঢাল, দুরবিনের ১৮টি অংশের অংশের যথার্থ নিয়োজন অতি সূক্ষ্ম প্রকৌশলের সার্থকতা নিদর্শন হবে। আমাদের আশা এই দুরবিনটি এই প্রতিটি দুরূহ পর্যায় অতিক্রম করে আমাদেরকে মহাশূন্যে দূরতম প্রান্ত থেকে তথ্য এনে দেবে, তেমনই নক্ষত্রের জন্ম বা বহিঃগ্রহ সম্পর্কের আমাদের জ্ঞান বহুগুণ বর্ধিত করবে। শুভকামনা, জেমস ওয়েব দুরবিন!!

পরিশিষ্ট:
কেন আবিষ্কৃত সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সির দূরত্ব বর্তমানে ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ নয়?
প্রথমতঃ যখন ওই গ্যালাক্সি থেকে আলো রওনা দিয়েছিল তখন সেই গ্যালাক্সি ও আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির মধ্যে দূরত্ব ছিল ২.৬৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষের মত। এটা কীভাবে আমরা গণনা করছি সেটা পরে বলছি। সেই গ্যালাক্সি থেকে আলোর কণিকারা যত পৃথিবীর দিকে আসবে মধ্যের স্থানের প্রসারণ ক্রমাগত হতেই থাকবে। কাজেই আলোকে সেই সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে সাঁতড়াতে হবে। আমি একটা নদী সাঁতড়ে পার হতে চাই, কিন্তু সাঁতড়ানোর সময় দেখি ঐ পাড় আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, পেছন ফিরে দেখি যে পাড় থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেই পাড়ও দূরে চলে যাচ্ছে। তাই ফোটনদের ৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের বদলে ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ লাগবে আমাদের কাছে পৌঁছাতে। ততদিনে উৎসের গ্যালাক্সিটি দূরে সরে গিয়ে পৃথিবী থেকে ৩২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করবে। আমাদের দুরবিনে সেই গ্যালাক্সির যে আলো দেখছি সেটা ১৩.৩ বিলয়ন বছর আগে গ্যালাক্সিটির কী অবস্থা ছিল তাই দেখাচ্ছে। স্থানের স্ফীতির ফলে এর মধ্যে আবার ফোটনেরও তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়েছে যার ফলে তার রেড শিফট বা লাল সরণ হয়েছে। অতিবেগুনী তরঙ্গে যে ফোটনের সৃষ্টি হয়েছিল স্থান সম্প্রসারণের ফলে তাকে অবলোহিত তরঙ্গে দেখছি।

GN-z11 গ্যালাক্সির লাল সরণ বা z হচ্ছে 11.09। কাজেই সেই গ্যালাক্সির যে আলো আমরা আজ দেখছি সেটা সেই গ্যালাক্সি থেকে যখন বেড়িয়েছে তখন মহাবিশ্বের ব্যাস আজ থেকে z + 1 = 11.09 + 1 = 12.09 বা 12.1 গুণ ছোট ছিল। পরবর্তী গণনাগুলির জন্য আমাদের মহাবিশ্বের একটা মডেল ঠিক করতে হবে। এটার জন্য জ্যোতির্বিদরা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা সমীকরণের ফ্রিডমান সমধান ব্যবহার করেন। মহাবিশ্বের মডেল বিভিন্ন প্যারামিটারের ওপর নির্ভর করে। আপাততঃ আমরা চারটা প্যারামিটার ঠিক করি – লাল সরণ, হাবল ধ্রুবক, বস্তুর (ডার্ক ম্যাটার বা তমোবস্তুসহ) পরিমাণ ও ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ। আমাদের মহাবিশ্বের দেশ-কালের মেট্রিক হবে সমতল, অর্থাৎ আলো এই মহাবিশ্বে স্থানীয় বিচ্যুতি বাদ দিলে মোটামুটি ভাবে সরলরেখায় ভ্রমণ করবে। যদি হাবল ধ্রুবক ৭০, বস্তুর পরিমাণ ২৭% ও কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ ৭৩% ধরা হয়, তবে এই মহাবিশ্বের বয়েস হবে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। এই মডেলে বিগ ব্যাং-এর ৪১২ মিলিয়ন বছর পরে সেই সুদূর গ্যালাক্সি থেকে আলোর যাত্রা শুরু হয়। সেই গ্যালাক্সির ‘কো-মুভিং’ বা ‘বর্তমান’ দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ৩২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। তাহলে যে আলো আমরা আজ দেখছি সেটা যখন সেই গ্যালাক্সি থেকে বেড়িয়েছিল তখন আমাদের আজকের অবস্থান ও সেই গ্যালাক্সির মধ্যে দূরত্ব ছিল ৩২/১২.১ বা প্রায় ২.৬৫ বিলিয়ন আলোকবছরের মত। সেই ২.৬৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ফুলে ফেঁপে আজ ৩২ বিলিয়ন হয়েছে। এর মধ্যে মহাবিশ্বের ১৩.৩ বিলিয়ন বছর বয়েস বেড়েছে।

চিত্র: মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুর স্থানের প্রসারণের সাথে সাথে 13.3 বিলিয়ন বছরে যে গ্যালাক্সি আমাদের 3 বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে ছিল তা 32 বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে।

আমরা কি তাহলে ঐ গ্যালাক্সীর থেকে দূরবর্তী কোন বস্তু এর আগে অবলোকন করি নি? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ! করেছি। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রায় শেষ প্রান্ত থেকে আগত আলো আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। সেই আলো গ্যালাক্সীর মত কোন একক বস্তু থেকে আসছে না, সে আলো আসছে আমাদের চারপাশ ঘিরে মহাবিশ্বের যে আপাতঃ ‘সীমানা’ সেইখান থেকে। একটু আগে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি (CMB বা অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ) নিয়ে যে আলোচনা করলাম সেটিই হল সবচেয়ে দূরবর্তী বিকিরণ। সেই ফোটন যখন বিকিরিত হয়েছিল তখন মহাবিশ্বের ব্যাস আজ থেকে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট ছিল। এর মধ্যে মহাবিশ্বের ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে এই সিএমবি ফোটনের তাপমাত্রা তাদের আদি 3000 কেলভিন থেকে 2.7 কেলভিনে নেমে এসেছে।

বলা যায় সিএমবি’র প্রতিটি ফোটন মহাশূন্যের শেষ প্রান্ত থেকে এসেছে। আমরা যাই করি না কেন আমরা সেই অস্বচ্ছ ‘দেয়াল’ পার হতে পারব না, অর্থাৎ বিগ ব্যাংএর ৩৮০,০০০ বছরের মধ্যে কী হয়েছিল তার কোন সম্যক ছবি আমরা পাব না যদিও নিউট্রিনো পটভূমি বলে একটা জিনিস আছে যার সূত্রপাত হয়েছে বিগ ব্যাংএর প্রথম ১০ সেকেন্ডের মধ্যে, সেই আদি নিউট্রিনোর সন্ধান এখনও পাওয়া যায় নি। কিন্তু তারও আগে মহাবিশ্বের শুরুতে যদি অতিস্ফীতি (inflation) হয়ে থাকে তাতে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ছাপ রয়ে যাবে CMBর মানচিত্রে। বিজ্ঞানীরা তারও সন্ধান করে যাচ্ছেন।

এই ‘দেয়ালটা’ কি সত্যি একটা কিছু? এর উত্তরটা মহাজাগতিক অনেক কিছুর মতই একটু জটিল। প্রথমেই বলি আলোর গতির (সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার) সীমাবদ্ধতার জন্যই এই ‘দেয়ালের’ সৃষ্টি, আলোর গতি অসীম হলে আমরা মুহূর্তেই সমগ্র মহাবিশ্ব দেখে ফেলতাম। এমন কি সিএমবির এই অস্বচ্ছ দেয়ালও আমাদের জন্য বাধা হত না, কারণ ‘এখনই’ সেখানে যেতে পারলে সেই ‘দেয়াল’ থাকত না, যেমন আমরা যেখানে আছি সেখানে কোন ‘দেয়াল’ নেই।

চিত্র: আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব এক ঘন-বস্তুর অস্বচ্ছ দেয়াল দিয়ে আবৃত, যে দেয়াল থেকে CMB ফোটন বের হয়ে আসছে।

আমরা যদি কোন অলৌকিক উপায়ে সেই ‘এখনই’ দেয়ালে উপস্থিত হতে পারতাম তাহলে আমরা হয়তো দেখতাম সেই ‘দেয়ালের’ অবস্থানে অবস্থিত আমাদের মতই এক গ্যালাক্সি, আমাদের চারপাশের সাধারণ যেরকম গ্যালাক্সিতে সেরকম গ্যালাক্সিতে ভরপুর। আর সেখানে যদি আমাদের মত ‘বুদ্ধিমান’ প্রাণী থেকে থাকে, তারাও হ্য়তো দূরবীন লাগিয়ে আমাদের দেখছে, কিন্তু আমাদের গ্যালাক্সির বদলে তারা দেখছে সেই সিএমবি ‘দেয়াল’। তারা হয়তো কোনদিনই জানবে না বর্তমানের ছায়াপথের কথা, এই মুহূর্তে ছায়াপথ তাদের কাছ থেকে আলোর গতিবেগের চাইতে বেশি গতিবেগে সরে যাচ্ছে।

চিত্র: প্রতিটি গ্যালাক্সি সেটির দৃশ্যমান মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত।

দৃশ্যমান মহাবিশ্ব হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণের আওতাধীন মহাবিশ্ব, শুধুমাত্র গত ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের মধ্যে যে আলো আমাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, সেই আলো অবলোকনের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সীমানা রচিত। মহাবিশ্বের মধ্যে কোন বিশেষ অবস্থান নেই, মহাবিশ্বের কোনো কেন্দ্র নেই। প্রতিটি দর্শক তার নিজস্ব দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ‘কেন্দ্রে’ দাঁড়িয়ে আছে। সমগ্র মহাবিশ্ব কত বড় সেই সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে মহাবিশ্ব হয় অসীম, নইলে এতই বড় যা অসীমেরই নামান্তর মাত্র। অতিস্ফীতি তত্ত্ব (inflation) অনুযায়ী মহাবিশ্বের দেশ-কাল (space-time) সৃষ্টির পর-পরই, এক সেকেন্ড সময়ও যখন অতিবাহিত হয় নি, সেই দেশ-কাল মুহূর্তে স্ফীত হয়েছিল অভাবনীয় মাত্রায়। সেই স্ফীতি আমাদের মহাবিশ্বকে বিশাল আকার দিয়েছে আজ। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব সমগ্র মহাবিশ্ব বলে যদি কিছু থাকে তার একটা খুবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশমাত্র। আর কিছু কিছু তত্ত্বে আমাদের মহাবিশ্বে অতিস্ফীতি এক সেকেন্ডের আগে বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো শেষ হয় নি অনেক জায়গায়। এই তত্ত্ব প্রমাণ হলে মহাবিশ্ব অসীমই হবে। আর একটি কথা, সৃষ্টির আগে স্থান বা দেশ এবং সময় বলতে কিছু ছিল না। এটা এমন নয় যে স্থানের মধ্যে কিছুর বিস্ফোরণ হয়েছিল। আসলে স্থানের আবির্ভাব মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাথে সাথেই।

এবার বর্তমানে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ নিয়ে দু-একটা কথা বলে শেষ করি। CMB ফোটন দেয়ালের লাল সরণ হল প্রায় ১১০০’র কাছাকাছি। এই দেয়ালটা থেকে আমরা যে ফোটন দেখছি তা ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে রওনা হয়েছিল। ইতিমধ্যে মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ১১০০ গুণ বেড়েছে এবং বর্তমানে তার ব্যাসার্ধ প্রায় ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ হয়েছে। কাজেই যে CMB দেয়াল আজ আমরা দেখছি তা মাত্র ৪০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে ছিল আমাদের গ্যালাক্সির অবস্থান থেকে; আমাদের গ্যালাক্সি তখন সৃষ্টিই হয় নি। সেই ৪০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের দেয়াল থেকে নির্গত ফোটন আজ প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পরে আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে আর সেই দেয়াল এখন মহাবিশ্বের সামগ্রিক প্রসারণের ফলে আমাদের কাছ থেকে ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। সেই দেয়াল থেকে ‘এই মুহূর্তে’ নির্গত ফোটন আমরা কোনোদিনই দেখতে পাব না। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই জায়গার CMB ফোটন ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে রওনা হয়ে গেছে। সেই ফোটন এখন যেয়ে পৌঁছাচ্ছে আমাদের থেকে ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে যে গ্যালাক্সি আছে – সেইখানে!!