লিখেছেনঃ কাজী ফয়সাল হোসেন 

১৩ই অক্টোবর, ২০২১। কুমিল্লায় একটি পূজা মণ্ডপে হনূমানের কোলে কোরআন শরীফ রাখার খবর ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন পূজা মণ্ডপ এবং মন্দিরে হামলা করে। এই হামলায় নিহতের ঘটনাও ঘটেছে। এরই সূত্র ধরে এখনও বিভিন্ন যায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। এটা অতীতের কোন ঘটনা নয়। এটাই বর্তমান। এটাই ৫০ বছরের স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চিত্র। তবে এই চিত্র কি নতুন? না, বহু বছর ধরেই চলমানভাবে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। সব ঘটনার হয়তো সঠিক হিসেবও নেই। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে গণমাধ্যমে না আসা খবরও আমরা জানতে পারছি। ফলে হাজারো খারাপ খবর দেখে মনে হচ্ছে যে, দেশ তো দিনদিন রসাতলে যাচ্ছে। আসলে না। অনেক আগে থেকেই দেশ রসাতলেই আছে, নতুন করে যাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আগেও হত বলে আজন্মকাল একটা অন্যায় চলতে পারে না। বর্তমানের উন্নত সভ্য রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব নেই বললেই চলে। 

মধ্যযুগের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক । তখন গির্জাসহ বিভিন্ন উপসনালয়ের প্রধানগন ব্যাপক ক্ষমতা উপভোগ করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে তারা রাজার সমান্তরাল কর্তৃত্ব দাবি করতেন। রাজা শাসন করতেন পারবেন কি না তার নির্ধারকের ভূমিকাও এই ধর্মগুরুরা পালন করতেন। রাজা যদি ঈশ্বর কর্তৃক স্বীকৃত না হন, তবে তিনি শাসন করতে পারবেন না। আর ধর্মগুরুরা যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিনিধি তাই এই বিষয়গুলোতে তাদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। জনগনের মাথায় এই কথাগুলো ঢুকিয়ে তারা নিজেদের শক্ত অবস্থানকে ধরে রাখতেন। তাই রাজাকে এই ধর্মগুরুদের মনরক্ষা করে চলতে হত। মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের প্রথম রাজনৈতিক হিসেবে খ্যাত নিকোলো মেকিয়াভেলিই সর্ব প্রথম রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করেন। মেকিয়াভেলির মতে রাষ্ট্র আর রাজনীতিতে ধর্মের কোন স্থান থাকবে না। পরবর্তীতে ফরাসি বিপ্লবের জ্যা জ্যাক রুশো, ভলতেয়ারসহ বিভিন্ন মনিষীরা এই মতবাদকে আরও শক্তিশালী করেছেন। 

তবে মেকিয়াভেলি আরও কিছু মতবাদ ব্যক্ত করেছেন যার প্রচলন বর্তমানে খুব বেশি লক্ষণীয়। তার মতে, ধর্ম শুধু জনগনের জন্য। জনগণকে ধার্মিক এবং সৎ হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রের অগ্রগতি ব্যাহত হবে। কিন্তু শাসকের ধার্মিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে শাসক অবশ্যই ধার্মিক এবং নীতিবান হওয়ার ছল করবেন। ধর্মকে তিনি জনগণকে নিয়ন্ত্রনে রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। মেকিয়াভেলি তার বিখ্যাত “দি প্রিন্স” গ্রন্থটি তখনকার ফ্লোরেন্সের রাজা লরেঞ্জো ডি মেডিসির জন্য লিখেছেন যাতে রাজা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারেন। মূলত রাজাকে খুশি করার জন্যই এই মূল্যবান গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন। 

কিন্তু পূজা মণ্ডপে হামলার সাথে এর কি সম্পর্ক? সম্পর্ক খুবই সূক্ষ্ম কিন্তু বুঝতে পারলে তা পানির মতই স্বচ্ছ। এ অঞ্চলের ইতিহাস বলে যে ধর্মীয় বিষয়ে এখানে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা প্রচণ্ড বেশি। ব্রিটিশ শাসনামলে বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। কেউ বলে দাঙ্গা লাগে, কেউ বলে দাঙ্গা লাগানো হয়। সেসময়ে ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে রেখেছিল নিজেদের শাসনের সুবিধার্থে। সেই বৈষম্য সম্প্রদায়গুলোর অভ্যন্তরীণ রোষানলকে বাড়িয়ে দিয়েছিলো বহুগুণ। এখনকার সময়ের তুলনায় সেই সময় ছিল অনেক বেশি ভয়ানক। দেশভাগ আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে নিয়ে সাদাত হোসেন মান্টোর ভাবনার উদ্রেক করার মত অনেক ছোট গল্প আছে। কিন্তু সময় বদলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। কৃষ্ণগহ্বরের ছবিও আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কৃষ্ণগহ্বর আরও বেশি প্রগাঢ়। দিনেদিনে ধর্মান্ধতা কমার কথা ছিল। কিন্তু কমে নি। মানুষের মধ্যে ধর্মের প্রভাব কমেছে, ধর্মীয় আচার পালনের বিষয়ও কমেছে। ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় যেসকল নৈতিক বিধান আছে, যেগুলো প্রায় সকল ধর্মেই বিদ্যমান সেসব মানার প্রবনতাও কমেছে। কিন্তু ধর্মান্ধতা বেড়েছে। ধার্মিক না হয়ে, ধর্মের কিছু না জেনেও ধর্মান্ধ হওয়া যায়। আমাদের মধ্যে এই ধর্ম না মানা ধর্মান্ধদের সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। খুব একটা কম সময় না। বেশ কয়েকটা প্রজন্ম পার হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। মানুষ এখন পড়তে লিখতে পারে। কিন্তু সুশিক্ষিত লোকজনের সংখ্যা বাড়ে নি। শিক্ষার কাজ কি শুধুই বাংলা ইংরেজি পড়তে লিখতে পারা? অংক করতে পারা? কেরানী তৈরি করা? হ্যাঁ, এগুলো শিক্ষার একটা অংশ যাতে করে আরও গভীর জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব হয়। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হল আলো আর আঁধারের পার্থক্য করতে পারা। শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে যৌক্তিকতার বিকাশ ঘটানো। 

হিন্দু-মুসলিম, ডানপন্থী-বামপন্থি তৈরি করা শিক্ষার কাজ নয় বরং সেই অন্তর্দৃষ্টি  আর জ্ঞান তৈরি করা যা একজন মানুষকে সচেতনভাবে নিজের ধর্মীয়, রাজনৈতিক মতাদর্শসহ জীবনের সকল স্তরে কুসংস্কারমুক্ত হয়ে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ঊর্ধ্বে গিয়ে সঠিক সিধান্ত নিতে সক্ষম করে তোলে। এই কারনেই আমাদের অঞ্চলে বিশেষ করে এই বঙ্গদেশে পড়তে লিখতে পারা লোকজনের পরিমাণ ঢের বৃদ্ধি পেলেও সুশিক্ষিত লোকজনের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কারন আমরা না বুঝে গরুর রচনা আর এইম ইন লাইফ পড়ে বড় হয়েছি। অংকের সূত্র মুখস্ত করেছি পরীক্ষায় পাশের জন্য, কিন্তু এর প্রয়োগক্ষেত্র জানতে পারি নি। সৃজনশীল মুখস্ত করে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে দেশে সৃজনশীলতার চাষ করছি। খাতায় বই বমি করলে শিক্ষকরা নাম্বার বেশি দিচ্ছেন, পাচ্ছি জিপিএ ৫। কিন্তু এই সিস্টেমে মস্তিস্ককে ধার দেয়ার জায়গা নেই, চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার ক্ষেত্র নেই। ফলে গতানুগতিক এবং কুসংস্কারে জর্জরিত আমাদের চিন্তাধারায় কোন পরিবর্তন আসছে না। 

সুশিক্ষার অভাবে সামাজিক পরিবর্তন খুব মন্থর গতিতে এগোচ্ছে আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। শিক্ষা হল আলো। আলো যেমন সবচেয়ে গতিশীল তেমনি শিক্ষাও আত্মিক অন্ধকারকে খুব দ্রুত জয় করতে পারে। যারা আমাদের মাথার ওপর বসে চরকি ঘোরাচ্ছেন , তারা আমাদের থেকে কিছু কম জানেন না বরং বেশিই জানেন। সরকার চাইলেই অনেক পরিবর্তন আনতে পারে, কিন্তু তারা সেটা করে না। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকার ধর্মকে ব্যবহার করেছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করেছে বিগত সরকারগুলো। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। আর অন্তঃসারশূন্য জাতি পেটের ক্ষুধা ভুলে এতেই খুশিতে আত্মহারা হয়েছে। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার করেছে ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধারনা জন্মেছিল যে এরশাদ ইসলামের বন্ধু। এ কারনে এরশাদের অন্য সকল অপকর্ম ম্লান হয়ে গিয়েছিলো তাদের কাছে। অথচ এই জনগন কখনও ভেবে দেখে নি যে এরশাদ ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক নন। এরশাদের পতন হলেও ধর্মীয় রাজনীতির এই ধারা অব্যাহত ছিল অন্যান্য সরকারের মধ্যেও। যার ফল এই বর্তমানের সংখ্যালঘু নিপীড়ন।

শাসক সবসময়ই ক্ষমতা রক্ষার জন্য যা কিছু জরুরি তাই করবেন। প্রয়োজনে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবেন, যে পরামর্শ কয়েক শত বছর পূর্বে নিকলো মেকিয়াভেলি দিয়েছিলেন। আমাদের দেশগুলোর সরকার ঠিক সেটাই করছে। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের পশ্চাৎপদতা দূর করবে; ফলে শাসকদের ধর্ম, বর্ণের রাজনৈতিক হাতিয়ার দুর্বল হয়ে পড়বে যা শাসকেরা কখনই হতে দেবে না। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, তারা সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারাকে লালন করছে। ফেসবুকে এরা সাম্প্রদায়িক এবং হীনমন্যতার বিষ ছড়াচ্ছে। “বিশ্ববিদ্যালয়” তার মাহাত্ম্য হারিয়ে পরিণত হয়েছে কূপমণ্ডূকদের আঁতুড় ঘরে। 

জেল, জরিমানা, লাঠিচার্জ ধর্মীয় সহিংসতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে পারে না, পারে না ধর্মীয় সম্প্রীতি আনতে। কিন্তু একমাত্র সুশিক্ষাই পারে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি দিতে।