একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং ট্রমার মধ্যে সময় পার করছি। গতকালের কুমিল্লা, চাঁদপুর আরও কয়েকটি জেলার মন্দির, প্রতিমা ভাংচুরের দুঃসহ দৃশ্য এবং এলাকার আতংকিত মানুষের কথা মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। ভুক্তভোগী হিন্দুদের মানসিক অবস্থা কী তা বলার অপেক্ষা রাখে না এবং আমার পক্ষে অনুধাবন সম্ভব নয়।

প্রতিবছর দুর্গার দুর্গতি শুরু হয় তার মূর্তি ভাংচুরের মাধ্যমে। এতদিন পর্যন্ত সেটা ভিজে মুড়ির মত হিন্দুদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমিও মাঝেমধ্যে মজা করে বলতাম হিন্দুদের উচিৎ দুই সেট প্রতিমা বানানো। একসেট নিজেদের পুজোর জন্য অন্যসেট ভাসুর পুতদের ভাংচুরের জন্য। এতে হিন্দুদের দুর্গাপুজোর পূণ্যও হলো আবার ভাসুর পুতদের মূর্তি ভাঙার সওয়াবও হলো। কী সুন্দর উইন উইন সমাধান দিয়েছিলাম। কিন্তু এবারের পুজোতে ভাসুর পুতরা ধর্মখেলায় সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড খেলে দিছে। এথনিক ক্লিনজিংয়ের একেবারে মোক্ষম দাওয়াই। হনুমানের কোলের উপর কোরআন! পরিকল্পনা মাফিক ভাইরালও হয়ে গেল, এরপর ছুটে এলে দলে দলে ভাসুরপুতের দল। মুহুর্তে তছনছ করে দিল কুমিল্লার নানুয়ার দিঘি পাড়ের অস্থায়ী মণ্ডপ। তৌহিদি ভাসুরপুতের ঈমানি জোস কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি, চিলের কান নিয়ে যাওয়ার মত সত্যমিথ্যা যাচাই-বাছাই না করেই গতকাল একযোগে হামলা করেছে চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ আরও কিছু জেলায়। যদিও দেশের কোন মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে সেসব সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে না।

ক্লাস ফোর, ফাইভের ইসলামধর্মের ধর্ম বইতে মূর্তি ভাঙার কথা লেখা আছে এবং কোমলপ্রাণ শিশুরা সেই শিক্ষা পায়। মসজিদ, মাদ্রাসায়ও মূর্তিপুজোর শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়। তদুপরি মিজানুর রহমান আজহারি, আবদুর রাজ্জাক, মাহমুদুল হাসান গুনভী ইত্যাকার বিভিন্ন ওয়াজি হুজুরের মাহফিলে মূর্তি ভাঙার ওয়াজ প্রচারিত হয়। হুজুর যখন চিৎকার করে বলে, “বলুন ঠিক কী না” তখন উপস্থিত ধর্মপ্রাণ সমস্বরে মূর্তি ভাঙার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করে। এই তো আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ধর্মচর্চার স্টাইল।

দুর্গাপুজোর ইতিহাস নিয়ে প্রতিবছর পুজোর শুরুতেই ফরহাদ মাজহার, সংকর্ষণ উপাধ্যায়, আরিফুজ্জামান তুহিন, কীনাকি শুয়োরাশ্চর্যদের মত কিছু জ্ঞানী লোক তাদের জ্ঞান প্রসব করেন। মাহমুদুল হাসান গুনভীর মত লোকরা যখন মূর্তি ভাঙার ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেয় তখন ফরহাদ মাজহারদের মত বামাতি লোকেরা দুর্গাপুজোর অসাড়তা তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণের চেষ্টা করে। তার ফলাফল এখন হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে। ফরহাদ মাজহার, শুয়োরাশ্চর্য আপনারা এখন খুশিতো! এদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশের ইন্ধন থাকতে পারে বলে মণ্ডপ ঘটনাকে নতুন মোড় দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরাম। শালারা চিন্তা করে কোন যন্ত্র দিয়ে আর হাগু করে কোন পথে ভেবে পাই না। কুমিল্লা, চাঁদপুরের অসাম্প্রদায়িক হামলার বিপরীতে এখন পর্যন্ত প্রশাসন থেকে কোন বিবৃতি ও প্রতিকার খুঁজে পাওয়া যায় নি। প্রশাসনের নিরবতা হিন্দু এথনিক ক্লিনজিংয়ের পথকে আরও সুপ্রসারিত করছে। ঘৃণার আগুন বড় অদ্ভুত জিনিস। অন্তসলীলে বয়ে যায়। ইউরোপের ইহুদি নিধনের আগেও এরকম ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি হয়েছিল। ঘৃণা এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে ছোট্ট একটা নাবালক শিশুও একজন ইহুদিকে এক্সিকিউট করে ফেলতে পারত। বাংলাদেশেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। জাস্ট অপেক্ষা করেন আর দেখেন কী হয়।

বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়নের মূল কাজটি সবার অলক্ষ্যে নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের একমাত্র সোল এজেন্ট বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। এরা গাছেরও খায়, তলারও কুড়ায়। নির্বোধ হিন্দুরা মনে করে আওয়ামী লীগ মনে হয় অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, কিন্তু বাস্তবে ঘটনা পুরো উলটা। বাংলাদেশের ভেস্টেড প্রপার্টির লায়ন শেয়ার এখন আওয়ামীলীগের দখলে। কারণ আওয়ামীলীগ হিন্দু ভোটকে “টেকেন ফর গ্রান্টেড” ধরে নিয়েছে। আগে ভোটের প্রয়োজনে যদিও হিন্দু নিপীড়নের কিছুটা রাখঢাক ছিল কিন্তু এখন তো এরা ভোট ব্যবস্থাই নাই করে দিয়েছে। ফলে হিন্দুরা থাকলে ভালো, না থাকলে আরও ভালো কারণ হিন্দুরা না থাকলে তাদের জমিটা স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতা নামমাত্র মুল্যে কিনতে বা জবর দখল করতে পারবে।

জামাত, বিএনপি বা সংবিধানের খতনাকারী জাতীয় পার্টিও হিন্দুদের এতটা ক্ষতি করতে পারেনি যতটা করেছে আওয়ামী লীগ। তার সর্বশেষ প্রমাণ কুমিল্লার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আতিকুর রহমান আঁখির নৌকা প্রতিকে মনোনয়ন প্রাপ্তি। এই সেই আতিকুর রহমান আঁখি যে ইতিপূর্বে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রমাণিত কালপ্রিট।

হিন্দুদের আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। স্বার্থপর এই শ্রেণির যতদিন নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় না হবে, প্রতিরোধ না করতে পারবে ততদিন ততদিন তাদের জমি, নারী ও ধর্ম অরক্ষিত থেকেই যাবে।

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐযে হিন্দুপাড়ার ঘরবাড়ি
পুড়ছে গরুসমেত গোয়াল, খড়ের গাঁদা,
সোনার গয়নার স্তুপ, বেদ, গীতা এবং সীতার ছবি,
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে হিন্দুর বাস্তুভিটা।
ভীষণ পুড়ছে চুতুর্দিকে জতুগৃহ, ভিতরে তালাবদ্ধ মানুষ।
পুড়ছে মলনের খুঁটিতে বাঁধা ছাগল, পঞ্জিকা, চুলার হাড়িতে ভাত,
টাকা পয়সা ও হিন্দু বাড়ির দলিল।
মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিলে যেমন ধেয়ে ছুটে আসে
লাঠি চাপাতি হাতে নামাজরত মুসল্লির দল,
তেমনি সবাই পোড়াচ্ছে যে যেমন পারছে কামাতে সোয়াব,
আর বাঁচাতে দ্বীনি এলেম।
এগারো বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে উদ্ভ্রান্ত জননী ছুটে এসেছে দাবানলের সামনে,
আর বলছে বাবারা আমাকে করো, মেয়েটা এখনো অনেক ছোট।
অদূরে আগুনের লকলকে ফাঁড়া জিভের খেলা, চারিদিক সলক, যেন নাটকের আলোক প্রক্ষেপণ।
ভেঙ্গে পড়ছে ঘরের খুঁটি, ঘরপোড়া আগুনের পটপটে শব্দ সবখানে।
হিন্দুদের গায়ে শ্মশানের মানুষ পোড়া ছাই,
ভয়ে কাঁপছে থরো থরো।
কিশোরী বলছে কাকে যেন ‘এই তরল আগুন থেকে বাঁচাও,
তলোয়ারের এককোপে দ্বিখণ্ডিত করে দাও।
আমাকে কেটে কুচিকুচি করে ফেল যেন মটর কলইয়ের শাক,
কিংবা গরুর মাংসের কিমা,
আমাকে থেঁতলে দাও চাপাতির ঘাড়া দিয়ে’।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐযে হিন্দুপাড়ার ঘরবাড়ি
আমাদের চারিদিকে জেহাদি মানুষের চোখে হিংসার আগুন, চাপাতির ঝনঝনানি,
কিশোরী বলেছিল, আমাকে মেরো ফেলো, কচুকাটা করো,
কাপুরুষ আমি তাও বলতে পারিনি।

[শামসুর রাহমানের ‘তুমি বলেছিলে’ কবিতা অবলম্বনে]