লিখেছেনঃ  অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় 

নভেল করোনা ভাইরাস একুশ শতকের শরীরে এঁকেছে অতিমারির ক্ষতচিহ্ন। এই বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। কেননা এই ভাইরাসের প্রভাব শুধুমাত্র মানুষের প্রাণের সংকটেই স্তব্ধ নয়, বরং তা সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির পরিসর ও মাত্রাকেও বদলে দিয়েছে। অর্থাৎ, একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিকতার আঙ্গিকে এর গতায়াত। ফলে আচমকা হুট করেই যেন মানুষ ঢুকে পড়েছে এক নতুন ব্যবস্থায়, অভ্যেসে। সেখানে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধানের সরকারি নীতি ও অ্যান্টি-মাস্ক আন্দোলন কিংবা সরকারের ভ্যাকসিন নীতি ও অ্যান্টি-ভ্যাক্সারদের অবস্থান সমাজে একটি অমোঘ প্রশ্নকে উসকে দিয়েছে যে, মানুষের নিজের শরীর কতটা ব্যক্তিগত আর কতটা রাষ্ট্রগত? রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মানুষের শরীরের মধ্যে সম্পর্ক আদৌ আছে কি? থাকলে তা কতটা জটিল ও গভীর তা অনুসন্ধানের অবশ্য দাবি রাখে। 

একথা কষ্টকল্পিত নয় যে, মানুষের শরীর মূলত দুটি উপাদানে গঠিত – একটি প্রাকৃতিক ও অন্যটি সাংস্কৃতিক। অর্থাৎ প্রকৃতিপ্রদত্ত আদিম শরীর ধীরে-ধীরে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হতে থাকে এবং ক্রমশ তা আধুনিকতর হয়। বিভিন্ন সমাজে শরীরের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিভিন্ন হলেও অবশেষে তা জনস্বাস্থ্যের নিরিখেই ব্যক্তিগত স্তর থেকে উত্তরণ করে রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্গত হয়ে যায়। দীপেশ চক্রবর্তী এ-প্রসঙ্গে লিখেছেন, 

পরিবার-পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মহামারি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সর্বত্রই দেখা যায় আমাদের এই তথাকথিত নিতান্ত ‘ব্যক্তিগত’ বস্তুটির সঙ্গে সরকারের সম্বন্ধর নজির। বুর্জোয়া সভ্যতা মানুষের শরীরকে যেভাবে ব্যবহার করে ও যে তাৎপর্য দেয়, তা প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শরীরের যে অবস্থান থাকে তার থেকে আলাদা। ‘কৃষক-শরীর’, ‘আদিবাসি-শরীর’কে ভেঙে-চুরে, দুমড়ে-মুচড়ে, নতুন অভ্যাসের ফাঁদে ফেলে, নতুন রুটিনের ছাঁচে ঢেলে তবে তো তৈরি হয় শ্রমিকের শরীর, বিপণন সমাজের অসংখ্য ভোগ্যবস্তুর ক্রেতার শরীর, ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের, স্বাস্থ্য-পত্রিকার শরীর। 

সুতরাং, এই বিবর্তনের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণেই শরীরের সার্বভৌমত্বের বলয়খানি নির্দিষ্ট হতে পারে। উন্মোচিত হতে পারে রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বোচ্চ ভাবস্পৃহার অর্থাৎ মানুষের একান্ত আপন তার নিজের শরীরের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের সম্পৃক্ততার সীমান্তরেখা। 

সোজাসুজি ও স্পষ্টভাবে বললে, ব্যক্তিগত শরীর ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে জনস্বাস্থ্য। জনস্বাস্থ্য যা নবজাগরণের পরে একটি নিয়মতান্ত্রিক সংস্কৃতি হিসাবে গড়ে উঠেছিল, সেটাই কালক্রমে জনকল্যানকামী রাষ্ট্রের দ্বারা নির্ধারিত সমাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে। আদিম মানুষ যখন শিকার, পশুপালন ও শস্য উৎপাদনকে খাদ্য-জোগানের অফুরন্ত উৎস হিসাবে শনাক্ত করেছিল, তখনই তা মানবদেহকে বিবিধ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াঘটিত ব্যাধীর সম্মুখে উন্মুক্তও করেছিল। যদিও প্রমাণের ব্যাপকতা নেই, তবুও মেসোপটেমিয়া ও ইন্দাস নদী উপকূলবর্তী এলাকায় যে নানান ট্রপিক্যাল ব্যাধীর, যেমন – ম্যালেরিয়া কিংবা স্কিস্টোসোমিয়াসিস, প্রভাব ছিল তা ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজে কিছু কিছু পাওয়া যায়। শরীর সম্বন্ধে যে ধারণা তখন প্রচলিত ছিল তাকে দৈববাদের অন্তর্গত বলা যায়। অর্থাৎ শরীরকে সেকালে ঈশ্বরের সৃষ্ট এক আশীর্বাদ বলেই গণ্য করা হত। ফলে তার পবিত্রতা রক্ষার নিরিখেই স্বাস্থ্যবিধির প্রাথমিক পাঠ মানুষ উন্মোচিত করেছিল। এই পাঠ ছিল সাফসুতরো (বা হাইজিন) থাকার বিভিন্ন নিয়মের নিদান। ধরা যেতে পারে, চীনের চৌ-শাসনকালের(১১২২-২৫০বিসি) কথা। সেখানে ডাক্তাররা মদ নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং ব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ ও উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের আধ্যাত্মিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আরোগ্যলাভের পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন। আবার ভারতবর্ষেও খ্যাদ্যাভ্যাস বদল থেকে ব্যায়ামকেই শরীরের সুস্থতার নিয়ন্ত্রক হিসাবে ধরা হত। মুখ, জিহ্বা, চুল ও নখের পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ মনোনিবেশ লক্ষ্য করা যেত।

পরে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে তা আরও বিস্তৃতি লাভ করেছিল। সম্রাট অশোকের আমলে তিনি সর্বত্র চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। এমনকি পশু হাসপাতালও নাকি ছিল। এইখানেই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাপদ্ধতির বীজ রোপিত হয়, যদিও সেটা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েই থেকে গিয়েছিল।  অন্যদিকে সুদূর ঈজিপ্ট দেশে মনে করা হয়েছিল যে, শরীর নিয়ন্ত্রিত হয় শিরা-ধমনী-নালীর মাধ্যমে অর্থাৎ রক্ত, মলমূত্র, বীর্য ও অশ্রুই হল দেহকে পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা। যে-কারণে ঈজিপ্ট দেশের নালা-নর্দমার মতই শরীরের রক্তনালীগুলিকেও পরিচ্ছন্ন রাখার নিমিত্তে যাদু, আচার ও নানা প্রায়োগিক বিধান দেওয়া হত। মেসোপটেমিয়ার স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে ব্যাবিলনীয়, আসুরীয় ও হিব্রুলিপির বিভিন্ন উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় যা অন্তিমে শরীরকে সেই পবিত্র রাখার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছাকাছি যাওয়ার কথাই ব্যক্ত করে। 

টালমুডিক যুগে তো খাদ্য, পুঁজরক্ত, পরিচ্ছদ ও জল-বায়ুবাহিত ব্যাধীর বিরুদ্ধে মানুষের আচরণের সুবিস্তৃত নিয়মেরও সন্ধান পাওয়া যায়। এমনকি মড়কের (লক্ষণীয় যে, আঞ্চলিক সমাজ-সাহিত্যে ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ মড়ক সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে বিবর্তিত হয় মহামারিতে, বর্তমানে যা পুঁজিবাদি ব্যবস্থায় অতিমারিতে পরিবর্তিত হয়েছে) সময়ে আলাদা রাখার ব্যবস্থারও উল্লেখ পাওয়া যায়। বিস্মৃত হলে চলবে না যে, টালমুডিক যুগের এই নিয়মাবলীর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল ইউরোপেও, যা মধ্যযুগে জনস্বাস্থ্যের পরিকল্পনায় ইহুদি ও ইসলামি চিকিৎসকদের বিশেষ সহায়তা করেছিল। তবে একথাও সত্য যে, প্রাচীনযুগে পথ্যের নিয়মাবলীর মধ্যে প্রাকৃতিক বিষয়ের সঙ্গে অতিপ্রাকৃতিক সম্বন্বয়ের যথেষ্ট উপাদান ছিল। মেসোপটেমিয়ার পথ্যাবলীর মতই মেক্সিকান কিংবা পেরুভিয়ান পথ্যাবলীও জ্যোতিষ ও জাদুবিদ্যার বলয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। একইভাবে অ্যাজটেক ও ইনকা সভ্যতার অভ্যন্তরেও এই অতিপ্রাকৃতিকতার প্রভাব লক্ষণীয়। ইনকা সভ্যতায় রীতিমত বার্ষিক স্বাস্থ্যনীতির নিদানে সমস্ত গৃহস্থালী পরিষ্কারের কথা বলা হয়েছিল। 

পক্ষান্তরে গ্রীক সমাজে প্রাক-সক্রেটিস সময়ে যাজকীয় ওষুধের প্রচলন হয়। তৎকালীন মহাকাব্যে স্বাস্থ্যের দেবতা অ্যাপোলোর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে যাঁকে প্রতিস্থাপন করেছিল তাঁরই পুত্র অ্যাসক্লেপিয়াস। অ্যাসক্লেপিয়াসের যে চিত্র পাওয়া যায় সেখানে তিনি কিছু সহযোগী কর্মচারী ও সর্পের মধ্যে বিচরণ করেন। এটা আর কিছুই নয় সেমেটিক সংস্কৃতিতে যাদুবিদ্যাজাত ওষুধের কথাকেই ব্যক্ত করে। কিন্তু খ্রীস্টপূর্ব সপ্তদশ থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে এশিয়া-মাইনরের স্নিডাস কিংবা সিসিলির ক্রটোনাতে লোকায়ত ও যাজকবিহীন পথ্যের ধারণা ক্রমশ প্রচলিত হতে শুরু করে। উল্লেখ্য যে, এই সময়ে পীথাগোরাসের পথ্য সংক্রান্ত সাংখ্যয়িকী নীতি আবিষ্কৃত হয় যাকে ভিত্তি করে অ্যাল্কমায়ন বৈপরীত্যের মিশ্রণে ব্যাধিতত্ত্বের (অর্থাৎ সর্দি-গর্মি বা ঠান্ডা-গরম কিংবা পক্স ইত্যাদির উৎসসন্ধান) প্রণয়ন করেছিলেন। এরই প্রভাব পরবর্তীতে দেখা যায় হিপোক্র্যাটিক শরীরবিদ্যায়। অর্থাৎ, রক্ত, কৃষ্ণপিত্ত, পীতাভপিত্ত ও কফকে শরীরের সঙ্গে প্রকৃতির মূল আধার হিসাবে বর্ণনা করেন হিপোক্রিট। তাঁর নামেই আজও ডাক্তাররা শপথ বাক্য পাঠ করেন। বলা যায় তিনিই হলেন আধুনিকতম মেডিসিনের দর্শনের প্রধানতম উদ্গাতা। তাঁর আবিষ্কারের ফলেই পরবর্তীকালে আলেকজান্দ্রিয়াতে অ্যানাটমি ও ফিজিওলজির চর্চা ব্যাপকতর রূপ লাভ করেছিল। আর এইভাবেই প্রাক-হিপোক্র্যাটিক সংস্কৃতির সঙ্গে হিপোক্রিট-উত্তর যুগে শরীর-স্বাস্থ্য ঈশ্বরত্ব থেকে আলাদা হতে শুরু করে ও নরাত্ম লাভ করে। 

কিন্তু শরীরের এই ঐশ্বরিক ধারণা থেকে সামাজিক ধারণায় উত্থানের পথে ঘটে যায় একটি পতনের ঘটনা – রোমান সাম্রাজ্যের পতন। যদিও তাতে করে উত্থানের বিপর্যয় ঘটেনি। বরং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে এই দর্শন হস্তান্তরিত হয় আরবীয় চিকিৎসকদের অভ্যন্তরে। সম্ভবত দশম শতকের মধ্যেই সমগ্র গ্রীক চিকিৎসাশাস্ত্রই সিরীয়, হিব্রু ও আরবী ভাষায় অনূদিত হয়ে যায়। উদ্ভাসিত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের নতুন ভুবন। উল্লেখ করা যায় মুহাম্মদ ইবন জাকারিয়া আল-রাযি বা রাহজেসের(৮৬৫ – ৯২৫), যিনি মিসেল ও স্মল পক্সের মধ্যে পৃথকীকরণের কিংবদন্তী পথিকৃৎ ছিলেন এবং তিনিই মার্কিউরিক্যাল মলম ও ক্ষত নিরাময়ে পশু-অন্ত্রের ব্যবহার শিখিয়েছিলেন। এছাড়া ছিলেন অ্যাভিসিন্না বা ইবন সিনা, যিনি ১০২৫-এ হিপোক্রিট ও গ্যালনের বিদ্যাকে অ্যারিস্টটলের জীববিদ্যার সঙ্গে মিলিয়ে পাঁচ খণ্ডের বিখ্যাত পুস্তক ‘দ্য ক্যানন অফ মেডিসিন’ লিখেছিলেন। আজকেও ‘মেটেরিয়া মেডিকা’-এর ঐতিহাসিক অবদান বিদ্যমান যা আরবীয় রসায়নবিদ্যার প্রতিচ্ছবিকে সুদৃঢ় রেখেছে। বলা যায় আরব কিংবা পারস্য থেকেই পরবর্তীকালে ইউরোপের নানা অঞ্চলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিবিধ বিষয়গুলি প্রসারিত হয়। তাঁরাও এগুলিকেই আঁকড়ে ধরতে থাকেন এবং কিছুক্ষেত্রে উন্নতিসাধনও করেন যা রেঁনেসাঁসের সময়ে আরও উন্নততর হয়। 

আর মেডিসিনের জগতের এমনই এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের মুহূর্তে আমাদের ফিরে যেতে হবে বা উঁকি দিতে হবে মহামারীগুলির ইতিবৃত্তে। মনে রাখতে হবে, এই সময়েই প্লেগ, কুষ্ঠ ও সিফিলিসের বাড়বাড়ন্ত দেখা দিয়েছিল। লক্ষ্য করা গিয়েছিল গুটিবসন্ত, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়া, কলেরা, টাইফাস, অ্যানথ্রাক্স, স্কারলেট জ্বর, হাম, মৃগী, ট্রোকোমা, যক্ষা, গনোরিয়া ও ম্যালেরিয়ার মত নানা ব্যাধীর। বলা যায়, উন্নয়নের মার্গেই এগুলির উত্থান হয়েছিল অর্থাৎ, আধুনিকতম কৃষিপদ্ধতি ও পশুপালনের প্রক্রিয়াতেই এই রোগগুলি মানবদেহকে আক্রান্ত করেছিল। আর এখানেই আরোপিত হয়েছিল সমাজ থেকে উত্তরিত রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিধি। অর্থাৎ, দৈবিক শরীর থেকে সামাজিক শরীর হয়ে তা রাষ্ট্রীয় শরীরে বিবর্তিত হওয়া। যেমন বলা যেতে পারে, হিব্রুদের থেকে লেপারদের(কুষ্ঠরোগী) আলাদা করা, সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে টালমুডিক যুগের নিয়মাবলীর প্রয়োগ, ল্যাজারেটোর(সংক্রামক রোগীদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল) প্রতিষ্ঠা ও রোগ শনাক্তকরণের কড়া বিধান ইত্যাদি রাষ্ট্রের তরফে লাগু হয়েছিল মানবজীবনের ওপরে। ফলে সেখানেও মানবশরীর ও মানবজীবনকে আবার বদলে ফেলতে হয়েছিল দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত রীতিনীতিগুলিকে। অর্থাৎ শরীরকে বাঁচানোর তাগিদেই মানুষকে এই বিধিগুলি মেনে নিতে হয়েছিল যা আসলে তার শরীরের প্রতি ব্যক্তিগত যে অধিকার তাকে কিছুটা হলেও সমঝোতা করে তুলে দিয়েছিল তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার হাতে। পরে অবশ্য বিধিনিষেধগুলোই স্বাভাবিক শিষ্টাচার ও হাইজেনিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় (উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ডাইরিয়ার কথা। একটা সময়ে মানুষ শৌচকার্য করে হাত পরিষ্কার করত না। পরে ঈশ্বরের কথা বলে তাকে কিছুটা রোখা গিয়েছিল। কিন্তু অভ্যেস সম্পূর্ণ নিকেশ হয়নি। পরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রজ্ঞাপনের দৌলতে ও সাবান আবিষ্কারের পরে ধীরে ধীরে হাত না ধোয়ার অভ্যেস লোপ পায়। এখন যেমন এটাকে নিয়ে শরীরের ব্যক্তিগত অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বলে কেউই চেঁচামেচি করে না, কেননা এটাই পরিচ্ছন্নতার ও সভ্যতার রীতি হয়ে গেছে। এমনকি মাত্র আগের শতকেই অস্ত্রপচার করে বা করার আগে হাত ধোয়ার রীতি চালু হয়। এখন কেউ এসব নিয়ে বিরোধাভাসের কথা কল্পনাও করতে পারেন না। কিংবা ধাইমা থেকে নার্সিংহোমে প্রসূতির স্থানান্তকরণেও শরীরের চেতনায় বিবর্তন দেখা যায়।)। সেগুলিকে নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মগুলি আর প্রশ্নও তোলেনি, কেননা এই রীতির মান্যতাই ছিল তাদের স্বাভাবিক জীবনের প্রকাশ। এমনই এই উত্তরণ যে ব্ল্যাক ডেথ মহামারির আগমণ সমগ্র ফিউডালিজমকেই উৎখাত করে দিয়েছিল। সে নিয়েই দীর্ঘ নিবন্ধ লেখা সম্ভব। কিন্তু সেই আলোচনা অন্যত্র হবে। এখন একথা অনস্বীকার্য যে বিভিন্ন রোগ ও মহামারিকে কেন্দ্র করে সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেভাবে পাল্টেছে তা প্রকৃতপ্রস্তাবে শরীরের সার্বভৌমত্বের ধারণাকেও যুগে যুগে বদলে দিয়েছে। যেমন প্লেগের সুদূরবিস্তৃত প্রভাবে নানান স্বাস্থ্যনীতি ও আর্থনীতিক পরিকাঠামোর যে অভ্যুত্থান হয় সেটা প্লেগযুগের অবসানের পরের নগরসভ্যতার গড়নে ও মননে তার ছাপ রেখে যায়। একে কিউমুলেটিভ জ্ঞানের সত্তা বলে অভিহিত করাই যায়।

এমনকি শরীরের এই ব্যক্তিগত, ব্যষ্টিগত ও রাষ্ট্রগত বিবর্তনের আঙ্গিকে সাম্রাজ্যবাদের অন্দরমহলেও ঢুকে গিয়েছিল ভীতি। সেটাই ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির সঙ্গে সমান্তরালভাবে ক্রমবর্ধিত হতে থাকে। কলম্বাসের আমেরিকায় আগমণ হোক কিংবা ব্রিটিশের ভারতশাসনের স্বপ্ন সর্বত্রই রোগব্যাধীর ভয় ও স্বাস্থ্যবিধির অনুশাসনের বিশেষ প্রাধান্য দৃষ্টিগোচর হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত শরীরের চিন্তা তখন রাষ্ট্রব্যবস্থার শরীরের চিন্তার সঙ্গে আরও সুতীব্রভাবে একাত্ম হতে শুরু করে। একে স্বাস্থ্যব্যবস্থার নবজাগরণ বলাই যায়। ধরা যাক ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের কথা। তাঁদের সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেও ছিল ট্রপিক্যাল অঞ্চলের প্রতি রোগের ভয়। আর ভয়ের কারণও ছিল যথেষ্ট। ব্রিটিশ শাসকরা যখন গ্রীষ্মের দেশগুলিতে অভিযান চালিয়েছিল তখন সেই দেশের সৈন্যবাহিনী ছাড়াও মোকাবিলা করেছিল ম্যালেরিয়া, রক্ত-আমাশা, উদরাময় ও কলেরার মত রোগকেও। কেননা ১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে ইউরোপীয় সেনা ও অফিসারদের প্রায় ৯৪ শতাংশই মারা গিয়েছিল এইসব রোগে ভুগে, যুদ্ধে নয়। এমনকি ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ সেনার সংখ্যা ২২৭,০০৫ থেকে হ্রাস পেয়ে ৮২,১৫৬ হয়েছিল। তার ফলে জনসমাগম মাত্রই ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হয়ে উঠত। কেননা এই দেশে তখনও এইরকমের স্বাস্থ্যবিধির প্রচলন ছিল না। আর তাই বিট্রিশরা কুম্ভমেলা, প্রয়াগ, জগন্নাথধাম, তিরুপতি, কাঞ্চিপুরম সর্বত্র আয়োজিত অনুষ্ঠানে গড়ে তোলে নানা নিয়মনীতি – পুলিশ, ডাক্তার, ওষুধ, পানীয় জল, মলমূত্রত্যাগের ব্যবস্থা ও বাঁশের বেড়া – যাতে করে ভিড়কে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা যায়। মহামারিকালে আইনগতভাবে জোর করে রুগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা, মেলা-হজযাত্রা বন্ধ করা, রেলযাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা ইত্যাদিও শুরু হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, ১৭৬৮সালে জে লিন্ড রচনা করেছিলেন ‘এসে অন ডিসিসেস ইন্সিডেন্ট অফ ইউরোপিয়ানস ইন হট ক্লাইমেট’। ১৭৬৪সালে শুরু হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিক্যাল সার্ভিস। উঠে এসেছিল একটি নতুন বিষয়- ট্রপিক্যাল মেডিসিন। ১৮৯৯সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন। ভারতবর্ষের জন্য রচিত হয় বিখ্যাত ‘মহামারি আইন’ যা এই করোনাকালেও প্রযুক্ত হচ্ছে। তবে একইভাবে ভারতীয়রাও এসব নিয়মকে প্রথমে মানতে চায়নি। কেননা শরীরের সামাজিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রগত ধারণা মানুষের মধ্যে ছিল না। আর তার কুফলও দেখা গিয়েছিল। দাঙ্গা লেগেছিল, খুন হয়েছিল। ১৮৯৬ সালে বম্বের প্লেগের দাঙ্গার ঘটনাও বিস্মৃত হলে হবে না। ১৮৯৭ সালে পুণার প্লেগ-কমিশনার ডব্লিউ.সি.র‍্যান্ড খুন অব্দি হয়েছিলেন। আবার অন্যদিকে এই সময়ে ছড়িয়েছিল নানা গুজব। কেউ কেউ বলেছিল যে, সুলতানি সেনাবাহিনীর আগমণ ঠেকাতে সরকার হজযাত্রা বন্ধ করছে। গুজরাটে ১৮৯৮ সালের দাঙ্গাও হয় গুজবের কারণেই। এরকম অনেক গুজবের মধ্যে উত্তর-ভারতে রটেছিল ইংরেজরা সংক্রামক ব্যাধী এনেছে যাতে রাশিয়া আক্রমণ না করে, কলকাতায় রটেছিল যে ইংরেজরা ওষুধ, টিকার আমদানি করে দুলক্ষ নরবলি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বলা হয়েছিল, হাসপাতালে রোগিদের শরীর থেকে তেল বের করে দক্ষিণ আফ্রিকায় যুদ্ধরত সেনাদের জন্য মলম প্রস্তুত করা হচ্ছে, পাঞ্জাবে বলা হয় টিকাতে ব্যবহৃত সূচের সাইজ প্রায় এক গজ যা ফোটামাত্রই বন্ধ্যাত্ব ও অসীম যন্ত্রণাভোগ অবশ্যম্ভাবী ইত্যাদি। কিন্তু আস্তে-ধীরে এগুলিও মানানসই হয়ে যায় জীবনের সঙ্গে। পাস্তুরের আবিষ্কার থেকে পোলিওর টিকা এখন সবই বিনা বিতর্কে সকলেই জরুরি বলে মনে করেন। কেউই ভাবেন না তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারে কিংবা শরীরের মৌলিক অধিকারে রাষ্ট্র জোর করে বিধি চাপিয়ে দিচ্ছে। মানুষ এভাবে নিজেই তার শরীরকে ধীরেধীরে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছে। 

তাছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনস্বাস্থ্যের নিয়মনীতিও বেশ অভিনব। ভারতে তখন ঔপনিবেশিকতা থাকলেও দুনিয়ার অন্যপার্শ্বে এর উত্থান হয়েছিল ফরাসী বিপ্লবের সময়েই। ১৭৯১সালে ডিউক দে লা রঁসেলির তত্ত্বাবধানে যে মেনডিক্যান্সি কমিটি তৈরি হয়েছিল তাতে গণতন্ত্রে জনস্বাস্থ্যের অধিকারের প্রশ্নটি তোলা হয়েছিল। কমিটি জানিয়েছিল, 

“If the state could not provide it, then it must ensure a means of subsistence to the unemployed. The Constituente Assembly’s Committee on Salubrity added health to the state’s obligations to its citizens. The Committee believed this could be achieved by establishing a network of rural health officers who, while trained in clinical medicine, would also become responsible for reporting on the health of communities and monitoring epidemics among both humans and farm animals”   

যদিও আমেরিকার গণতন্ত্রে স্বাস্থ্যকে প্রথমে রাষ্ট্রের তরফে প্রদত্ত জনগণের সার্বিক অধিকারের প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট করা হয়নি, পরে থমাস জেফারসন এই বিষয়ে জোরালো দাবি তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 

Sick populations were the product of sick political systems. The iniquity of European absolutism was reflected in its people’s wretchedly unhealthy and demoralized condition. Democracy was the source of the people’s health. Democratic citizens, self-educated in exercising their political judgment, would secure a healthful existence. Jefferson claimed that the healthiness of the American people reflected the superiority of democratic citizenship.

অর্থাৎ, যা অনুধাবন করা গেল তা হল, মহামারী, গণচেতনা ও নৈতিকতার ধারণা, রেনেসাঁসের প্রভাব ও জনস্বাস্থ্যে ঔপনিবেশিক প্রভাবের কালপ্রবাহে মানুষের শরীরের অধিকার ক্রমশ জনস্বাস্থ্যের স্থানীয়করণের দ্বারা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। যা পরবর্তীকালে জন্ম-নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার কল্যাণের আদলে জনকল্যানকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার আঙ্গিক হয়ে জন্ম দিয়েছিল আজকের উত্তর-আধুনিক জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার। 

আর আজকের দিনে অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, শরীর ও তার আচরণকে রাষ্ট্রের আর্থনীতিক ও রাজনৈতিক সম্পত্তির অংশ হিসাবে গণ্য করা এবং বিজ্ঞানের সহায়তায় তাকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের বিভিন্ন কার্যকলাপে যাতে সর্বাধিক কার্যকারিতার অভীষ্টে নিয়ে যাওয়া যায় সেই চেষ্টাই হল মূল লক্ষ্য। এখানে কি আর সত্যই শরীরের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন বা মৌলিক অধিকারের দাবি তোলা যায়। বোধহয় যায় না। কেননা ঐতিহাসিক বিবর্তনের পথে বহু যুগ আগেই এই শরীর মানুষের ব্যক্তিগত সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছে রাজনৈতিক এক্তিয়ারে। এক্ষেত্রে মিলিটারি কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে উদাহরণ হিসাবে ধরা হলে বিষয়টা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। মিলিটারি ট্রেনিং-এ তো মানুষের শরীরকে রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনমতই গড়েপিঠে নেয় এবং ব্যবহার করে নিজের খেয়ালখুশি মত। তাছাড়া আরও বৃহত্তর পরিমণ্ডলে দেখলে এখন মানুষের শরীরগুলি যেন আর রাষ্ট্রেরও নয়। তা হয়ে গেছে কর্পোরেটীয় কনজিউমারিজমের দাস।  আর তাই-ই রোগের ভয়ের প্রজ্ঞাপন করে তাকে নিরাময়ের নিমিত্তে বিভিন্ন প্রকারের আচরণবিধি আরোপ ও টিকা কিংবা ওষুধ-নির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে দেওয়া জলভাত হয়ে গেছে। আসলে যখন স্বাস্থ্য পুঁজির একটি লাভযোগ্য স্থান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল তখন থেকেই স্বাস্থ্যকে বাণিজ্যক্ষেত্রের অন্তর্গত করা হয়েছিল। ফলে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ছিল বৈচিত্রময় জনসংস্কৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন এক জীবনযাপনরীতি। মেডিসিন, সমাজবিজ্ঞান ও জননীতি একত্রিতভাবে প্রজ্ঞাপিত করেছিল রাষ্ট্র দ্বারা নির্দিষ্ট সামাজিক আচরণগুলিকে। যেমন, ‘নাসবন্দী’ কিংবা কন্ট্রাসেপ্টিভ মেথডগুলিকে, যার দ্বারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও অবশেষে প্রচারের দ্বারা রাষ্ট্র জন্মনিয়ন্ত্রণের ধারণাকে জনমনে বদ্ধমূল করতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যান্য উদাহরণ হিসাবে সামুদ্রিক লবণের পরিবর্তে আয়োডাইজড লবণের ব্যবহার চালু করা, রেড মিট বন্ধ করা, সর্ষের তেলের বদলে সাদা তেল বা অলিভ তেল ব্যবহার করা ইত্যাদিকে গণ্য করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে কিছুক্ষেত্রে এমন অভিযোগ শোনা গিয়েছিল যে আয়োডাইজড লবণে শরীরের চাহিদার তুলনায় বেশি আয়োডিন থাকার জন্য থাইরয়েড ও রক্তচাপের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবুও সে-সব ধোপে টেকেনি। অর্থাৎ এখন শরীর বাণিজ্যপণ্যের ক্রেতা ও বিক্রেতার মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

আবার শিল্পপতিরা ব্যক্তিগত শরীরকে বিজ্ঞাপনের দ্বারা কিছুক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ও জাতিবাদের সহায়ক হিসাবেও ব্যবহার করে থাকেন এবং নানা পণ্যের বিক্রিও তাতে বাড়ে অনেক উচ্চস্তরে। ফর্সা হবার মলম থেকে বগলের ত্বকচর্চার জন্যও এখন নানাবিধ সামগ্রী উপলব্ধ। এছাড়াও সুঠাম ও সুডৌল শরীরকেই ফিট ও হিট বলে এমন প্রচারিত হয়েছে যে তা থেকে প্রোটিন শেক ও ইনসুলিন গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তার জন্য বল্ডি-বিল্ডিং-এর প্রতিযোগিতাও চালু হয়েছে যেখানে অংশগ্রহণকারীদের চেহারা স্বাস্থ্য যতই পেশী দৃঢ়তায় মজবুত দেখাক না কেন বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা দ্রুত নষ্ট হতে শুরু করে। পক্ষান্তরে নারীদের শরীরকে ব্যবহার করার পরিমাণ সর্বাধিক। যৌন-উত্তেজক বিবিধ প্রকরণের ঢালাও আয়োজন সেখানে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ম্যাগাজিনের আকর্ষনীয়া মুখ হয়ে ওঠার জন্য আরোপিত হয়েছে ডিজাইনারের চাহিদা। কেননা ডিজাইনের জন্য যে প্রয়োজন একটি সুদৃশ শরীর। চালু হয়েছে অপারেশন। হাস্যকর বিষয় এও যে কোনটি মানবচক্ষুতে সুদৃশ আর কোনটা নয় তাও নির্ধারিত করেছে পুঁজির প্রজ্ঞাপণ। আর এই সমস্ত প্রকরণই ধীরে ধীরে শরীরকে রাজনৈতিক, আর্থনীতিক ও সামাজিক ব্যবহারযোগ্য পণ্যে পরিণত করেছে। এ-প্রসঙ্গে ডরোথি পোর্টার লিখেছিলেন যে, ‘শিল্পবিপ্লব-উত্তর সময়ে এইসব পণ্যায়িত শরীরগুলি আসলে রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক বক্রোক্তির শিকার যাকে কার্ল মার্ক্সের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবাদের বস্তুগত বিশ্লেষণের উপযুক্ত উদাহরণ হিসাবে ধরা যায়’। 

ফলে আজ মানুষ যতই ভাবুক ‘মাই বডি মাই রুলস’, আসলে তার সার্বভৌমত্ব কবেই রাষ্ট্র ও পুঁজির করায়ত্ত হয়ে গেছে, কেউ টেরই পায়নি। প্রাচীন যুগ থেকে একুশ শতকের মধ্যবর্তী সময়কালে শরীর ব্যক্তিগত মার্গ থেকে প্রথমে ঐশ্বরিকতায়, তারপরে সামাজিকতায়, রাষ্ট্রিক চেতনায় ও অন্তে কর্পোরেটিয় বৃত্তে এসে নিজের অবস্থান নির্দিষ্ট করেছে। এখন অ্যান্টি-মাস্ক বা অ্যান্টি-ভ্যাক্সিন যে সব কথাবার্তা বা প্রতিবাদ-আন্দোলন চলছে তাও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাবে। কেননা, যে জিনিস অনেক আগেই হাতছাড়া হয়ে গেছে মানুষের তাকে আবার আগলে ধরার চেষ্টা করার অর্থ তেল মাখানো দড়ি ধরে টান মেরে কোনকিছুকে অর্জন করার অভিপ্রায়। এটা সফল হওয়ার সম্ভবনা নিতান্তই ক্ষীণ। বিভিন্ন ডেটা ও তার অ্যানালিসিস এসে সমগ্র সমাজকেই এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে কিংবা ঘৃণার পাঠ দেবে। প্রমাণ করে দিয়ে দেখাবে যে, স্বাস্থ্যবিধি ও ভ্যাকসিনের জন্যই মানুষের গড় আয়ু ২০(প্রাচীন দাস বা স্লেভদের), ৩৫(সম্ভ্রান্তদের) থেকে ৫০(ঔপনিবেশে) হয়ে এখন ৭০(আধুনিক গণতন্ত্রে) অব্দি পৌঁছেছে। আর এই যুক্তিকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করা অসম্ভব। আর কেনই বা মানুষ অস্বীকার করতে যাবে, বেঁচে থাকতে কে না চায়? কিন্তু যদি মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায় অন্যমার্গে তবে তা নিশ্চয়ই এক নতুন আশার আলো হবে বইকি! তবে বিকল্প সমাজব্যবস্থা ব্যতিরেকে শরীরকে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের আওতায় এনে নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব। কেননা এই ব্যবস্থায় তোমার নিজেরই শরীরই যে আর একটুও তোমার নয় যতটা তুমি কল্পনা করো। মানুষ মানুক বা নাই মানুক এটাই নির্মম বাস্তব, কঠোর সত্য।      

সূত্রনির্দেশঃ

  1. ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ – দীপেশ চক্রবর্তী
  2. স্বাস্থ্য, সভ্যতা এবং রাষ্ট্র : প্রাচীন থেকে আধুনিক সময় অব্দি জনস্বাস্থ্যের একটি ইতিহাস – ডরোথি পোর্টার