এক

বাংলাদেশে মুচি সম্প্রদায় একটি অবহেলিত দলিত শ্রেণী। এরা আমাদের খুবই পরিচিত কিন্ত এদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সংকীর্ণ। এরা সমাজের এমনই একটি অস্পৃশ্য অংশ যে আমাদের শরীরে এদের স্পর্শ সয়না। এরা যে গ্লাসে পানি পান করে যে কাপে  চুমুক লাগায় যে প্লেটে  ভাত খায় সেসবে আমরা মুখ লাগাতে পারিনা আমাদের রুচিতে বাঁধে।এরা আমাদের পাশে থেকেও অনেক দূরলোকের বাসিন্দা। মুচিদের আবাসগুলিও নির্মিত হয় আমাদের আবাসের সাথে দূরত্ব রেখে। এদের সংখ্যা অতি নগন্য। মুচিদেরকে সংখ্যালঘু বললেও মনে হয় লঘুত্বকে হালকা করা হয়। আমরা তথাকথিত সভ্যজনরা বিপুল বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই দিনে দিনে আমরা সংখ্যায় আরও বেশি গরিষ্ঠ হই। আমাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী আবাসগুলি যখন এদের আবাসকে ছুঁয়ে ফেলে বা ছুঁয়ে ফেলার উপক্রম হয় তখন এদেরকে আরও দূরে সরে যেতে হয়। হুমকি দিয়ে গরিষ্ঠতার দাপট দেখিয়ে অর্থের প্রলোভন দিয়ে সরে যেতে বাধ্য করা হয়।সভ্য সমাজের মাঝখানে এই নোংরা মুচি সম্প্রদায় বসবাস করতে পারেনা। এ যেন চর্যা আমলের ডোম বা ডুম্বির মত। “নগর বাহিরিরে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ,ছোই ছোই জাহ সো বাম্মনাড়িয়া’ চর্যা কবির রচনায় তবু ডোম্বিকে নিয়ে মানবিক অনুভূতির দেখা মেলে কিন্তু আমাদের নাগরিক সাহিত্যে মুচি সম্প্রদায় আজও অপাংক্তেয়। মুচিকে নিয়ে উন্নত সাহিত্য রচিত হয়না। গল্প সিনেমার নায়ক সেতো কল্পনারও অতীত। তবে গ্রামবাংলায় মুখরোচক অনেক গল্পে অনেক সময় অনেক মুচির কথা উঠে আসে। আমার বর্তমান রচনার বিষয় তেমনি এক মুচির গল্প। ঘটনাটি হয়তো শত বছর আগের তবে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও সেই গল্প প্রচুর শুনা যেত।ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মুখে ভিন্ন ভিন্ন রঙ্গের আবেসে। ভাববেন না এটি কোনো বীর রসোপখ্যান। মুলত একজন মুচির কাপুরষতার গল্প এটি। গল্পের সেই মুচির নাম ছিল চিরায়তন,লোকমুখে তা হয় চিরাতন,চিরাতন মুচি। যেভাবে গল্পটি শুনেছি তাতে মনে হয় বৃটিশ আমলের শেষে বা পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকের ঘটনা এটি এবং অনুমিত হয় চিরায়তন হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ সদরের আশপাশের কোনো গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। অবশ্য অন্য জায়গারও হতে পারে। এসব গল্প লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে সর্বত্রই একটা স্থানীয় আবহ ধারণ করে। দেখি চোরে কী করে’ এমন একটি গল্প আবার সর্বত্র প্রচলিত আছে। সে যাই হোক আলোচ্য গল্পটি নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির নামে প্রচলিত এবং তার বিষয়বস্তুও স্বতন্ত্র। রাতের আঁধারে এক দুর্বৃত্ত চিরায়তনের ঘরে ঢুকে তার অনুঢ়া মেয়েকে ধর্ষণ করে।তার চোখের সামনেই ঘটে ঘটনাটি। একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে স্থানীয় থানার দারোগার সামনে চিরায়তন যে জবানবন্দি দেন তাই এক সময় মুখ হতে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।ঘটনাটি যেহেতু ধর্ষণের সুতরাং তাতে মানুষের আগ্রহ বেশি থাকবে তাই স্বাভাবিক। বহু মুখ থেকে শ্রুত এবং বহুরসে সিক্ত জবানবন্দির মার্জিত রূপটি এরকম:

দারোগা-তোমার মেয়ের ধর্ষণের ঘটনা কি তোমার চোখের সামনেই ঘটেছে?

চিরায়তন- হাঁ বাবু, হামার চোখের সামনে।

দারোগা-তোমার চোখের সামনে এরকম ঘটনা ঘটল তুমি কিছু করলেনা?

চিরায়তন-কী আর করবে বাবু। রাতের খাওনের পর বিছনায় গিয়াছি তখনও ঘুম আসে নাই এই সময় দরওয়াজায় মানুষের আওট পাই। হামি কান পাতিয়া মড়ার মত পড়িয়া থাকি। এই সময় দরওয়াজা খুলিয়া একটা লোক হামার ঘরে ঢুকে। ম্যাচের কাঠি জ্বালাইয়া বেটা হামার ঘরের চারদিকে কী য্যান খুঁজে। আমি চুপচাপ চাইয়া চাইয়া দেখি আর মনে মনে চিন্তা করি দেখি শালা কী করে? চারদিক খুঁজে চোরা হামার মেয়ের বিছানার পাশে চলিয়া যায়। তারপর লোকটা হামার মেয়ের শরীলে হাত দেয়।

দারোগা-তখনও তুমি কিছু করনা? শুধু চেয়ে চেয়ে দেখ?

চিরায়তন-কিছুই বলিনা বাবু খালি চিন্তা করি দেখি শালা কী করে। শরীলে মানুষের হাত পড়ায় হামার মেয়ের ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়।মেয়ে চিক্কুর দিতে চায় কিন্তু বদমাশ লোকটা হামার মেয়ের মুখ চাপিয়া ধরে।আমি তখনও কিছু বলিনা বাবু, খালি চিন্তা করি দেখি শালা কী করে। এরপরে…।

হাঁ এরও পর আছে এবং সেটাই গল্পের প্রাণ। বলাই বাহুল্য মানুষের বিকৃত যৌনকামনা  গল্পের সেই উপসংহারকে পুরোই ক্লেদাক্ত করে ফেলে, ফলে একটি পাশবিক নির্যাতনের মর্মান্তিক কাহিনী রূপান্তরিত হয় একটি যৌন রসাত্নক গল্পে,ঘটনার অসহায় বাবা আমাদের চরিত্রগুণে হয়ে যায় খলনায়ক আর এই ফাঁকে হাওয়া হয়ে যায় আসল দুর্বৃত্তটি। দুর্বৃত্তের নাম পরিচয়ও গল্প থেকে লাপাত্তা হয়ে যায় কেবল থাকে নির্বোধ কাপুরুষ চিরায়তন আর তার জবানবন্দি। আমাদের চিন্তায় এবং মন মগজে এইটুকু বোধ জন্মেনাযে কতটুকু অসহায় হলে পড়ে একজন পিতা মড়ার মতো পড়ে থেকে আত্নজাকে ধর্ষণের মত বিভৎস এবং বেদনাদায়ক দৃশ্যটিকে হজম করে যেতে হয়।

দুই

আগেই উল্লেখ করেছি ঘটনাটি প্রায় শত বছরের পুরনো। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় একশত বছর পেরিয়ে এসে চিরায়তনের উত্তরসূরিরা সামাজিক অবস্থানের দিক দিয়ে কতটুকু এগিয়েছে তার উত্তর হবে নেতিবাচক। এখনও যদি একজন সুন্দরী মুচি-কন্যার দিকে একজন ক্ষমতাবানের কুনজর পড়ে তবে তাকে রক্ষার ক্ষমতা মুচি সম্প্রদায় আজও অর্জন করতে পারেনি। তাহলে কী হল এইসব ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনে? একাধিকবার মানচিত্র বদলে? এত এত উন্নয়ন ফুন্নয়নে? না, একেবারে অর্জন যে নেই তা বলা যাবেনা বরং একটি অর্জন সম্ভবত তারা পরম তৃপ্তি সহকারেই উপভোগ করছে আর তাহলো একশত বছর আগে তাদের পূর্বসূরি চিরায়তন যে সামাজিক অবস্থানে ছিল দেশের সিংহভাগ মানুষের সামাজিক অবস্থান এখন একই সমতলে এসে দাঁড়িয়েছে। এককালে যারা চিরায়তনের নির্বুদ্ধিতা আর কাপুরুষতার সমালোচনায় মুখর ছিল তাদের উত্তরসূরী গণ আজ চিরায়তনের চেয়েও অধিক অসহায়। তাদের তরতাজা যুবক সন্তানটিকে প্রকাশ্যে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অথচ তারা টু শব্দটিও করতে পারছেনা।উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া সন্তানটির ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ জেনেও অসহায় পিতা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেনা। চিরায়তন তবু একটি মামলা রুজু করতে পেরেছিলেন কিন্তু রাষ্ট্রের আম চিরায়তনরা এখন সে সুযোগও পাচ্ছেনা।

একাত্তরের পরে দেশের সাধারণ একজন নাগরিকের এমন অনিরাপদ অসহায় অবস্থা কখনও এসেছে বলে মনে হয়না।এর পূর্বেও বিভিন্ন শাসনামলে অনেককে উঠিয়ে নিয়ে গুম করা হয়েছে এমনকি রাষ্ট্রীয় মদদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভায় প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলা করে অনেককে হতাহত করা হয়েছে  কিন্তু সেগুলি ছিল পলিটেকেলি মটিভেটেড মার্ডার। কিন্তু এখনকার গুম মার্ডারে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নেই আছে স্রেফ অর্থনৈতিক স্বার্থ আর তা করছে দেশের একটি বিশেষ বাহিনী যারা নিয়োজিত হয়েছে জনগণের অর্থে এবং জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায়। কিন্তু দিনশেষে এর দায় আমাদের দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপরই বর্তায় কারণ রাজনীতিকরাই এখন পর্যন্ত দেশ এবং এইসব বাহিনীকে পরিচালনা করছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব চূড়ান্তভাবে অসৎ নীতি আদর্শহীন হলে পরেই বিভিন্ন বাহিনী তাদের ঘাড়ে বসে জনগণের উপর এমন ট্রিগার টিপার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে। দেখি শালা কী করে’ এই ভান করে চিরায়তন যেমন  অলৌকিক কিছু ঘটার প্রতিক্ষা করছিলেন আজ বেশিরভাগ ভুক্তভোগী মানুষের অবস্থা ঠিক তেমনি। এ যেন কবিগুরুর সেই পংক্তির মতো- “বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি,শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে ঊর্ধমুখে নরনারী”। কেউ হয়তো এ বাহিনী সে বাহিনীর দিকেও ইতিউতি তাকাচ্ছে। আসলে মানুষের আত্ববিশ্বাস আর সোজা হয়ে দাঁড়াবার মেরুদন্ডটি যখন ভেঙ্গে যায় বা ভেঙ্গে দেয়া হয় তখন তার অলৌকিকতায় বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো পথই থাকেনা। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার গণ যুবক বৃদ্ধ নির্বিশেষে ধরে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ারে মেরে ফেলত কারণ তাদের অপরাধ ছিল বাঙ্গালী হওয়া। আজ কোনো অপরাধ ছাড়াই অনেককে প্রহসনের গল্প সাজিয়ে একইভাবে হত্যা করা হচ্ছে। হাঁ অপরাধ একটা আছে আর তাহলো স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকা মানুষ তার জীবনের মূল্য, বেঁচে থাকার ট্যাক্স বা মুক্তিপণ পরিশোধ করতে পারছেনা। একাত্তরে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা শহীদ, জাতি চিরকাল তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে, তাদের উত্তরপুরুষগণ তাদের নিয়ে গর্ব করে বলতে পারেন আমার পূর্বপুরুষ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন কিন্তু আজ যারা প্রাণ হারাচ্ছেন তাদের নিয়ে কি তাদের স্বজন গর্ব করতে পারবে? কেননা পুলিশ রেকর্ডে তারা সমাজ জাতি দেশবিরোধী ঘৃণ্য ড্রাগ ডিলার সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকছেন। এভাবে রাষ্ট্রের একজন নাগরিককে হত্যার পর তাকে অনন্তকাল ধিক্কৃত সংজ্ঞায় পরিচিত হয়ে থাকতে হবে কত বড় অন্যায় অবিচার এটি। এদিক দিয়ে চিরায়তনের উত্তরসূরিদের বরং কিছুটা ভাগ্যবানই বলা যায় কেননা তাদেরকে অন্তত নিজ সন্তানকে নিয়ে এমন শংকা আর উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়না। মাছ নয়, মৎস্য শিকারীর এই অবজ্ঞা নিঃসন্দেহে হাগাডালুর (এক প্রকার ক্ষুদ্র মাছ বিশেষ) সামাজিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে কিন্তু এই তুচ্ছ তার কারণে তাদের প্রাণটি তো অন্তত বেঁচে যায়।