লিখেছেন: অনামিকা

অনন্ত বিজয়, আমাদের প্রিয় অনন্ত দা। শুনেছিলাম ছোটবেলায় তিনি বেশ খানিকটা ডানিপিটে ছিলেন, হালকা-পাতলা ছিলেন। যখন ভার্সিটি শুরু করলেন তখন স্বাস্থ্য কিছুটা ভাল হয়। আমার সাথে তার যখন পরিচয় তখন তিনি সম্ভবত ভার্সিটিতে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। অসম্ভব পড়ুয়া,নিরহঙ্কার, অমায়িক মানুষটি অতি অল্প দিনেই খুব ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন। সবার সাথে ভাল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের এক অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তাঁর। এমন কারো সন্ধান পাই নি কখনো যে তাঁর সম্পর্কে মন্দ বলে।

তিনি অতটা বই পড়তেন যে পাবলিক লাইব্রেরিতে কোনো বই খুঁজে না পেলে তাঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারতাম বইটা কোন তাকে খুঁজলে পাওয়া যাবে। তাঁর কাছে পাওয়া যেত খুব দুর্লভ বইগুলো, প্রায়ই ধার নিতাম, অসংখ্য বই তাঁর কাছ থেকে নিয়ে ফটোকপি করেছিলাম।

তখনো ইন্টারনেট জগত সবার কাছে অতটা সহজলভ্য হয়ে উঠেনি। কিন্তু অনন্ত বিজয়ের পদচারণা ছিল নেটের অলিগলিতে- ইয়াহু গ্রুপ, মুক্তমনা, মুক্তচিন্তা সম্পর্কিত দেশ বিদেশের অনেকের সাথে তাঁর যোগাযোগ গড়ে উঠে। আমরা তাঁর কাছ থেকে এ খবরগুলো পেয়ে যেতাম সহজেই।

মাঝে মাঝে তাঁকে দেশের বাইরে চলে যেতে বলতাম। তিনি কোনোভাবেও রাজি হতেন না। বলতাম, দেশের পরিস্থিতি কখন কী হয়! কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। তাঁর উপর নির্ভরশীল অসুস্থ বাবা, তাঁকে ছেড়ে যাওয়া যাবে না। মনে আছে কয়েকবার তাঁর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেয়া এবং আনায় অংশ নিয়েছিলাম। অনন্তদাকে হত্যা করার পর তাঁর বাবা বেচেছিলেন আরো বছর দুয়েক। মাঝে মাঝে ভাবি, এ সময়টা তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? আর এখনো তাঁর মা ও স্বজনরা কতটা দু:খ বুকে চেপে আছেন। গত রবিবার ছিল মা-দিবস। এদিন কি অনন্তদার মা তাঁর এ পুত্রের মা-ডাক শোনার জন্য একটু হলেও ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন?

তাঁর বাসায় আড্ডা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে উঠলে চলে যেতাম পাশের দীঘির পারে, যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছে। খোলা জায়গা, তাই ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতাম প্রায়ই। কে জানত, কয়েক বছর পরেই তাঁকে ঐ জায়গায় হত্যা করবে কিছু নরপিশাচ।

অনন্ত বিজয় লেখাপড়ায় খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না কখনো। তারপরেও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন, ভার্সিটিতে ঠিকমত লেখাপড়া শেষ করেছিলেন। এরপরে তাঁর অসুস্থ বাবার আশা ছিল একটা ভাল চাকুরি। সবকিছুর পরে একটা চাকুরি জুটেছিল বঠে। সেই কর্মস্থলে যেতে গিয়েই নিহত হতে হয়েছিল।

মাত্র ৩৩ বছরের একটা মানুষ, যিনি কিনা এই মাত্র লেখালেখি শুরু করছেন, কয়েক বছর পেরিয়ে হয়ে উঠবেন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক তাঁকে হত্যা করা হল অসীম বর্বরতায়। না, আমরা অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখনো অনেক সংগ্রাম বাকি। কিন্তু আমরা আশাবাদি হই, কেননা অকাতরে প্রাণ বিসর্জনের সাহস নিয়ে অনন্তরা বেচে আছে এবং ছিল সবসময়, আমাদের চারপাশে।

অনন্ত আমাদের রক্তের মধ্যে বহমান। আগামী দিনের সকল মুক্তসংগ্রামী বিদ্রোহীর হৃৎস্পন্দন হয়ে বেচে থাকবেন তিনি।