এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছি জানি না তবে বুঝতে পারছি লঞ্চ সম্ভবত বুড়িগঙ্গা পার হয়ে পদ্মায় প্রবেশ করেছে। বুড়িগঙ্গার দুষিত পানির উৎকট গন্ধটা এখন আর নাকে লাগছে না। লঞ্চ ছেড়েছে সাড়ে নয়টায়, বুড়িগঙ্গা পার হয়ে পদ্মায় আসতে কতক্ষণ লাগলো সেটা জানতে ইচ্ছে হয় আমার। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি- বাজে দশটা চল্লিশ। আমি বসে আছি লঞ্চের তৃতীয় তলার বারান্দায়। আমার এক পাশে লঞ্চের আলোকিত কোলাহল, কেবিনের টিভিতে চলমান দেব-শুভশ্রীর বাংলা ছবি আর অন্য পাশে রাত্রির বিস্তীর্ণ শান্ত নদী। বারান্দায় আমার পাশ দিয়ে একটা ছোট শিশু হেঁটে যায়, প্রতিবার হাঁটলেই তার জুতাজোড়া থেকে ভেসে আসছে বিচিত্র সব শব্দ। পিছনে ভাতের প্লেট নিয়ে দাঁড়ানো তার মা। পরম মমতায় তিনি ডাকছেন- বাবা আরেক বার। ভাতের প্লেট কিংবা মা কারো প্রতি শিশুটির কোন মনযোগ নেই, তার সকল মনযোগ এই মুহূর্তে আবর্তিত হচ্ছে তার অদ্ভুত জুতাজোড়াকে ঘিরে। সে হাঁটছে আর বিচিত্র একটা শব্দ উৎপাদন করছে। আমার নিজের মার কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় হয়তো আমার মাও এমন কাতর ভঙ্গীতে ভাতের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কে জানে হয়তো নিজের ফেলে আসা শৈশবটাকেই চোখের সামনে দেখছি। লঞ্চের সামনের দিকে দেখি এক তরুণী বিরহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিছনে ফেলে আসা ঢাকার মিটমিট করে জ্বলতে থাকা আলোর দিকে, কোন প্রিয়জনকে কি ফেলে এসেছে ব্যস্ত শহরটিতে? হয়তোবা। ক্যান্টিন বয়রা দেখি কেবিনে কেবিনে নক করে রাতের খাবারের অর্ডার নিচ্ছে। খেয়ে রওয়ানা দিয়েছি বলে কিছুই অর্ডার করলাম না। চারপাশের আকাশ জুড়ে দেখি শুধুই মেঘ। মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলায় পুরো আকাশ রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ এই মুহূর্তে মেঘের হাতে, একবিন্দু জমি সে চাঁদকে ছাড়তে রাজী নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো এক সময় হার মানবে মেঘ, দিগন্ত ঘিরে দেখা দিবে রুপালী কোমল জ্যোছনা কিংবা জয় হবে মেঘের, অঝোর বৃষ্টি হয়ে এক সময় সে ঝড়বে নদীর বুকে।
বরিশাল যাবার সুযোগটা পেলাম হঠাৎ করেই, চাকুরী সুত্রে। বাংলাদেশে দারিদ্রের হার বেশি এমন তিনটি বিভাগ হচ্ছে রংপুর, বরিশাল, রাজশাহী। যেখানে দারিদ্রের হার বেশি সেখানে কনডম আর বার্থ কন্ট্রোল পিলের মার্কেট ডিমান্ড বেশি। পরিবারে একটা বাড়তি সন্তান মানে এক গুচ্ছ বাড়তি খরচ। নারীদের শরীরে বার্থ কন্ট্রোল পিলের নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব আছে, বার্থ কন্ট্রোল পিল এভোয়েড করাই বেটার আজকাল অনলাইনে এরকম একটা প্রচারণা আছে। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে কনডম হচ্ছে সবচেয়ে সহজ এবং সস্তা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী। একটা কনডম কোম্পানীর সেলস এক্সিকিউটিভ আমি, সপ্তাহে ছয়দিন ঢাকার আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে ঘুরে কনডমের অর্ডার সংগ্রহ করি। তারপর সেগুলো হেড অফিসকে বুঝিয়ে দেই। কনডম কোম্পানীতে চাকরী করি একথা পরিবার আর বন্ধু বান্ধবকে বলতে লজ্জা পাই, মিথ্যে করে বলি একটা ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরী করি। পাঠকরা হয়তো ভাবছেন এত যখন লজ্জা পাই তাহলে চাকুরীটা করি কেন, কারণ এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। দুইবার বিসিএস দিয়েও টিকিনি। বেকারত্বের দীর্ঘ অমর খরা শেষে এই চাকুরীটা ছিল আমার জন্য ছিল এক পশলা বৃষ্টির মত । পুরো মাসের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে যখন মাসের বেতন হাতে পাই তখন নিমেষেই যেন সব লজ্জা কষ্ট হাওয়া হয়ে যায়। এই টাকায় গ্রামে আমার প্যারালাইসিসে আক্রান্ত প্রায় বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসা চলে, চলে একমাত্র ছোট বোনটির লেখাপড়া। রংপুর, বরিশাল, রাজশাহী এই তিন বিভাগকে ঘিরে আমাদের কোম্পানীর ষ্পেশাল মার্কেটিং ষ্ট্রাটেজি আছে। তৃনমূল পর্যায়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পুরুষদের টার্গেট করে বাজারে আসা আমাদের নুতুন প্রডাক্টটির মার্কেটিং ক্যাম্পেইন করার দায়িত্বটা আমার। এই ধরনের কাজ আগে কখনো করি নাই, আমার জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। ঠিক ভাবে করতে পারলে নেক্সট এজিএমে এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে একটা প্রমোশন পাবার সম্ভাবনা আছে। হেড অব মার্কেটিং বশির স্যার অনেক আশা করে আমাকে এসাইনমেন্টটা দিয়েছেন। একদিন ডেকে বললেন-
-আহাদ সাহেব, বুঝলেন সেক্স হচ্ছে আমাদের সমাজে এক ধরনের ট্যাবু। লোকজন কনডমের মার্কেটিং ক্যাম্পেইনিং দেখে মজা পাবে, ফলে আশা করি সেখানে দর্শক শ্রোতার অভাব হবে না। একটা সফল সিনেমা হচ্ছে সেই সিনেমা যে সিনেমা শেষ হবার পরও কিছু দৃশ্যের রেশ দর্শকের মনে থেকে যায়, কারন তারা সেই দৃশ্যে থাকা ক্যারেক্টারগুলোর সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে শুরু করে। আমাদেরও কাজ হচ্ছে আমাদের প্রোগ্রামে দর্শক শ্রোতাকে রিলেট করানো। তারা যেন শো শেষ করে সবকিছু ভুলে না যায় সেটা এনসিওর করাই আমাদের প্রধান কাজ। তারা যখন আমাদের ক্যাম্পেইনের সঙ্গে রিলেট করবে ঠিক তখনই তারা আমাদের প্রডাক্ট কিনতে ইন্সপায়ারড হবে।
আমি মনযোগী ছাত্রের ভঙ্গীতে বলি- জ্বি স্যার।
– আর অবশ্যই কনডম সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমান তথ্য জেনে রাখবেন যেন প্রয়োজনের সময় সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
আমি আবারো বলি- জ্বি স্যার।
বশির স্যারের কথা মত কনডম সম্পর্কে বিচিত্র কিছু তথ্য মুখস্থ করে রাখি। যেমন-
১) পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন কনডম আবিষ্কৃত হয়েছে সুইডেনে। ষোল শতাব্দীতে এই কনডম তৈরী করা হয়েছিল শূকরের নালী দিয়ে।
২) বিশ্বের পার ক্যাপিটা কনডম ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি জিম্বাবুয়েতে। আর সবচেয়ে কম নাইজারে। দুটোরই ভৌগলিক অবস্থান আফ্রিকায়।
লঞ্চের বারান্দায় একটানা বসে থেকে কিছুটা ঝিমুনির মত এসে যায় আমার। ঝিমুনি কাটানোর জন্য নিচতলার ডেকে যাই। মার্ক্স আর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজ থেকে মুক্তির উপায় এনালাইসিস করেছেন সেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের এক সহজ নিদর্শন যেন লঞ্চের ডেক। ডেকের মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে আছে কিছু ক্লান্ত বিষন্ন নিম্ন আয়ের মানুষ। কেউ সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে ঢলে পড়েছে রাজ্যের ঘুমে। কেউ বা ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে টিভি পর্দায় চলমান কলকাতার বাংলা সিনেমার দিকে, সেখানে নায়ক তার নায়িকার বড় ভাইয়ের মন জয় করার জন্য রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে জমিতে ফসলের চাষ করছে। নায়কের জন্য করুণা হয় আমার। আমাদের দেশে প্রেমের সার্থক পরিণতির জন্য শুধু প্রেমিকার মন জয় করলেই চলে না, একই সঙ্গে জয় করতে হয় প্রেমিকার বাবা বা ক্ষেত্র বিশেষে বড় ভাইয়ের মন। একদল তরুণ বসেছে তাসের বান্ডিল নিয়ে। কেউবা তাকিয়ে আছে হাতের মোবাইলটির দিকে। ডেকের এক কোণায় একটা খাঁচায় ভরা ময়না পাখির দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা ছোট মেয়ে। কিছুক্ষণ পরপর সে একটা করে গমের দানা ছুঁড়ে দিচ্ছে খাঁচার ভিতরে। মুহূর্তেই সেটিকে মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলছি পাখিটি। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটি কখনোই একটির বেশি গমের দানা ছুঁড়ে দিচ্ছেনা। প্রতিবার সেটি গিলে ফেলবার পর পাখিটি তাকাচ্ছে মেয়েটির দিকে। দুইজোড়া সরল চোখের দৃষ্টিতে লেখা হচ্ছে নিষ্পাপ বন্ধুত্বের গল্প। লঞ্চের আরেক কোণে ইলিশ ভাজা হচ্ছে। এক মধ্য বয়সী লোক তার লোমশ হাতে লবণ মরিচ মাখানো ইলিশ ছেড়ে দিচ্ছে কড়ইয়ের গরম তেলে। তেলে ভাজার মচমচ শব্দ আর ইলিশের সুঘ্রাণ মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আবহ তৈরী হচ্ছে আগ্রহী ক্রেতাদের মনে। তারা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কড়ইয়ের গরম তেলে ভাজতে থাকা ইলিশের টুকরাটির দিকে। তাদের ক্ষুধা বাড়ছে।
ডেকের ক্যান্টিনে একটা কফির অর্ডার করি , কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ভিন্ন একটা ভাবনা মাথায় আসে আমার- কি হবে যদি মাঝ নদীতে হঠাৎ ঝড়ে ডুবে যায় লঞ্চ। ডেকের যাত্রী আর উপর তলার এসি-নন এসি কেবিনের মিডল-আপার ক্লাস যাত্রীদের মধ্যকার শ্রেনীব্যবধান ঘুচে যাবে নিমেষেই। তারা সকলেই ঝাপিয়ে আরেকটু সময় বেঁচে থাকবার প্রাণান্তকর চেষ্টায়। জীবন মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে একদম ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সবারই কমন মৌলিক চাহিদায় পরিণত হবে কয়েক গ্রাম বিশুদ্ধ অক্সিজেন। এরকমই কি কোন ঝড় উঠেছিল একসময় রাশিয়া, চীন, কিউবায় যে ঝড়ে উপড়ে পড়েছিল সকল শ্রেনীবিভক্তির শিকড় ? ডেকের কোণে সেই ছোট মেয়ে আর তার সঙ্গী খাঁচার ময়না পাখিটির কথা মনে পড়ে আমার । ওদের সরল বন্ধুত্বের কথা ভেবে লঞ্চ ডোবার ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি, আজ রাতের জন্য থাকুক না হয় শ্রেণীব্যবধান।
ডেকের বিচিত্র জীবন দেখে যখন তৃতীয় তলার বারান্দায় আমার আগের অবস্থানে ফিরি, দেখি যে আমার সিটে বসে আছে এক মধ্য বয়সী লোক। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি, তার পরনে পায়াজামা পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি, দুগাল বেয়ে নেমে আসছে মেহেদী রং দাড়ি। আমাকে দেখে বিনয়ী ভঙ্গীতে বলেন- ছোট ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনার সিটে বইসা পড়ছি।
তার উল্টোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে আমি উত্তর দেই- না না ঠিক আছে।
ভদলোক – জিজ্ঞেস করেন- ভাইয়ের বাড়ি কি বরিশালেই?
-জ্বিনা, অফিসের কাজে যাচ্ছি।
-ও আচ্ছা। অফিসের কাজ কি শুধু শহরেই ?
-শহর প্লাস শহরের বাইরেও যেতে হতে পারে।
-বরিশালে গৌরনদী নামে একটা উপজেলা আছে জানেন?
-নাম শুনেছি।
-আমার বাড়ি গৌরনদী । আমি গৌরনদী জামিয়া মিলিয়া মাদ্রাসায় আরবি পড়াই। আমার নাম আবুল বাহার। ওয়াজ মাহফিলের পোস্টারে অবশ্য আবুল বাহার সদানন্দপুরী লেখা হয়। গ্রামের নাম সদানন্দপুর, ঐ থেকে সদানন্দপুরী । একটু আকটু ওয়াজ করি, মানে মুল বক্তার বয়ান শুরুর আগে আমরা ছোট বক্তারা কিছুক্ষণ কথা বলি।
আমি মৃদু হেসে বলি- ও আচ্ছা।
এই পর্যায়ে ভদ্রলোক তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওয়াজ মাহফিলের পোস্টারের ছবি আমাকে দেখান, সম্ভবত তার পরিচয় ঘিরে আমার মনে থাকা সামান্য সন্দেহটুকু দূর করবার আশায়। আমি দো জাহানের অশেষ নেকি হাসিলের আহ্বান যুক্ত পোস্টারের ছবি দেখি মোবাইলের পর্দায়।
তিনি বলেন – বুঝলেন ভাই, লঞ্চের পরিবেশ আর আগের মত নাই, এই লঞ্চ গুলান পরিণত হইছে বেলেল্লাপনার প্রধান জায়গায়। খালি লঞ্চ না মনে হয় পুরা সমাজ আস্তে আস্তে পইচা যাইতাছে।
একটা সরস গল্পের ঘ্রাণ পেয়ে আমার মৃদু কৌতূহল জাগে, জিজ্ঞেস করি- কেন তার এরকম মনে হল?
মাওলানা আবুল বাহার সদানন্দপুরী স্যান্ডেল থেকে তার পা জোড়া খুলে চেয়ারে আরাম করে বসেন। তার সংগ্রহে থাকা অসংখ্য গল্পের মধ্য থেকে আমাকে যে গল্পটা শোনান তা শুনে আমার এতক্ষণের ক্লান্তি মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যায়। ঘটনাটা হল এরকম-
লঞ্চে উঠার কিছুক্ষণ পর বাথরুমের বেগ আসে মাওলানা আবুল বাহারের, একেবারে বড় বাথরুম। অগ্যতা তড়িঘড়ি করে তিনি ছোটেন বাথরুমের দিকে, গিয়ে দেখেন সব কটা বাথরুম একই সঙ্গে এনগেজড। তিনি বেশ খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকেন, তার অস্তিরতা চক্রাকারে বাড়ে, কপালে জমে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এক সময় একটা বাথরুম ফাঁকা হয়, তিনি রুদ্ধশ্বাসে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেন। যখন তিনি ঠিক করেছেন যে কমোডে বসবেন ঠিক তখনই তিনি আবিস্কার করেন যে কমোডে জমে থাকা পানির মধ্যে ভাসমান একটি ব্যবহৃত সুডৌল কনডম, যেন বিলের মধ্যে ভেসে থাকা সদ্য ফুটন্ত কোন এক শাপলা ফুল। ঐ জিনিস দেখে মাওলানা আবুল বাহারের বাথরুমের বেগ কমে আসে, তার মধ্যে জন্ম নেয় ভিন্ন এক অস্বস্তিবোধ। এক পর্যায়ে তিনি হাই কমোডের বাটনে পুশ করেন এই আশায় যে কয়েক লিটার পানি এসে ঐ জিনিসটাকে সরিয়ে নিয়ে তার মনের যাবতীয় অস্বস্তিবোধ দূর করবে। কিন্ত মজার ব্যাপার হচ্ছে মুহূর্তেই কিছু পানির মধ্যে ডুবে গেলেও দক্ষ সাঁতারুর মত ডুবতে যেয়েও সে যেন আবার নুতুন করে ভেসে ওঠে। যেন হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে পরাজিত মাওলানা আবুল বাহার সদানন্দপুরীর দিকে। মাওলানা আবুল বাহার অসহায় বোধ করেন। অতঃপর তিনি ঐ বাথরুম থেকে বের হয়ে অন্য একটি বাথরুমে ঢুকে তার প্রাকৃতিক কর্ম সারেন এবং একই সঙ্গে লঞ্চের বেলেল্লাপনা সম্পর্কিত এই উত্তরাধুনিক ধারণাটি তার মনে পাকাপোক্ত ভাবে আসন গাঁড়ে।
আমাদের কথাবার্তার এক পর্যায়ে সামনের কেবিনের দরজা খুলে যায়, ভেতর থেকে বের হয়ে আসে এক সুন্দরী তরুণী আর তার সঙ্গী এক যুবক। তারা এসে দাঁড়ায় বারান্দার রেলিং ধরে। তরুণীর লম্বা চুল, তার চুলের একাংশ গিয়ে পড়েছে, যুবকটির ঘাড়ে। রাজ্যের মেঘের ভিড়ে জানালার মত ফাঁক করে উঁকি দিতে শুরু করেছে হলুদ উদাস চাঁদ, রুপালী জ্যোছনার একাংশ গিয়ে পড়ছে তাদের মুখে । নিচতলার কোন এক নির্ঘুম যাত্রীর মোবাইল থেকে ভেসে আসছে সাহানা বাজপেয়ীর রবীন্দ্র সঙ্গীত-
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা,
এসো হে গোপনে আমার স্বপনলোকে দিশাহারা
ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন…
আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা।
নদী, জ্যোছনা, প্রেমিক-প্রেমিকা আর সাহানা বাজপেয়ী মিলিয়ে নদীর বুকে পরাবাস্তব একটা আবহ তৈরী হয়। রোমান্টিক একটা সিনেমার শেষ দৃশ্য হিসেবে দৃশ্যটা মনে হয় মন্দ হবে না। তবে এই দৃশ্য মনঃপুত হয় না আমার সঙ্গী মাওলানা আবুল বাহার সদানন্দপুরীর। তিনি বিড়বিড় করে বলেন- দেখছেন বেলেল্লাপনার নমুনা!
রাত গভীর হলে এক সময় নীরব হয়ে যায় লঞ্চ। মাওলানা আবুল বাহার তার কেবিনে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, তার রুম থেকে নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসতে থাকে। মোহনায় প্রবেশ করলে প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে লঞ্চের বুকে। তারপর এক সময় আবার শান্ত হয়ে যায় নদী। বারান্দা ছেড়ে লঞ্চের সামনের দিকটায় এগিয়ে যাই। লঞ্চের এদিকটা বেশ অন্ধকার। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাই, সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। মুহূর্তেই একটা ভেজা ঠান্ডা বাতাস এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি ঠান্ডায় কাঁপতে থাকি।
কতক্ষণ পার হয়েছে জানি না। আপনে তো দেহি ঠান্ডায় কাঁপতাছেন, এরকম একটা কথা শুনে পিছনে ফিরে তাকাই আমি। দেখি আমার ঠিক দুই হাত পিছনে লঞ্চের মেঝেতে কাঁথায় মুড়ে শুয়ে থাকা দুই নির্ঘুম কিশোর। জিজ্ঞেস করি- কে তোমরা ?
একজন উত্তর দেয়- আমরা লঞ্চের ক্যান্টিনে কাম করি।
-এখনো ঘুমাওনি?
-কি করুম ভাই, ঘুমতো ধরে না। আপনে তো ঠান্ডায় কাঁপতাছেন, আমাগো একটা বেশি কাঁথা আছে, নিবেন?
আমি ওদের কাছ থেকে কাঁথাটি নেই, সেটিকে জড়িয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। মিটিমিটি আলোর মধ্যেও কাঁথার এক কোণে থাকা লেখাটি পড়তে পারি -“মনে রেখো আমায়”। যে নারী দিনের পর দিন পরম মমতায় বুনেছে এই কাঁথাটি, এক রাশ উষ্ণতার প্রতিদানে সে শুধু চাইছে আমরা যেন তাকে মনে রাখি। কাঁথার পরশে কিছুক্ষণ পর আমার শরীরের তাপমাত্রা আবার স্বাভাবিক হতে থাকে, আমি আবার উষ্ণ হতে থাকি। এই উষ্ণতার প্রতিদানে কিশোরদুটোকে কিছু একটা দিতে ইচ্ছে হয় আমার। জিজ্ঞেস করি- এই কাঁথাটির বদলে কি চাও তোমরা?
একজন হেসে বলে- না না কিছু লাগবো না।
-আরে বল না , কি চাও তোমরা ? টাকা?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে একজন উত্তর দেয়- ভাই একটা গান শোনাইতে পারবেন?
গান! আমি রীতিমত আকাশ থেকে পড়ি। এত কিছু থাকতে এরা কিনা মধ্যরাতে শেষ পর্যন্ত আমার কাছে গান শুনতে চাইছে! সাবরিনার কথা মনে পড়ে আমার। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় একবার আমাদের ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের সবাই মিলে গিয়েছিলাম গাজীপুরের শাল বনে। রাতে ক্যাম্প ফায়ার ঘিরে সবাই কিছু না কিছু বলছিল- গান, কবিতা কৌতুক। সাবরিনা এসে আমাকে বলেছিল- তুমি একটা গান শোনাও।
না না বলে এভোয়েড করার চেষ্টা করলেও সবার জোরাজুরিতে কি একটা যেন গেয়েছিলাম। সাবরিনা সেই গান শুনে বলেছিল- তুমি তো বেশ ভাল গান গাও। তোমার তো এনুয়াল প্রোগ্রামে গান গাওয়া উচিত।
আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম- সেটা কখনোই সম্ভব নয়, ষ্টেজে দাঁড়ালে আমার হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে যায়।
আমি আর সাবরিনা ক্যাপিটাল এসেট প্রাইসিং মডেলের ব্যাখ্যা সম্বলিত নোট দেওয়া নেওয়া করতাম, কখনো আমি সাবরিনাকে বোঝাতাম ম্যাক্রোইকোনমিক্সের ডিমান্ড-এগ্রিগেট সাপ্লাই মডেল, কখনো সাবরিনা আমাকে বোঝাত হ্যারি মারকোইটজের মর্ডান পোর্টওফোলিও থিওরি। ডিমান্ড-এগ্রিগেট সাপ্লাই মডেল আর মর্ডান পোর্টওফোলিও থিওরির বাইরেও একবিংশ শতাব্দীর একজন তরুণ তরুণীর মধ্যে আরো কিছু সম্পর্ক যে হতে পারে এ ব্যাপারে বেশি কিছু ভাববার মত সাহস তখন ছিল না আমার মধ্যবিত্ত ভীরু মনের। এর পর এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে ক্যাম্পাসের চায়ের দোকানে উদাস মনে বসেছিলাম। সাবরিনা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল , হাতে একটা সোনালী খাম। বলেছিল – আরে তোমাকেই তো খুঁজছি, আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে, মনে করে অবশ্যই আসবে কিন্ত!
সাবরিনার ভেজা চুল, ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি। সাবরিনার ভেজা চুল বেয়ে নেমে আসা কয়েক ফোঁটা জল পড়ে ভিজে গিয়েছিল সেই সোনালী খাম।
আমার ভাবনা চিন্তাগুলো আবার ফিরে আসে ঢাকা থেকে বরিশাল গামী কীর্তনখোলা -১০ লঞ্চে। আকাশ থেকে মেঘ এখন পুরোপুরি বিদায় নিয়েছে। চারপাশের পৃথিবী জুড়ে এখন শুধুই জ্যোছনা। দু পাশে পদ্মার অফুরন্ত জলরাশি আর চরাচর ব্যাপী জ্যোছনার মধ্যে দুই খেয়ালী নির্ঘুম কিশোরকে আমি শুনাই রূপঙ্করের গান-
আজ শ্রাবণের বাতাস বুকে এ কোন সুরে গায়
আজ বরষা নামলো সারা আকাশ আমার পায়…
Leave A Comment