প্রশ্নটা মেয়েদের কাছে।
প্রথম কখন আপনি অ্যাবিউস হয়েছিলেন? মানে ইভটিজিং এর স্বীকার,কিংবা কেউ আপনার শরীরে অনুমতি ছাড়াই ইনঅ্যাপ্রপিয়েটলি/অনুচিতভাবে হাত দিয়েছে কিংবা ইঙ্গিত করেছিল?
উত্তর দিতে হবে না। আমি জানি,খুব কম বয়সেই আপনি, আমি, আমরা এই জঘন্য অভিজ্ঞতার স্বীকার হয়েছি। প্রশ্নটা করলাম কারন আজকের লেখার সাথে প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক।বলা হয়ে থাকে মেয়েরা বিপদ আগে থেকে টের পায় কিংবা মেয়েদের সিক্সথ সেন্স অনেক প্রবল, কিংবা মেয়েরা বদ পুরুষের হাব-ভাব বুঝতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি এখানে প্রশ্ন হল কেন পারে? একই পরিবারে একই পরিবেশে বড় হওয়া একটা ছেলে থেকে, একটা মেয়ের মধ্যে, বিপদ আগে থেকে টের পাওয়ার ক্ষমতা, ঐ ছেলেটার থেকে কেন বেশি হয় ?
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় তরঙ্গের ফেমিনিজম, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী পুরুষের দৃশ্যমান বৈষম্য গুলোর দিকেই দৃষ্টি দিয়েছে। কিন্তু চতুর্থ তরঙ্গের ফেমিনিজম আসলে অনেক বেশি সাইকোলজিকাল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠা নারীদের শারীরিক ক্ষতিগুলো দৃশ্যমান হলেও মানসিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়নি এতদিন। চতুর্থ তরঙ্গের ফেমিনিজম, এই বিষয়গুলোকেই সামনে এনেছে।
বিষয়টা বুঝিয়ে বলি,
ঢাকার রাস্তায় রাত ১২টার সময় একটা ছেলে বাইরে যেতে ভয় পাবে কারন, ছিনতাই হতে পারে, একটা গাড়ি তাকে চাপা দিতে পারে, কেউ তাকে খুন করে ফেলতে পারে, কিন্তু একটা মেয়ে রাত ১২টায় একা বাইরে যেতে চাইবে না, তার কারণ সে জানে তার কোন বিপদ হলে প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করা হবে, এত রাতে কেন বাইরে গেছিলা? সে সেক্সচুয়ালি অ্যাবিউসড হলে প্রশ্ন করা হবে, সে কোন পোশাক পরেছিলা? একা কেন গেছে? তার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে, তাকে মন্দ মেয়ে বানিয়ে ক্রাইমটাকে জাস্টিফাই করা হবে। অথচ কোন ছেলের সাথে ক্রাইম হলে ছেলেটাকে এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন কিংবা এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। তাই বিপদের ঝুঁকি গুরুত্ব না দিয়ে, ছেলেরা রাত বিরাতে বাইরে যায়। আড্ডাবাজি তথা সোশ্যালাইজ করে। এটা তাদের স্বাভাবিক জীবনের অংশ।
আমাদের দেশের হিসাব বাদ দিলাম, খোদ ওয়াশিংটনে সিয়াটেল এর অধিবাসীদের উপরে করা একটা রিসার্চ অনুযায়ী, ৪২ ভাগ মেয়ে শুধু বিপদে পড়তে পারে জেনে নিজেকে সোশ্যালাইজ করা করা থেকে বিরত রাখে,যেখানে ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৯ ভাগ !যেখানে মেয়েরা বিপদের ভয়ে সোশ্যালাইজ-ই করে না, সেখানে তার সিক্সথ সেন্স ভাল, বিপদ আগেই টের পায়, অনেক বেশি ম্যাচিউর ইতাদি বলে আসল সমস্যাটা পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু না ।
‘নারীরা বাইরে নিরাপদ না’ এই কনসেপ্টটাই আসলে একটা অপকারী কনসেপ্ট। আমাদের মাইন্ড সেটটা এমন হয়ে গেছে যে, মেয়েরা বাইরে গেলেই অ্যাবিউস হবে তাই তাদের পাবলিক এক্সেস যত কম তত তারা নিরাপদ, অথচ স্টাটিস্টিকস অনুযায়ী মেয়েরা ঘরে এবং পরিচিত মানুষ দ্বারাই অ্যাবিউস বেশি হয়। তাহলে মেয়েদের সিক্সথ সেন্স কিংবা বিপদ বোঝার ক্ষমতা আসলে কি কাজে লাগে!!
এই যে এতদিন ধরে ভেবে এসেছেন মেয়েরা বিপদ বোঝে,তারা পুরুষের চোখ দেখলে বুঝে ফেলে মনের কথা, এটা তাদের গুণ, অথচ আজকে জানছেন যে মেয়েরা বোঝে কারন তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করে। এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করার কুফল!!!
মাথায় কি জট পাকিয়ে গেছে? গেলেও সমস্যা নাই, কারন হল এই বিষয় আমাকে বুঝতে, রাইট এমাউন্ট অফ প্যানিক: হাউ ওমেন ট্রেড ফ্রিডম ফর সেফটি, মি টু এন্ড দা পলিটিক্স অফ সোশ্যাল চেইঞ্জ, গার্ল ট্রাবল: প্যানিক এন্ড প্রগ্রেস ইন দা হিস্ট্রি অফ ইয়ং ওমেন পড়তে হয়েছে। জট খুলতে রেফারেন্স দিলাম, পড়ে দেইখেন। সেই সাথে শিল্পা ফাদকে(Shilpa Phadke) এর টেড-টক টাও দেখে নিয়েন।
যাই হোক প্রসঙ্গে ফিরি,
এই যে মেয়েদের বিপদ বোঝার ক্ষমতা টাইপ ধারনা হল ছোট বেলা থেকে তারা যে জঘন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে তার প্রতিফলন। এই প্রক্রিয়ার ভেতরে বড় হওয়া মেয়েদের মানসিক বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে আর এখানে তার মানসিক ক্ষতি দৃশ্যমান তখনই হয়, যখন সে ছেলে দেখলেই এক্সট্রা সতর্ক হয়, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠতে ভয় পায়, নির্জন রাস্তা দেখলে তার হাত পা ঠাণ্ডা হতে শুরু করে, কোন অপরিচিত পুরুষ তার দিকে তাকালে সে আঁতকে ওঠে। বাসার বাইরে যেতে অস্বস্তি বোধ করে ইত্যাদি মানসিক ট্রমা।
একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শুধু মেয়েদের অর্থনৈতিক, শারীরিক, সামাজিক বৈষম্যই দেয় না, সেই সাথে তার মানসিক স্বাভাবিক বিকাশ এর পথ বন্ধ করে দেয়। আর এই বিষয়টাই হল মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য।
এখন প্রশ্ন হল এই বৈষম্য দূর করতে চতুর্থ তরঙ্গের ফেমিনিজ কিভাবে কাজ করছে? এর একটা ভাল উদাহরণ আমাদের পাশের দেশ ভারতেই আছে। মুম্বাইয়ে কিছু মেয়ে মিলে #WhyLoiter মুভমেন্টটা শুরু করেছিল। কোন কারন ছাড়াই ছেলেদের মত রাত-বিরাতে বাসার বাইরে আড্ডা দেয়া, চা খাওয়া, কিংবা স্রেফ সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছিল যে ‘মেয়েদের রাতে বাইরে যাওয়া যাবে না’ টাইপ ট্যাবু কিংবা ভয় ভাঙাতে, এবং বর্তমানে এটা যথেষ্ট বড় মুভমেন্ট হয়ে গেছে।
মিটু মুভমেন্ট এর কথা পাড়ার অশিক্ষিত লোকটাও জানে, তাই এটা নিয়ে বলার কিছু নাই।
আপনার, আমার, সর্বোপরি এই সমাজের বোঝার সময় এসেছে যে, মেয়েদের সিক্সথ সেন্স ভাল কিংবা তারা অল্প বয়সে ম্যাচিউর হয় ভাবা আসলে প্রশংসা না। তাদের কে খুব অল্প বয়স থেকেই নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য লড়াই করতে হয়, যেটা একটা ছেলের করা লাগে না। আর এই কারনে মেয়েরা সব সময় সতর্ক থাকে, যেমন খাঁচার ভেতরে একটা বাঘ কে রোজ পেটালে সে লাঠি দেখলেই ভয়ে সরে যাবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এটা তার ম্যাচিউরিটি না, তার অভিজ্ঞতা, তার স্বাভাবিক স্বভাব কেড়ে নেবার প্রক্রিয়া।
অনেক ভালো লাগলো পড়ে,আমাদের সমাজের দৃষ্টিপরিবর্তন হবে আমাদেরই প্রচেষ্টায়।
লেখক হিসেবে আপনাকে বা কথাগুলো অবমাননা করার কোন কারন নেই। কিন্তু নারী বিষয়ে সমতার জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতার যে রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন তাকে মনুষ্য সৃষ্টি রহস্যের সাথে মিলিয়ে দেখা দরকা।
স্বীকার করি, হিমবাহের নীচে পরিস্থিতি এমনই ভয়ংকর।
নারী অধিকারের গুরুতর বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরায় ক্যামেলিয়াকে ধন্যবাদ। উড়ুক 👌
অসাধারণ, প্রতিটি মেয়ের এই লিখাটি পড়া উটিৎ………………………..ধন্যবাদ।
সুন্দর লিখেছেন, ভালো লাগলো। আমার মেয়েটার বয়স সাড়ে তিন বছর মাত্র অথচ ওকে নিয়ে আমার কতোই না টেনশন। মেয়েটাকে দেখি আর মাঝে মাঝে ভাবি, তুই মেয়ে হয়ে কেন জন্ম নিশি ।
ধন্যবাদ। আপনার মেয়ের জন্য শুভকামনা রইল।
“মা বা বোন হিসেবে যে সম্মানটা দেওয়া হয় সেটাও পারতপক্ষে অপমান।” ফেসবুকে মন্তব্যটা করি
। আপনি ব্যখ্যা চেয়েছিলেন। কোন কারনে আমি ফেসবুকে রিপ্লাই দিতে পারছিনা😞। তাই এখানে দিলাম।
প্রথমত নারীকে নারী হিসেবে কেন সম্মান দেওয়া যাবেনা? মা বা বোনের সম্মানটা নারী হিসেবে নয় মা অথবা বোন হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। এখানে আমার মনে হয় নারীর নারীত্ব এবং ব্যক্তি স্বত্ত্বা চাপা পড়ে যাচ্ছে। আমার কাছে এটা অপমান
ধন্যবাদ।
শক্তিশালী লেখা। নিজ থেকে বাংলাদেশের মেয়েদের খুব সাহস করে দল বেঁধে এগুতে হবে। কোথাও কোথাও হচ্ছে সম্ভবত এইসব ট্যাবু ভাঙার কাজ। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ ফড়িং।
ধন্যবাদ কাজী দা।