থ্রিলার পাঠকদের আসর ফেসবুক গ্রুপে “পাঁচটি রহস্যময় ঘটনা, এখনো যার কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পান নি বিজ্ঞানীরা” নামে একটি পোস্ট দেয়া হয়েছিলো। সে প্রসঙ্গে লিখছি। দেখা যাক, ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কি না।
ঘটনা ১- ড্যান্সিং প্লেগ
বিবরণ- “১৫১৮ সালের জুলাই মাসে মিসেস ত্রোফফেয়া নামের এক নারী” হঠাৎ নাচতে শুরু করেন। তার দেখাদেখি আরো শত শত মানুষ নাচতে থাকেন, এবং টানা এক মাস নেচে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এক মাস ধরে অবিরাম নাচতে থাকা কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই এর যথাযথ ব্যাখ্যাও বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি।
ব্যাখ্যা- হ্যাঁ, এরকম ঘটনা আসলেই ঘটেছিলো। কিন্তু এর কি কোন ব্যাখ্যা নেই? আছে। ধারণা করা হয়, যে মহিলার মাধ্যমে নাচ শুরু হয়েছিলো, তিনি Ergot নামক একটি ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। রাই থেকে রুটি তৈরির সময় কোনভাবে তার ভেতর এটি সঞ্চালিত হয়েছিলো। এই বস্তুটি অনেকটা এলএসডির মত কাজ করে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ড্রাগসের প্রভাবে একজন নাচতে পারে, কিন্তু এতজন মানুষ কেন তার সাথে যোগ দিলো? এর ব্যাখ্যা হিসেবে মনোবিজ্ঞানীরা যে তত্ত্বটি দেন, সেটি হজম করা একটু কঠিন হলেও সেটা মোটেও অবাস্তব না। তারা ম্যাস হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলো। ম্যাস হিস্টেরিয়া (Mass Hysteria) অথবা ম্যাস সাইকোজেনিক ইলনেস (Mass Psychogenic Illness); একসাথে সংঘবদ্ধভাবে অদ্ভুত এ ধরণের আচরণ করাকে বলে ম্যাস হিস্টেরিয়া। ম্যাস হিস্টেরিয়া কেন বা কোথায় হয়? সাধারণত এমন সব এলাকায় হয়ে থাকে, যেখানকার মানুষেরা প্রচণ্ডরকম স্ট্রেস এর মধ্যে থাকেন। সেই সময় স্ট্রসবাগের অধিবাসীরা নানারকম রোগ ব্যাধি এবং দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত ছিলেন। তাই তাদের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটা অসম্ভব না।
Mass Psychogenic Illness এর উদাহরণ কিন্তু বাংলাদেশেই আছে! সন তারিখ মনে নেই, তবে মাঝখানে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিলো মফস্বলের স্কুলে (নির্দিষ্ট করে নাম বলতে পারছি না)। সেখানে ক্লাসরুমে হঠাৎ করে বাচ্চারা একসাথে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো। শ্বাসকষ্ট এবং ভীতিতে ভুগছিলো। যে সময়কার কথা মনে করতে পারছি, তখনকার খবর খুঁজে বের করা মুশকিল। তবে সার্চ দিয়ে এই বছরেরই একটি ঘটনা পেলাম, চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার। ৩৫ জন ছাত্রী ক্লাসরুমে একসাথে অসুস্থ হয়ে পড়ে। লিংক- https://www.kalerkantho.com/…/country-news/2019/02/05/734031
ম্যাস হিস্টেরিয়া বা গণমনস্তাত্বিক অসুস্থতার আরেকটি চমৎকার উদাহরণ হলো Tanganyika laughter epidemic. ১৯৬২ সালে তাঞ্জানিয়ার স্কুলগুলিতে হঠাৎ করে হাসি ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক রূপে। প্রায় ১০০০ শিক্ষার্থী এতে আক্রান্ত হয়।
সুতরাং, ড্যান্সিং প্লেগ আর যাই হোক, অতিপ্রাকৃত কিছু নয়, এই উপসংহারে আসা যায়।
ঘটনা-২ সময় ভ্রমণকারী
বিবরণ- ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য আন্ড্রু কার্লসসিন নামধারী একজন ব্যক্তিকে আটক করে। আটক হওয়ার পর অ্যান্ড্রু দাবি করেন যে তিনি একজন সময় ভ্রমণকারী। ২২৫৬ সালের পৃথিবী থেকে তিনি সময় ভ্রমণকারী যানে চেপে ২০০৩ সালে পৌঁছেছেন। কিছুদিন পর নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ দিয়ে কঠোর নজরদারির জেল থেকে বেমালুম হাওয়া হয়ে যান এই সময় ভ্রমণকারী।
ব্যাখ্যা- এটা পুরোপুরি অসত্য একটি দাবী। http://www.weeklyworldnews.com/নামক একটি এন্টারটেইনমেন্ট সাইটে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ২০০৩ সালে ইন্টারনেটে খবরের জন্যে প্রধান উৎস ছিলো ইয়াহু নিউজ। তারাও তাদের এন্টারটেইনমেন্ট অংশে এই খবরটি প্রকাশ করে।
লিংক http://web.archive.org/…/ent…/wwn/20030319/104808600007.html(পেইজটি এখন আর লাইভ নেই, আর্কাইভ থেকে নেয়া)।
ইয়াহুতে প্রকাশিত হওয়ার পর মেইনস্ট্রিমের নিউজপেপারে এবং টিভিতেও চলে আসে। এফ বি আই এর দপ্তরে একের পর এক ফোন আসতে থাকে। অতঃপর ২০০৩ সালের ২৯শে এপ্রিল অপকর্মের হোতা weeklyworldnews.com নিউজের ফলো-আপ দেয় এভাবে- একজন ছদ্মপরিচয়ের ব্যক্তি ১ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। তবে এতবছর পরেও কিছু কিছু ওয়েব সাইট এবং ফেসবুক পেইজ আবার এই ঘটনাটিকে পুনরুজ্জীবিত করে লাইক, ভিউ বাগিয়ে নিচ্ছে, দুঃখজনক।
সূত্র- https://www.snopes.com/fact-check/insider-trading/
ঘটনা-৩ ব্রালরনে জাদুঘরের ছবি
বিবরণ- ১৯৪১ সালে কানাডার গোল্ড ব্রিজ থেকে একটি ছবি তোলা হয়। যে ছবিতে একজন ব্যক্তিকে দেখা যায়, যার পোশাক-আশাক মোটেও ১৯৪১ সালের মতো নয়; বরং তা বর্তমান সময়ের। তাঁর পরনে ছিল একটি চেন লাগানো হুডি, টি-শার্ট এবং অবাক করা ব্যাপার ১৯৪১ সালের ওই সময়ে তাঁর হাতে ছিল একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা ছিলো।
ব্যাখ্যা- এটার ব্যাখ্যা অতি সরল। সে যেসব পোশাক-আশাক পরে ছিলো, এবং যেসব বস্তু তার কাছে ছিলো, তার সবকিছুই ১৯৪১ সালে পাওয়া যেতো।
আপনি চাইলে সেই সানগ্লাস এখনও e-bay থেকে কিনতে পারেন। লিংক- https://www.ebay.com/b/Original-1940s-Vintag…/…/bn_111709055
তার হাতে কোন ডিএসএলআর ছিলো না। ছিলো Kodak-35 পোর্টেবল ক্যামেরা। ক্যামেরাটি সম্পর্কে পড়ুন এখানে- https://en.wikipedia.org/wiki/Kodak_35_Rangefinder
এবং সর্বশেষে তার হুডি! ওকে, সে পরে ছিলো Montreal Maroon আইস হকি টিমের জার্সি। তারা ১৯২৪ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিলো।
ঘটনা-৪ হিমায়িত বালিকা
বিবরণ- ১৯৮০ সালের ২০ ডিসেম্বর জিন হিলিয়ার্ড নামক এক নারী মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বরফের মধ্যে আটকা পড়েন। মাইনাস ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৬ ঘন্টা থাকার পর যখন তাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তার শরীর এতটাই শক্ত হয়ে গিয়েছিলো, যে ডাক্তাররা ইনজেকশন পুশ করতে পারছিলেন না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে অবিশ্বাস্যভাবে তিনি তিন দিন বাদে হাত পা নাড়াতে শুরু করেন, এবং ছয় সপ্তাহ পরে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ব্যাখ্যা- এটি সত্য ঘটনা। তাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তার শরীরে প্রাণের লক্ষণ খুব সামান্যই ছিলো। হৃৎস্পন্দন ছিলো মিনিটে মাত্র ৮ বার। ব্লাড প্রেসার ছিলোই না বলতে গেলে। তার বেঁচে থাকাটা প্রায় অসম্ভবই ছিলো। তবে এ ধরণের ঘটনা এটাই প্রথম এবং একমাত্র নয়। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় তার বেঁচে ফেরার ঘটনায় নানারকম অলৌকিকতা আরোপ করা হয়।
ঘটনা-৫ বৃষ্টি মানব
বিবরণ- ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার স্ট্রাউডসবার্গ নিবাসী ডন ডেকার তার একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ছাদ ও দেয়ালজুড়ে বৃষ্টির মতো পানি পড়া শুরু করে। অথচ বাড়ির ছাদ বা দেয়ালে কোনো পানির পাইপ সংযুক্ত ছিল না। সমস্যা সমাধানের জন্য ডনের বন্ধু পুলিশ ডাকেন। পুলিশের সহায়তায় ডনকে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির কাছের পিৎজা রেস্টুরেন্টে। অবাক করা বিষয়, ডন বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বৃষ্টি থেমে যায়।
ব্যাখ্যা- এটাকে আমার গালগল্প ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। বৃষ্টি হবার যে প্রক্রিয়া, তার সাথে একজন মানুষের শোক অথবা শক্তির কোন সম্পর্ক নেই। এই ঘটনা আপনি চাইলে বিশ্বাস করতে পারেন, চাইলে ছড়িয়ে দিতে পারেন, কিন্তু তাহলে এরকম হাজারো বুজরুকিতে আপনার বিশ্বাস আনতে হবে।
আমার নিজস্ব ব্লগ- https://hasanmahbubofficial.blogspot.com/
অনেক কিছু শেখার ও জানারআছে।