এক

আমাদের বাসায় কাজ করেন হাসুর মা, প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন তিনি। কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে আমরা মাঝে মাঝে বসে গল্প শুনি তাঁর কাছে থেকে। বেশ চমৎকার সব কাহিনী, তাঁর নিজের জীবন থেকে নেয়া। এরকম একটি কাহিনী হচ্ছে- বিয়ের কয়েক বছর আগে তাঁর সাথে গ্রামের বট গাছের এক জিন লেগে যায়। এগুলো এখনকার সময় কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য।

এমনকি বিয়ের এক যুগ পরে এখনো আরেকটি জিন মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে দেখতে আসে তাঁকে।
– জিনটা দেখতে কেমন?
– সুন্দর। এই ধরো মাঝরাতে আসে, একঘণ্টা থাহে, তারপর চলে যায়।
– হাসুর বাবা কী করে জিন আসলে?
– সে ভালা মানুষ। এসবে বিশ্বাস করে না, কখনো মাথা ঘামায় না। বেচারা রিকশা চালায়াই হয়রান।
সবাই হাসাহাসি করে, কিন্তু ভয় পায়। আমি বরাবরের মত নিরবতা পালন করি।

দুই

সামনেই পরীক্ষা। বইয়ের একটা অধ্যায় গিলতে গিয়ে রাত দুইটা বেজে গেল সেদিন। বাসা থেকে বের হয়ে কিছুটা দূরে একটু আঁধার, ওখানে গেলে তারা দেখা যায়। পথিমধ্যে দেখলাম হাসুর মায়ের বাসার পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, চুল লম্বা। সিগারেট টানছে। আমার সাথে চোখাচোখি হলে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি জিন?
লোকটা একটু হেয়ালী করে বলল, হ ভাই, আমি জিন।
– তাহলে চলুন, কিছু সময় তারা দেখি।
– হ চলো।

আমি নিবিড়ভাবে আকাশ পর্যবেক্ষণ করছি। জিন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কী খুঁজছ?

– এই কালপুরুষ তারকামণ্ডলীর একটি তারা হারিয়ে গেছে কিছুদিন থেকে। হাত থেকে নিজের আঁকা ম্যাপ বের করে দেখালাম এই দুটো তারার মাঝে একটা তারা ছিল, এখন নেই হয়ে গেছে! এটা একটা কথা হল?

জিনের হাতে ম্যাপটি দিয়ে আমি আলোক দূষণ থেকে কিছুটা রক্ষা পাবার জন্য কাগজ প্যাচিয়ে টেলিস্কোপের মত করে বানানো জিনিসটায় চোখ দিয়ে তারা খুঁজছি। হঠাৎ দেখি উনি নেই, আমার পাশেই ম্যাপটি পড়ে আছে।

বলাবাহুল্য এ অভিজ্ঞতা কারো সাথে শেয়ার করি নাই। কিন্তু এর পরে আর কখনো হাসুর মা জিনের গল্প বলে নাই। কেউ জিজ্ঞেস করলে দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে বলত, নাহ, জিন আর আসবে না। সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত মানুষ আমি, পার্থিব একটা জটিল ঘটনায় অনাবশ্যক-অনাকাংক্ষিত-আকস্মিক-নির্দোষ এই অনুপ্রবেশ মাঝে মাঝে বিব্রত করত।

তিন

রোজা মাস। এ মাস রান্না-বান্নার দায়িত্ব ছিল হাসুর মার। কিন্তু তিনদিন থেকে তিনি নেই।
দুপুরে কাউকে না জানিয়ে হিন্দু হোটেলে পেট পুরে খেয়ে আসায় আমার সমস্যা তেমন হল না। কিন্তু বাকিরা কাহিল। একজন গান বানাল,

হাসুর মা আইলো না,
হইলাম আমরা দিউয়ানা
ক্ষুধায় মরি, ছোলা-বটু
কিছুই রান্না হইল না।

অবশেষে তিনি এলেন একটা দু:সংবাদ নিয়ে। হাসুর বাবা হুট করে মারা গেছেন।
– বেচারা সকাল-সকাল রিকশা নিয়ে বের হয়েছিল। দুপুরে এসে বলল একটু পানি দিতে, শরীর তাঁর কেমন করছে। আমি রাগ করে বললাম, রোজা রাখতে চাওনা, তামাশা শুরু করছ? তারপর ঘন্টাখানেক ঝিম মেরে বসে থাকল। হঠাৎ পড়ে যাওয়ার শব্দ শোনে গিয়ে দেখি তিনি আর নেই।
– আর পানি পান করা হয় নাই?
– না, রোজামুখেই উনি মারা গেছে, কী সুন্দর মউত হইছে তানোর!
– ঠিক বলছ হাসুর মা, রোজা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। অনেক উপকার নিয়ে মারা গেছে তিনি! রোজা রেখে দরিদ্রদের অনাহারে থাকার কষ্টটাও বুঝে গেছে বেচারা।

কিন্তু পরের দিনই বারান্দায় বসে হাসুর মা আবার কান্নাকাটি শুরু করল। আল্লাগো, মাবুদগো, চারডি বাচ্চা থুইয়া, ক্যাম্নে উনারে উডাইয়া নিতে পারলা? কী দোষ করেছিলাম তোমার কাছে? এত কষ্ট কইরা রোজা রাখনের এই ফল তুমি দিলা?
আমি হাসুর মা’র পাশে গিয়ে দাড়ালাম। সান্তনা দিয়ে ধীর গলায় বললাম,
– শোনো, কাউকে অভিশাপ দিয়ে লাভ নাই। আমরা নিজেদের তৈরি একটা অন্ধকারে বান্ধা পড়েছি, নিকষ কালো সে অন্ধকার। মর্মভেদী ভোগান্তিই এর পরিণতি।

হাসুর মা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চলে গেল।

আমি একটু এগিয়ে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য হেলে পড়ছে, মেঘগুলো সাদা তুলোর মত ছড়িয়ে আছে, মাঝখানে উঁকি দিচ্ছে আকাশের নীলিমা। কী মানে আছে প্রকৃতির এসব আয়োজনের?