উপরের ছবিতে লোহার গেটের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রবেশ দ্বার। যদিও বুখেনভাল্ডের আরও কয়েকটি প্রবেশ দ্বার ছিল। গেটের উপরে লেখা চিহ্নটা দেখা যাবে শুধুমাত্র কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভিতরে প্রবেশ করলে। বুখেনভাল্ডের একটা বৈসাদৃশ্য আছে সেটা হলো অন্যান্য নাৎসি ক্যাম্পের প্রবেশ দ্বারের উপরে জার্মান ভাষায় লেখা আছে “Arbeit Macht Frei” বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় “কর্মেই মুক্তি” কিন্তু বুখেনভাল্ডের প্রবেশ দ্বারে লেখা আছে “Jedem Das Seine” অর্থাৎ “যে যেমন সে তেমন”।
প্রাক্তন বুখেনভাল্ডে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প আজকে যেরকম দেখতে সেটা আমার সারা জীবনের দেখা সবথেকে হতাশাজনক দৃশ্য। এটা প্রায় সম্পূর্ণ ফাঁকা, নুড়ি এবং কালো পাথরের বিস্তীর্ণ বিরান প্রান্তর যেখানে বোঝা যাচ্ছে এখানে একদা বন্দীদের জন্য বাসস্থান দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যন্ত্রণা কেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার সময় বন্দীদের বেশিরভাগ বাড়িঘরগুলো পুড়িয়ে ফেলে অথবা বিষ্ফোরকের আঘাতে উড়িয়ে দেয়। ফলে অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ যেটা পড়ে আছে সেটা দেখে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ দেখার স্বাদ পাওয়া যায়। বেশিরভাগ নাৎসি যন্ত্রণা কেন্দ্রগুলোকে যুদ্ধের পরে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানে রূপান্তরিত করা হয়েছে সেখানে রয়েছে নান্দনিক স্মৃতিসৌধ, পরিণত হয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়ে বা শোক প্রকাশের স্থানে। কিন্তু বুখেনভাল্ডের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু হয়নি। প্রাক্তন এই ক্যাম্পের ভিতরে একটা মাত্র স্মৃতিসৌধ স্থাপিত আছে মাটির প্রায় বুক ঘেঁষে ফলে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রবেশ করে প্রথমে এটা প্রায় নজরেই আসে না। ক্যাম্পের প্রকৃত অবস্থান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ভুক্তভোগী হতভাগ্যদের জন্য সম্মানার্থে বানানো হয়েছে দুইটা বড় স্মৃতি ফলক।
সাচেনহাউজেন এবং অসউৎজে কর্মরত জার্মান প্যারামিলিটারির অন্যতম কার্যনির্বাহী রুডলফ হস তার আত্মজীবনীতে দেখা যায়, অরাজনৈতিক বন্দীদেরকে বাছাই করে শারীরিক কাজের উপযুক্ত হলে প্রাথমিকভাবে ছয় মাসের জন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হতো, এবং পরে ছেড়ে দেয়া হতো। কিন্তু এই নিয়ম কমিউনিস্ট এবং সাম্যবাদী গণতন্ত্রপন্থীদের জন্য বলবত ছিল না, তাদেরকে চিরতরে আটক করা হতো। হিটলারের ৫০তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে ১৯৩৯ সালের ২০ এপ্রিল বুখেনভাল্ডের ২৩০০ বন্দীকে ক্ষমা করে মুক্তি দেয়া হয়। বুখেনভাল্ডে ছিল প্রথম দিকে রাজনৈতিক বন্দীশালা। বন্দীশালার দরজায় লেখা ছিল “Jedem Das Seine” এবং এখানে ইংরেজিতে অন্য একটা অনুবাদ করা ছিল “যার যা প্রাপ্য সে তা পাবে” যার সরলার্থ আসলে কঠোর পরিশ্রম করলেও এখান থেকে মুক্তির কোন নিশ্চয়তা নেই।
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের দেয়ালে সিমেন্ট বালির অক্ষরে লেখা একটা বাক্য মুছে ফেলা হয়েছে যেখানে বলা ছিল “Recht oder Unrecht mein Vaterland.” জার্মানরা যার ইংরেজি অনুবাদ করেছিল “ভালো হোক মন্দ হোক, আমার পিতৃভূমি।” মূলত বুখেনবাল্ড নির্মাণ করা হয় ৬০০০ থেকে ৮০০০ হাজার বন্দীর বাসস্থানের জন্য। সামরিক বাহিনীর জন্য ৩০টি কাঠের বাড়ি এবং অসউৎজের মত ১৫টি দুই তলা ইটের বিল্ডিং। যুদ্ধ জয়ের পর সোভিয়েত বাহিনী সবগুলো ভবন এবং বাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।
একটা অল্প উঁচু পাহাড়ি ঢালের উত্তর প্রান্তে বুখেনবাল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেটি নির্মিত ফলে বন্দীদের ঘরের জানলা দিয়েই প্রবেশ দ্বারে লোকজনের আসা যাওয়ার নিয়ন্ত্রণ দেখতে পায়। ছবিতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মাঠের পুরোভাগে দেখা যাচ্ছে বন্দীদের খাদ্যের জন্য আলু, গাজর, শালগম, বিট রাখার ভাণ্ডারের দরজা। বন্দীদের খাদ্য তালিকায় ছিল প্রধানত শস্য দানার রুটি এবং সবজির স্যুপ। বুখেনবাল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরে আসা একজন বন্দী বলেন যে, বন্দীদেরকে কখনো কখনো শুধুই খোসাসহ আলু খেতে দেয়া হতো। প্রতিটি বন্দী তাদের পকেটে স্যুপ খাওয়ার চামচ রাখত। বুখেনবাল্ড ক্যাম্পের জাদুঘরে এনামেলের স্যুপের বাটি প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে।
বুখেনবাল্ড ক্যাম্পের চতুর্দিক ঘিরে বৈদ্যুতিক আগুনের তারের বেড়ার নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর ২২ জন নিরাপত্তারক্ষীর জন্য চৌকির ব্যবস্থা আছে। এদের মধ্যে মাত্র দুটা নিরাপত্তা চৌকি এখনো অক্ষত আছে আর দুইটা চৌকি কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেড়ার সামনে এক খণ্ড পাথুরে জমি তারপরেই ঘাসের মাঠ। এই অংশটাকে হলো অ-প্রবেশ্য অঞ্চল যেখানে বন্দীদের পা রাখাও নিষেধ। নিচের ছবিতে সীমানার বেড়া এবং নিরাপত্তারক্ষীদের পর্যবেক্ষণ স্থান দেখা যাচ্ছে। ছবির ডান দিকের লাল ছাদের ভবনে বন্দীদের জন্য খাবার ঘর। এখান থেকে বন্দীরা ক্যাম্পে শ্রমের বিনিময়ে ইনকাম করা টাকা দিয়ে সিগারেট বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারত। খাবার ঘরে একটা চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হচ্ছে বেচাকেনার উদ্দেশ্য হলো বন্দীদের কাছে যত টাকাপয়সা আছে যাতে নাৎসি-বাহিনী নিয়ে নিতে পারে।
ক্যাম্পের দৈর্ঘ্য প্রস্থের চতুর্দিকে প্রায় কিলোমিটার বিস্তৃত বৈদ্যুতিক তারের নিরাপত্তা বেড়া। বেড়ার বাইরে ২২ টা পাহারা চৌকি এবং প্রতিটিতে ৩ জন নিরাপত্তা রক্ষীর বসার ব্যবস্থা। বেড়ার বাইরে ৩০ মিটার অতিক্রম করলেই নিরাপত্তারক্ষীরা বন্দীদেরকে গুলি করার অনুমতি প্রাপ্ত ছিল। ক্যাম্প থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময়ে প্রায় ১০০ জন বন্দীকে গুলি করা হয়েছিল। ক্যাম্পের বাইরে পায়ে চলার পথেও নিয়মিত পাহারা দিতো।
১৯৪২ সালের শেষ দিকে পাহাড়ের ঢালে ক্যাম্পের প্রবেশপথের উত্তরে রোগাক্রান্ত বন্দীদের আলাদা করার জন্য ক্যাম্পের পশ্চিম প্রান্তে আর একটা নির্জন ঘর বানানো হয়। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পের ভিতরে একটা পাথুরে পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। ছবির পিছনে ক্যাম্পের ভাণ্ডার এবং জীবাণুমুক্তকরণ ভবন দেখা যাচ্ছে। হিটলারের আধাসামরিক বাহিনী নির্জন ঘরকে বলত দ্বিতীয় নম্বর ক্যাম্প আর বন্দীরা বলত “ছোট ক্যাম্প”। প্রথমে এখানে পোল্যান্ডের কুখ্যাত বারকিনাউ ক্যাম্পের আদলে সেনাবাহিনীর ১২টি ঘোড়ার আস্তাবল নির্মাণ করা হয়। এইসব ভবনের ছাদের কার্নিশে খুব ছোট জানালা থাকত। বুখেনভাল্ডের অন্যান্য আবাসে বন্দীদের দৃষ্টি বরাবর অনেক জানালা থাকত। বুখেনভাল্ডে যেসব বন্দীরা আসত তাদেরকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কয়েকদিন এখানে থাকতে হতো যাতে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ছোট ক্যাম্পকে যন্ত্রণাকেন্দ্র থেকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালে পোল্যান্ডের পরিত্যক্ত ক্যাম্প থেকে ফেরত ইহুদী বন্দীদেরকে বুখেনভাল্ডে স্থানান্তর করলে এটা অতিরিক্ত মানুষের ভিড়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ছোট ক্যাম্পের দুইজন বিখ্যাত বন্দী ছিলেন এলি ভিজেল এবং তার পিতা। ১৯৪৫ সালে রাশিয়ান সেনাবাহিনী আগমনের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া অসউইৎজ-বারকিনাউ ক্যাম্প থেকে তারা দুজনে কোনভাবে বেঁচে গেছেন। ৪০ মিটার দীর্ঘ আর ৯.৫ মিটার প্রস্থ আবাস স্থানে ১২০০ থেকে ১৭০০ জন মানুষকে গাদাগাদি করে থাকতে দেয়া হয়। যখন আবাসস্থলগুলোতে যখন তিল ঠাই আর নাহিরে তখন বন্দীদের জায়গা হয় তাবুতে। রোগে শোকে ছোট ক্যাম্পে এলি ভিজেলের পিতার সাথে হাজার হাজার বন্দীর মৃত্যু হয়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ছোট ক্যাম্প পরিণত হয় রোগে ভোগা এবং মরণাপন্ন রোগীদের আলাদা করে রাখার আক্ষরিক ভাগাড়ে।
বড় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কয়েদিরা ছোট ক্যাম্পের কয়েদিদের ঘৃণার চোখে দেখত। বুখেনভাল্ডে প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণ করত জার্মানির রাজনৈতিক বন্দীরা; তারা আবার ঘুষ ছাড়া কেউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিতো না। এমনকি যুদ্ধের পর ক্যাম্প থেকে মুক্তির পরেও ছোট ক্যাম্পের বন্দীদের অন্যদের সাথে মেলামেশায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং তাদেরকে মুক্তির আনন্দ উদযাপনে ডাকা হয়নি।
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে খাবার ঘরের সামনের দিকে ফুটবল খেলার বড় একটা মাঠ ছিল। যখন ইহুদী বন্দীদের জন্য অস্থায়ী আবাস নির্মাণ করা হয় তখন খেলার মাঠটি সরিয়ে নেয়া হয় এবং পরে সে স্থানেও ছোট ক্যাম্পটি বানানো হয়। বুখেনভাল্ডের নথিপত্রে পাওয়া যায় ফুটবল এখানকার জনপ্রিয় খেলা কিন্তু বন্দীরা হ্যান্ডবল, ভলিবল, ক্রিকেট এবং বাস্কেটবল খেলত। খেলার মাঠে ছোট ক্যাম্প বানানোর পরে জঙ্গল সাফ করে সবজি বাগানের কাছাকাছি নতুন একটা খেলার মাঠ বানানো হয়। বন্দীরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে খেলত এবং প্রতি দলই জেতার জন্য খেলত। চলচ্চিত্র মঞ্চে বক্সিং খেলা অনুষ্ঠিত হতো এবং কিছু বন্দী শরীর চর্চা করত। বুখেনভাল্ডে শুধু একটা সুইমিং পুলের অভাব ছিল যেটা আবার অসউইৎজে ছিল।
প্রাক্তন বুখেনভাল্ডে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভবন
বুখেনভাল্ডে জাদুঘরের স্যুভেনির বইতে উল্লেখ আছে ফ্যাসিজম বিরোধী বিপ্লব উদযাপন করতে ১৯৫১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাহিনী বুখেনভাল্ডে ক্যাম্পের সব ভবন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে প্রাক্তন ক্যাম্পের উপর বুখেনভাল্ডে জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে। বুখেনভাল্ড স্মৃতিসৌধ বুখেনভাল্ডে স্মৃতিসৌধ ফাউন্ডেশনের একটি অংশ এবং কেন্দ্রীয় সরকার আর থুরিনগিয়া রাজ্য সরকারের যৌথ পরিচালনায় পরিচালিত হয়। প্রবেশদ্বার দিয়ে যন্ত্রণাকেন্দ্রে ঢুকলে হাতের বামেই দেখতে পাবেন ১৯৪৩ সালে নির্মিত বন্দীদের খাবারের ঘর। ১৯৬৪ সালে এক প্রদর্শনীর সময়ে খাবারের ঘরটিকে “জাতীর সম্মানের ঘর” মর্যাদা দেয়া হয়। ভবনটিতে সমাবেশ করার মত পর্যাপ্ত জায়গা আছে। স্মৃতি সৌধ ঘিরে জড়ো হয়েছে ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ এবং “বুখেনভাল্ডের শপথ” নিচ্ছেন।
উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে খাবার ঘরের ভবন এবং ক্যাম্পের পশ্চিম প্রবেশদ্বারের নিরাপত্তা চৌকি। হাতের বায়ে প্রবেশদ্বারের নিরাপত্তারক্ষীদের ঘর। ছবির ডানে দিকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন ১৯৪৫ সালের ১৯ এপ্রিল বন্দীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত সৌধের নিচে ভ্রমণপিয়াসীরা দাঁড়িয়ে আছে। নিচের ছবিতে যে স্মৃতি সৌধ দেখা যাচ্ছে সেটা পরে (Ettersburg Strasse) ইটারসবার্গ রাস্তার মোড়ে স্থানান্তর করা হয় যে রাস্তাগুলো শাখা প্রশাখায় ভাগ হয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে ১৯৯৫ সালে একটা স্মৃতি চিহ্ন স্থাপন করা হয়।
স্যাবাইন এবং হ্যারি স্টাইনের লেখা উক্তিটি বুখেনভাল্ডের গাইডবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে:
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কিছু সৌভাগ্যবান বন্দী ক্যাম্পের প্রথম বছরে নিত্যদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রাদি কেনার সুযোগ পেতো। হিটলারের আধাসামরিক বাহিনী (Schutzstaffel) পণ্যের দোকান খুলে বসেছে যাতে আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বন্দীদের পাওয়া টাকা পয়সা যেকোনভাবে হাতিয়ে নেয়া যায়। প্রতিটি বন্দীনিবাসে একজন করে ক্যান্টিন চালানোর দায়িত্ব দেয়া হতো। সে পরিচিত ছিল ‘ব্লক বায়ার’ বা ‘ক্যান্টিনার’ হিসেবে। ক্যাম্পে ১৯৪২ সালে খাবার ঘরের যাত্রা শুরু হয়। বন্দীদের টাকা নেয়ার কত ফন্দি ফিকির! ১৯৪৩ সালের হেমন্তে ক্যাম্পের চালু করা নির্দিষ্ট মূল্যের শপিং ভাউচার দিয়ে বন্দীরা কেনাকাটা করতে পারত। (ভাউচার টিকেটিকে ক্যাম্প মানি বা বোনাস মানি নামে মানুষের কাছে পরিচিত ছিল।)
বুখেনভাল্ডের খাবার ঘর এখন যে জায়গাটাতে এটা ছিল একটা অস্থায়ী ক্যাম্প যেখানে ৯,৮৪৫ জন ইহুদী বন্দীকে আটক রাখা হয়েছিল। এই ইহুদীদেরকে Kristallnacht বা গ্লাস ভাঙ্গা রাতের ঘটনার পরে (৯-১০ নভেম্বর, ১৯৩৮ রাতে ইহুদিদের বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের উপর হিটলার বাহিনীর প্রথম বড়সড় হামলা) বন্দী করা হয়। মুক্তির পরে তারা চিরতরে জার্মানি ছেড়ে চলে যাবে এই শর্তে তাদেরকে ১৯৩৯ সালের বসন্তে মুক্তি দেয়া হয়। ক্যাম্পে দুই ধরণের স্থায়ী বন্দী ছিল যথা সি স্প্রে আর নাইট এবং ফগ। ‘নাইট এবং ফগ’ বন্দীরা বাইরে থেকে কোন প্যাকেট বা চিঠি গ্রহণ করতে পারত না। সি স্প্রে বন্দীরা বাইরে থেকে চিঠি বা প্যাকেট গ্রহণ বা পাঠাতে পারত কিন্তু চিঠি জার্মান ভাষায় লিখিত হতে হবে। তারা সিগারেট, চকলেট, কমলা বা অন্যান্য জিনিসপত্রের প্যাকেট গ্রহণ করতে পারত এবং এগুলো দিয়ে তারা ব্যবসা করতে পারত বা ভালো কাজ পাওয়ার জন্য ঘুষ হিসেবে ব্যবহার করত।
কোন জার্মান অপরাধী বন্দী হিসেবে এলে তাকে ক্যাম্পের অন্য বন্দী বা বাধ্য শ্রমিকদের কাজের তদারকির কাজে নিয়োগ দেয়া হতো। তাদের ডান হাতের বাহুতে পরিধান করত কালো একটা ব্যাজ। এদের নাম ছিল ‘কাপোস’। কাপোস প্রধান হতে ক্যাম্পের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ যার হাতে ক্যাম্পের সর্বময় ক্ষমতা। হিটলারের আধাসামরিক (Schutzstaffel) বাহিনীর সদস্যদের সাথে বন্দীদের দেখা সাক্ষাৎ ছিল যৎসামান্য। কাপোসদের উপর দায়িত্ব ছিল ক্যাম্পের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং বন্দীদের মাঝে কাজ বণ্টন করা। বুখেনভাল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে শেষ বছরে কমিউনিস্টপন্থী রাজনৈতিক বন্দীরা যন্ত্রণাকেন্দ্রের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে খাবার ঘরের ভবনে প্রবেশ দ্বার। খাবার ঘরে আগে বন্দীরা ক্যাম্পের বন্দীদের জন্য পশুর চর্বি থেকে সাবান বানাত। অনেকগুলো নাৎসি যন্ত্রণাকেন্দ্রে বন্দীদের ব্যবহারের জন্য সাবান কারখানা ছিল। ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরা কিছু বন্দী মনে করত মৃত ইহুদীদের চর্বি ব্যবহার করে সাবান বানানো হতো। ন্যুরেমবার্গ আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শিত হয়। বুখেনভালডে চামড়ার তৈরি প্রদীপের ঢাকনা এবং সংকুচিত করে ফেলা মানুষের মাথার খুলি পাওয়া যায়। যাইহোক ন্যুরেমবার্গ আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে কোন ফরেনসিক প্রতিবেদন পেশ করা হয়নি যা দিয়ে প্রমাণিত হয় সাবান বা প্রদীপের ঢাকনা মানুষের শরীরের উপাদান দিয়ে বানানো।
বুখেনভাল্ডে নির্দেশিকা বই থেকে জানা যায়, ক্যাম্পের অত্যাচার প্রতিরোধ যোদ্ধারা হাতে বানানো গ্রেনেড এবং বোতলে দাহ্য জ্বালানি ভরে বোমা বানানোর জন্য যন্ত্রণাকেন্দ্রের কারখানার সুবিধা নিয়েছিলেন। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে মানুষ পোড়ানোর চুল্লি এবং বন্দীদের রোগ নির্ণয় কেন্দ্র। ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারের নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরের দক্ষিণে মানুষ পোড়ানোর চুল্লি। মাঠের সামনে আপনি দেখতে পাবেন পাথুরে চিহ্ন যা দিয়ে বুঝতে পারেন এখানে একদা বন্দীদের থাকার ঘর ছিল। দাচাউ এবং সাচেনহাউজেনে মানুষ পোড়ানোর চুল্লি ছিল ক্যাম্পের সীমানার বাইরে বন্দীদের চোখের আড়ালে দেয়াল বা গাছ দিয়ে ঘেরা কোন স্থানে। কিন্তু বুখেনভাল্ডের মানুষ পোড়ানোর চুল্লি ছিল ক্যাম্পের ভিতরেই পাহাড়ের ঢালে। বন্দীরা চোখের সামনেই দেখতে পেত তাদের আরেক বন্দী ইহুদী সঙ্গীকে পোড়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রোগ নির্ণয় কেন্দ্রটা মানুষ পোড়ানোর চুল্লির বর্ধিতাংশের সাথে লাগোয়া ছিল। এখানেই মৃত মানুষের মৃত্যুর কারণ জানতে তার শরীরের ব্যবচ্ছেদ চলত।
নিচের ছবিতে ক্যাম্পের ভাণ্ডার দেখা যাচ্ছে, এটাই এখানের সবচেয়ে বড় ভবন যেখানে বন্দীদের কাপড় চোপড় এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখা হতো। ভাণ্ডার এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভাণ্ডার ঘরের সামনে ক্যাম্পের ধোপার ঘর ছিল যেটা এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। ধোপার ঘরের সামনেই একদা ছিল গ্যাটে ওক গাছের সারি। ১৯৪৪ সালের ২৪ আগস্ট ক্যাম্পে যৌথবাহিনীর বোমা হামলায় সেই ওক গাছগুলো মারা যায় এবং সেই সাথে মারা যায় কিছু ইহুদী বন্দী। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে মাঠের দূর প্রান্তে যত্নে সংরক্ষিত ধ্বংসাবশেষ গাছের গুড়ি। গুড়ির উপরিভাগ ঢেকে গেছে ক্যাম্পে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের ফেলে দেয়া পাথরে।
উপরের ছবিতে ডান দিকে দেখা যাচ্ছে একতলা জীবাণুমুক্তকরণ ভবন যেটা ভাণ্ডারের মাটির নিচের একটা সুড়ঙ্গ পথের সাথে। ক্যাম্পে আসা নতুন বন্দীদেরকে প্রথমে জীবাণুমুক্তকরণ ভবনে এনে মাথা এবং সারা শরীর কামিয়ে তাদের শরীরকে জীবাণুনাশক তরলের মধ্যে ডুবিয়ে উকুন এবং ব্যাকটেরিয়া মুক্ত করা হতো। ক্যাম্পে সংক্রামক ব্যাধি যাতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য তাদেরকে নেয়া হতো স্নান ঘরে এবং তাদের শরীরে স্প্রে করা হতো জীবাণুনাশক তরল। প্রতি দুই মাস অন্তর বন্দীদের চুল কাটা হয়। প্রথম চুল কাটার সময়ে বন্দীদের সারা শরীর কামানো হয় এবং পরবর্তী মাসে মাথার পাশে কামানো হয়। রাজনৈতিক বন্দীদের কিছু অতিরিক্ত সুবিধা ছিল যেমন তারা চুল বড় রাখতে পারত বা কেউ টাক হলে দাড়ি রাখতে পারত।
বেশিরভাগ বন্দী নিবাস ছিল লম্বা এবং নিচু কাঠের ঘর। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বন্দী নিবাস কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। বন্দী নিবাসগুলো ক্যাম্পের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। প্রবেশ দ্বার থেকে দূরে পাহাড়ের ঢালে বলে অনেকেই কষ্ট করে এটা আর দেখতে যায় না। প্রায় ৩০টার বেশি কাঠের বন্দী নিবাস আছে এবং প্রতিটি নিবাসে ১৮০ থেকে ২৫০ জন বন্দীর থাকার ব্যবস্থা। বন্দী নিবাসের দৈর্ঘ্য ছিল ৫৩ মিটার লম্বা আর প্রস্থে ৮ মিটার চওড়া। এছাড়াও ইটের তৈরি ১৫টা বন্দী নিবাস ছিল যাদের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৩৯ সালের হেমন্তে। বন্দী নিবাসকে ডাকা হতো ব্লক। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত আগত ইহুদীদের স্থান সংকুলান হয় ১৭ নাম্বার ব্লকে। ১৯৪২ সালের শুরুতে সব ইহুদী বন্দীদেরকে পোল্যান্ড থেকে এখানে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৪৫ সালে পোল্যান্ডের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্ধ হয়ে গেলে বন্দী ইহুদীদের মরণযাত্রা শুরু হয় জার্মানির দিকে। তাদেরকে ট্রেনে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হতো বুখেনভাল্ডে এবং মাউথহাউজেনের দিকে।
মূল প্রবন্ধ: Tour of Buchenwald concentration camp
কি নির্মম!
ফটো স্টোরি খুব ভালো হয়েছে। আরো লিখুন
বিকাশ দা, বরাবরের মতন চমৎকার অনুবাদ।। পরবর্তী অনুবাদ প্রবন্ধের অপেক্ষায় রইলাম।
তোমার অনুপ্রেরণায় আমি অনুবাদক হয়ে গেলাম।
অসাধারণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর অনুবাদ এখন দুর্লভ। বিকাশ মজুমদার নিজ উদ্যোগে খেটেখুটে অন্যেদের জন্য তা করে দিয়েছে। ধন্যবাদ। এই ধরনের লেখাগুলো সম্ভবত ৭৪/৭৫ এর পর আর চোখে পড়েনি। তার মানে পাড়ায় পাড়ায় সবেধন নীলমনির মত অল্প কিছু যে লাইব্রেরী ছিল সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, অনুবাদ বইগুলোও হারিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার যুগের মত প্রায় একটা যুগ বা তারও বেশি পার হয়েছে তখন। তারপরের পড়াগুলো সম্ভবত বেশিরভাগই ছিল হালকা ধরনের, বিনোদনের। যা’হোক, আমি চাইব এইরকমের লেখাগুলো বার বার পড়ে দেখতে, ডটগুলো জোড়া লাগিয়ে আরো এগিয়ে পড়তে।
বিকাশ মজুমদার, আপনার অন্যান্য অনুবাদগুলোও অত্যন্ত সুখপাঠ্য। ঝরঝর করে পড়ে ফেলা যায়। অবশ্যই আপনার পরবর্তী লেখা/অনুবাদ পাবার অপেক্ষায় রইলাম। আবারো ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ কাজী রহমান ভাই।