গ্রীক দার্শণিক ও বিজ্ঞানী এরিস্টেটল ( জন্ম- খৃস্টপূর্ব ৩৮৪; মৃত্যু খৃস্টপূর্ব ৩২২) বোধহয় প্রথমে এ পৃথিবীতে প্রাণীর উৎপত্তি সম্বন্ধে ধারণা দেন। এরিস্টেটলের ধারণা ছিল যে, পৃথিবীর বাইরে এ মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব নেই। এরিস্টেটলের সময় থেকে দুই হাজার দুই শ’বছরেরও বেশী সময় পার হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়েও পৃথিবীর বাইরের অন্য কোথাও যে প্রাণের অস্তিত্ব আছে, সে প্রমান মেলেনি।

তাই ব’লে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা কিন্তু বসে নেই। এ বিশাল বিপুল মহাবিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোথাও কোথাও যে প্রাণের অস্তিত্ব আছে সে সম্ভাবনায় আশান্বিত হয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিরন্তর,নিরলস গবেষণা ও মহাকাশ অভিযানে হাজার হাজার নতুন গ্রহ-নক্ষত্র এবং আনুসঙ্গিক গ্রহানুপুঞ্জ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ সৌরমন্ডলের বাইরের এক্সট্রা-টেরেশিয়াল জগতের সন্ধানেও ছুটছে মহাকাশযান। প্রতিদিন মহাবিশ্বের অজানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং তা পরীক্ষা-নিরিক্ষা ক’রে মহাকাশ বিজ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছে প্রায় অসীমেই।

তবুও এ পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধানের চেষ্টা এখনও সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানীরা প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাব্য জায়গাগুলোর একটি তালিকা ক’রে ফেলেছেন। দীর্ঘ এ তালিকা থেকে প্রাণের অস্তিত্ব আছে এ রকম সম্ভাব্য ৬টি স্থানও অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করেছেন। এ তালিকাটি প্রাণের অস্তিত্বের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমান এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণলব্ধ ফলাফলের উপরে ভিত্তি করেই করা।

(১) এনসিলয়াডাস ( Enceladus) : সৌরমন্ডলের শনিগ্রহের একটি উপগ্রহ বা চাঁদ এটি। প্রায় ৫০০ কিলোমিটার ব্যাসের এ উপগ্রহটি পৃথিবী থেকে ১.২৭২ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শনি গ্রহের মোট ৬২টি উপগ্রহ বা চাঁদ আছে। এনসিলয়াডাস আকারের দিক থেকে ষষ্ঠ। এটি শনির বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটান-এর প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ।

মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এনসিলয়াডাস সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জানতে পারেন ১৯৮০ সালের দিকে। তখন ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২ এনসিলয়াডাস এর সন্নিকট থেকে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করে। ২০০৫ সালের নাসার “ক্যাসিনি” মহাকাশযান এনসিলয়াডাসের বায়ুমন্ডলের ছবি প্রেরণ করে। সেখানে দেখা যায় যে, এনসিলয়াডাসের দক্ষিণাংশে জুড়ে আছে জমাট বরফের আস্তর। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই জমাট বরফের ন্যায় আস্তরের নিচেই থাকা সম্ভব তরল জলের। আর সেটা শনি ও এনসিলয়াডাসের মহাকর্ষ শক্তির টানেই সেখানে অবস্থান করছে। আর জলের অস্তিত্ব নিশ্চিত হ’লে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকাও অসম্ভব নয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার “ সেটি ( SETI) ইন্সটিটিউট”-এর বিজ্ঞানী সিন্থিয়া ফিলিপ্সের ধারণা, “ একদিন হয়ত শনির এই উপগ্রহের জলীয় স্তর থেকে প্রাণের অস্তিত্ব মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত হবে, আমাদের শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা মাত্র”।

(২) টাইটান (Titan) : শনির উপগ্রহ “টাইটান” নিয়ে বলার আগে “শনি গ্রহ” নিয়ে কিছু বলা দরকার। পৃথিবী থেকে সূর্য যে দিকে শনির অবস্থান ঠিক তার বিপরীত দিকে। দূরত্বের দিক থেকেও সূর্য ও শনি গ্রহের দূরত্ব পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের প্রায় ৯ গুন অর্থ্যাৎ ১.৪ বিলিয়ন কিলোমিটার। তাই সহজেই অনুমান করা যায় সূর্যের আলো ও উত্তাপ শনিগ্রহে পৌঁছে অনেক কম। আর শনিগ্রহ সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে পৃথিবীর প্রায় সাড়ে ২৯ বছরের মতো।

কিন্তু একটি সম্ভাবনাময় দিক হলো, শনিগ্রহ এবং তার উপগ্রহে পৃথিবী ও মংগলের মতো একটি সক্রিয় বায়ুমন্ডল আছে। এই সক্রিয় বায়ুমন্ডলই বিজ্ঞানীদের আশাভরসা জাগিয়েছে। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও মিথেন গ্যাসে ভরা এই দূরের গ্রহ ও তার উপগ্রহ নিয়েও তাই মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এতো উৎসাহ -উদ্দীপনা।

শনির উপগ্রহ “ টাইটান” আবিষ্কার করেন ডাস মহাকাশবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হিউজেন্স মার্চ ২৫, ১৬৬৫ সালে। গ্যালিলিও ১৬১০ সালে জুপিটারের সর্ববৃহৎ উপগ্রহ আবিষ্কার করেন এবং তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই ক্রিস্টিয়ান ও তার ভাই কন্সটান্টিন হিউজেন্স টেলিস্কোপের উন্নতি ও মহাকাশ নিয়ে নানা গবেষণা আরম্ভ করেন। মহাকাশ বিজ্ঞানে এই দুই ভাইয়ের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য।

১৬৬৫ সালের পর থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা “টাইটান” নিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা “টাইটান”-এ মানুষের বসতি স্থাপনের পক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

“টাইটান”-এর বায়ুমন্ডল মংগল এবং পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের বায়ুমন্ডল থেকেও অনেক পুরু। ফলে সূর্যের আলো এবং বায়ুচাপের যে প্রতিকূলতা মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মংগল ও চাঁদে সহ্য করেন, “টাইটান”-এ সেটা অনেকটা সহনীয় মাত্রায় থাকবে এখানে।

“টাইটান”-এর আয়তন আমাদের পৃথিবীর চাঁদের আয়তনের প্রায় দেড়গুন। একমাত্র পৃথিবীর বাইরে “টাইটান”-এ আছে তরল সমুদ্র এবং লেক। যদিও এ লেকের তরল পদার্থ জল নয়, শুধুই মিথেন গ্যাস। তবুও এই মিথেন গ্যাসের লেক বা সমুদ্রে মানুষ মিথেন প্রতিরোধক পোশাক নিয়ে সাঁতার কাটতেও পারবে; এ টুকু সম্ভাবনাও কিন্তু মংগল ও চাঁদের পৃষ্ঠে নেই।

এখানে মধ্যাকর্ষণ টান পৃথিবীর মাত্র ১৪ শতাংশ কিন্তু এর পুরু বায়ুমন্ডলের জন্য মংগল ও চন্দ্র পৃষ্ঠের তুলনায় এখানে মহাকাশের পোষাক প’রে চলাফেরা করা অনেক সহজ হবে ব’লেই ধারণা।

সূর্য থেকে অধিক দূরত্বের জন্য এখানকার গড় তাপমাত্রা মাইনাস ১৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো। “টাইটান” একটি নির্দিষ্ট অক্ষকে কেন্দ্র করে শনি গ্রহকে আবর্তন করে এবং একবার আবর্তন করতে সময় লাগে ১৫দিন ২২ ঘন্টা কিন্ত এর অবস্থানের জন্য টাইটানের “দিন” সব সময় এই কক্ষ আবর্তনের ঠিক সমান থাকে।

পৃথিবী থেকে “টাইটান”- এ যেতে সময় লাগবে প্রায় ৭ বছরেরও অধিক সময়। এই দীর্ঘ সময়ের জন্য শনি ও তার উপগ্রহ “টাইটান” নিয়ে গবেষণা করাও বেশ সময় সাপেক্ষ।

তবুও বিজ্ঞানীদের ধারণা, মংগল ও চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের বসতি নিশ্চিত করতে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এখন থেকে যে সময়টুকু লাগবে , “টাইটান” অভিযানে এখন যেসব প্রতিকূলতা আছে সেগুলো ততোদিনে সমাধান হয়ে যাবে।

(৩) মংগল ( Mars ): আমাদের পৃথিবীর বাইরে আর যে সকল গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা সন্ধান করছেন মঙ্গল গ্রহ তাদের অন্যতম। পৃথিবীর সাদৃশ্য এ গ্রহটি আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম। যা পৃথিবীর আয়তনের মাত্র সিকি ভাগ মাত্র। জলবায়ুও প্রতিকূল কিন্তু জীবন ধারণের উপযোগী। ঋতু বৈচিত্রও প্রায় পৃথিবীর মতোই। তাপমাত্র সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস কিন্তু সর্বনিম্ন মাইনাস ১৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহ প্রায় একই সময়ে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল। এক সময়ে আমাদের পৃথিবীর মতোই নদী-লেক-জলাশয় ছিল; সেখানে পানি প্রবাহেরও চিহ্ন পাওয়া যায়।কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তিত হোতে হোতে এখন মঙ্গল প্রচন্ড কঠিন ও শীতল এক গ্রহ।

একই সময়ে সৃষ্টি হয়েও মঙ্গল এখন এক মৃত ভূখন্ড কিন্তু পৃথিবী আজও কিভাবে এতো সবুজ, সেটা জানারই প্রচন্ড আগ্রহ বিজ্ঞানীদের। আর সে ঔৎসুক্য থেকেই মঙ্গল গ্রহের প্রতি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এতো আগ্রহ এবং এতো অভিযান।

(৪) ইউরোপা ( Europa) : ইউরোপা সৌরমন্ডলের গ্রহ জুপিটারের একটি উপগ্রহ বা চাঁদ। ইউরোপার ব্যাস প্রায় ৩,০০০ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে দূরত্ব প্রায় ৬২৮.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার। জুপিটারের ৭৯টি উপগ্রহ বা চাঁদ আছে। সৌরমন্ডলের উপগ্রহের মধ্যে আকারের দিক থেকে ইউরোপার আয়তন ষষ্ঠ। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, ইউরোপার অধিকাংশ জায়গা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার বরফে আচ্ছাদিত। এই বরফে ঢাকা বিশাল অংশের নিচের প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত আছে বিশাল লবনাক্ত জলের সমুদ্র। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই বিশাল শীতল জলরাশির কোথাও হয়ত লুকিয়ে আছে উষ্ণ জলের আধার এবং প্রাণের অস্তিত্ব।

(৫) ক্যালিস্টো ( Callisto) : জুপিটার গ্রহের এই বিশাল উপগ্রহটি ১৬১০ সালে গ্যালিলিও আবিষ্কার করেন। জুপিটারের ৭৯টি উপগ্রহের মধ্যে এটি আকারের দিক থেকে দ্বিতীয়। প্রায় ৪৮০০ কিলোমিটার ব্যাসের এ উপগ্রহটি সৌরমন্ডলের তৃতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ বা চাঁদ, যা জুপিটারকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে। ইউরোপার মতোই ক্যালিস্টোর আচ্ছাদিত স্বচ্ছ বরফের নীচে আছে বিশাল শীতল জলের সমুদ্র। ইউরোপার মতো এখানেও এককোষীয় প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে বলেই মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা।

(৬) জ্যানিমিড ( Genymede ) : এই বিশাল আয়তনের উপগ্রহটিও জুপিটারেরই। প্রায় ৫,৩০০ কিলোমিটার ব্যাসের এই বিশাল উপগ্রহটি সৌরমন্ডলের বৃহত্তম উপগ্রহ। সমস্ত উপগ্রহের মধ্যে একমাত্র এই উপগ্রহেই আছে চুম্বক-ক্ষেত্র। বিজ্ঞানীদের ধারণা জ্যানিমিড সমপরিমানের সিলিকেট পাথর এবং বরফ দিয়ে গঠিত। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, খুব হালকা একটি বায়ুমন্ডল আছে জ্যানিমিডে। আর এ বায়ুমন্ডলে আছে অক্সিজেন এবং ওজোন। এ উপগ্রহের বায়ুমন্ডলে হাইড্রোজেন অনু কিছু পরিমানে থাকাও অসম্ভব নয়। এই সকল বিবেচনায় জ্যানিমিডে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিস্ময় লাগে যে, এ উপগ্রগটিও গ্যালিলিওই আবিষ্কার করেছিলেন ১৬১০ সালে।

মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এ তালিকায় থাকা উপগ্রহগুলোর মধ্যে দু’টি শনি গ্রহের এবং তিনটি জুপিটারের। আর একমাত্র গ্রহ মংগল। মংগল গ্রহে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের অভিযাত্রা পূর্ণ-উদ্যোমে চলছে। মংগলের অনেক তথ্য-উপাত্তই এখন অনেকটা জানা। মংগলে মানুষের অভিযাত্রাও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কিন্তু এখনও শনি ও জুপিটারের উপগ্রহগুলোতে অভিযান মহাকাশবিজ্ঞানীদের কল্পনাতেই রয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ হয়ত পৃথিবী থেকে এ দু’টো গ্রহ এবং উপগ্রহের দূরত্ব। পৃথিবী থেকে জুপিটারের নিকটতম দূরত্ব ৫৮৮ মিলিয়ন কিলোমিটার। আর পৃথিবী থেকে শনি গ্রহের দূরত্ব ১৪০০ মিলিয়ন কিলোমিটার। সে তুলনায় পৃথিবী থেকে মংগল গ্রহের দূরত্ব মাত্র ৫৪.৬ মিলিয়ন কিলোমিটার। তাই প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধানে শনির ও জুপিটারের উপগ্রহগুলোর চেয়ে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী মংগলের দিকেই মহাকাশ বিজ্ঞানীদের অধিকতর মনোযোগ।

কিন্তু সেদিন বেশি দূরে নয়, চন্দ্র এবং মংগল ছাড়িয়ে মানুষ নিজেদের সতীর্থের সন্ধানে জুপিটার ও শনিতেও হাত বাড়াবে।

(সূত্রঃ প্রকাশনা, নাসা এবং সেটি ইন্সটিটিউট, ক্যালিফোর্নিয়া)

( মে ০৯, ২০১৯ )