মোনালিসা দেখে মুগ্ধ হয়েছি, বার বার তাকিয়েছি এর দিকে অবাক হয়ে। কিন্তু যে ছবি দেখে বিস্ময়ে একেবারেই হতবুদ্ধি হয়ে যেতে হয়, ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগে যায় এক প্রহর, তার নাম আর্নোলফিনি। এটি রাখা আছে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে।

ওক কাঠের প্যানেলে ১৪৩৪ সালে আর্নোলফিনি তৈলচিত্রটি একেছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ইয়ান ভ্যান আইক। আমরা বর্তমানে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের ছবি তোলে রাখি, কিন্তু ক্যামেরা আবিষ্কার হয়েছে এই সেদিন। সুতরাং অতীতকে নিজের চোখে দেখতে হলে এসব বিরল চিত্রকর্মের কোনো বিকল্প নেই। এতকাল আগের ছবিগুলোতে যখন চোখ বুলাই তখন মনে হয় যেন দূরবীণ দিয়ে অতীত দেখছি। এ ছবি দেখেন আর ভাবতে থাকেন এতকাল আগে কোনো প্রযুক্তিজ্ঞান ছাড়াই কিভাবে শুধু নিজের কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করে এ ধরণের নিখুঁত একটি ছবি আঁকা সম্ভব হল।

মূল ছবিটির আকৃতি ৮২.২ সে.মি.× ৬০ সে.মি.। নিচে ছবিটি দেয়া হল।

Arnolfini

আমরা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করব পুরো ছবি। প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা সম্ভব যে এরা অত্যন্ত ধনিক শ্রেণীর অন্তর্গত। পুরো কক্ষ জুড়ে রয়েছে বিলাসবহুল আসবাবপত্র। দেখা যায় একজন লোক একজন মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটির মাথার উপর সাদা একফালি কাপড়, হয়তবা পবিত্রতার প্রতীক; যা তাঁর শিঙ আকৃতিতে সজ্জিত চুলকে ঢেকে রেখেছে। তিনি নীল রঙের জামার উপরে বেশ লম্বাটে গাঢ় সবুজাভ একটি বহির্বাসে আবৃত হয়ে আছেন যার নিচের দিকে বেশ কিছু অংশ মাটিতে পড়ে আছে, স্পষ্টত এই মাটিতে পড়ে থাকা অংশটুকু ধরে রাখার জন্য একজন সার্বক্ষণিক চাকুরে প্রয়োজন। এ থেকেও তাদের আভিজাত্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নীচের নীল রঙের জামাটি ধরে নিলাম আভিজাত্যের রঙ, কারণ নীল রঙ সবসময়ই খুব দুর্লভ ও বিরল ছিল। উপরের সবুজ রঙের জামাটি স্পষ্টই আশার প্রতীক। সবুজ শস্যক্ষেত্র আসন্ন ফসলের ইঙ্গিত দেয়, নারীর ক্ষেত্রে সেটা সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনার সাথে সম্পর্কিত। এই সবুজাভ ঢিলা জামা ও এর নিচে্র নীল জামার প্রান্ত পশমের তৈরী, খেয়াল করে দেখেন। সামনের দিকে এক পাশে খুলে রাখা এক জোড়া জুতা, জুতাটি পুরুষটির। তাহলে মহিলাটির জুতা গেল কোথায়? (খুঁজে পেলে মন্তব্যে জানান)। লোকটির মাথায় চমৎকার একটি কালো টুপি, গায়ে ঢিলেঢালা মখমলের জামা।

তারা দুজনে যেখানে আছে সেটি একটি অভ্যর্থনা কক্ষ। তখনকার সময়ে এ ধরণের অভ্যর্থনা কক্ষের প্রচলন ছিল যেখানে খাটের উপর বসে অতিথির সাথে গল্প করা যেত। মেঝেতে পাতানো আছে প্রাচ্যের বিলাসী কার্পেট। লোকটির মাথায় খড় দ্বারা নির্মিত যে কালো রঙের টুপি দেখা যাচ্ছে সেটা গ্রীস্মকালে পরিধেয়। এছাড়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় চেরি গাছে ফুল ফুটেছে(নিচের ছবি দেখেন)। এদুটো ব্যাপার থেকে বুঝা যায় সময়টা গ্রীস্মকাল।

summer Arnolfini

পুরুষটি ডান হাত খাড়া করে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছেন যে স্পষ্টতই বুঝা যায় তিনি এখানে কর্তা; আর মহিলাটির ডান হাত সমান্তরাল, বাম হাত পুরুষটির হাতের উপরে, তাকিয়ে আছেন কিছুটা নিচের দিকে। এ ভঙ্গি মহিলাটির পুরুষের অধস্তন অবস্থাকে নির্দেশ করছে। কিন্তু সামাজিক পদমর্যাদায় এ মহিলা পুরুষটির সমান কেননা তিনি ঠিক মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন এমনটি নয়। আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করা দরকার। মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন খাটের পাশে, যা থেকে বুঝা যায় তাঁর দায়িত্ব মূলত গৃহের মধ্যে সীমাবদ্ধ আর পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছেন জানালার পাশে, এ থেকে বুঝা যায় বাইরের জগত সামাল দেয়ার দায়িত্ব পুরুষটির।

যা বলছিলাম, মহিলার ডান হাত লোকটির বাম হাতের উপরে। মহিলাটি অপর হাত বুকের নিচে ভাঁজ করে রেখেছেন, তাঁর দৃষ্টি নিচের দিকে। লোকটি আরেকটি হাত উচু করে রেখেছে, তাঁর দৃষ্টি সামনের দিকে। উভয়েই খুলে রেখেছেন জুতা। মনে হচ্ছে তাদেরকে কেউ কোনো শপথ পড়াচ্ছেন অথবা তারা নিজেরাই কোনো শপথ নিচ্ছে্ন। আচ্ছা, তারা কিসের শপথ নিতে পারেন? তারা কি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন?

দুজনে হাতের উপর হাত রেখেছেন, এর উপরে একটি কাঠের ভাস্কর্য, যা আসলে রাখা আছে পেছনের বিলাসী গদির বাম প্রান্তে।

পায়ের কাছে থাকা কুকুরটি তাদের মধ্যকার এমন কোনো সম্পর্ককে নির্দেশ করছে যাতে বিশ্বস্থতার প্রয়োজন হয়। আবার লোকটির পাশে পেছনের দিকে আছে একটা জানালা। জানালার ধারি ও এর ঠিক নিচের টেবিল আকৃতির বস্তুটায় দেখেন কিছু কমলালেবু রাখা আছে। কমলালেবু তখন একটি বিলাসী ফল হিসাবে বিবেচিত হত। এছাড়া এটি ভিটামিন-সি এর অভাব দূর করে, স্কার্ভি রোগ হওয়া থেকে বাচায়। স্কার্ভি রোগ হলে বা ভিটামিন-সি এর অভাব দেখা দিলে সন্তান জন্মদানে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাই এক্ষেত্রে এই ফলগুলো নারীর সন্তান জন্মদান ক্ষমতা বা উর্বরতার প্রতীক। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন তবে মহিলাটিকে ছবিতে অন্ত:স্বত্তা মনে হচ্ছে কেন? এটি একটি রহস্য যার সমাধান পাওয়া গেছে, এ বিষয়ে একটু পরে আসছি। ছবিটির ইতিহাস থেকে এতকাল আমরা জেনেছি যে লোকটির নাম জিওভানি আর্নোলফিনি যার নামানুসারে ছবির নামকরণ করা হয়েছে এবং পাশে সত্যি সত্যি তাঁর স্ত্রী জিওভানি সেনামি। এঁরা ছিলেন চিত্রকর ভ্যান আইক এর বন্ধু। তারা অবস্থান করছেন বেলজিয়ামের ব্রুজ শহরে। জিওভানি আর্নোলফিনি মূলত ইটালির লোকা শহর থেকে আসা বণিক। এখানে তাদের বিয়ে হচ্ছে বলে প্রচারিত হলে এই ছবির নাম দাঁড়ায় The Arnolfini Wedding বা The Arnolfini Marriage।

বহু দিনের প্রচার ও ছবিটির নাম অনুসারে ধরে নিলাম এখানে সত্যি সত্যি তাদের বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু লোকটি বাম হাত দিয়ে মহিলাটির ডান হাতে ধরে আছেন কেন? এটা কি তবে ‘বাম হাতি বিয়ে’ মানে যেক্ষেত্রে অভিজাতরা সাধারণ কোনো মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন? উত্তর হচ্ছে না, মহিলাটি অর্থাৎ জিওভানি সেনামি বাস্তবে অভিজাত ছিলেন।

তাদের মাথার উপর আছে একটি অলঙ্কৃত ঝাড়বাতি। দুজনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে একটি আয়না যা বিশাল প্রহেলিকার সৃষ্টি করেছে ছবির বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। আমরা আয়নার ছবিটি বড় করে দেখব।

আয়নাটি দেখতে গোলাকার ও চোখের আকৃতির। আয়নার চতুর্দিকে আঁকা যিশু ও অন্যান্য ধর্মীয় ছবিগুলো দেখুন। এর মানে হচ্ছে আয়নাটি ঈশ্বরের চোখের প্রতীক যা সব কিছু দেখতে পায়, এ শপথের সময় ঈশ্বর তা লক্ষ করছেন এবং এর পর কেউ অবিশ্বস্থ হলেও তা ঈশ্বরের অগোচর হবে না। এবার আয়নার মধ্যভাগে লক্ষ করি। এখানে লোকটি ও তাঁর সঙ্গিনীর পেছনভাগের প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে যেটা স্বাভাবিক। কিন্তু আয়নাতে আরো দুজন ব্যক্তির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরা কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। আয়নার বাম পাশে ঝুলে আছে ‘তসবি জপ করার মালা’ আকৃতির একটি বস্তু, ডান পাশে ঝাড়ু আকৃতির একটি বস্তু যার উপরের দিকে কাঠের একটি ছোট ভাস্কর্য ও পাশে কারুকার্য দেখা যায় (নিচের ছবিতে দেখেন)। j

এই আয়না ও ঝাড়বাতির মাঝখানে কিছু একটা লেখা আছে। সেটা কী হতে পারে? বলছি, এখানে লেখা আছে Johannes de eyck fuit hic 1434 অর্থাৎ ইয়ান ভ্যান আইক এখানে ছিলেন, ১৪৩৪ সাল। তাতে বুঝা যাচ্ছে এ ছবির পেছনের দুইজন লোকের মধ্যে একজন ছিলেন এ ছবির চিত্রকর ‘ইয়ান ভ্যান আইক’ যাকে আয়নাতে দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা, চিত্রকর কী এদের কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করতে বা কোনো চুক্তির সাক্ষী হতে সেখানে গিয়েছিলেন?

জার্মানের শিল্পকলা ঐতিহাসিক আরউইন পেনোফস্কি খুব আকর্ষণীয় যুক্তি দেন ছবিটির ব্যাখ্যার জন্য। তাঁর মতে আর্নোলফিনি নিছক কোনো চিত্রকর্ম নয় বরং এটি তাদের বিয়ের বৈধ দলিল। পেনোফস্কির যুক্তিমত এ ছবিতে দুজনের জুতা খুলে হাতে হাত রেখে শপথ করা, পাশে বিশ্বস্থতার প্রতীক কুকুর থাকা, উর্বরতার প্রতীক কমলালেবুর উপস্থিতি, সর্বদ্রষ্টা ঈশ্বরের চোখের প্রতীক গোল-আয়না নি:সন্দেহে তাদের বিয়ের শপথকে নির্দেশ করছে।

তারপরেই ঝামেলার শুরু। আগেই একটি প্রশ্ন করেছিলাম, তারা যদি এখানে বিয়ের শপথ নিচ্ছেন তাহলে এখানে মহিলাটিকে অন্তঃসত্তা দেখাচ্ছে কেন? এর উত্তর সহজ। তখনকার সময়ে অভিজাত মহিলারা এমনভাবে ভাজের পর ভাজ করে কাপড়-চোপড় পরতেন যেন মনে হয় তিনি গর্ভবতী। এই গর্ভবতীর মত দেখানোকে উর্বর ও আকর্ষণীয় মনে করা হত। তদুপরি এই মহিলা অর্থাৎ জিওভানি সেনামি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান।

পরের প্রশ্ন, এখানে যদি তারা বিবাহের শপথ নিচ্ছেন তাহলে তাদেরকে এতটা স্বতঃস্ফূর্ত মনে হচ্ছে কেন? দেখলে মনে হয় মহিলাটি সংসার পরিচালনায় এবং পুরুষটি তাঁর কাজে অভ্যস্থ। এটিও না হয় কোনোভাবে মেনে নেয়া গেল।

গোল বাধাল ১৯৯৭ সালে আবিষ্কৃত একটি দলিল। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা সকল বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা-চিন্তাভাবনাকে হুট করে এলোমেলো করে দিল। ছবিতে উল্লেখ করা আছে যে তা ১৪৩৪ সালে আঁকা হয়েছে। কিন্তু ঐ দলিল থেকে জানা যায় যে এ দম্পত্তি বিয়ে করেছিলেন ১৪৪৭ সালে অর্থাৎ ছবিটি আঁকার ১৩ বছর পর এবং সবচেয়ে বড় কথা এ সালটি চিত্রশিল্পী ইয়ান ভ্যান আইক এর মৃত্যুর ৬ বছর পর।

তাহলে এ ছবিটি কার? এটি কি জিওভানি আর্নোলফিনি এর কাজিন জিওভানি আরিগো ও তাঁর স্ত্রীর? সেক্ষেত্রেও কী রয়েছে না জানা অবাক করা কোনো রহস্যময় কাহিনী? না, এই ব্যাখ্যা মেনে নেয়া কষ্টকর।

এর মধ্যে দেখা গেল আর্নোলফিনি আসলে প্রথমে বিয়ে করেছিলেন কস্তানজা ত্রেন্তাকে। তাহলে ছবির এ মহিলা আসলে কস্তানজা ত্রেন্তা, পরে বিয়ে করা জিওভানি সেনামি নন। ত্রেন্তা মারা যান ১৪৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, খুব সম্ভবত বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে। আর ছবিটি আঁকার বছর হচ্ছে ১৪৩৪ সাল। অর্থাৎ ত্রেন্তা মারা যাবার ১ বছর পরে ছবিটি আঁকা হয়েছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?

এরও চমৎকার ব্যাখ্যা আছে। আপনারা ছবির ঝাড়বাতির দিকে ভাল করে তাকান। ওখানে দেখতে পাবেন লোকটির মাথার উপরে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি। কিন্তু মহিলাটির মাথার উপরে থাকা মোমবাতি নিভে গেছে, খেয়াল করে দেখেন নিভে যাওয়া মোমবাতির অংশবিশেষ মোমদানিতে লেগে আছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে ছবির মহিলাটি মৃত। অর্থাৎ ছবিটি একটি মেমোরিয়েল পোট্রেইট বা স্মারক প্রতিকৃতি।

শেষ পর্যন্ত কী বিতর্কের অবসান হল? না, বরং নতুন বিতর্কের শুরু হল।

——————————————————————-

(এই ছবিটির যেকোনো অংশ ইচ্ছেমত বড় বা ছোট করে দেখার জন্য এই সাইটের শরণাপন্ন হতে পারেন। যারা সম্পূর্ণ লেখাটি পড়েছেন তারা নিজ নামে অথবা প্রয়োজনে ছদ্মনামে মন্তব্য করে জানান। ধন্যবাদ)

লেখাটি উৎসর্গ করা হল অগ্রজ-প্রতিম অনন্ত বিজয় দাশ কে। আসন্ন ১২ ই মে তাঁর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী।

মুক্তমনা ই-বই গ্রন্থাগার

সহায়ক লিংক: এক দুই তিন চার পাঁচ