নিউ মার্কেটের মোড়ে যেখানে রাস্তায় পত্রপত্রিকা বিছানো থাকে, সেখানে মাঝে মাঝে আমি যাই। এক প্রচ্ছদে কোনো তরুণীর গোপন কথা, আরেক প্রচ্ছদে কোনো নায়িকার নগ্নকথা; এক প্রচ্ছদে রঙিন হয়ে আছে কোনো আকর্ষণীয় ধর্ষিতা, আরেক প্রচ্ছদে ঝলমল করছে কোনো সম্ভাব্য পতিতা। আমি বুঝি এরা খুবই প্রসিদ্ধ, বিখ্যাত; সারা জাতি তাদের জীবন ও শরীরের রোমাঞ্চকর বাঁকগুলোর জন্য পাগল হয়ে আছে। জায়গাটি একটি মুদ্রিত পতিতালয়। বাচাল প্রিন্টিংপ্রেস তার বিষাক্ত পেট থেকে উগড়ে দিচ্ছে এসব আবর্জনা। প্রসিদ্ধ হতে হলে এখন বাঁকশোভিত হতে হয়, বাঁকগুলো ছড়িয়ে দিতে হয়, ক্যামেরার সামনে উপচে দিতে হয়; প্রসিদ্ধ হতে হলে ন্যাংটো হতে হয়। এখন দিকেদিকে তলী আর পট্টিগুলো উঠে যাচ্ছে বলে তার স্থান নিচ্ছে পত্রিকাগুলো? কয়েক দশক ধ’রে বাঙালি মুসলমানের খুব উন্নতি হয়েছে। এক সময় অভিনেত্রী হওয়া ছিল কলঙ্ক, এখন গৌরব। কোন মেয়েটি এখন অভিনেত্রী, কোন ছেলেটি অভিনেতা হতে চায় না? না চাইবে বা কেন? যে সমাজ যতো চিত্রতারকা সৃষ্টি করতে পারে, সে সমাজই ততো উন্নত! শুনেছি এক সময় সিনেমায় নাটকে মেয়েরা আসতো পতিতালয় থেকে, দাসী বিনোদিনী এসেছিলো সেখান থেকেই। সেটা বড়ো দুর্দিন ছিল। এখন অভিনেত্রীরা আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের আমরা ওখানে পাঠিয়ে বলি, যাও মেয়ে….হও। চমৎকার উন্নতি ঘটেছে আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকাও এখন এক্সট্রা হওয়ার জন্য পাগল; অধ্যাপক পাগল টেলিভিশনের বিদুষক হওয়ার জন্যে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন কার স্থান দখল করছে?
অভিনেত্রী হতে পারলে কথা নেই, একরাতেই বিখ্যাত, এমনকি অমর। মনীষী সিনেমা সাংবাদিক তাকে উন্মোচিত ক’রে দেবেন বিশ কোটি চোখের সামনে। পাগল হয়ে উঠবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কি মাথা ঘামায় বিজ্ঞানীর জন্য, প্রকৌশলীর জন্য, গবেষক মেয়েটির জন্য, কবির জন্য, ওরা আবার কে? রাষ্ট্র চায় নায়কনায়িকা। – মাতাল তরণী, চ্যাপটার: পতিতারাই প্রসিদ্ধ এখন, হুমায়ুন আজাদ।
১) কোনো তরুণী তার গোপন কথা কি পত্রপত্রিকায় বা লিখিতরূপে অন্য যেকোথাও প্রকাশ করতে চাইলে করতে পারবে না? এতে দোষের কী আছে?
২) নায়িকার নগ্নকথা মানে কী জিনিস? আজাদ নায়িকার নগ্নকথা বলতে কী বুঝিয়েছেন, জানি না। তবে তা যা-ই হোক না কেন, তা কোনো প্রচ্ছদে এলে দোষ কোথায়?
৩) ‘আরেক প্রচ্ছদে ঝলমল করছে কোনো সম্ভাব্য পতিতা’! সম্ভাব্য পতিতা মানে কী? মেয়েটি যে সম্ভাব্য পতিতা সে-ব্যাপারে আজাদ বুঝলেন বা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? সম্ভাব্য পতিতার সজ্ঞা কী আজাদের কাছে? তাছাড়া কেউ স্বেচ্ছায় যৌনতাকে পেশা হিসেবে নিলে তাতে অন্য কারো সমস্যা কোথায়? লেখালাখি পেশা হলে অপরাধ না, গান গাওয়া পেশা হলে খারাপ না, ছবি আঁকা পেশা হলে খারাপ না, শিক্ষকতা পেশা হলে খারাপ না, ইটভাঙা পেশা হলে খারাপ না, রিকশা চালানো পেশা হলে খারাপ না; কিন্তু কেউ নিজের ইচ্ছায় যৌনকর্মী হলে তা এত খারাপ এত নিন্দনীয় কেন আজাদের কাছে? তিনি ত মানুষের যৌনস্বাধীনতা ও অধিকারের কথা বলেছেন!
৪) গোপন কথা বলা কোনো তরুণী, কোনো নায়িকা বা কোনো যৌনকর্মী প্রসিদ্ধ হলে অসুবিধা কী? এদের কি প্রসিদ্ধ হবার অধিকার নেই? প্রসিদ্ধ হবার অধিকার একচেটিয়া কাদের বা কার তাহলে?
৫) ‘সারা জাতি তাদের জীবন ও শরীরের রোমাঞ্চকর বাঁকগুলোর জন্য পাগল হয়ে আছে’ — জীবন ও শরীরের রোমাঞ্চকর বাঁক কোনগুলো? আর কেউ নিজের ইচ্ছায় তার জীবনের রোমাঞ্চকর ঘটনা প্রকাশ করলে তা দোষের তো নয়! তাছাড়া কাপড় পরা বা না পরাও যার যার ইচ্ছা সভ্য সমাজে। পৃথিবীতে চিত্রশিল্পীরা মানবদেহের যত চিত্র এঁকেছেন তার বিশাল অংশই নগ্ন। ভাস্করেরা মানবদেহের যত ভাস্কর্য বানিয়েছেন, তার অধিকাংশই নগ্ন। অনেক সময় শিল্পীরা জীবন্ত মডেলদের নিজেদের সামনে নগ্ন উপস্থিত রেখেই শিল্প-সৃষ্টি ক’রে থাকেন। নগ্নতা বা কাপড় পরা শ্লীলতা বা অশ্লীলতা কিছুই নয়। কে কখন কতটুকু কাপড় পরবে বা পরবে না তা তার নিজের পছন্দ ও ইচ্ছায় ব্যাপার। এখানে অপরাধ যেমন নেই, তেমনি কোনো মাহাত্ম্যও নেই। শরীর, শরীরের বাঁক বা সৌন্দর্য এবং তা স্বেচ্ছাকৃত প্রদর্শনে কোনো অন্যায়ই থাকতে পারে না, অন্তত একজন শিল্পানুরাগী মানুষের কাছে। আজাদ কেবল একজন বিদগ্ধ মানুষই নন, শিল্পানুরাগীও বটেন। তাহলে নগ্নতা তাঁর কাছে এত নিন্দনীয় কেন?
৬) প্রসিদ্ধ হতে হলে এখন বাঁকশোভিত হতে হয়, বাঁকগুলো ছড়িয়ে দিতে হয়, ক্যামেরার সামনে উপচে দিতে হয়; প্রসিদ্ধ হতে হলে ন্যাংটো হতে হয়– কেউ নিজের ইচ্ছায় নগ্ন হয়ে নিজের শরীরের বাঁকগুলো দেখালে তাতে কোনো দোষ নেই, অন্যায় নেই। মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর শরীরে নেই কোনো অন্যায়। যার ইচ্ছা করবে তা দেখবে, যার ইচ্ছা করবে না, দেখবে না। ব্যস।
৭) কয়েক দশক ধ’রে বাঙালি মুসলমানের খুব উন্নতি হয়েছে। এক সময় অভিনেত্রী হওয়া ছিল কলঙ্ক, এখন গৌরব — একসময় মেয়েদের বাইরে বের হওয়াও বড় কলঙ্কের ব্যাপার ছিল; লেখাপড়া করা, চাকরি করা বড় কলঙ্কের কথা ছিল। একসময় প্রেম করা কলঙ্কের ছিল, গান গাওয়া কলঙ্কের ছিল, নাচা কলঙ্কের ছিল। এখন এসব সভ্য মানুষদের কাছে আদরণীয়। অভিনয়ও একসময় কলঙ্কের ছিল ব’লে চিরকাল তা কলঙ্কের হয়েই থাক, এমন কেন চান আজাদ? শিল্পের একটা শাখা অভিনয়। এই শিল্পের প্রতি কথাশিল্পী ও শিক্ষাশিল্পী আজাদের এত বিরাগ কেন?
8) শুনেছি এক সময় সিনেমায় নাটকে মেয়েরা আসতো পতিতালয় থেকে, দাসী বিনোদিনী এসেছিলো সেখান থেকেই। সেটা বড়ো দুর্দিন ছিল। এখন অভিনেত্রীরা আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের আমরা ওখানে পাঠিয়ে বলি, যাও মেয়ে….হও। চমৎকার উন্নতি ঘটেছে আমাদের—
তথাকথিত সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র ঘরের মেয়েরা তখন শতভাগ গৃহবন্দি ছিল। তাদের চেয়ে বরং দরিদ্র ঘরের মেয়েরাই স্বাধীন ছিল অনেকখানি। ওরা উপার্জনের জন্য বের হতো। কথিত ভদ্র ঘরের মেয়েদের সেসময়ে অভিনয়ে আসবার কথা ভাবাও যায় না। এটা তো কোনো সুখবর নয় বিমোহত হবার মতো! সেসময় পতিতালয় থেকে মেয়েরা এসে অভিনয় করেছিল বলেই আজ আমরা ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, রোকেয়া প্রাচি প্রমুখ দুর্দান্ত অভিনয় শিল্পীদের পেয়েছি।
‘সেটা বড়ো দুর্দিন ছিল’ — আর সেই দুর্দিন আজো কেন সেইভাবে বিদ্যমান নেই, এজন্য আজাদের এত বড়ো দীর্ঘশ্বাস ও খেদ?
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েরা অভিনয়ে এলে সমস্যা বা দোষ কোথায়? কেউ লেখাপড়া শিখে অভিনয় শিল্পী হলে তাতে অপরাধ কী? ‘যাও মেয়ে……হও’ মানে কী? ডট ডটের মধ্যে কোন নিষিদ্ধ শব্দ লুকিয়ে রেখেছেন আজাদ? পতিতা? কিংবা অভিনেত্রী?
৯) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকাও এখন এক্সট্রা হওয়ার জন্য পাগল; অধ্যাপক পাগল টেলিভিশনের বিদুষক হওয়ার জন্যে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন কার স্থান দখল করছে? —- বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা অভিনয়ে আসতে চাইলে এলে অন্যায় কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিদুষক হতে চাইলে বা হ’লে অন্যায় কীসে? শিক্ষকতাই শুধু সম্মানের আর অভিজাত্যের? অভিনয় শিল্প আর এর শিল্পীরা এত ঘৃণ্য আজাদের কাছে!
১০) রাষ্ট্র কি মাথা ঘামায় বিজ্ঞানীর জন্য, প্রকৌশলীর জন্য, গবেষক মেয়েটির জন্য, কবির জন্য, ওরা আবার কে? রাষ্ট্র চায় নায়কনায়িকা’ — একটি কল্যাণোমূলক রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তার প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য মাথা ঘামানো। একজন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, গবেষক, কবি যেমন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের জন্য; ঈকজন অভিনয়শিল্পীও তেমনি। এদের সবারই অবদান থাকে রাষ্ট্রে বা সমাজে বিভিন্ন মাত্রায় ও বিভিন্নভাবে। যাঁরা ইট ভাঙেন, যাঁরা ঠেলাগাড়ি চালান, যাঁরা রাস্তা পরিষ্কার করেন তাঁদের অবদানও কম নয়। তাঁদের নিয়েও মাথা ঘামানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এমন কি, যাদের কোনো অবদান নেই, তাদের নিয়েও মাথা ঘামানো কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দায়িত্ব।