নিউ মার্কেটের মোড়ে যেখানে রাস্তায় পত্রপত্রিকা বিছানো থাকে, সেখানে মাঝে মাঝে আমি যাই। এক প্রচ্ছদে কোনো তরুণীর গোপন কথা, আরেক প্রচ্ছদে কোনো নায়িকার নগ্নকথা; এক প্রচ্ছদে রঙিন হয়ে আছে কোনো আকর্ষণীয় ধর্ষিতা, আরেক প্রচ্ছদে ঝলমল করছে কোনো সম্ভাব্য পতিতা। আমি বুঝি এরা খুবই প্রসিদ্ধ, বিখ্যাত; সারা জাতি তাদের জীবন ও শরীরের রোমাঞ্চকর বাঁকগুলোর জন্য পাগল হয়ে আছে। জায়গাটি একটি মুদ্রিত পতিতালয়। বাচাল প্রিন্টিংপ্রেস তার বিষাক্ত পেট থেকে উগড়ে দিচ্ছে এসব আবর্জনা। প্রসিদ্ধ হতে হলে এখন বাঁকশোভিত হতে হয়, বাঁকগুলো ছড়িয়ে দিতে হয়, ক্যামেরার সামনে উপচে দিতে হয়; প্রসিদ্ধ হতে হলে ন্যাংটো হতে হয়। এখন দিকেদিকে তলী আর পট্টিগুলো উঠে যাচ্ছে বলে তার স্থান নিচ্ছে পত্রিকাগুলো? কয়েক দশক ধ’রে বাঙালি মুসলমানের খুব উন্নতি হয়েছে। এক সময় অভিনেত্রী হওয়া ছিল কলঙ্ক, এখন গৌরব। কোন মেয়েটি এখন অভিনেত্রী, কোন ছেলেটি অভিনেতা হতে চায় না? না চাইবে বা কেন? যে সমাজ যতো চিত্রতারকা সৃষ্টি করতে পারে, সে সমাজই ততো উন্নত! শুনেছি এক সময় সিনেমায় নাটকে মেয়েরা আসতো পতিতালয় থেকে, দাসী বিনোদিনী এসেছিলো সেখান থেকেই। সেটা বড়ো দুর্দিন ছিল। এখন অভিনেত্রীরা আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের আমরা ওখানে পাঠিয়ে বলি, যাও মেয়ে….হও। চমৎকার উন্নতি ঘটেছে আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকাও এখন এক্সট্রা হওয়ার জন্য পাগল; অধ্যাপক পাগল টেলিভিশনের বিদুষক হওয়ার জন্যে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন কার স্থান দখল করছে?
অভিনেত্রী হতে পারলে কথা নেই, একরাতেই বিখ্যাত, এমনকি অমর। মনীষী সিনেমা সাংবাদিক তাকে উন্মোচিত ক’রে দেবেন বিশ কোটি চোখের সামনে। পাগল হয়ে উঠবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কি মাথা ঘামায় বিজ্ঞানীর জন্য, প্রকৌশলীর জন্য, গবেষক মেয়েটির জন্য, কবির জন্য, ওরা আবার কে? রাষ্ট্র চায় নায়কনায়িকা। – মাতাল তরণী, চ্যাপটার: পতিতারাই প্রসিদ্ধ এখন, হুমায়ুন আজাদ।
১) কোনো তরুণী তার গোপন কথা কি পত্রপত্রিকায় বা লিখিতরূপে অন্য যেকোথাও প্রকাশ করতে চাইলে করতে পারবে না? এতে দোষের কী আছে?
২) নায়িকার নগ্নকথা মানে কী জিনিস? আজাদ নায়িকার নগ্নকথা বলতে কী বুঝিয়েছেন, জানি না। তবে তা যা-ই হোক না কেন, তা কোনো প্রচ্ছদে এলে দোষ কোথায়?
৩) ‘আরেক প্রচ্ছদে ঝলমল করছে কোনো সম্ভাব্য পতিতা’! সম্ভাব্য পতিতা মানে কী? মেয়েটি যে সম্ভাব্য পতিতা সে-ব্যাপারে আজাদ বুঝলেন বা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? সম্ভাব্য পতিতার সজ্ঞা কী আজাদের কাছে? তাছাড়া কেউ স্বেচ্ছায় যৌনতাকে পেশা হিসেবে নিলে তাতে অন্য কারো সমস্যা কোথায়? লেখালাখি পেশা হলে অপরাধ না, গান গাওয়া পেশা হলে খারাপ না, ছবি আঁকা পেশা হলে খারাপ না, শিক্ষকতা পেশা হলে খারাপ না, ইটভাঙা পেশা হলে খারাপ না, রিকশা চালানো পেশা হলে খারাপ না; কিন্তু কেউ নিজের ইচ্ছায় যৌনকর্মী হলে তা এত খারাপ এত নিন্দনীয় কেন আজাদের কাছে? তিনি ত মানুষের যৌনস্বাধীনতা ও অধিকারের কথা বলেছেন!
৪) গোপন কথা বলা কোনো তরুণী, কোনো নায়িকা বা কোনো যৌনকর্মী প্রসিদ্ধ হলে অসুবিধা কী? এদের কি প্রসিদ্ধ হবার অধিকার নেই? প্রসিদ্ধ হবার অধিকার একচেটিয়া কাদের বা কার তাহলে?
৫) ‘সারা জাতি তাদের জীবন ও শরীরের রোমাঞ্চকর বাঁকগুলোর জন্য পাগল হয়ে আছে’ — জীবন ও শরীরের রোমাঞ্চকর বাঁক কোনগুলো? আর কেউ নিজের ইচ্ছায় তার জীবনের রোমাঞ্চকর ঘটনা প্রকাশ করলে তা দোষের তো নয়! তাছাড়া কাপড় পরা বা না পরাও যার যার ইচ্ছা সভ্য সমাজে। পৃথিবীতে চিত্রশিল্পীরা মানবদেহের যত চিত্র এঁকেছেন তার বিশাল অংশই নগ্ন। ভাস্করেরা মানবদেহের যত ভাস্কর্য বানিয়েছেন, তার অধিকাংশই নগ্ন। অনেক সময় শিল্পীরা জীবন্ত মডেলদের নিজেদের সামনে নগ্ন উপস্থিত রেখেই শিল্প-সৃষ্টি ক’রে থাকেন। নগ্নতা বা কাপড় পরা শ্লীলতা বা অশ্লীলতা কিছুই নয়। কে কখন কতটুকু কাপড় পরবে বা পরবে না তা তার নিজের পছন্দ ও ইচ্ছায় ব্যাপার। এখানে অপরাধ যেমন নেই, তেমনি কোনো মাহাত্ম্যও নেই। শরীর, শরীরের বাঁক বা সৌন্দর্য এবং তা স্বেচ্ছাকৃত প্রদর্শনে কোনো অন্যায়ই থাকতে পারে না, অন্তত একজন শিল্পানুরাগী মানুষের কাছে। আজাদ কেবল একজন বিদগ্ধ মানুষই নন, শিল্পানুরাগীও বটেন। তাহলে নগ্নতা তাঁর কাছে এত নিন্দনীয় কেন?
৬) প্রসিদ্ধ হতে হলে এখন বাঁকশোভিত হতে হয়, বাঁকগুলো ছড়িয়ে দিতে হয়, ক্যামেরার সামনে উপচে দিতে হয়; প্রসিদ্ধ হতে হলে ন্যাংটো হতে হয়– কেউ নিজের ইচ্ছায় নগ্ন হয়ে নিজের শরীরের বাঁকগুলো দেখালে তাতে কোনো দোষ নেই, অন্যায় নেই। মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর শরীরে নেই কোনো অন্যায়। যার ইচ্ছা করবে তা দেখবে, যার ইচ্ছা করবে না, দেখবে না। ব্যস।
৭) কয়েক দশক ধ’রে বাঙালি মুসলমানের খুব উন্নতি হয়েছে। এক সময় অভিনেত্রী হওয়া ছিল কলঙ্ক, এখন গৌরব — একসময় মেয়েদের বাইরে বের হওয়াও বড় কলঙ্কের ব্যাপার ছিল; লেখাপড়া করা, চাকরি করা বড় কলঙ্কের কথা ছিল। একসময় প্রেম করা কলঙ্কের ছিল, গান গাওয়া কলঙ্কের ছিল, নাচা কলঙ্কের ছিল। এখন এসব সভ্য মানুষদের কাছে আদরণীয়। অভিনয়ও একসময় কলঙ্কের ছিল ব’লে চিরকাল তা কলঙ্কের হয়েই থাক, এমন কেন চান আজাদ? শিল্পের একটা শাখা অভিনয়। এই শিল্পের প্রতি কথাশিল্পী ও শিক্ষাশিল্পী আজাদের এত বিরাগ কেন?
8) শুনেছি এক সময় সিনেমায় নাটকে মেয়েরা আসতো পতিতালয় থেকে, দাসী বিনোদিনী এসেছিলো সেখান থেকেই। সেটা বড়ো দুর্দিন ছিল। এখন অভিনেত্রীরা আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের আমরা ওখানে পাঠিয়ে বলি, যাও মেয়ে….হও। চমৎকার উন্নতি ঘটেছে আমাদের—
তথাকথিত সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র ঘরের মেয়েরা তখন শতভাগ গৃহবন্দি ছিল। তাদের চেয়ে বরং দরিদ্র ঘরের মেয়েরাই স্বাধীন ছিল অনেকখানি। ওরা উপার্জনের জন্য বের হতো। কথিত ভদ্র ঘরের মেয়েদের সেসময়ে অভিনয়ে আসবার কথা ভাবাও যায় না। এটা তো কোনো সুখবর নয় বিমোহত হবার মতো! সেসময় পতিতালয় থেকে মেয়েরা এসে অভিনয় করেছিল বলেই আজ আমরা ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, রোকেয়া প্রাচি প্রমুখ দুর্দান্ত অভিনয় শিল্পীদের পেয়েছি।
‘সেটা বড়ো দুর্দিন ছিল’ — আর সেই দুর্দিন আজো কেন সেইভাবে বিদ্যমান নেই, এজন্য আজাদের এত বড়ো দীর্ঘশ্বাস ও খেদ?
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েরা অভিনয়ে এলে সমস্যা বা দোষ কোথায়? কেউ লেখাপড়া শিখে অভিনয় শিল্পী হলে তাতে অপরাধ কী? ‘যাও মেয়ে……হও’ মানে কী? ডট ডটের মধ্যে কোন নিষিদ্ধ শব্দ লুকিয়ে রেখেছেন আজাদ? পতিতা? কিংবা অভিনেত্রী?
৯) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকাও এখন এক্সট্রা হওয়ার জন্য পাগল; অধ্যাপক পাগল টেলিভিশনের বিদুষক হওয়ার জন্যে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন কার স্থান দখল করছে? —- বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা অভিনয়ে আসতে চাইলে এলে অন্যায় কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিদুষক হতে চাইলে বা হ’লে অন্যায় কীসে? শিক্ষকতাই শুধু সম্মানের আর অভিজাত্যের? অভিনয় শিল্প আর এর শিল্পীরা এত ঘৃণ্য আজাদের কাছে!
১০) রাষ্ট্র কি মাথা ঘামায় বিজ্ঞানীর জন্য, প্রকৌশলীর জন্য, গবেষক মেয়েটির জন্য, কবির জন্য, ওরা আবার কে? রাষ্ট্র চায় নায়কনায়িকা’ — একটি কল্যাণোমূলক রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তার প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য মাথা ঘামানো। একজন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, গবেষক, কবি যেমন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের জন্য; ঈকজন অভিনয়শিল্পীও তেমনি। এদের সবারই অবদান থাকে রাষ্ট্রে বা সমাজে বিভিন্ন মাত্রায় ও বিভিন্নভাবে। যাঁরা ইট ভাঙেন, যাঁরা ঠেলাগাড়ি চালান, যাঁরা রাস্তা পরিষ্কার করেন তাঁদের অবদানও কম নয়। তাঁদের নিয়েও মাথা ঘামানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এমন কি, যাদের কোনো অবদান নেই, তাদের নিয়েও মাথা ঘামানো কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
হুমায়ুন আজাদ ‘নিবিড় নীলিমা’ গ্রন্থের ‘একটি অশ্লীল বই’ পরিচ্ছেদে বলেছেন,
“বাঙালির শ্লীলতাবোধ খুব সংস্কৃত নয়; বাঙালি সাধারণত সুন্দরকে অশ্লীল আর নোংরাকে মনে করে সমাজসম্মত। রূপসীর নগ্ন বাহু তাদের কাছে অশ্লীল, ভিখিরিনির অস্থিসার উলঙ্গ দেহ সুশ্লীল। নারীপুরুষের আন্তরিক শারীরিক সম্পর্ক তাদের কাছে অশ্লীল; আর বিবাহিত বলাৎকার শ্লীল। কামসূত্র, দেকামেরন, লেডি চাটারলিজ লাভার, ডোরিয়ান গ্রে, ট্রপিক অফ ক্যান্সার, রাত ভ’রে বৃষ্টি, প্রজাপতি আমার কাছে অশ্লীল নয়, সুন্দর। আমার কাছে অশ্লীল সে রচনা, যা ভণ্ড; অশ্লীল ঐ পত্রপত্রিকাগুলো, যেগুলো অভিনেত্রীর উলঙ্গ ছবি অফসেটে ছেপে জেহাদ ঘোষণা করে নগ্নতার বিরুদ্ধে; অশ্লীল সে সব বই ও পত্রপত্রিকা, যেগুলো ধর্ষণের সংবাদকে ব্যবহার করে পুঁজিরূপে। আমার কাছে অশ্লীল হচ্ছে নোংরা ছবির সেই নায়িকার বচন, যে বলে স্বামীর পায়ের নিচে তার বেহেস্ত।”
বোঝাই যায় হুমায়ুন আজাদ একজন উন্নতমনস্ক মানুষ ছিলেন যিনি বাংলাদেশের মিডিয়া এবং চলচ্চিত্র/মন-মানসিকতার যৌনতার উপস্থাপনকে ঋণাত্মক মনে করতেন কারণ উনি বুঝতেন বাংলাদেশের সমাজের প্রায় সর্বত্র যৌনতাকে ঋণাত্মক ভাবে উপস্থাপন করা হয়।
আবার ‘মাতাল তরণী’ বইতে উনি বলেছেন (নারী ও মৌলবাদী-মার্ক্সবাদী রক্ষণশীলতা অধ্যায়ে),
“নারীব্যাপারে প্রগতিশীলেরাও হয়ে ওঠে রক্ষণশীল। কিছুদিন আগে বিজ্ঞাপনে নারীর ব্যবহার নিয়ে একটি বিতর্ক হয়েছিলো। তাতে দেখা যায় প্রগতিশীলেরা বিজ্ঞাপনে নারী ব্যবহারের বিরোধী। কিন্তু এ বিরোধিতা তো প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে যায়, মৌলবাদীদেরই শক্তিশালী ক’রে তোলে। মৌলবাদীরা নারীদের নিষিদ্ধ করতে চায় বাইরে, আর প্রতিক্রিয়াশীলেরা নারীদের নিষিদ্ধ করতে চায় বিশেষ বিশেষ স্থানে। ………………………… ………প্রগতিশীলদের লক্ষ্য তো ক্ষতি সাধন নয়।”
আবার একই অধ্যায়ে একটু পরেই বলেছেন,
“মনে করা যাক একটি মেয়ে জিন্স পরে বাইরে বেরোয়, কর্মস্থলে যায়। তখন বুঝতে হবে রক্ষণশীলতা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে সে এবং আঘাত করে চলেছে সে মধ্যযুগীয় অনেককে। যে অভিনেত্রী স্বামীর পায়ের নিচে বেহেস্ত বলে বিশ্বাস করে সে ক্ষতিকর সব দিক দিয়ে। সে অনেক বাজে ছবিতে অশ্লীল অভিনয় করে সমাজের ক্ষতি করেছে………………আবার মধ্যযুগীয় বিশ্বাস প্রচার করে সমাজ এগোতে বাধা দিচ্ছে। আর যে অভিনেত্রীটি নিজের নগ্ন ছবি তুলতে দেয়; প্রকাশ্যে স্বীকার করে ও গৌরব বোধ করে সে প্রগতির জন্য অনেক উপকারী।”
উপরের বক্তব্যেও হুমায়ুন আজাদের উন্নত মন-মানসিকতার পরিচয় পাওয়া গেলো, উনি বোঝালেন নগ্নতা মানেই অশ্লীলতা নয়।
পতিতাবৃত্তি কোনোক্রমেই পেশা হতে পারে না।
১ – তরুণীর গোপন কথা, তাই যাই হোক না কেন, সে প্রকাশ করলে তাতে অন্যের সমস্যা কোথায়?
২ – দুজনের মধ্যে যৌন-সম্পর্কটা কেমন হবে, কীসের ভিত্তিতে হবে তা নির্ধারণ করবে সে দুজনই, অন্য কেউ নয়। তারা পরস্পর প্রণয়ী হোক বা না হোক। যৌন সম্পর্কে সবসময় প্রেম থাকে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবস্ময় প্রেম থাকে না, তবুও সেক্স হয় অনেকসময় শরীরের প্রয়োজনে। তাতে সমস্যা নেই। সম্মতি থাকলেই হলো দু’পক্ষের। আমাদের বাড়িতে অতিথি এলে আমরা তাদের আপ্যায়ন করি, থাকতে দিই বিনা পয়সায়। কিন্তু হোটেল রেস্টুরেন্ট তাদের অতিথিদের কাছ থেকে থাকাখাওয়া বাবদ টাকা নেয়। এটা কোনো অন্যায় নয়। গান গায় মানুষে নিজের মনের আনন্দ শান্তি ইত্যাদির জন্য। গান শোনেও এসব কারণে। কেউ কেউ ফ্রীতে গান শোনায়, কেউ কেউ তার জন্য টাকা নেয়। অসুবিধা কোথায়? খেলাধুলা করে মানুষ শরীর ও মনের আনন্দ ও সুস্থতার জন্য। কিন্তু খেলেও অনেকে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে। এরকম আরো অনেককিছুই বলা যায়। যে মেয়েটি বা ছেলেটি যৌনতার বিনিময় নেয় তাকে তা না দেওয়াই বরং অন্যায় ও অবমাননা। আমি বলছি না, সব যৌন সম্পর্কেই বিনিময় থাকতে হবে। যারা বিনিময় নেয় তাদের তা দিতে হবে। যাদের তা পছন্দ না, তারা না করুক এরকম সম্পর্ক। কেউ জোর করছে না ত।
৩ – যৌনকর্মবৃত্তি পুরুষতান্ত্রিক তখনই হয় যখন কোনো পুরুষ কোনো নারী যৌনকর্মীর সাথে সম্পর্ক করে তার মূল্য পরিশোধ না করে। আর পৃথিবীতে শুধু নারী যৌনকর্মীই না, পুরুষ যৌনকর্মীও আছে কিন্তু, যদিও সংখ্যায় খুব কম।
৬ – অর্ধনগ্ন বা পৌনেনগ্ন বা পূর্ণনগ্ন এসবের মানেটা কী? বাজে মানসিকতার মানুষের বাজে কথা এসব। কে কখন কতটুকু কাপড় পরবে বা পরবে না তার সম্পূর্ণই তার নিজের ব্যাপার, সে নারী বা পুরুষ যে-ই হোক। নারী পুরুষকে দেখে বা পুরুষ নারীকে দেখে অবশ্যই কামনাবোধ ক্রতে পারে যদি কামরহিত না হয়। কিন্ত তার প্রকাশভঙ্গিটা সুন্দর হওয়া চাই। আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরুষ তা যেভাবে করে সেটা অসুস্থ। সেটা সামাজিক ব্যবস্থার সমস্যা আমাদের। কেউ কাউকে দেখে কামনাবোধ করতে পারবে না কেন? দেশটাকে কামরহিত প্রেমরহিত ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী বানিয়ে রাখতে হবে নাকি?
৮ – সেসময় পতিতালয় থেকে আসা অভিনেত্রীদের কেউই ভাল অভিনয় পারতেন না, এটা আপনাকে কে বললো? আমি অনেক জায়গায় পড়েছি, তাঁদের অনেকেই খুব ভাল অভিনেত্রী ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ ও ‘সেই সময়’ এই দুটি বইতেও পড়েছি তখনকার অভিনেত্রীদের অভিনয়ের প্রশংসা।
আমাদের চলচ্চিত্র কখনোই প্রগতিশীল ছিল না, এই কথাটা ভুল বললেন। অনেক ভাল ভাল চলচ্চিত্র আমাদের দেশে নানান সময়ে নির্মিত হয়েছে। যদিও তাদের সংখ্যা তেমন বেশি না। আর পশ্চিমা ভাবধারার জিনিস দেখালেই তা খুব ভাল জিনিস বা ভাল চলচ্চিত্র হয়ে যায় নাকি? নিজেদের ভাবধারায়ও অনেক উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব। পথের পাঁচালিতে পশ্চিমা ভাবধারার কিছু ছিল নাকি? এরকম উদাহরণ আরো হাজারটা দেওয়া যায়।
পতিতাবৃত্তি নারীদের প্রতি শোষণ। সেচ্ছায় বহুগামিতায় লিপ্ত হলেও, পতিতাবৃত্তি নারীরা পছন্দ করেন কি না সে বিষয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। কারন এই পেশা আদিম একটা পেশা হলেও, এটা সম্মানজনক নয়; এমনকি উদারমনা পাশ্চাত্ত্যেও না। পতিতাবৃত্তি যে কতটা বঞ্চনা সেটা বোঝার জন্য পতিতালয়ের নারীদের ইতিহাস আর মনোভাব জানা জরুরি।
সুপ্রিয় নীলাঞ্জনা দিদি আপনার হুমায়ুন আজাদের প্রতি সমালোচনার প্রতিবাদ আমি আপনার মতই পয়েন্ট আকারে লিখলামঃ
নং ১ঃ কোনো তরুণীর গোপন কথা বলতে হুমায়ুন আজাদ খুব সম্ভবত নারীদের ঋতুস্রাব বা অন্তর্বাসের কথা বুঝিয়েছেন, হুমায়ুন আজাদ কিন্তু ঋতুস্রাব বা অন্তর্বাস গোপন রাখতে হবে – এমনটা চাইতেননা (লেখিকা আপনি ভালো করেই জানেন যে আমাদের দেশে ঋতুস্রাব এবং নারীদের অন্তর্বাস ট্যাবু)।
নং ২ঃ নায়িকার নগ্ন কথা দ্বারা হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাভিনেত্রীদের একভাবে অবমাননা করেছেন, বাংলাদেশের আশির দশকের চলচ্চিত্রাভিনেত্রীরা শাড়ী পরতো, শাড়ীতে কোমর বের করে রাখতো, অপরদিকে ঐ সময়কার হিন্দি চলচ্চিত্রে বিকিনি দেখানো চালু হয়ে গিয়েছিলো, ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঋষি কাপুর এবং ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত চলচ্চিত্র ‘ববি’তে বিকিনির দৃশ্য আছে, হুমায়ুন আজাদ বিকিনি বা চুম্বন দৃশ্য বা চলচ্চিত্রে দেখানো সম্পূর্ণ নগ্নতার বিরোধিতা করতেননা। ১৯৭১ সালের ইংরেজি চলচ্চিত্র ‘ক্লকওয়াইজ অরেঞ্জ’ এ সত্যিকারের নগ্ন দৃশ্য আছে। হুমায়ুন আজাদ এগুলোকে বেয়াদোবি বলতেননা।
নং ৩ঃ যৌনতাকে পেশা হিসেবে পছন্দ করতেননা হুমায়ুন আজাদ, যৌনতা একজন মানুষের পেশা হবে কেন? একজন ছেলে তার কোনো বান্ধবীর সঙ্গে বিনা পয়সায় (অবশ্যই পারস্পরিক সম্মতিতে) দৈহিক মিলন করবে; এটা হচ্ছে যৌন-স্বাধীনতা আর টাকা দিয়ে একটা মেয়েকে হোটেলে নিয়ে বা নিজের বাসায় নিয়ে এসে একটা মেয়ের সঙ্গে যৌনমিলন করাটা একধরণের নারীঅবমাননা যে নারীটি টাকার বিনিময়ে নিজের দেহ বিভিন্ন পুরুষদেরকে দিয়ে বেড়ায় – এটাকে কি যৌন-স্বাধীনতা বলে নাকি যৌনতাকে পুরুষতন্ত্রবাদীরা একটা ঘৃণ্য বস্তু এবং নারীদেরকে শুধুই যৌনবস্তু ভাবে বলে ‘পতিতালয়’ ধারণা সৃষ্টি করেছে (লক্ষ্য করুনঃ নামটাও কি অসভ্য, ‘পতিতালয়’ অর্থাৎ পতিতাদের গৃহ, পতিতা? মানে দেহ ব্যবসায়ী নারীরা পতিত মানুষ?)
নং ৪ঃ ঋতুস্রাব, তারপর নারীদের নিজেদের বক্ষবন্ধনী-জাঙ্গিয়া এগুলো গোপন এবং নিষিদ্ধ বিষয় হবে কি কারণে? আর পতিতাবৃত্তি তো পুরুষতান্ত্রিক।
নং ৫ঃ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাভিনেত্রীরা কখনোই কাহিনীর প্রয়োজনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হননি, ১৯৮০ সালের ইংরেজি চলচ্চিত্র ‘হেভেন গেট’তে সম্পূর্ণ নগ্নতার দৃশ্য আছে, একজন অভিনেত্রী কাহিনীর প্রয়োজনে অবশ্যই নগ্ন হবেন, কাহিনীকে ঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য – হুমায়ুন আজাদ এটিই বুঝিয়েছেন।
নং ৬ঃ হুমায়ুন আজাদ যদি আশির দশকে (‘মাতাল তরণী’ আশির দশকে লেখা, প্রকাশিত হয় ‘৯২ সালে) বাংলাদেশের ফুটপাতে পাওয়া কোনো ম্যাগাজিনে সেইসময়কার কোনো বাংলা চলচ্চিত্রাভিনেত্রীর বিকিনি পরিহিত ছবি দেখতেন বা সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছবি দেখতেন তাহলে ‘প্রসিদ্ধ হতে হলে ন্যাংটো হতে হয়’ – এই ধরণের কথা বলতেননা, এখানে উনি ‘ন্যাংটো বলতে অর্ধনগ্ন (শাড়ীতে কোমর বের করে দেখানো বুঝিয়েছেন)। অর্ধনগ্ন বা পৌনেনগ্নতা নারীঅবমাননা কর এবং পুরুষতান্ত্রিক কারণ পুরুষেরা তাদের যৌন-উত্তেজনা উঠানোর জন্য নারীদের পেট,কোমর এইগুলো দেখায় পুরুষ দর্শকদের ভেতরে যৌন-উত্তেজনা ওঠানোর চেষ্টা করেন, যেমনঃ আজকাল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে হিন্দি চলচ্চিত্রের মত ‘আইটেম গান’ খুব ভালোভাবেই উপস্থাপিত হয় যেখানে একটা মেয়ে ‘আইটেম’ হিসেবে নাচে তার পেট দেখিয়ে।
নং ৭ঃ হুমায়ুন আজাদ নাটক বা চলচ্চিত্র শিল্পের সমালোচনা করতেননা, উনি বাংলাদেশের টিভি এবং নাটকে দেখানো নারীদেরকে ‘রক্ষণশীল’ভাবে উপস্থাপন করা হয় এইটা বুঝিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মিডিয়া বিকিনি বা চলচ্চিত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্রের মত সত্যিকারের নগ্নতা দেখালে মৌলবাদীরা ক্ষেপে যেত, খেলাফত জারী করা হতো, এমনিতেই হুমায়ুন আজাদ ‘নারী’ বইটি লিখে মৌলবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
নং ৮ঃ হুমায়ুন আজাদ বলেছেন অভিনেত্রীরা আগে পতিতালয় থেকে আসতো, এটি বলতে উনি বুঝিয়েছেন যেইসব অভিনেত্রীরা আসতো তারা ভালো অভিনয় পারতেননা, আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কখনোই প্রগতিবাদী ছিলোনা, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কখনোই পশ্চিমা ভাবধারার জিনিস দেখানো হয়নি বা হলেও ঋণাত্মকভাবে আজকালকার প্রযোজক-পরিচালকরা দেখান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের একটা বদভ্যাস হচ্ছে প্রেম-বিয়ে সবকিছুকেই পুরুষতান্ত্রিক এবং রক্ষণশীল স্টাইলে দেখানো।
নং ৯ঃ হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের অধ্যাপকদের রক্ষণশীলতাবাদী বুঝিয়েছেন, সত্যিই তো তারা রক্ষণশীল, তাদের অনেকেই প্রেম করে বিয়ে করা বা পশ্চিমা স্টাইলে নৈশক্লাবে নাচাকে অনৈতিক বলতেন।
নং ১০ঃ বাংলাদেশের নায়ক-নায়িকাদেরকে দিয়ে পশ্চিমা স্টাইলে অভিনয় করানো হতো তাহলে হুমায়ুন আজাদ এরকম কথা বলতেননা।
নীলাঞ্জনা দিদি আপনার হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন’ বইটা পড়া উচিৎ, হুমায়ুন আজাদ বইটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। আর আমি আবারো বলছি ‘পতিতাবৃত্তি’ বা ‘পতিতালয়’ পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি, যৌনতা টাকার বিনিময়ে ভোগ করা একধরণের নারী-অবমাননা তো অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে এটা একধরণের যৌনঅবমাননা কারণ যৌনতা মানুষের মৌলিক চাহিদা।