আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্ভবত কথাটি এভাবে বলেছেন- মানুষ যখন স্বপ্নে সঙ্গম করে তখনও সে পার্টনার নির্বাচনের ক্ষেত্রে শ্রেণি সচেতন থাকে। কথাটা বলার মূল উদ্দেশ্য; বাংলাদেশের জঙ্গি বাদ ইস্যুতেও সরকার, পুলিশ ও আদালতের শ্রেণি চরিত্র দেখানো। গুলশান হামলায় আইএসআইএস-এর সদস্য পরিচয়ে যারা হামলা চালিয়েছে তাদের সবার পিতা-মাতা এই সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়ংকর ও নৃশংস জঙ্গি হামলার (৭ বিদেশি ও তিন বাংলাদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করা হয়) পর তাদের পরিবারের কাউকে গ্রেফতার কিংবা থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। বরং খুনিদের পিতা-মাতা নিজ বাস ভবনে বসে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
সন্তানের জঙ্গিবাদের উদ্ভুদ্ধ হওয়ার সাথে পরিবার কিংবা বাবা-মায়ের কোন দায় আছে কিনা সবসময় পুলিশ তা খতিয়ে দেখে। পরিবার থেকে জঙ্গিবাদে উদ্ভুদ্ধ হয়ে অসংখ্য বাঙালি তরুণ-তরুণী ব্রিটেন কিংবা ইউরোপ থেকে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে এমন সংখ্যা কম নয়। কিন্তু জঙ্গিবাদের সাথে যদি পিতা-মাতার কোন সম্পর্ক না থাকে তাহলে সন্তানের অপরাধে পিতা-মাতাকে মামলায় জড়ানো কতোটা যৌক্তিক ও আইনি?
প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদে লেখা হয়; “জাফর ইকবালকে হত্যা-চেষ্টার মামলার প্রধান আসামী ফয়জুল জবানবন্দিতে বলেছে ওয়াজ শুনে, বই পড়ে ও ভিডিও দেখে হামলায় উদ্বুদ্ধ হয়। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফয়জুল তাঁর বন্ধু সোহাগের কাছ থেকে একটি ৮ জিবি মেমোরি কার্ড নেন। এতে জসিম উদ্দিন রাহমানী, তামিম উল আদনানীসহ বিভিন্ন জনের ওয়াজ শুনে তিনি জিহাদে উদ্বুদ্ধ হন। এ ছাড়াও নানাভাবে ফয়জুলের ধারণা হয়, জাফর ইকবাল ইসলামকে কটাক্ষ করেছেন। “
প্রকাশিত সংবাদের কোথাও লেখা নেই যে; ফয়জুলের জঙ্গিবাদে পরিবার কিংবা পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অথচ অভিযোগ পত্রে আসামী করা হয়েছে ছয় জনকে; ফয়জুল, তার বন্ধু মো. সোহাগ মিয়া, বাবা আতিকুর রহমান, মা মোছাম্মৎ মিনারা বেগম, মামা ফজলুর রহমান ও ভাই এনামুল হাসান। আর যদি পরিবারের সম্পৃক্ততা থেকে থাকে তাহলে পুলিশ কেন সংবাদ সম্মেলনে তা বলল না?
গুলশান হামলার জঙ্গিরা ধনীর দুলাল বলে তাদের পিতারা ড্রয়িংরুমে বসে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন। অন্যদিকে জঙ্গি যদি গরীব ঘরের হয় তাহলে বাপ-ভাই, মামা-চাচা সবাইকে ধরে আনা হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন ফয়জুলের পিতা-মাতার আসামী হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম নয়। ফয়জুলের জঙ্গি হওয়ার কারণে যদি তার বাপ ভাই’র বিরুদ্ধে চার্টশীট গঠন হয় তাহলে গুলশান হামলার সেই জঙ্গিদের অভিভাবকরা কেন নয়? ফয়জুলের পিতারা যেহেতু সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয় সেহেতু সন্তানের অন্যায়ের খেসারত তাদেরও দিতে হবে তাই তো?
গত ২৪ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় রিপন ও খালিদসহ ৮ জঙ্গি অভিযুক্ত করে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। যদিও সেখানে নর্থ সাউথের শিক্ষক হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। জাপানি ভদ্রলোকের ভিডিও যদি প্রকাশ না পেত তাহলে হয়তো হাসনাত ও তার পরিবারের কলেমা বলতে পারায় ছেড়ে দেয়ার গল্প আমাদের বিশ্বাস করতে হতো। কিন্তু সবকিছু বদলে দেয় জাপানি ভদ্রলোকের ভিডিও। যেখানে এক জঙ্গির সাথে হাসনাত করিম ও শিল্পপতি শাহরিয়ার খানের ছেলে তাহমিদ হাসিব খানের অস্বাভাবিক চলাফেরা, যা সবার মনে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়।। বাংলাদেশের পুলিশ অভিযোগ-পত্র থেকে অনেক আগেই শিল্পপতির দুলালকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয় (২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল)। পুলিশ কিসের ভিত্তিতে এদের মুক্তি দিল তা এখনো অনেকের কাছে অস্পষ্ট।।
মজার বিষয় হল, শিল্পপতির ছেলের মুক্তির জন্যে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত সেলিব্রেটির সাথে সাথে অনেক ফেসবুকারও তাহমিদ হাসিবের জন্যে অনলাইনে আন্দোলন, সংগ্রামে করেছে। তাহমিদ দোষী কিনা তা অন্য সবার মতন আমিও জানি না কিন্তু সেসময় তাহমিদ পুলিশী হেফাজতে, অন্যদিকে গুলশান হামলার মতন এমন একটা আলোচিত মামলার সন্দেহজনক আসামী ছিলেন তিনি।। এতো কিছু পরও ভদ্রলোক তার পক্ষে কথা বলার জন্যে মানুষ পেয়েছেন।।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার কয়েক ঘণ্টার মাথায় ওই এলাকা থেকে রক্তাক্ত যে তরুণকে পুলিশ আটক করেছিল, তবে সেই জাকির হোসেন শাওন এতোটা ভাগ্যবান নন। তিনি এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকার পর হাসপাতালে মারা যান। ছেলেকে পুলিশের জিম্মায় হাসপাতালে খুঁজে পাওয়ার পর মাসুদা বেগম পুলিশের বিরুদ্ধে শাওনকে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ছেলে বেঁচে আছে কি নাই, জানতাম না। এখন সে বাঁচবে কি না সেটা জানি না। এমন পিটান পিটাইছে হ্যার চেহারা দ্যাহা যায় না। হাত-পা সব ফোলা।। জাকির হোসেন শাওন যখন রেস্তোরাঁ থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় তখন পুলিশ তাকে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার করে। তাই তো শাওনের মৃত্যুর পর বাংলা ট্রিবিউন সংবাদ করে- গুলশান হামলার ‘সন্দেহভাজন’ শাওন মারা গেছে।
গরীব এই ছেলেকে আমাদের বীর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন হওয়ার (হয়তো করতে চায় নাই) পর বাংলাদেশের কোন মিডিয়া, সংবাদপত্র এই বিষয়ে কিছু লেখেনি।। একটা ছেলে জিম্মি দশা থেকে উদ্ধারের পর কীভাবে মারা যায় তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। ভুলে গেলে চলবে না গুলশান হামলার পরের দিন আওয়ামী লীগ নেতার জঙ্গি পুত্র রোহান ইমতিয়াজ এর ছবির বদলে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের ছবি ছাপা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে পুলিশ জাকির হোসেন শাওন ও বাবুর্চি সাইফুল ইসলামকে নির্দোষ ঘোষণা করেছে।
কী অদ্ভুত তাই না? একই অপরাধে দোষী হয়েও শ্রেণিভেদে আলাদা আলাদা আচরণ। গরীব পরিবার থেকে উঠে আসা জঙ্গি ফয়জুলের পিতা-মাতার ঘটনা আমাদের বিচলিত করবে না। আমরা হয়তো এই বিষয়ে কথা বলতেও স্বস্তি বোধ করবো না। কিন্তু সন্তানের অপরাধে পিতা-মাতা কিংবা মামার বিরুদ্ধে মামলা কীভাবে হয় তা আমাদের জানতে হবে।। আমরা যদি এসব প্রশ্নের মীমাংসা করতে না পারি হয়তো একদিন আমরা কিংবা আমাদের কোন আপনজন ফয়জুলের পিতা-মাতা কিংবা মামার আসনে থাকবে।
বিস্মিত হলাম
কোন বিষয়ে এবং কেন?
হাসনাত সাহেব কানাডার নাগরিক। কানাডার সাথে বর্তমানে আওয়ামী সরকারের গভীর সম্পর্ক। জামাত এখন পরিচালিত হচ্ছে কানাডা থেকে। বিএনপি-র নেতাদের ঘুষ দিয়ে সেখানে ঢুকে জামাতিরা যেভাবে পার্টিটাকে ধ্বংস করেছে, আওয়ামীতেও সেই প্রক্রিয়া চলছে। তাই জামায়াতের হাতে দেশ তুলে দেয়ার সোপানে এসে সিয়াইএ-র এতোবড় একজন এজেন্টকে সরকার আটক করবে, বিচার করবে ভাবা মুশকিল। v
যথার্থই বলেছেন।
“পুলিশ কিসের ভিত্তিতে এদের মুক্তি দিল তা এখনো অনেকের কাছে অস্পষ্ট।”
এ ক ম ত। কিন্তু এই ছবি দুইটিই একমাত্র প্রমাণ হিসেবে বেশ দুর্বল।
আমিও তেমনটা মনে করি এক ছবি দিয়ে সিন্ধান্তে পৌছানো মুশকিল। কিন্তু আমাদের পুলিশ বাহিনীর প্রতি যে অবিশ্বাস মানুষের জন্মেছে তা থেকে বাহিরে এসে পুলিশের বক্তব্য গ্রহণ করাটাও বেশ মুশকিল।
ঠিকই বলেছেন।
লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই, মিডিয়া এখন চাইলেই যে কোনো পুলিশ বা র্যাব কর্মকর্তার বক্তব্য নিতে পারে না। তাদের মুখপাত্রের বক্তব্য পাওয়াও সহজ নয়।
আর আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংএ যেটুকু বক্তব্য পাওয়া যায়, তার সবই গৎ বাধা।