দুষ্টু উদ্ভিদ। অভিমানী উদ্ভিদ। অবিশ্বাস্য রকম Intelligent উদ্ভিদ। মানুষের একমাত্র মগজে (Brain) আছে Multiple Control Units। উদ্ভিদেরও Multiple Control Units রয়েছে, কিন্তু তা ডিস্ট্রিবিউটেড, বিচ্ছিন্ন।
এখন ল্যাপটপ, ডেস্কটপেও ব্যবহৃত হচ্ছে মাল্টিপ্রসেসর। অনেক আগেই স্পেস মিশন সহ গবেষনা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার শুরু হয়েছে হাজার হাজার প্রসেসর যোগে বহুজায়গায় অবস্থিত কিন্তু একক কম্পিউটার সিস্টেম – Distributed Multiprocessor system. এটা এখন আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু উদ্ভিদেরা লক্ষ-কোটি বছর থেকেই টিকে আছে Multiprocessor সিস্টেম সহযোগে। একটা উদ্ভিদের প্রতিটা শিকড়ই এক একেকটা Control Unit. Control Unit এ Memory থাকতেই হবে। গাছের নতুন শিকড় বেরোচ্ছে মানেই নতুন Control Unit যোগ হচ্ছে গাছটির নতুন বেড়ে উঠা অংশটির জন্য।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা Plant Pathology, Plant Genetics and Breeding, Entomology, Plant Nutrient, Water Requirements, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। উদ্ভিদের Intelligence এর উপর উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কোন গবেষনাপত্র পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সৃষ্টি নয়, বিবর্তনের ফসলই জীবন। টিকে থাকার প্রয়োজনে উদ্ভিদের থাকে একাধিক মস্তিষ্ক। এদের কিছু মস্তিষ্ক (শিকড়) কেটে দিন। গাছ ঠিকই টিকে থাকবে এবং চাইলে মস্তিষ্কের সংখ্যা আবার বাড়িয়ে নেবে। উদাহরণ, দুর্বাঘাস, সেন্ট অগান্টিন ঘাস, কচুর লতি। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভিদের Intelligence নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম ৭ বছর আগে।
থাক সে কথা। উদ্ভিদরা কী যে বুদ্ধিমান তার কিছু উদাহরণ নিয়ে আজ আলাপ করি।
আমার পোষা জীব গাছ-গাছালী। প্রতি মূহুর্তে গাছের বৃদ্ধি হয়। আমি তাই দেখি, অনুভব করি, আমার ভালো লাগে। শ্রম এবং অর্থ দুটোই খরচ হয়। কিন্তু আমার পোষা জীবগুলোর কাছ থেকে রিটার্ণ পাই শত গুণ, হাজার গুণ। বাংলাদেশের মাটি কী পরিমান উর্বর তা আমেরিকাতে এদের পুষতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পাচ্ছি। এদেশে মাটির উপরিভাগের কয়েক ফুট গভীর পর্যন্ত এটেল মাটি (Heavy Clay). এটেল মাটিতে জল পড়লে তরল পদার্থে পরিণত হয়। এত তরল হয় যে, তিন বছর আগে একটা গাছ লাগাতে গিয়ে দেখি গাছটি ডুবে যাচ্ছে। নাতি-নাতনীদের জন্য বানানো খেলার জায়গায় গেট বসাতে গিয়ে দেখছি, গেটখানা ডুবে যাচ্ছে। আবার এই মাটি শুকোলে পাথরের মত কঠিন পদার্থ হয়। এটেল মাটিতে কোন প্রকার জৈব পদার্থ থাকে না। উদ্ভিদরা তা ভালো করেই জানে। তাই বুদ্ধিমান উদ্ভিদের শিকড় এটেল মাটির স্পর্শে এলেই শিকড়ের দিক পালটিয়ে দেয়। এক সেন্টিমিটার পরিমানও সেদিকে এগুবে না।
পোষা জীব হিসেবে কুকুর বিড়াল আমার পছন্দ। কিন্তু মুশকিল ওদের পটি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। এটা আমার দ্বারা হয়না। কিন্তু গাছেদের বিচিত্র আচরণ দেখে শিখেছি আমেরিকাতে গাছ পোষাও কম কঠিন কাজ নয়। প্রথম দিকে একটু মাটি খুড়েই গাছ লাগিয়ে দিতাম। পরে বুঝলাম আমেরিকার মাটি বাংলাদেশের মাটির মত নয়। তখন মাটি খুড়ে বাজার থেকে কেনা মাটি দিয়ে গাছ লাগাতে শুরু করলাম। গাছেরা খুশী হলো। আমিও খুশী। কিন্তু সেটা কোন কাজের কাজ হলো না। মাটি খুড়ে কাদামাটি ফেলে দিয়ে ভালো মাটি দিই। এই ভালো মাটির বাইরেটা কিন্তু একেবার এটেল মাটি। বলা যেতে পারে বড় একটা ভাতের ডেকচীর মধ্যে ভালো সুষম মাটি দিয়ে গাছ লাগানো। ডেকচি যেমন এলুমিনিয়াম জাতীয় একটা শক্ত ধাতুর তৈরী, গাছের জন্য তৈরী গর্তটাও শক্ত আবরণে আবদ্ধ। গাছের শিকড় ডেকচীসম শক্ত আবরণের মধ্যেই সীমিত থাকে। গাছ ডেকচীর ভিতরের মাটি থেকে খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। গাছ যতই বাড়ছে ততই বেশী পরিমান খাবার দরকার হচ্ছে। কিন্তু বুদ্ধিমান শিকড় এটেল মাটি দেখলে ওদিকে পা বাড়াবে না। কারণ জানে এটেল মাটিতে কোন খাবার থাকেনা। ফলে দিন দিন খাবারের পরিমান কমতে থাকে। তখন গাছেদের কষ্ট হয়, রাগ হয়, ভীষন অভিমান হয়। তারপরেও অনাহারে, অপুষ্টিতে বেঁচে থাকে কয়েক বছর। তারপর হতদরিদ্র কৃষকের মত আত্নহননের পথ বেছে নেয়।
তিনটে ছবি আছে এখানে।
প্রথম ছবিটি একটি Pear গাছের। সবুজ পাতায় ভর্তি গাছটি। কিন্তু দুটো ডাল মরে গেছে। আসলে গাছটি হিসেব করে দেখেছে অতি শীগ্রই প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং পুষ্টির অভাব হবে। তাই ফল আসার আগেই গাছটি খাবার-দাবার বন্ধ করে দুটো ডালে মেরে ফেলেছে। লক্ষ্য করে দেখেছি প্রত্যেক বছরই গাছটি একটা দুটো ডাল মেরে ফেলতো। কিন্তু আসল কারণটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিলো।
দ্বিতীয় ছবিতে একটি Mapple গাছের গুড়ি দেখানো হয়েছে। গাছটি বড় হয়েছিলো। পুষ্টি এবং খাদ্যাভাবে গাছটি আত্মহত্যা করেছে।
ডেকচির মত গর্তে বাজার থেকে পুষ্টিযুক্ত মাটি দিয়ে তার মধ্যে ম্যাপল গাছটি লাগিয়ে দিই ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ডিসেম্বর-জানুয়ারীর শীতে গাছটি যথারীতি পাতা ফেলে টিকে থাকে। বসন্তের শুরুতে প্রচুর নতুন ডাল এবং পাতা যোগ হয়। ২০১৫ সালে লক্ষ্য করি গাছটি বেঁচে আছে, কিন্তু বৃদ্ধি নেই। গাছটি ২০১৭ সালে যখন আত্মহত্যা করলো তখন গাছের গুড়িটা দেখতে ইচ্ছে হলো। যা ভেবেছিলাম তাই। ডেকচির মত জায়গায় যতটুকু মাটি তাতে গাছটির আর চলছে না। প্রতিবছর বসন্তে নতুন ডাল-পাতা গজায়। কিন্তু শিকড় ডিকচি পরিমান জায়গা থেকে বেরোতে পারছে না। শিকড় বাড়ছে আর তা অল্প একটু জায়গায় সাপের কুন্ডলীর মত পেঁচিয়ে আছে। জলের সাপ্লাই আছে, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, গাছের মালিক প্রয়োজনীয় বাড়তি খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ করছে না। ইতিহাস থেকে ভবিষ্যতের প্রেডিকশন করলো গাছটি। তারপর হতদরিদ্র কৃষকের মত আত্নহত্যার পথই বেছে নিলো।
একই ভাবে আরও দুটো গাছ মারা গেছে। তিনটি গাছ তাদের ডাল মেরে ফেলেছে। লক্ষ্য করে দেখলাম আরও পাঁচটি গাছের বৃদ্ধি নাই। উপরে মাটি দিয়ে খুব একটা লাভ নাই। নীচ থেকে এটেল মাটি খুড়ে ফেলে দিতে হবে। প্রথমে গাছের একপাশ থেকে এটেল মাটি ফেলে দিয়ে ভালো মাটি সেঁটে দিতে হবে। তারপরে অন্য পাশেও তাই করতে হবে।
তৃতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা Water Oak গাছের অভিমানী দৃশ্য। গাছের মাথা থাকবে আকাশের দিকে। কিন্তু গত তিন বছরে গাছটি মাথা উচু করেনি। কলাপাতার মত মাথা নুইয়ে বেঁচে আছে। আত্নহনের সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি। শোভেলের সাথে একটা রোলার দাঁড় করানো আছে। প্রায় চব্বিশ ইঞ্চি গর্ত করে ফেলেছি। আরও কিছু এটেল মাটি সরিয়ে পুষ্টিযুক্ত মাটি সেঁটিয়ে দেবো।
একে একে নিজ হাতে মোট আটটি গাছের গোড়ায় ভালো মাটি ঢুকিয়ে দিলাম। বিলম্বে হলেও করলাম তো। আশা করছি এখন গাছেদের রাগ-অভিমান-আত্নহত্যা বন্ধ হবে। বাকি সব মালিকের ইচ্ছা।
বাপ্রে! এতো সত্যিই অবাক করা ব্যাপার।
তবে শিরোনামসহ লেখার ভেতরে যত দূর সম্ভব ইংরেজি পরিহার করাই বুঝি ভাল ছিল, প্রয়োজনে ব্রাকেটে ইংরেজি ব্যবহার করা যায়।
উড়ুক। 💕
কখোন ভাবিনি, আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানলাম। অনেক ধন্যবাদ
খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ।আরও এ রকম লেখা দেখতে চাই।
বিস্মিত হলাম
গাছ নিয়ে আপনার অবজার্ভেশন দেখে প্রকৃতি বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর গাছপালা এবং কীটপতঙ্গ নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা গ্রহন্থ ও প্রবন্ধ আছে। আপনার অবজার্ভেশন থেকে আপনিও তেমন কিছু করতে পারেন।