সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় থেকে বেশ সাড়ম্বরে রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের  ঘোষণা দেয়া হয়েছে।ঘোষণায় বলা হয়েছে রাজাকারদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাদের ছেলেপুলেরা যাতে এদেশে চাকরি-বাকরি না পায় তারও ব্যবস্থা করা হবে। রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগটি বিলম্বিত হলেও প্রশংসনীয় নিঃসন্দেহে। এতদিন পরে হলেও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষের তালিকা তৈরির মহতি এবং অতিব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি সরকার নিতে যাচ্ছে সেজন্য তারা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। কিন্তু সরকার কি সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে প্রস্তাবিত এই তালিকাটি প্রণয়ন করতে পারবে? মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের কাজটি কিন্তু আজও সম্পন্ন হয়নি কোনোকালে হবে তারও কোনো সম্ভাবনা দেখিনা।এ বিষয়ে দিনে দিনে বিতর্ক আর ঘাপলা বাড়ছেই। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে আমরা দেখেছি মুক্তিযোদ্ধা সনদ ক্রয় বিক্রয়ের জমজমাট বাণিজ্য। বাহাত্তর সালে অনেককেই এই সনদ সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় শরিক হতে দেখেছি যারা কস্মিনকালেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেনি। অবশ্য এই ভুয়া সনদ সংগ্রহকারীদের মাঝে যাদের সামান্যতম বিবেক-বুদ্ধিও অবশিষ্ট ছিল তারা সেই সনদ কিনে আনলেও পরে লোকলজ্জার ভয়ে পোর্টম্যান থেকে আর বের করেননি বা নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবিও করেননি কিন্তু এদের সংখ্যাতো হাতেগোনা। বাদ-বাকিদের সবাই বাহাত্তরে কেনা এই সনদ দেখিয়ে  মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি-বাকরি সহ সকল রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগ করছেন।সেক্রেটারি পর্যায়ে অন্ততঃ আধা ডজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার তথ্য সংবাদে আসা থেকেই অনুমিত হয় অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভুয়ারা কেমন বিপ্লব ঘটিয়েছে। আর এই কর্মটি তারা সম্পাদন করেছেন নিজ নিজ পক্ষের দল যখন ক্ষমতায় এসেছে তখন। এজন্য সরকার বদলের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এক ভুতুড়ে যোগ বিয়োগের খেলা লক্ষ্য করা যায়। একাত্তরে যার জন্ম হয়নি সেও যেমন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠে যাচ্ছে তেমনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনও স্বীকৃতির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখনও একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে এবং স্বাভাবিকভাবেই এই তালিকা কলেবরে আরও লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান হবে। আমাদের জাতীয় বীরদের নিয়ে এই প্রহসন দূর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার নজির সামনে নিয়ে রাজাকারের সঠিক তালিকা প্রণয়ন নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যায়না। তালিকা একটা হবে হয়তো কিন্তু তা হবে আংশিক এবং পক্ষপাতদুষ্ট। অথবা এই তালিকা প্রণয়নের ঘোষণা আসলে কিছুই না এক ধরণের রাজনৈতিক ভেলকিবাজী। আজকাল প্রায়ই খবরে দেখা যায় পথচারীর পকেট সার্চ করার নামে কৌশলে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশ পাবলিককে ব্ল্যাকমেইল করছে। সরকার কি এই পুলিশি কৌশলটিকেই গ্রহণ করবে? ‘দলে আস না হয় তালিকায় ফাঁসিয়ে দেব’ এমন হুমকিতে এখন ভাল ফায়দা আসতে পারে। ইলেকশনের বছর এটা। প্রকৃত রাজাকার বা মানসিক রাজাকারগণ হয়তো এ সময় দেশনেত্রীর কোল থেকে জননেত্রীর কোলকেই অধিক নিরাপদ এবং লাভজনক মনে করবে।এই  আলামত অবশ্য শুরুও হয়ে গেছে। রাজাকারকে নিয়ে কোলে টানাটানির এই খেলায় রাজাকারদের কোনো ক্ষতি হচ্ছেনা বরং তারা উপলব্ধি করতে পারছে দিনে দিনে তারাও এরশাদ  বা প্যারাসাইট মোল্লাদের মত সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

এরপর আসা যাক রাজাকারের সন্তানের চাকরি-বাকরি প্রসঙ্গে। রাজাকারকে দ্বিতীয় শ্রেণীর কেন তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিক করলেও কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি, যে কুলাঙ্গারগণ দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, হত্যা নির্যাতন লুন্ঠন ধর্ষণে অংশ গ্রহণ করেছিল বা হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়ে পাকিস্তানের প্লেন ধরিয়ে দিলেও কেউ আপত্তি করবেনা কিন্তু তাদের সন্তান সন্ততিদের চাকুরীচ্যুত করা বা চাকুরী না দেয়ার ধারণার সাথে দ্বিমত করার অবকাশ থেকে যায়।জাতীয় আবেগ ও ভালবাসার বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধার নাতি কোটারও নাহয় একটি যুক্তি থাকে কিন্তু একই আবেগপ্রসূত ঘৃণা দিয়ে রাজাকারের পুত্র নাতিদের উপর তাদের পূর্বপুরুষের কলংক চাপিয়ে দেয়া হবে দুর্ভাগ্যজনক।এতদিন রাজাকার নিয়ে রাজনীতি হয়েছে এবার রাজাকারের সন্তানও পর্দায় আসছে। এটা কি সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায়? সরকারের এক প্রাক্তন বাম মন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ঢালাওভাবে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। মন্ত্রীর এই গালের যথার্থতা প্রমাণ করতেই কি রাজাকারের সন্তান প্রসঙ্গটিকে এবার লাইম লাইটে আনা হল? যে কারণেই প্রসঙ্গটির অবতারণা হোকনা কেন প্রশ্ন উঠবেই ক্রিমিনেল জনকের অপরাধের দায়ভার কেন সন্তান বহন করবে? রাজাকারের সন্তান যে পর্যন্ত না পিতার আদর্শকে সমর্থন করে সে পর্যন্ত তাকে রাজাকার বলা যায় কি? একই প্রশ্ন আসে মুক্তিযুদ্ধার সন্তানের বেলায়ও। মুক্তিযুদ্ধার সন্তান যে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মৈলিক চেতনাগুলোকে ধারণ করবে সে পর্যন্তই সে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে যখন সে বিপরীত চেতনায় আক্রান্ত হবে সকল সুযোগ সুবিধা সে হারাবে। এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্কে জঙ্গি হামলাকারী বাঙ্গালীর কলংক আকাইদ উল্লাহর দৃষ্টান্ত দেয়া যায়।আকাইদ উল্লাহ একজন মুক্তিযুদ্ধার সন্তান কিন্তু তার বিশ্বাস আর কর্মকান্ড মুক্তিযুদ্ধ চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে সুতরাং সে রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ সুবিধা পেতে পারেনা। আকাইদ উল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। এরকম অজস্র আকাইদ উল্লাহ আছে যারা মুক্তিযুদ্ধার সন্তান হয়েও জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়েছে।ব্যক্তি তার নিজস্ব যোগ্যতায় মূল্যায়িত হবে পূর্বপুরুষের দুস্কৃতি বা সুকৃতির দায়ে বা কল্যাণে নয়।একজন রাজাকারের সন্তান যদি দেশের জন্য কিছু করতে চায় বা দেশের জন্য সুনাম সুখ্যাতি বয়ে আনে তবে রাষ্ট্র কি তার অবদানকে গ্রহণ করবেনা? তার অবদানকে গ্রহণে যদি কোনো সমস্যা না থাকে তবে রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগে কেন সে বৈষম্যের শিকার হবে?

বিহারীরা একাত্তরে তাদের ঘৃণ্য অপরাধের জন্য আজও এদেশের নাগরিত্ব লাভ করতে পারেনি, পাকিস্তানের আটকে পড়া নাগরিক হিসেবে জেনেভা ক্যাম্পে তারা সুবর্ণজয়ন্তি পালন করতে চলেছে।এই বিহারী সম্প্রদায়ের এক সদস্য অনেকদিন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং আজও তিনি তার আবেগ অনুভূতি ভালবাসা দিয়ে বাংলাদেশকে উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপন করছেন। তার দেশপ্রেম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেনা।দেশ নিয়ে তার আবেগ উচ্ছাস আমাদিগকে ভাবতে দেয়না তিনি বিহারী বংশোদ্ভুত। বহির্বিশ্বেও তিনি বিহারী নয় একজন বাঙ্গালী বা বাংলাদেশী হিসেবেই পরিচিত। একজন প্রথিতযশা সাংবাদিকের কথা জানি যিনি একজন রাজাকার সন্তান। একাধিক টকশোতে তাকে স্বীকারুক্তি করতে শুনেছি তার বাবা রাজাকার ছিলেন এবং তিনি পিতার ভূমিকার জন্য লজ্জিত অনুতপ্ত এবং পিতার পক্ষ থেকে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। এই বিহারী বংশোদ্ভুত আমাদের ভালবাসার মানুষটিকে বা সেই সাংবাদিক ভদ্রলোককে কি আমরা ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিতে পারি? অথবা পিতার অপকর্মের জন্য রাষ্ট্রপ্রদত্ব সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার কথা বলতে পারি? অবশ্য যারা রাজাকার সন্তান হয়েও পিতার অপকর্মের জন্য লজ্জিত বা অনুতপ্ত হবে দূরে থাক উল্টো বুক ফুলিয়ে পাকিস্তানপ্রীতি দেখায়, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে উদ্ধত আচরণের ধৃষ্টতা দেখায়, বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলার সময় পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে মাঠে যায় তারা তাদের পিতৃরাজাকারদের চেয়েও অধিক ঘৃণ্য প্রাণী।কেন অধিক ঘৃণ্য বলছি তার একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। রাজাকারদের আমি মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করার পক্ষপাতি। এক ভাগে সাধারণ রাজাকার অন্যভাগে আদর্শিক রাজাকার।আদর্শিক রাজাকার এসেছে জামাত মুসলিমলীগ নেজামে ইসলাম ইত্যাদি কট্টর সাম্প্রদায়িক দল থেকে। রাজাকারদের মাঝে এ শ্রেণীটিই ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক।এরাই সুপরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গণ-হত্যার ছক তৈরি করেছে। আর সাধারণ রাজাকারদের অনেকে এসেছে লোভের বশবর্তি হয়ে কেউ এসেছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে। অনেককে বাধ্য করা হয়েছে রাজাকারে যোগ দিতে। সুতরাং ঢালাওভাবে সব রাজাকারকে এক পাল্লায় ওজন করলে সমকালীন প্রেক্ষাপট বিচারে আমাদের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হবে। হয়তো এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই বঙ্গবন্ধু কম ক্ষতিকারকদের প্রতি ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেছিলেন যদিও বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারকে আহত করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দি অতিক্রম করেও যে রাজাকারের উত্তরপুরুষেরা ইতিহাস মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়ে পূর্বপুরুষের কলংকিত ভূমিকার জন্য লজ্জিত হয়না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করে তারা সাধারণ রাজাকারের চেয়েও অধিক বিষাক্ত এবং  এদেরকেও বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এদেরকে চিহ্নিত করবেন কীভাবে? সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হলে সবার আগে একটি সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর অবশ্যই সেই দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে নির্মোহ এবং ব্যক্তিগত বা দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কি দলীয় স্বার্থের বাইরে যেতে পারবে?

বিএনপির কথা বাদই দিলাম কেননা দলটির ভিত্তিই রচিত হয়েছিল কুখ্যাত সব রাজাকারকে নিয়ে আর দীর্ঘ দিন ধরে এই রাজাকারগণই তাদের পথ চলার অকৃত্রিম সাথী।যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শুরুতে  দেখা গেছে রাজাকারদের জন্য তাদের প্রাণের আকুতি কত প্রবল। কাদের মোল্লা যখন ত্রুটিপূর্ণ এক আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন দেশের প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের নিয়ে শাহবাগ গর্জে উঠেছিল সেই গর্জে ওঠা জনতাকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘নাস্তিকদের সমাবেশ’ মন্তব্য করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই ঘটনায় তিনি এবং তার দল কতটা ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত। অথচ গণজাগরন মঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত কেউ বিএনপি সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন বলে মনে পড়েনা বিএনপি নিজে থেকেই এর অন্যতম প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল। এখানেই শেষ নয় নিজামীর রায়ের পরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নিজামী গংদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যারা এই বিচারের রায় দিয়েছেন এই বাংলার মাটিতে একদিন তাদেরও বিচার হবে। একজন আইনজীবী হিসেবে এমন হুমকি দেয়ার আস্পর্দা তিনি রাখেননা তিনি এই হুমকি দিয়েছিলেন বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা হিসেবে এবং এটি আসলে ছিল বিএনপিরই ঘোষণা। রাজাকারের সাথে বিএনপির এই অবিচ্ছেদ্য রাখিবন্ধনকে অতিক্রম করে তারা রাজাকারের তালিকা করবে এটা অবিশ্বাস্য। পারলে তারা ঘাতক মুক্তিযুদ্ধার  বিচার করবে।তাদের দলীয় উপদেষ্টা এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানতো খোলাসা করেই বলেছেন তাদের দল ক্ষমতায় গেলে ট্রাইবুনাল করে রাজাকার হত্যার জন্য ঘাতক মুক্তিযুদ্ধাদেরও বিচার করা হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকারের স্পর্ধিত পতাকা- ‘খন্দকার নুরুমিয়া সড়ক’

 

 

এবার আসা যাক আওয়ামীলীগ প্রসঙ্গে। এ দলটি শুধু স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাই নয়,স্বাধীনতার জন্য অনেক মূল্যও দিয়েছিল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান কিলিং টার্গেটই ছিল হিন্দু এবং আওয়ামীলীগার।স্বাধীনতা যুদ্ধে এই দলের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই কিন্তু এক কালের ধর্মনিরপেক্ষ এই শীর্ষ রাজনৈতিক দলের হালের অবস্থা কী? এরা কি রাজাকার  বিষয়ে একটি স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের ক্ষমতা রাখে যেখানে তাদের মন্ত্রীসভায় এবং কেন্দ্রীয় কমিটি সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদ-পদবি দখল করে বসে আছে বর্ণচোরা রাজাকারগণ? বর্তমান আওয়ামীলীগ স্বাধীনতার চেতনা আর রাজাকার চেতনা মিলিয়ে যে এক অদ্ভুত ককটেল নীতি গ্রহণ করেছে এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের পরস্পর সাংঘর্ষিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে। একদিকে এরা জঙ্গি ইস্যুতে জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে আবার জঙ্গিবাদের গুরুদের প্রেসক্রিপসনে শিশুপাঠ্যে এমন সব পরিবর্তন এনেছে যা পাঠ করে একটি শিশু দিনশেষে জঙ্গিবাদেই দীক্ষা নেবে। এ যেন অনেকটা এ রকম, বিষাক্ত গাছের সন্ধান পাওয়া মাত্র কেটে ফেলা আবার এই বিষবৃক্ষের বীজ বপন করেই দেশ সয়লাফ করে দেয়া।এটা অমার্জিত অপরাধ। ক্ষমতার স্বার্থে আমাদের শিশুদের মর‍্যাল বেজকে নষ্ট করার অধিকার কারোরই নেই। এই একটি অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য আওয়ামীলীগের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমুদ্র জয় পদ্মাসেতু ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো বড় অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যায় কারণ যাদের জন্য এই কাজগুলো করা সেই ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত করলে এরা এসব অর্জনের অপপ্রয়োগ করবে। চিন্তা এবং যুক্তিতে যারা দুর্বল তাদের হাতে মারনাস্ত্র তুলে দেয়া বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। আবার দেখুন একদিকে তারা রাজাকারের তালিকা করবে বলে ঢাক-ঢোল পেটাচ্ছে, এক অসৎ মন্ত্রীর নেতৃত্বে লংমার্চ করছে আবার রক্তে মাংসে চেতনায় বিশ্বাসে যারা বিশুদ্ধ রাজাকার, সেই জামাত থেকে আসা নেতা কর্মীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। সংসদে একাধিক রাজাকারকে পাশে বসিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজাকার যেন চাকরী না পায় সেদিকে খেয়াল রাখার ফরমান জারি করছেন। কী অদ্ভুত স্ববিরুধীতা! এ যেন ‘বগলে ইট নিয়ে মুখে সেখ ফরিদ’ নাম নেয়ার কৌশল।

একজন মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে আপোসহীন হবেন এটা স্বাভাবিক। তিনি যদি তার চেতনার তাগিদে তালিকা করতেই চান তবে তার বুকের পাটাকে অনেক শক্ত করতে বলব কেননা এই তালিকায় তাকে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বা তদিয় পিতা খন্দকার নুরু মিয়ার নামও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেখ সেলিমের বেয়াই ধুরন্দর রাজাকার এবং দেশসেরা ধনাঢ্য ব্যক্তি মুসা বিন সমসের বা নুলা মুসার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার স্পর্ধা দেখাতে হবে। দলের তুখোর নেতা খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বা কর্নেল ফারুক খান সাজেদা চোধুরী বা সৈয়দ জাফরুল্লাহ সহ বিতর্কিত আওয়ামীলীগ নেতাদের একাত্তরের ভূমিকা বিষয়ে সত্যান্বেষী অনুসন্ধান চালাতে হবে।প্রমাণ পেলে এদের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।প্রয়োজনে খন্দকার নুরু মিয়ার নামে নামকরণ করা সড়কের সাইন উপড়ে ফেলতে হবে। সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের কথা মনে আছেতো? তিনি মুক্তিযুদ্ধা সন্তান এবং ভাল আওয়ামীলীগার। জামাত বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাকে পিটিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছিল। তিনি ‘সেই রাজাকার’ শীর্ষক লেখায় একজন রাজাকারের কিঞ্চিত আমলনামা প্রকাশ করেছিলেন মাত্র এর ফল হিসেবে পঙ্গু এ মানুষটিকে কীভাবে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল তার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। অনেকে আত্নতুষ্টি অনুভব করেন এই ভেবে যে ফুঁসে ওঠা মানুষের চাপে প্রবীর শিকদারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার সুতরাং জয় এখানে প্রবীর সিকদারেরই। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। আসলে জয় হয়েছিল ‘সেই রাজাকারের’ই। চেতনা অবচেতনার যুগ নির্বিশেষে সকল আমলেই রাজাকারের হাত কত লম্বা, তাদের পায়ের নিচের মাটি কত শক্ত তা তারা দেখাতে চেয়েছিল এবং তারা তাদের মিশনে সফল হয়েছে। প্রবীর সিকদার এবং সমগোত্রীয়রা রাজাকারদের ভিত্তি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেছেন এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়।

আওয়ামীলীগে রাজাকারশক্তি কত প্রবল তার প্রথম প্রমাণ পেয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল রূপকার শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ। একটি অসামান্য এবং সফল যুদ্ধ পরিচালনা শেষে যখন দেশ পরিচালনার সময় আসল তখনই তাঁকে শূণ্য হাতে ফিরে যেতে হয়েছিল। আওয়ামীলীগের ভেতরে সক্রীয় বর্ণচোরা রাজাকারচক্রের প্ররোচনায় এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের এই মহানায়কের মূল্যায়ন করা হয়েছিল। যে রাজাকারচক্র শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের পিছু লেগেছিল তাদের ভুতই আবার তার সন্তানেরও পিছু নেয়। শেষ পর্যন্ত এই  চক্রের কাছে নতি স্বীকার করে সোহেল তাজ শুধু মন্ত্রীত্ব নয় দেশও ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তনয় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেখেছেন এই চক্রের শক্তির গভীরতা। তিনি তাঁর দলীয় পদ আর মন্ত্রীত্ব দুটিই হারিয়ে দেশান্তরে গমন করতে বাধ্য হন। আর চমকপ্রদ ব্যাপার হল বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি(অস্থায়ী) তনয়ের কাছে থেকে কেড়ে নেয়া মন্ত্রনালয়টিতে যাকে বসানো হয় তিনি লুকানো চাপানো কেউ নন একেবারে প্রকাশিত রাজাকারের পুত্র রাজাকার।মুক্তিযুদ্ধকালীন কঠিন সময়ে বাংলাদেশ নামক দেশটির হাল ধরা দুই নাবিক প্রধানমন্ত্রী এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পুত্রদ্বয়ের করুণ পরিণাম দেখেই অনুধাবন করা যায় আওয়ামীলীগে রাজাকার শিবির কত শক্তিশালী। তাই বিএনপিকে যদি রাজাকারের ঘর বা অভয়ারণ্য বলা হয় তবে আওয়ামীলীগকে অবশ্যই বলতে হবে চেতনার আড়ালে রাজাকার মোটাতাজাকরণের আদর্শ খামার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়শঃ একটা কথা বলে থাকেন ‘আর কোনো রাজাকার বা রাজাকারের সন্তান এদেশের ক্ষমতায় আসতে পারবেনা।‘ কথাটি আমাদের কানে মধুবর্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যঞ্জণা দিতে এই বাক্যের তূলনা হয়না। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে মনে হয় কথাটি কত অসার এবং অসত্য। আমাদের দেশের রাজনীতির যে গতি প্রকৃতি তাতে উত্তরাধিকারের রাজনীতি আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। এই উত্তরাধিকারের ‘ঘোড়ায় চড়িয়া’ প্রধানমন্ত্রী তনয়া সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সন্তানও একদিন ক্ষমতার শীর্ষপদে বসতে পারেন। সেই হবু রাষ্ট্রপ্রধানের শরীরে বহমান রাজাকারের রক্তকে আপনারা কীভাবে পরিশুদ্ধ করবেন? শেখ পরিবারের রক্তে  অবশ্যই এমন কোনো বিশেষ উপাদান নেই যার সংস্পর্শে আসলে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়? তাহলে ফলাফল কী দাঁড়াল?  রাজাকারের সন্তান না হোক রাজাকারের নাতি নাতনী দূর ভবিষ্যতে এ দেশ শাসন করবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুয়োদর্শনকে ‘বধিবার জন্য স্বকুলেই বাড়িছে সে। এরচেয়ে প্রধানমন্ত্রী যদি বলতেন- আমরা এমন একটি আইন করতে যাচ্ছি যাতে কারো উর্ধ্বতন চার বা পাঁচ পুরুষের কারো বিরুদ্ধে রাজাকারের রেকর্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বা সেনাবাহিনী প্রধান ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় পদে অযোগ্য বলে গণ্য হবেন’ তাহলে রাজাকার সম্পর্কে তাঁর ইতিবাচক অবস্থান স্পষ্ট হতো।

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী, রাজাকারের পোলাপানকে চাকরী দেবেননা বলছেন, কিন্তু সেদিন যদি আপনি বেঁচে থাকেন তবে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন রাজাকারের নাতিই দেখভাল করছে আপনার নাতির মুক্তিযোদ্ধা কোটা চাকরী-বাকরি মায় অস্থিত্বটুকুও।